
একসময় পুরো বিশ্ব দাপিয়ে শাসন করতো ইউরোপীয় শক্তিসমূহ। শিল্পবিপ্লবের ফলে সৃষ্ট কাঁচামালের চাহিদা ব্রিটেন ও ইউরোপীয় শক্তিসমূহের উপনিবেশগুলো টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তা বাড়িয়ে তোলে। উপনিবেশগুলো শাসন পাকাপোক্ত করার জন্য ‘ভাগ কর, শাসন কর’র মতো বিভিন্ন নীতি ও সিদ্ধান্ত নিতে থাকে। অটোমান সাম্রাজ্য তখন ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়ার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশদের উপনিবেশ ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে। ভূমধ্যসাগর, দার্দেনেলিশ ও বসফরাস প্রণালীর অধিকার হারালে ভারতে সহজে যাতায়াতের পথ বন্ধ হয়ে যেত ব্রিটিশ শক্তির জন্য। তাছাড়া, এই অঞ্চলের প্রতি লোভ ছিল তাদের।

সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ যখন হাজার বছর ধরে টিকে থাকা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল বিজয় করেন এবং অটোমান রাজধানী সেখানে স্থানান্তর করেন, তখন থেকেই অটোমান সাম্রাজ্যের ইউরোপে বিস্তার শুরু। ধীরে ধীরে ইউরোপীয় ভূমি আসতে থাকে অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে।
সুলতান সুলাইমানের সময়ে সর্বোচ্চ বিস্তৃতি ঘটে সাম্রাজ্যের, যা মূলত ইউরোপীয় শক্তির কাছে ভালো ঠেকেনি। ইউরোপের ঔপনিবেশিক শক্তির কাছে তাই অটোমান সাম্রাজ্য একটি হুমকি হিসেবে ছিল। অটোমানরা হয়ে উঠছিল ইউরোপের বড় প্রভাবশালী শক্তি। কিন্তু এই জৌলুশ বেশিদিন টেকেনি। সুলতান সেলিম, সুলতান সুলাইমানের পর সাম্রাজ্যের দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ১৫৭১ সালে ভূমধ্যসাগরে লেপান্টোর নৌযুদ্ধে পরাজয়ের পর। পরবর্তীতে অটোমানদের জন্য কাল হয়ে আসে কার্লোইটাস ও কুচুক কারইনার্যের সন্ধি, যা ইউরোপীয়দের কাছে অটোমানদের আরও দুর্বল শক্তি হিসেবে তুলে ধরে।
ব্রিটেন তথা ইউরোপীয় শক্তিসমূহ অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে নানাভাবে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার কারণ এই অঞ্চলকে ঘিরে তাদের ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক স্বার্থ, সংস্কৃতি-সভ্যতার ভিন্নতা, আধিপত্যের লড়াই ইত্যাদি।

Image source: Boot Camp and Military Fitness Institute
জাতীয়তাবাদী আন্দোলন
আরব বিশ্বে তৎকালীন অটোমান সাম্রাজ্যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রথম সূচনা হয় স্থানীয় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের হাত ধরে। তৎকালীন অটোমান সাম্রাজ্যে প্রচুর খ্রিষ্টান মিশনারী প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়া সাম্রাজ্যে গুপ্ত সংস্থার উত্থান ঘটে। মিশনারি ও গুপ্ত সংস্থাগুলো সাম্রাজ্যে জাতীয়তাবাদী বার্তা প্রচার করে। পরবর্তীতে এই জাতীয়তাবাদের তিনটি ধারা লক্ষ্য করা যায়- ধর্মনিরপেক্ষ ধারা, তুর্কি জাতীয়তাবাদ, এবং আরব জাতীয়তাবাদ। ধর্মনিরপেক্ষ ধারার সূত্রপাত তুরস্কেই। ফরাসি বিপ্লবের ছোঁয়া লেগে এই ধারা সমৃদ্ধ হতে থাকে। তুর্কি জাতীয়তাবাদের সূত্রপাত হয়েছে মূলত বিভিন্ন স্থান থেকে এসে অটোমান সাম্রাজ্যে চাকরি নেয়া জনগণের হাত ধরে, যার মধ্যে রয়েছে রাশিয়া থেকে আসা তাতার সম্প্রদায়।
আরব জাতীয়তাবাদের ধারার সূচনা হয় ১৮৬০ সালে খ্রিষ্টান আরব ও গুপ্ত সংস্থার মাধ্যমে। পরবর্তীতে তা আরও প্রভাবশালী হয় কাওয়াকিবী ও রশিদ আল রিদার হাত ধরে। ইতিহাসবিদ এ বি এম হোসেনের ভাষায়, “প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যে নতুন স্বাধীনতাকামী সামগ্রিক আরব জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয়, তার উদ্যোক্তা ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ এবং ফরাসি শক্তি।” কার্যত ব্রিটিশ এবং ফরাসি শক্তি সাইকাস-পিকোট চুক্তি অনুযায়ী নিজেদের মধ্যে অটোমান সাম্রাজ্যের ভাগাভাগি করার যে পরিকল্পনা, তা বাস্তবায়নে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে উস্কে দেয়। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ক্ষমতা ভাগাভাগি করার সময়, তখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকারীদের তারা বঞ্চিত করে মধ্যপ্রাচ্যে উপনিবেশ স্থাপন করে। পশ্চিমা শক্তি কর্তৃক এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে অটোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে, সূচনা হয় স্বাধীনতা আন্দোলনের।
নেপোলিয়নের কূটকৌশল
১৭৯২ সালে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টের সেনাবাহিনী অটোমান সাম্রাজ্যভুক্ত মিশর আক্রমণ করে। কিন্তু ইংল্যান্ড যখন দেখল ফ্রান্স মিশর দখল করলে তারা হারাবে ভারতের সাথে যোগাযোগের পথ, তখন ইংল্যান্ডের বাধায় মিশরীয়দের কাছে পরাজিত হয়ে ফিরে আসে নেপোলিয়নের সেনারা। কিন্তু কিছু সেনা থেকে যায় মিশরে। নেপোলিয়ন প্রাচ্য নিয়ে আগ্রহ পান ভোলনির লেখা থেকে। তিনি বুঝতে পারলেন- এই ভূমি দখল করলেও তা শাসন করা কঠিন হবে। তিনি মিশে যেতে থাকেন মুসলমানদের সাথে। ইসলামি ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে যেতে তিনি সাহস করেননি, বরং তিনি ইসলামি ভাবাদর্শের সাথে পশ্চিমা ভাবাদর্শের সংমিশ্রণ শুরু করেন। তিনি মুসলিমদের সাথে এবার যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন প্রাচ্যবিদ পন্ডিতকে জড়ো করেন, গড়ে তোলেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও।
নেপোলিয়ন নিজেকে ইসলাম ও মুসলিমদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে শুরু করলেন। তিনি আলেমদের নিজের কাছে ডাকতেন। তিনি স্থানীয় আলেম, মুফতি ও ইমামদের দিয়ে কোরআনের এমন ব্যাখ্যা প্রচার করালেন যাতে সবাই মনে করে ফরাসিরা ইসলামের পক্ষের শক্তি। এভাবে নেপোলিয়নের প্রভাব ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। মিশরীয় সেনাবাহিনীর ইউরোপীয়করণে তারা প্রভাব রাখে। ভবিষ্যতে মিশরে মোহাম্মদ আলী পাশার উত্থান ঘটলে ফরাসিদের প্রভাব প্রতিপত্তি এই অঞ্চলে আরও বৃদ্ধি পায়।

মিশরে মোহাম্মদ আলী পাশার উত্থান
মোহাম্মদ আলী পাশা ১৭৯৮ সালে ফরাসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পারদর্শিতার দরুন অটোমান সুলতান কর্তৃক মিশরের গভর্নর মনোনীত হন ১৮০৫ সালে। গভর্নর হয়ে তিনি ফরাসি বাহিনীর দক্ষতা দ্বারা ব্যাপক প্রভাবিত হন। তিনি অটোমান সালতানাতের দুর্বলতা উপলব্ধি করেন। তিনি মামলুক সময়ের মিশরীয় বে-দের একত্রিত করে স্বীয় বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। উন্নয়নের উদ্দেশ্যে তিনি ফরাসিদের আমন্ত্রণ জানান। ফরাসি সেনাবাহিনীর আদলে সেনাবাহিনী গঠন করেন নিজ স্বার্থে। তিনি ফরাসি স্টাইলে গড়ে তোলেন আমলাতন্ত্র, অর্থনীতি, স্কুল-কলেজ ইত্যাদি। একপর্যায়ে আলী পাশা নিজেকে অটোমানদের প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করেন। উল্লেখ্য, তিনি তার সেনাবাহিনীতে মুসলিম বা তুর্কিদের প্রাধান্য না দিয়ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের দিতেন। সব ক্ষেত্রে মুসলিম ছেড়ে ইউরোপীয় মডেল অনুসরণ করতেন। ভরসা করতেন অটোমানদের থেকে ইউরোপীয়দের, অপেক্ষায় ছিলেন অটোমান সালতানাত আক্রমণের সুযোগের।
সৌদি-আরবের উত্থান
অটোমান দুর্বলতার সু্যোগে নজদ প্রদেশের এক গোত্র প্রধান মোহাম্মদ ইবনে সৌদ হিযাজ ও নজদ প্রদেশ দখল করে গোত্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মোহাম্মদ ইবনে আবদ-আল ওয়াহাবের মতাদর্শ দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হন। অতঃপর তিনি যখন মক্কা, মদিনা দখল করে শাসন শুরু করেন, তা ছিল অটোমান আদর্শের বিরোধী ও সাম্রাজ্যের জন্য মানহানিকর। অটোমান সুলতানের বাহিনী তাকে পরাজিত করে, ইবনে সৌদ পালিয়ে কুয়েতে আশ্রয় নেন। পরবর্তীতে আবার তিনি শক্তি সঞ্চয় করে এই অঞ্চল দখল করেন।

ব্রিটেন যখন দেখে এখানে সৌদ পরিবারের উত্থান হচ্ছে, তখন তারা তার সাথে গোপনে যোগাযোগ শুরু করে। কিন্তু সৌদের উত্থানে বাধা হয়ে দাঁড়ান মক্কা-মদিনার শরীফ হোসেন ইবনে আলী বা শরীফ হোসেন। তিনি মহানবীর (সা) বংশধর হওয়ার কারণে সুলতান দ্বিতীয় হামীদ তাকে এই পদে নিয়োগ দেন। কিন্তু তিনি ছিলেন উচ্চভিলাষী। তাই তিনি বংশীয় শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বৃহৎ শক্তির সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। তিনি ব্রিটিশদের সহায়তা পান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশরা তাকে অটোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বলে। কিন্তু দেখা যায় ব্রিটিশরা দুই পক্ষের সাথেই যোগাযোগ রাখে। পরবর্তীতে যখন সৌদ পরিবার পুনরায় আক্রমণ করে মক্কা-মদিনা এলাকা দখল করে, তখন ব্রিটিশরা দোটানায় পড়ে অবশেষে সৌদ পরিবারকে সমর্থন জানায়। বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী অটোমান সাম্রাজ্যের পতন হলে ব্রিটিশরা সৌদ পরিবারের শাসনকে স্বীকৃতি দেয়। কার্যত ব্রিটিশরা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে অটোমানদেরর বিরুদ্ধে কাজে লাগায়।
গ্রীসে স্বাধীনতা আন্দোলন
একসময় গ্রীক ভূখন্ড ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। সেখানে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হলে তা রাশিয়া, ব্রিটেন ও পশ্চিমা শক্তির সমর্থন পায়। ফলে তা আরো বেগবান হয়। এই পালে হাওয়া দেয় ফরাসি বিপ্লবও। বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয় গুপ্ত সংস্থা। পরবর্তীতে যখন অটোমানদের সাথে যুদ্ধ বাধে, তখন স্বাধীনতাকামীদের সহায়তা করে ইউরোপীয় শক্তিসমূহ। রাশিয়া, ব্রিটেন ও ফরাসি সহায়তায় একসময় গ্রীস স্বাধীনতা লাভ করে, যা অন্য অঞ্চলেও অটোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ উস্কে দেয়।
দেখা যায়, ১৮০৫ সালে যখন সার্বরা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু করে, তখন বৃহৎ শক্তির সহায়তা না থাকায় তা বেশি দূর গড়াতে পারেনি। ফলে পিছিয়ে যায় সার্বিয়ার স্বাধীনতা। বর্তমানে আমরা দেখি যে- বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে বৃহৎ শক্তি সমর্থন দেয় বিভিন্ন রাজনৈতিক স্বার্থে।

Image source: Wikimedia Commons
আন্তর্জাতিক রাজনীতি হচ্ছে শক্তির রাজনীতি। এখানে একটি রাষ্ট্র কেমন আচরণ করবে তা নির্ভর করবে তার জাতীয় স্বার্থের ওপর। একে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাস্তববাদ বলে। বর্তমান বিশ্বে যেমন প্রতিটি রাষ্ট্র নিজ স্বার্থের জন্য বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সমর্থন দেয়, স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করে, তা সবই স্বীয় স্বার্থে হয়। অটোমান সাম্রাজ্যের কাছে ইউরোপীয় শক্তিসমূহের স্বার্থ ছিল- যা উপরে বর্ণিত হয়েছে। ইউরোপের প্রতিটি শক্তি তখন বিশ্বে নিজ আধিপত্য বিস্তারে মগ্ন ছিল, ছিল উপনিবেশ রক্ষার তাড়না। বিশ্লেষকদের মতে, অটোমানদের পতনের জন্য সবচেয়ে বেশি তারা নিজেরাই দায়ী।
সুলতান সুলাইমানের পর আর তেমন যোগ্য শাসকের উত্থান কম ঘটেছে। তাছাড়া ইউরোপীয় শক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলার মতো সামর্থ্য তৈরি করতে পারেনি তারা। শিল্পবিপ্লবের ফলে ইউরোপ যখন উন্নত হচ্ছিল, তখন অটোমান সাম্রাজ্য ছিল বেশ পিছিয়ে। অনেকে মনে করেন, ইউরোপীয় শক্তি আন্তর্জাতিক রাজনীতির নিয়মানুযায়ী নিজ স্বার্থে অটোমান সাম্রাজ্যের বিরোধিতায় লিপ্ত ছিল, কিন্তু তা তাদের পতনের একমাত্র কারণ নয়।