র্যাম্বো সিরিজের দ্বিতীয় সিনেমাটা, যেখানে শত্রুপক্ষের হাতে ধরা পড়া নায়ক একাই ছাড়খার করে দেয় ভিয়েতনামীদের- এর কথা মনে আছে কি আপনার? কিংবা বিহাইন্ড এনিমি লাইনস সিনেমাটা, বসনিয়ার গণহত্যা সম্পর্কে গোপনে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে মিসাইলের আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায় এফ/এ-১৮এফ সুপার হর্নেট। বেঁচে যায় বৈমানিক ক্রিস বার্নেট। আর তারপর থেকেই শুরু হয় তার শত্রু অঞ্চলে বেঁচে থাকার লড়াই। কখন আসবে সাহায্য জানা নেই, ওদিকে পাগলা কুকুরের মতো ধেয়ে আসছে সার্ব প্যারামিলিটারির দল।
বাস্তবে এমন রোমাঞ্চকর ও সাড়া জাগানো রেসকিউ মিশনের কমতি নেই কিন্তু। ভিয়েতনাম যুদ্ধেই সহযোদ্ধাদের উদ্ধারে বিপদকে তুচ্ছ করে বহুবার ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমেরিকান সোলজাররা। জ্যান্ত না হলেও কেবলমাত্র লাশটা যাতে প্রিয়জনদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, সেজন্যও মিশনে নামতে দ্বিধা করেনি তারা। তবে আজকে যে গল্পটা আমরা জানব সে গল্পে বীরত্বের চাইতে বেশি মিশে আছে বিতর্ক। যে কারণে এই উদ্ধার অভিযান সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল প্রায় ২৫ বছর ধরে।
মার্চ ৩০, ১৯৭২। নর্থ ভিয়েতনামীজ আর্মি (এনভিএ) দক্ষিণ ভিয়েতনামের সীমান্তে তিন ডিভিশন আর্টিলারি, ট্যাংক আর ইনফ্যান্ট্রি ইউনিট জড়ো করো। সীমান্তে নিজেদের পতাকা উড়িয়ে দিয়ে অহংকার ও কর্তৃত্ব প্রকাশ করে।
দুই ভিয়েতনামের সীমান্তের মাঝে ফাঁকা জায়গাটুকু ছিল ডিমিলিটারাইজড জোন। ডিমিলিটারাইজড জোনে কোনো প্রকার সেনাবাহিনীর অস্ত্র ব্যবহার বা প্রদর্শন কিংবা কোনো বাহিনীর কর্মকর্তার প্রবেশাধিকার নেই।
এই কর্মসূচীর মাধ্যমে শুরু হতে যাচ্ছিল বর্তমানে ইস্টার অফেন্সিভ নামে পরিচিত এক ক্যাম্পেইনের (ভিয়েতনামবাসীরা এখন একে ‘আগুনে লাল গ্রীষ্ম’ নামে অভিহিত করে)। এনভিএ দুই ভিয়েতনামের সীমান্তে ৩০,০০০ ট্রুপ আর ভারী অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে আর্মি অফ সাউথ ভিয়েতনাম (এআরভিএন)-এর পাল্টা পদক্ষেপের জন্য। অবস্থা বেগতিক দেখে এআরভিএন-এর মদদ দাতা আমেরিকান এয়ারফোর্সের পাইলটরা বুঝে ফেলেছিলেন যে এনভিএ-র আকাশ পথে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে পরাজিত করতে তাদের বেশ বেগ পেতে হবে। খারাপ খবর হলো- চিন্তার চেয়ে বাস্তবের শত্রুরা বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দেয় তাদের জন্য।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল আইসীল ‘জিন’ হ্যাম্বলটন তখনও কল্পনা করতে পারেননি তার নিয়তিতে কী দুঃসহ অভিজ্ঞতা লেখা হয়ে গেছে। তারিখটা ছিল এপ্রিল ২, ১৯৭২। শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নয়, বরং বিমানবাহিনীর ইতিহাসেই সব থেকে বড় আর দীর্ঘ সময়ব্যাপী সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ অপারেশন শুরু হতে যাচ্ছে সেদিন।
এয়ারফোর্সে হ্যাম্বলটন ছিলেন ডগলাস ইবি-৬৬সি বিমানের সিনিয়র নেভিগেটর ও ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার স্পেশালিস্ট। এ ধরনের বিমানগুলো সাধারণত কোনো অস্ত্র বহন করত না, বরং তুলনামূলকভাবে বড় আকারের বি-৫২ বোম্বারের এসকর্ট হিসেবে উড়ত। এ জাতের বিমানগুলোর কাজ ছিল শত্রুপক্ষের সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল (এসএএম) সাইট খুঁজে বের করা ও প্রয়োজনমাফিক এসএএম’র রাডার জ্যাম করে দেয়া।
এপ্রিলের উল্লিখিত দিনটাতে আচমকা খবর এলো তিনটা বি-৫২’কে সাহায্য করবার জন্য দুটো ইবি-৬৬ তলব করা হয়েছে। উত্তর ভিয়েতনামের একটা নতুন মিসাইল স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে- এমন খবর পাওয়া গেছে। অতএব চারা গাছ মহীরুহ হয়ে উঠবার আগেই ধ্বংস করতে হবে। সাইগনে অবস্থিত জেনারেল ক্রেইটনের হেডকোয়ার্টার থেকে হুট করে আসা নোটিশের জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনও কমিয়ে আনছেন মিলিটারি শক্তি, গুটিয়ে নিচ্ছেন ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার উপস্থিতি।
৪২তম ট্যাক্টিকাল ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার স্কোয়াড্রনের লোকবল কম হওয়াতে এগিয়ে এলেন ৫৩ বছর বয়সী হ্যাম্বলটন, সাধারণত তিনি ক্রু’দের কর্মতালিকা তৈরির কাজ করেন। বিমানের নেভিগেটর হিসেবে কাজ করতে রাজি হলেন তিনি। তার কলসাইন হবে- ব্যাট টুওয়ান ব্রাভো। তবে কাজটা যে খুব বুদ্ধিমানের ছিল তা বলা যাবে না। কারণ এয়ারফোর্সের অতি মূল্যবান আর গোপন সব তথ্য প্রবীণ হ্যাম্বলটনের নখদর্পনে ছিল।
চটপট ব্রিফিং সেরেই মেঘলা আকাশে উড়াল দিল পাঁচটা প্লেন। তিনটা বি-৫২’কে সাথে নিয়ে চলছে হ্যাম্বলটনের ব্যাট ২১, দ্বিতীয় ডগলাস বিমানটার কলসাইন ব্যাট ২২। ব্রিফিঙে কোনো সতর্কবার্তা দেয়া হয়নি দক্ষিণ ভিয়েতনামের এসএএম সাইটের নিশ্চিত উপস্থিতি সম্পর্কে। বিমানবহর সীমান্তের কাছাকাছি আসা মাত্রই বিপদ সঙ্কেত বেজে উঠল। ভূমি থেকে এনভিএ এসএ-২ মডেলের সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল ছুঁড়েছে! তীব্র গতিতে আঁকা-বাঁকা উড়ে প্রথম দুটো মিসাইলকে ধোঁকা দিতে সক্ষম হলো ইবি-৬৬ বিমান জোড়া।
তবে ফাঁড়া কাটেনি তখনও। আবারও ছোঁড়া হলো মিসাইল। এবারও দুটো, ফোঁস ফোঁস করতে করতে ছুটে আসছে যেন বিষাক্ত সাপ। বহরের অন্য বিমান গুলো রক্ষা পেলেও এ যাত্রায় মাফ পেল না ব্যাট ২১। বিমানটার পেটে এসে আঘাত হানল মিসাইল। মাটি থেকে ২৯,০০০ ফুট উঁচুতে আগুনের গোলায় পরিণত হল বিমানটি। বলতে হবে স্রেফ ভাগ্যের জোরে প্রাণে বেঁচে গেলেন নেভিগেটরের সীটে বসা হ্যাম্বলটন। নিয়ম অনুযায়ী সবার আগে তার সীট ইজেক্ট করে জ্বলন্ত ককপিট ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল। তবে সে সুযোগ বা সময় পাইলট ওয়েইন ব্র্যাডি ও বিমানের বাকি চারজন ক্রু’র কপালে ছিল না। তাদের মরদেহ কোনোদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
শূন্যে ঝুলতে ঝুলতে নামার সময়ই হ্যাম্বলটন দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিজ্ঞা করেন, যেভাবেই হোক এখান থেকে তাকে বেঁচে ফিরতে হবে। অবসরের আর মাত্র ৯ মাস বাকি তার, শত্রুর হাতে ধরা পড়বার জন্য খুব খারাপ সময় এটা। তাছাড়া তার বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করতে আসবে- এ তো জানা কথা। তবে ব্যাট-২১ ব্রাভো তখনও জানেন না যে তিনি খোদ বাঘের গুহায় পা দিতে যাচ্ছেন। ত্রিশ হাজার ভিয়েতনামীজ সৈন্যে গিজগিজ করা অঞ্চলে তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাতাস।
হ্যাম্বলটন নামলেন কোয়াং ট্রাই প্রদেশে। ক্যাম লো গ্রামের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত শুকনো খটখটে ধানক্ষেতে এসে শেষ হলো তার উড্ডয়ন। জায়গাটা থেকে ক্যাম লো ব্রিজ বেশি দূরে না। হ্যাম্বলটনের অবস্থা তখন খুব একটা ভালো না, ভাঙা বিমানের শ্র্যাপনেল এসে গেঁথে গেছে শরীরে। ক্লান্ত, আহত, শ্রান্ত শরীরে গা ঢাকা দিলেন জঙ্গলের অন্ধকারে।
বিশ্রামরত ইউজিন ওই এলাকাতে টহলরত একজন ফরওয়ার্ড এয়ার কন্ট্রোলার (এফএসি) পাইলটের সাথে রেডিওতে যোগাযোগ করে তার অবস্থা জানান। এই পাইলট আবার ইউজিনকে প্যারাশুটে ভেসে নামতে দেখেছিলেন। পাইলট সাহায্য না আসা পর্যন্ত তাকে লুকিয়ে থাকার নির্দেশ দিলেন। হ্যাম্বলটন গর্ত খুঁড়ে তাতে লুকিয়ে বসে রইলেন উদ্ধারকর্তাদের আশায়। ওদিকে পাইলটের দিক নির্দেশনা নিয়ে এএইচ-১ কোবরা হেলিকপ্টার গানশিপ ও এফ-৪ ফ্যান্টম ফাইটার বিমান মুহুর্মুহু বোমাবর্ষণ করে গ্রামবাসী ও ভিয়েতনামী সৈন্যদের ব্যতিব্যস্ত রাখে যাতে তারা হ্যাম্বলটনের খোঁজে মনোনিবেশ করতে না পারে।
চারদিন পার হয়ে গেল এভাবে আত্মগোপন করে। কিন্তু বেশ কয়েকটি আকাশযোগে উদ্ধার অভিযান ব্যর্থ হলো তীব্র গোলাবর্ষণের মুখে। পঞ্চম দিনে হ্যাম্বলটনের মানসিক শক্তি প্রবল ধাক্কা খেল, অসহায়ভাবে তিনি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন তাকে উদ্ধার করতে আসা একটা রেসকিউ হেলিকপ্টার ভূপতিত হলো শত্রুদের গোলার আঘাতে, মারা গেল সবমিলিয়ে ছয়জন। ষষ্ঠ দিনে অবস্থা আরও খারাপের দিকে মোড় নিল। এবার দুটো হেলিকপ্টারসহ আটজন নিহত হলো। শুধু তাই না, একটা ওভি-১০ মডেলের লাইট অ্যাটাক বিমানও ধ্বংস হয়ে গেল, উত্তর ভিয়েতনাম সেনাদের হাতে ধরা পড়ল বিমানের পাইলট, তবে মার্ক ক্লার্ক নামের একজন ক্রু পালিয়ে গেল তাদের চোখে ধুলো দিয়ে।
ক্ষতির খাতার হিসাব এখনই বন্ধ হলো না। মরিয়া হয়ে উঠা আমেরিকানরা বলি দিল আরও পাঁচটি এয়ার ক্র্যাফট, তবে এবার হতাহত হল না কেউ, ধরাও পড়ল না। সব মিলিয়ে তখন আমেরিকানদের অবস্থা শোচনীয়। হ্যাম্বলটনের সাথে নতুন যোগ হয়েছে ক্লার্ককে উদ্ধার করবার দায়িত্ব। তাও আবার দুইজনের মাঝের দূরত্বটাও নেহাত কম নয়। এখানে একটা কথা বলে দেয়া ভাল- পুরোটা সময় জুড়েই কর্তৃপক্ষের সাথে হ্যাম্বলটনের রেডিওতে যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ ছিল।
ষষ্ঠদিনের ক্ষয়ক্ষতির হিসেব মেলাতে গিয়ে সাইগনের হেডকোয়ার্টার প্রধান জেনারেল ক্রেইটন আব্রামসের মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আর কোনো হেলিকপ্টার বা বিমানকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া যাবে না। আকাশে ভিয়েতনামীরা ত্রাস রচনা করে রেখেছে তাদের মিসাইল দিয়ে। অতএব যা করবার মাটিতেই করতে হবে। একাধিক ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর তারা পরিকল্পনা করলেন দু’জনকে তুলে আনবার জন্য ছোট একটা টিম পাঠানো হবে। দলের মাথা হবে নেভি সিল টম নরিস, সাথে থাকবে আরেক সিল সদস্য লেফটেন্যান্ট কর্নেল অ্যান্ডারসন ও পাঁচ ভিয়েতনামী কমান্ডো। তবে পুরো প্ল্যানটা ছিল খুবই বিপজ্জনক। এআরভিএন এর এক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিয়াই এর ভাষায়- “পুরোই পাগলামি।”
পরিকল্পনাটি ছিল এরকম- দুই সিল সদস্য ও পাঁচ ভিয়েতনামী কমান্ডো মিউ জিয়াং নদীর ধারে পজিশন নেবে। ক্লার্ক ও হ্যাম্বলটন দুজনই এখন যেখানে আছেন সেখান থেকে নদীতে ভেসে ভেসে উদ্ধারকারী দলটার কাছে চলে আসা খুবই সম্ভব। তবে সমস্যা হচ্ছে প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে পালিয়ে থেকে আর এনভিএ’র তাড়া খেতে থাকা হ্যাম্বলটনের শারীরিক অবস্থা তখন শোচনীয়। এদিকে হাতে নষ্ট করবার মতো সময়ও নেই, অতএব সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো আগে ক্লার্ককে উদ্ধার করা হবে; কারণ হ্যাম্বলটনের আগেই পৌঁছে যাবে সে, ক্লার্ক নিরাপদ হলে হ্যাম্বলটনের দিকে নজর দেবে দলটা।
আকাশে টহলরত একটা বিমানকে রেডিওতে বলা হলো যাতে পাইলট ক্লার্ককে সিগন্যাল দেয় পানিতে নেমে পড়ার জন্য। এরপর দলের অর্ধেককে নিয়ে নরিস তীরের দিকে এগোলেন। অ্যান্ডারসন আর বাকিরা অপেক্ষা করতে লাগল ব্যাকআপ হিসেবে। কথা ছিল দুই দলের দূরত্ব এক হাজার মিটারের বেশি হবে না, কিন্তু নরিস তার দ্বিগুণ পথ অতিক্রম করে ফেলেন। এমনকি রেডিও সংযোগও বন্ধ করে দেন। শত্রুপক্ষের চোখ এড়িয়ে যেতে বেশ কিছুটা সময় লেগে গেলেও নরিস আর তার দল নিরাপদেই নদীর তীরে পৌঁছান। এরপর ঝোপঝাড়ের আড়ালে হাঁটু গেড়ে পজিশন নেন। এমন সময় কানে আসে স্রোতের মাঝে সংগ্রামরত ক্লার্কের হাঁপানোর আওয়াজ। ঠাণ্ডা পানিতে পতিত বৈমানিক তখন নাকানি-চুবানি খাচ্ছিলেন। যে মুহূর্তে নরিস কাভার ছেড়ে বেরিয়ে আসতে যাবেন, ঠিক তখনই ছয়জনের একটা এনভিএ পেট্রল তার আর ক্লার্কের মাঝে এসে উদয় হয়। নরিসের সৈনিক প্রবৃত্তি চাইছিল আচমকা হামলা করতে, কিন্তু ট্রিগারে আঙ্গুল দাবালেন না তিনি। সেটা করলে নিজেদের অস্তিত্ব ফাঁস হয়ে যেত, তাছাড়া সংখ্যার দিক দিয়েও তার দল পিছিয়ে। ভাগ্য ভাল যে ক্লার্ককে দলটা দেখেনি। পেট্রল টিম চলে যাবার পর নদীতে ক্লার্ককে দেখা গেল না। তবে সিল সদস্য নরিস হতাশ হবার নন, নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন পানিতে। প্রায় ঘণ্টাখানেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে ক্লার্কের দেখা পান। এরপর নিজের দলের সাথে মিলিত হয়ে ক্লার্ককে পৌঁছে দেন অ্যান্ডারসনের কাছে। সকাল নাগাদ ক্লার্ক উদ্ধার হয়ে যাবার পর এখন অন্ধকার নামার অপেক্ষা। ছায়ায় গা ঢেকে আবার বেরুতে হবে হ্যাম্বলটনের জন্য।
এদিকে এফএসি বার বার রেডিওতে সতর্ক করে দিচ্ছিল, হ্যাম্বলটন ক্রমশ মানসিক-শারীরিক ভাবে ভেঙে পড়ছেন। এত দিন ধরে বিপদ, ক্ষুধা আর পানিস্বল্পতার বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছেন। এ সময় হ্যাম্বলটন-এফএসি মিলে এক অভিনব বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়। ভিয়েতনামীদের অনেকেই ইংরেজি বোঝে, বলতেও পারে। রেডিওতে কথোপকথন তাই সঙ্কেতের মাধ্যমে চালাতে হচ্ছিল হ্যাম্বলটনের সাথে। হ্যাম্বলটন গলফের পোকা ছিলেন, কবে-কোথায়-কখন-কোন গলফ কোর্সে খেলেছেন তাও তার মুখস্ত ছিল। এফএসি তাকে নির্দিষ্ট স্থানের বদলে গলফ কোর্সের নাম বলতে লাগলো যাতে ভিয়েতনামীরা কান পেতে রাখলেও কিছু বুঝতে না পারে। নির্দেশনা নিয়ে হ্যাম্বলটন শত্রুসঙ্কুল পথ পাড়ি দিতে লাগলেন।
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলতে চলতে একটা গ্রামের সীমানায় এসে উপস্থিত হলেন তিনি। এমন সময় লক্ষ্য করলেন একটা জীর্ণ কুটিরের সামনে মোটাসোটা একটা মোরগ দেখা যাচ্ছে। আধপেটা আর অভুক্ত থেকে থেকে ততদিনে ৪৫ পাউন্ড ওজন হারিয়েছেন হ্যাম্বলটন। সুস্বাদু মাংসের লোভ সামলাতে পারলেন না, গাছের আড়াল ছেড়ে এগিয়ে গেলেন। এমন সময় হঠাৎ কুটিরের ভেতর থেকে এক লোক বেরিয়ে এলো। হ্যাম্বলটনকে দেখেই আক্রমণ করে বসল সে। বাম কাঁধে খ্যাচ করে হাতের ছুরিটা বসিয়ে দিল আগন্তুক। বাধ্য হয়ে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হলেন হ্যাম্বলটন। হাতাহাতি যুদ্ধে মিলিটারি ট্রেনিং পাওয়া হ্যাম্বলটনের জয় হলেও বিসর্জন দিতে হলো সাধের মোরগখানা আর আধ পেয়ালা রক্ত। অভুক্ত পেটেই আবার চলতে লাগলেন হ্যাম্বলটন।
ওদিকে নরিস-অ্যান্ডারসনের দিন কাটতে লাগল এফএসি’র জন্য বোম্বিং টার্গেট রিলে করতে করতে। তবে এনভিএ-ও পাল্টা জবাব দিতে কার্পণ্যবোধ করছিল না। বৃষ্টির মতো মর্টার শেল আর বি-৪০ রকেট ফেলতে লাগল তাদের অবস্থান লক্ষ্য করে। যুদ্ধে লেফটেন্যান্ট কর্নেল অ্যান্ডারসন আর সিনিয়র ভিয়েতনামী কমান্ডো চীফ গুরুতর আহত হল। বাধ্য হয়ে তাদের হেলিকপ্টার যোগে ফেরত পাঠিয়ে দিতে হল। দলের দুই নেতাকে হারিয়ে তখন উদ্ধারকারীরা চোখে অন্ধকার দেখছে। নরিসের সঙ্গী বলতে এখন কেবল তিনজন ভিয়েতনামী কমান্ডো, যারা ঠিকমতো ইংরেজিও বলতে পারে না। হ্যাম্বলটনের নবম দিন চলছে, দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ছেন তিনি। এদিকে নরিসদের অ্যামুনিশনেও ঘাটতি পড়েছে। সেদিন রাতে তারা মরিয়া হয়ে গেলেন বলতে গেলে। দলের তিন কমান্ডোর দু’জন অনিচ্ছা প্রকাশ করল আবার খোঁজাখুঁজিতে অংশ নিতে। তবে দলের তৃতীয় ভিয়েতনামী- তরুণ পেটি অফিসার ওয়েন ভ্যান কিয়েট রাজি হল নরিসের সার্চ পার্টির সঙ্গী হতে। দুজন মিলে নদীর উৎসের দিকে এগোবেন ঠিক করলেন, কারণ হ্যাম্বলটনের এতদূর আসার মতো শক্তি অবশিষ্ট নেই। সারা রাত ধরে খোঁজাখুঁজি চালিয়ে গেলেন তারা। লাভ হল না। দশম দিনের সূর্য উঠবার পর ফিরে গেলেন নিজেদের আউটপোস্টে। বিশ্রাম না নিলে আর চলছে না শরীর।
সেদিন বিকেলে পরিত্যক্ত একটা গ্রাম থেকে স্থানীয়দের ফেলে যাওয়া পুরনো কাপড় চুরি করে আনলেন। চৌর্যবৃত্তির খাতায় একটা সাম্পানও যোগ হল। নৌকাতে করে ছদ্মবেশযোগে নদীতে আবার যাত্রা শুরু হল দুই সৈনিকের। সন্ধ্যা নেমে গেছে ততক্ষণে। ঘন কুয়াশা আর রাত্তিরের কালো চাদর ভেদ করেও দূরবর্তী তীরে ভিয়েতনামী সৈন্যদের ক্যাম্পে জ্বালানো আগুন দেখা যাচ্ছে। নীরবে এগুতে লাগলো নৌকা। একসময় নদীর পশ্চিমমুখী তীরে আবছামতো দেখতে পেলেন কার যেন দেহ পড়ে আছে। বাকিটা হ্যাম্বলটনের মুখ থেকেই শোনা যাক-
সাম্পানে করে দু’জন মানুষকে এগিয়ে আসতে দেখলাম আমি। গলুইতে এক ভিয়েতনামী একে-৪৭ রাইফেল বাগিয়ে ধরে রেখেছে। মনে মনে ভাবছিলাম- ‘এবারই খেলা শেষ।’ তবে পেছনে বসে থাকা লোকটার পোশাক দেখে স্থানীয় জেলে মনে হলেও বড় বড় চোখ দুটো খাঁটি আমেরিকান ছিল।
আধ-অচেতন হ্যাম্বলটনকে দ্রুত নৌকায় তুলে নিলেন নরিসরা। তারপর কয়েকটা বাঁশ দিয়ে গোঙানিরত নেভিগেটরকে ঢেকে রাখলেন যাতে কারো চোখে না পড়ে। নদীর উৎসমুখে রওনা দিল দলটা। তবে কপাল খারাপ- কিছুদূর এগোতেই একটা উত্তর ভিয়েতনামী পেট্রলের চোখে ধরা পড়া গেল নৌকাটা। ওদিকে তীরে ক্যাম্প ফেলা সৈন্যরাও জেগে উঠছে ভোরের আলোয়। গুলি ছুঁড়তে শুরু করল তারা। তবে নরিস-ওয়েন তখন যুদ্ধে নামতে আর আগ্রহী নন। হ্যাম্বলটনকে নিয়ে পালাতে পারলেই বাঁচেন তারা। গুলিবর্ষণের মুখে বাধ্য হয়ে ভিয়েতনামীদের উল্টো পাশের তীরে নৌকা ভিড়িয়ে কাভার নিলেন। রেডিওতে এয়ার সাপোর্ট চাইলেন দ্রুত। তাদের আবেদনের জবাবে মুহূর্তেই পাঁচটা ডগলাস এ-৪ স্কাইহক উড়াল দিল আকাশে। খুব দ্রুতই স্কাইহকগুলো ধুলোয় মিশিয়ে দিল শত্রুদলকে। অবস্থা অনুকূল দেখে আবার সাম্পানে চড়ল তিনজন। লক্ষ্য- নরিসদের পুরনো আউটপোস্ট।
ত্রিমূর্তির নৌযাত্রা অবশ্য তখনও পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত হয়নি। আবারও তীর থেকে গুলি করতে লাগল ভিয়েতনামীরা। হালকা অস্ত্রশস্ত্র, মর্টার আর রকেট লঞ্চার নিয়ে শেষ চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। তবে নরিসরা আর এখন নদীতে একা নন। দক্ষিণ ভিয়েতনামীরাও যোগ দিয়েছে তাদের সাথে। আকাশে উড্ডয়নরত স্কাইহক পাঁচটা তো রয়েছেই। এ-৪ গুলো কাজ শেষ করে চলে যাবার পর এআরভিএন-এর একটা এম১১৩ আর্মার্ড পার্সোনাল ক্যারিয়ার এসে নরিস, কিয়েট আর হ্যাম্বলটনকে তুলে ডং হা’র উদ্দেশ্যে রওনা দিল। হ্যাম্বলটন তখনও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না, তবে পুরোপুরি নিরাপদেই উদ্ধার করা গেছে তাকে। সমাপ্তি ঘটেছে দীর্ঘ উদ্ধার অভিযানের, ব্যাট ২১ এখন বাড়ি ফিরবে।
একজন মানুষের জীবন রক্ষা করতে গিয়ে ঝরে গিয়েছিল অনেকগুলো প্রাণ। ড্যারেল ডি হোয়াইটকম্ব রচিত ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত বই দ্য রেসকিউ অফ ব্যাট*২১-এর লেখা অনুযায়ী সাড়ে এগারদিনের প্রচেষ্টায় হ্যাম্বলটনকে উদ্ধার করতে গিয়ে মারা গিয়েছিল ১০ জন এয়ারম্যান ও সেনাসদস্য, আরও দু’জন ধরা পড়েছিল শত্রুদের কব্জায় (তাদের অবশ্য পরে ছুটিয়ে আনা হয়), এছাড়া বেশ কয়েকজন আহত ও ধ্বংস হয় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এয়ারক্র্যাফট।
অভিযানে দুঃসাহসিকতার বদৌলতে পেটি অফিসার ওয়েন ভ্যান কিয়েটকে ভূষিত করা হয় নেভি ক্রসে। প্রেসিডেন্ট ফোর্ড নিজ হাতে লেফটেন্যান্ট থমাস রোল্যান্ড নরিসকে মেডেল অফ অনার প্রদান করেন ১৯৭৬ সালে। হ্যাম্বলটনকে ভূষিত করা হয় সিলভার স্টার, দ্য ডিসটিংগুইশড ফ্লাইং ক্রস, দ্য এয়ার মেডেল, দ্য মেরিটোরিয়াস সার্ভিস মেডেল ও পার্পল হার্টে। তিনি বিমানবাহিনী থেকে অবসর নেন ১৯৭৩ সালে। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০০৪ সালে ৮৫ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন আমেরিকানরা এত মরিয়া হয়ে গিয়েছিল আইসিল ইউজিন হ্যাম্বলটনের জন্য? কেন তারা একের পর এক সৈন্যকে বলিতে চড়াচ্ছিল, নির্দ্বিধায় বিসর্জন দিচ্ছিল মূল্যবান আকাশযান ও ব্যয় করছিল এত সময়?
উত্তরটায় বেশ কিছু ব্যাপার জড়িত আছে। প্রথমত, হ্যাম্বলটন প্রায় ২০ বছরের কর্মজীবনে অর্জন করেছেন এয়ারফোর্স সংক্রান্ত অমূল্য সব জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা, জেনেছেন গোপন সব তথ্য- যা শত্রুপক্ষের হাতে পড়লে বেশ বড় রকমের ধাক্কা হয়ে আসত যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ পরিচালনায়। দ্বিতীয়ত, এয়ারফোর্স একজন এয়ারম্যানকেও হারাতে নারাজ। এতে যেমন জড়িয়ে আছে ফোর্সের প্রতিটি যোদ্ধার মনোবল বজায় রাখার প্রশ্ন তেমনি জড়িত আছে বিমানবাহিনীর প্রতি তাদের উৎসর্গতার প্রভাবক। কারণ নৌ-বিমান-সেনাবাহিনীর প্রতিটি সৈনিক থেকে কর্মকর্তা পর্যন্ত জানে- শত্রুদের হাত ধরা পড়লেও এগিয়ে আসবে তার সহযোদ্ধা ও সমগ্র দেশ। আর সেই ভরসার প্রতিদান দিতেই এগিয়ে এসেছিল এয়ারফোর্স। তবে এক প্রাণের বিনিময়ে যে পরিমাণে মূল্য চুকিয়েছে তারা, তা বহু প্রশ্ন ও বিতর্কের জন্ম দেবে বলেই চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল ইউএস এয়ারফোর্সের ইতিহাসের দীর্ঘতম রেসকিউ মিশনের খুঁটিনাটিকে।