‘টার্কুইন দ্য প্রাউড’ বা লুসিয়াস টার্কুইনাস সুপারবাস ছিলেন রোমের সপ্তম রাজাদের মধ্যে সর্বশেষ। টার্কুইনাস দ্য এল্ডারের এই পুত্র তার শ্বশুর এবং পূর্ববর্তী রাজা সার্ভিয়াস টুলিয়াসকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেছিলেন। তার এই কাজের মাধ্যমে রাজাদের উপর রোমান সিনেটের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে; টার্কুইনাস দ্য এল্ডারের স্ত্রী টানাকুইলের সিনেটকে পাশ কাটিয়ে সার্ভিয়াস টুলিয়াসকে অভিষিক্ত করার সময় থেকেই যার সূচনা।
রোমের সর্বশেষ ইট্রুস্কান বংশোদ্ভূত রাজা টার্কুইনাস সুপারবাস অন্য রাজাদের মতোই যুদ্ধের মাধ্যমে রোমের সীমানা বাড়ানোর উদ্যোগ নেন। তিনি অনেক লড়াইয়ে জয়লাভ করেন এবং কিছু জায়গাতে রোমান কলোনি স্থাপন করেন, তবে রাজতন্ত্রের পতনের পর রোমের অস্থির সময়টাতে তার দখলকৃত অনেক শহর আবার বেদখল হয়ে যায়। টার্কুইনাস সুপারবাসের ছিল অসীম লোভ। তার বোন টার্কুইনিয়া বিয়ে করেছিলেন জুনিয়াস নামে ধনবান এক ব্যক্তিকে। তার ঘরে জন্ম নেয় দুই ছেলেসন্তান।
সন্তানদের অপ্রাপ্তবয়স্ক রেখে জুনিয়াস মারা গেলে তার সম্পদ ভোগ করার লালসায় টার্কুইনাস জুনিয়াসের বড় ছেলেকে হত্যা করেন। ছোট ছেলে লুসিয়াস চালাকি করে নির্বোধের ভান ধরলে টার্কুইনাস তাকে মানসিকভাবে অপরিপক্ক বলে মনে করলেন । তখনকার সময় রোমান ও অন্যান্য সভ্যতা এধরনের মানুষকে পবিত্র জ্ঞান করত। তাই তিনি লুসিয়াসকে কোনো ঝুঁকি মনে না করে ছেড়ে দেন এবং নিশ্চিন্তে জুনিয়াসের সম্পত্তি ভোগদখল করতে থাকেন।
টার্কুইনাসের অভিভাবকত্বে লুসিয়াস জুনিয়াস বোকার বেশ ধরে বেড়ে উঠতে থাকেন। তিনি ব্রুটাস নাম ধারণ করে (এই ব্রুটাস সিজারের ব্রুটাস থেকে ভিন্ন) রাজার বিশ্বস্ত হওয়ার চেষ্টা করে যান এবং একসময় রাজকীয় দেহরক্ষীদের একজন প্রধান হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হন। পুরো সময় তিনি তার আসল রূপ কারো কাছে প্রকাশ না করলেও তার বুকে প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছিল। তিনি জানতেন, স্বেচ্ছাচারী টার্কুইনাসের পা একসময় না একসময় হড়কাবে, আর সেই সুযোগের অপেক্ষায় তিনি তক্কে তক্কে ছিলেন।
অশুভ সংকেত
টার্কুইনাস তখন দোর্দণ্ডপ্রতাপে রাজ্য শাসন করছেন। দিকে দিকে রোমান বাহিনীর জয়পতাকা উড়ছে। রোমের শত্রুরা কেউ তার সামনে দাঁড়াতে পারছে না। এমন সময় ঘটল এক অঘটন। প্রাসাদে দেবতাদের বেদির নিচ থেকে মাথা জাগাল এক ভয়ানক সাপ, নিয়ে গেল বেদিতে রাখা দেবতাদের অর্ঘ্য। সময়টা ছিল ডেলফির ওরাকলের। কাজেই কুসংস্কারাচ্ছন্ন রাজা টার্কুইনাস তার দুই পুত্র টাইটাস আর অ্যারুনসকে বহু মূল্যবান উপঢৌকন দিয়ে ওরাকলের কাছে পাঠালেন এই অশুভ ঘটনার মর্মার্থ উদ্ধারের জন্য। তাদের সঙ্গী হলেন ব্রুটাস।
ওরাকলের উত্তর সবসময়ই ছিল ধাঁধার মতো। এবারো তার ব্যতিক্রম হল না। টার্কুইনাসের পতন কখন হবে, এ প্রশ্নের ওরাকলের জবাব ছিল “যখন কুকুর মানুষের গলাতে কথা বলে উঠবে”। এর অর্থ করা যায়, যখন আপাতবিশ্বস্ত কেউ তার বিপক্ষে কথা বলবে। কিন্তু দুই রাজপুত্র এর গূঢ় অর্থ বুঝতে ব্যর্থ হল। নিজেদের কাজ সম্পাদন হয়েছে ভেবে তারা পরবর্তী প্রশ্ন করল, পিতার পর কে রাজা হবে? এবার ওরাকলের উত্তর ছিল “যে প্রথম তার মা’কে চুম্বন করবে”। টাইটাস আর অ্যারুনস দু’জনেরই ইচ্ছা ছিল ক্ষমতায় বসার।
তাই তারা অতিরিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা এড়াতে তাদের বড় ভাই সেক্সটাসকে এ কথা না জানাতে একমত হল। এদিকে ব্রুটাস কিন্তু ওরাকলের কথার মূলভাব বুঝতে পারলেন। তাই পাহাড় বেয়ে যখন সবাই নেমে আসছিল, তখন তিনি ইচ্ছা করে পা পিছলে পড়ে গেলে তার ঠোঁট মাটি স্পর্শ করে। মাটিকেই ধরা হতো সবার মাতা, সুতরাং এই কাজের মধ্য দিয়ে ব্রুটাসই প্রথম মা’কে চুম্বন করলেন।
এদিকে পুত্রদের মুখে ওরাকলের কথা শুনে টার্কুইনাস বেশ হালকা বোধ করলেন। কুকুর বলবে মানুষের ভাষায় কথা? এ যে অসম্ভব! তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, ওরাকলের কথার আক্ষরিক নয়, বরং ভাবার্থই গুরুত্বপূর্ণ। অশুভ চিহ্ন কিন্তু বন্ধ হল না। রাজা দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। একবার তিনি দেখলেন, ইগল পাখি বাসা ছেড়ে বের হয়ে গেলে শকুনেরা হামলা করল। তারা ইগলের বাচ্চাদের বাসা থেকে বের করে দিল এবং ইগল ফিরে এলে তাকেও তাড়িয়ে দিল।
আরেকবার সদ্য জন্ম নেয়া দু’টি ভেড়ার শাবক তার কাছে নিয়ে আসা হলে তিনি সবল ও সুন্দর শাবকটিকে পছন্দ করে দেবতার বেদিতে বলি দিতে নিয়ে এলেন। তখন অন্য শাবকটি, যাকে দুর্বল মনে হয়েছিল সে তাকে শিং দিয়ে বেদির গায়ে ঠেসে ধরল। এসমস্ত সুস্পষ্ট ধ্বংসের আলামত বলে পুরোহিতেরা রাজাকে সতর্ক করে দিলেও তিনি সেসব অগ্রাহ্য করলেন।
আর্ডেয়া অবরোধ
রুটুলিয়ানদের অন্যতম শহর আর্ডেয়ার অবস্থান ছিল আগ্নেয় পাহাড়ের মাথায়। চারিদিকে খাড়া ঢাল দিয়ে সুরক্ষিত নগরের নিচু জায়গাতেও ছিল দুর্ভেদ্য সীমানাপ্রাচীর। তৎকালীন প্রযুক্তির সাহায্যে সরাসরি আক্রমণ করে নগর বিজয় এককথায় অসম্ভব। সুতরাং রাজা টার্কুইনাস সিদ্ধান্ত নিলেন অবরোধের। তিনি তার তিন পুত্র সেক্সটাস, টাইটাস, অ্যারুনস এবং তার আত্মীয় লুসিয়াস কলেটিনাসকে নিয়ে শহর ঘিরে ছাউনি ফেললেন।
অনেক ইতিহাসবেত্তার মতে, লুসিয়াস কলেটিনাস ছিলেন টার্কুইনাস দ্য এল্ডারের বড় ভাইয়ের নাতি। টার্কুইনাস দ্য এল্ডার যখন ইট্রুরিয়াতে বসবাস করতেন, তখন তার বড় ভাইয়ের মৃত্যু হয়। পরে তিনি যখন রোমে চলে আসেন, তখন বড় ভাইয়ের ছেলেকেও নিয়ে এসেছিলেন। তারই ঔরসে লুসিয়াসের জন্ম। তার পরিবার রোমের অদুরে কলেশিয়া নামে ছোট্ট একটি শহরের প্রধান ছিল। তিনি বিয়ে করেছিলেন রোমের প্রিফেক্ট, মতান্তরে চিফ ম্যাজিস্ট্রেট লুক্রেশিয়াসের রূপসী ও গুণবতী কন্যা লুক্রেশিয়াকে।
কলেটিনাস বাজি জয়
রোমান সেনারা দিনরাত পাহারা দিতে থাকল, অন্যদিকে তাদের সেনাপতিরা ব্যস্ত ছিলেন মদ্যপান আর বিলাসব্যসনে। একরাতে রোমান সেনাছাউনিতে সেক্সটাস, টাইটাস, অ্যারুনস এবং কলেটিনাস ব্যস্ত গল্প আর মদ্যপানে। একপর্যায়ে গল্প রূপ নিল বাজিতে, কার স্ত্রী কত বেশি গুণবতী- তা নিয়ে। কলেটিনাস ঘোষণা করল, লুক্রেশিয়াকের চাইতে আর কেউই বেশি গুণের অধিকারিণী নয়। তখন বাকিরা প্রস্তাব দিল একথা যাচাই করে দেখবার জন্য। তারা সবাই প্রথমে রোমের দিকে ঘোড়া ছোটাল। উদ্দেশ্য- টার্কুইনাসের পুত্রবধূরা কে কী করছে, তা দেখে এরপর কলেশিয়াতে যাওয়া। রোম আর আর্ডেয়ার দূরত্ব বেশি নয়, মাত্র ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার হবে।
তারা রোমে পৌঁছে দেখতে পেল, টার্কুইনাসের পুত্রবধূরা ভোজসভায় মত্ত। এবার সবাই রওনা করল কলেশিয়ার দিকে। সেখানে লুক্রেশিয়াকে তারা আবিষ্কার করল সহচরী পরিবেষ্টিত হয়ে তাঁতবুননরত অবস্থায়। তখনকার রোম সমাজে একেই নারীদের প্রধান এবং সম্মানজনক কাজ বলে মনে করা হতো। সবাই রায় দিল, কলেটিনাস সঠিক। তার স্ত্রীই সবথেকে বেশি গুণবতী।
রেপ অভ লুক্রেশিয়া
কিন্তু কলেটিনাস জানত না, সে খাল কেটে ঘরে কুমির নিয়ে এসেছে। রূপসী লুক্রেশিয়াকে দেখে রাজপুত্র সেক্সটাসের মনে উদয় হয়েছে কুচিন্তা। নিজেকে সামলাতে না পেরে কিছুদিন পরে অবরোধ চলাকালেই আবার সে হাজির হলো কলেটিনাসের বাসায়। এবার সে এসেছে একাকী। রাজার পুত্র হিসাবে লুক্রেশিয়া তাকে যথাযথ সমাদর করল। রাত হলে সেক্সটাস লুক্রেশিয়ার শয়নকক্ষে ঢুকে পড়ল। সে নানাভাবে লুক্রেশিয়াকে প্রলুব্ধ করতে চাইলেও লুক্রেশিয়া কিছুতেই তার অবৈধ কামনার বলি হতে সম্মত হচ্ছিল না।
লালসায় উন্মক্ত সেক্সটাস এবার খোলা তরবারি হাতে হুমকি দিল, লুক্রেশিয়া তার শয্যাসঙ্গী না হলে সে তাকে ও একটি দাসকে হত্যা করে পাশাপাশি রেখে দেবে এবং তার সবাইকে বলেবে যে তাদের ব্যভিচারে মত্ত পেয়ে কলেটিনাসের সম্মান রক্ষায় সে তাদেরকে হত্যা করে ফেলেছে। নিরুপায় লুক্রেশিয়া অনিচ্ছাসত্ত্বেও সেক্সটাসের কাছে নিজেকে সমর্পণ করলো।
লুক্রেশিয়ার স্বীকারোক্তি ও মৃত্যু
ভোর হলো। সেক্সটাস তার বাসনা চরিতার্থ করে বিদায় নিল। শোকে মুহ্যমান লুক্রেশিয়া নিজেকে সংযত করে কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিল। সে তার পিতা ও স্বামীকে খবর পাঠাল, তাদের একজন করে ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে নিয়ে অবিলম্বে আসার জন্য। সেইমতো লুক্রেশিয়াস তার বন্ধু ভ্যালেরিয়াস, যিনি পরে পাবলিকোলা নামে পরিচিত হন এবং রোমান কন্সালের পদ অলঙ্কৃত করেন, এবং কলেটিনাস ব্রুটাসকে নিয়ে উপস্থিত হয়। তারা লুক্রেশিয়াকে শোকের পোশাক পরিহিত দেখতে পায়।
তাদের কাছে লুক্রেশিয়া আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা বয়ান করে প্রতিশোধের দাবি করে। তার বাবা ও ভাই ক্রোধে আত্মহারা হয়ে যায়। তারা লুক্রেশিয়াকে সম্পূর্ণ নির্দোষ ঘোষণা করে কীভাবে সেক্সটাসকে শাস্তি দেয়া যায়, তা নিয়ে আলোচনা শুরু করে। একপর্যায়ে লুক্রেশিয়া পোশাকের নিচে লুকানো ছুরি বের করে নিজের বুকে বসিয়ে আত্মহত্যা করে। মারা যাবার আগে সে বাবা ও স্বামীর কাছ থেকে প্রতিশোধের শপথ নেয়।
লুক্রেশিয়ার মৃতদেহ কোলে নিয়ে তার বাবা ও স্বামী আহাজারি করতে থাকে। ব্রুটাস বুঝতে পারে, এবার তার প্রতিশোধের সময় হয়েছে। সে যে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, তা সমাগত। ব্রুটাস তার নির্বুদ্ধিতার খোলস ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে। সে লুক্রেশিয়াস ও কলেটিনাসকে সংযত হবার আহ্বান জানায়। এখন শোকের নয়, এখন প্রতিশোধ গ্রহণের সময়। তা না হলে লুক্রেশিয়ার আত্মা শান্তি পাবে না। সে ব্যাখ্যা করে, তার বোকামির ভাব শুধুমাত্র স্বেচ্ছাচারী রাজাকে বিভ্রান্ত করার জন্য, যে তার পরিবারকেও হত্যা করেছে। ব্রুটাসের আহ্বানে প্রত্যেকে লুক্রেশিয়ার রক্তাক্ত ছুরি হাতে তুলে নিয়ে তারা শপথ নেয়
“এই রক্ত ও দেবতাদের সাক্ষী রেখে আমি শপথ করছি, টার্কুইনাসের ও তার স্ত্রী পুত্রদের কাউকেই রেহাই দেব না। এর জন্য যা প্রয়োজন, তা-ই আমি করবো। এদের বা অন্য কেউ আর কখনো রোমের রাজা হতে পারবে না।”
অভ্যুত্থান ও রাজতন্ত্রের অবসান
ব্রুটাস, লুক্রেশিয়াস ও কলেটিনাস লুক্রেশিয়ার মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে প্রথমে কলেশিয়ার অধিবাসীদের জড়ো করে। সেখান থেকে তারা রওনা হয় রোমের দিকে। রোমান ফোরামে তারা কমিতিয়া সেঞ্চুরিয়াটার বৈঠক আহ্বান করল। কমিতিয়া কিউরিয়াটা যেখানে ছিল সব কিউরিয়ার সমন্বয়ে আইন প্রণয়নকারী সংস্থা, সেখানে কমিতিয়া সেঞ্চুরিয়াটা ছিল নাগরিকদের অভাব অভিযোগ জানানোর স্থান। কিউরিয়াটাতে শুধু তারাই সদস্য ছিল, যারা অস্ত্র বহনে সক্ষম, অন্যদিকে সেঞ্চুরিয়াটাতে সব রোমান নাগরিকই আসতে পারত। রাজতন্ত্রের অবসানের পর ধীরে ধীরে কমিতিয়া সেঞ্চুরিয়াটা অধিক ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে এবং কমিতিয়া কিউরিয়াটার অনেক দায়িত্ব নিয়ে নেয়।
সেঞ্চুরিয়াটাতে সমস্ত রোমবাসী কাছে সেক্সটাসের অপকর্ম বর্ণনা করলে রোমে জ্বলে উঠে বিদ্রোহের আগুন। রোমানরা আগে থেকেই টার্কুইনাসের ও তার পুত্রদের স্বেচ্ছাচারিতায় বিরক্ত ছিল। লুক্রেশিয়ার ঘটনা তাতে ঘি ঢালল মাত্র। জনসমক্ষে ব্রুটাস সিংহাসনের ওপর থেকে তার বংশগত সকল দাবি প্রত্যাহার করে ঘোষণা দিল- রোমে এখন থেকে রাজাকেন্দ্রিক শাসনের অবসান হল। রোম হবে রিপাবলিক (ল্যাটিন res publica যার মানে public affair)।
রোমান সিনেট হবে মূল উপদেষ্টা পরিষদ এবং তারা রোমান নাগরিকদের সম্মতিতে প্যাট্রিশিয়ানদের মাঝ থেকে নিয়োগ করবে দু’জন কন্সালকে, যারা এক বছরের জন্য রোমের শাসনভার নেবে। প্রতি বছর এভাবে কন্সাল নির্বাচন হবে। জরুরি পরিস্থিতিতে সিনেট একজন একনায়ক নিয়োগ দিতে পারবে, তবে তার মেয়াদ কখনোই ছ’মাসের বেশি হবে না, এবং তার ক্ষমতা সীমিত থাকবে রোমের দেয়ালের বাইরে।
সাময়িকভাবে রোমের প্রিফেক্ট হিসেবে লুক্রেশিয়াস শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন এবং সিনেটের অনুমোদনে ব্রুটাস ও কলেটিনাসকে নির্বাচিত করা হল কন্সাল হিসেবে। রোমের দুয়ার বন্ধ করে দেয়া হল। রানি টুলিয়া প্রাসাদ থেকে আগেই পালিয়ে গেলেন। এদিকে টার্কুইনাস খবর পেয়ে অবরোধ তুলে নিয়ে রোমের কাছে এসে ছাউনি ফেলেন। ব্রুটাস স্বেচ্ছাসেবক সেনাদল নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে টার্কুইনাসকে তার ও পরিবারের অপরাধের ফিরিস্তি দিয়ে তাকে রোমে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করলেন। সেনারা তাকে পরিত্যাগ করলে তিনি পালিয়ে যান। তার পুত্র সেক্সটাস গ্যাবি শহরে, যা তখন রোমের অধিকারে ছিল, চলে যায়। সেখানকার বাসিন্দারা তার বিশ্বাসঘাতকতার কথা ভোলেনি, তারা সেক্সটাসকে হত্যা করে বদলা নেয়।
সিংহাসন পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা
টার্কুইনাস তার ইট্রুস্কান মিত্রদের কাছে গিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করেন। ভেই ও টার্কুইনি থেকে তার জন্য সেনাদল পাঠান হয়। তিনি রোমের দিকে যাত্রা করেন এবং শহরের বাইরে এসে তার প্রতিনিধিদলকে পাঠান। আপাতদৃষ্টিতে তাদের উদ্দেশ্য টার্কুইনাসের সম্পত্তির ফয়সালা করা বলা হলেও আসলে তাদের কাজ ছিল- রোমান সিনেট ও অভিজাতদের একাংশকে হাত করে তাদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা। তার এই কূটকৌশল ধরা পড়ে গেলে রোমানদের মধ্যে যারা টার্কুইনাসের সাথে হাত মিলিয়েছিল, তাদের সকলকে কন্সালরা মৃত্যুদণ্ড দেন, যার মধ্যে ব্রুটাসের দুই পুত্রও ছিল।
টার্কুইনাস এবার তার বাহিনী নিয়ে আক্রমণের প্রস্তুতি নিলেন। রোমের সুরক্ষাভার লুক্রেশিয়াসের হাতে দিয়ে ব্রুটাস তার সেনাদল টার্কুইনাসের মোকাবেলা করতে এলেন। এই যুদ্ধ ‘ব্যাটল অভ সিলভা অ্যারাশিয়া’ নামে বিখ্যাত।
ব্রুটাস পরিচালনা করছিলেন অশ্বারোহী বাহিনী, আর ভ্যালেরিয়াসের দায়িত্বে ছিল পদাতিক। শুরুতে দুই পক্ষেরই অশ্বারোহী বাহিনীর সংঘর্ষ হয়, যেখানে রোমান পক্ষে ব্রুটাস ও টার্কুইনাসের পক্ষে অশ্বারোহী সেনাপতি তার ছেলে অ্যারুনস মারাত্মকভাবে আহত হন। দু’জনেই পরে মারা যান। এরপর পদাতিকদের মাঝে যুদ্ধ শুরু হয়। টার্কুইনাসের বাহিনীর ডান বাহুতে টার্কুইনি সেনারা জয়ী হলেও রোমান বাহিনীর ডান বাহু ভেই সেনাদের পরাজিত করে। শেষ পর্যন্ত টার্কুইনাসের বাহিনী পিছু হটে গেলে রোমানরা বিজয়ী হয়। ব্রুটাসের সম্মানে রোমানরা উন্মুক্ত তরবারি হাতে তার বিশাল মূর্তি রোমের সাত রাজার ভাস্কর্যের মধ্যে স্থাপন করে।
ব্যর্থ হয়ে টার্কুইনাস এবার ক্লাস্টিয়ামে ইট্রুস্কান রাজা লার্স পোরসেনার কাছে যান। কিন্তু রোমান বাহিনী তাকেও পরাজিত করে। সবশেষে ৪৯৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে টার্কুইনাস তার জামাতা টাস্কুলামের রাজপুত্র অক্টাভিয়াস ম্যামিলাসের সাহায্য চান। তার বাহিনী রোমের দিকে যাত্রা করে, কিন্তু এবারও তার চেষ্টা আগেগ অভিযানগুলোর মতই ব্যর্থ হয়। টার্কুইনাস কিউমিতে অ্যারিস্টোডিমাসের দরবারে আশ্রয় নেন এবং সেখানেই ৪৯৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তার মৃত্যু হয়। টার্কুইনাসের সাথেই শেষ হয় রোমের সাত রাজার ইতিহাস এবং জন্ম নেয় রোমান রিপাবলিক, যা টিকেছিল ২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবার আগ পর্যন্ত।