ছাতা, আমাদের প্রতিদিনকার ব্যবহার্য জিনিসপত্রের মধ্যে অন্যতম এক অনুষঙ্গ। রোদ হোক কিংবা বৃষ্টি, ছাতার কোনো বিকল্প নেই। সূর্য থেকে ত্বক, কিংবা বৃষ্টি থেকে মাথা, আমাদের সর্বদা রক্ষা করে ছাতা। এছাড়াও আজকাল ছাতার আরো বহুরকম ব্যবহার আমাদের আশেপাশে আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাই। হোক সেটা বীচে, পানীয়র গ্লাস পরিবেশনে, ফটোগ্রাফিতে কিংবা কোনো রাস্তা সাজাতে। কিন্তু কখনও কি আমরা ভেবে দেখেছি কবে, কখন, কীভাবে মানুষ এই ছাতা ব্যবহার শুরু করল? চলুন, আজ আমাদের সঙ্গী এই ছাতার গল্পই হোক।
ভাবতে অবাক লাগলেও সত্যি, আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগেও মানুষ ছাতা ব্যবহার করত! আমাদের আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের মধ্যে খুব অল্প জিনিসই আছে যা হাজার বছর ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে। সেদিক থেকে বিচার করলে ছাতা সত্যিই অনবদ্য! আজকাল ছাতা বৃষ্টিতে অধিক ব্যবহৃত হলেও, প্রাচীনকালে কিন্তু একমাত্র রোদ থেকে বাঁচতেই ছাতা ব্যবহার হত। ছাতার ইংরেজী Umbrella শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘Umbrage’ থেকে, যার অর্থ ছায়া। এছাড়াও হালকা ছাতা বা ‘Parasol’ শব্দটি ইতালীয় শব্দ Para এবং Sole এ দুটির সমন্বয়ে গঠিত। যেখানে Para অর্থ প্রতিরক্ষা আর Sole অর্থ সূর্য।
চার হাজার বছর পূর্বের প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার নিদর্শন থেকে তাদের ছাতা ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। পাম গাছের পাতা, পালক এবং কাঠ দিয়ে তারা ছাতা তৈরি করত। স্বভাবতই, ছাতা কেবল রোদ থেকে বাঁচার জন্যই ব্যবহার হত আর তা করত শুধুমাত্র ফারাওরা।
খ্রিস্টপূর্ব ১১০০ সালের দিকে চীনারা তাদের নিজস্ব ঢংয়ে ছাতা তৈরি শুরু করে। প্রথমদিকে গাছের পাতা এবং শাখা-প্রশাখা ব্যবহৃত হত ছাতা তৈরির ক্ষেত্রে, পরবর্তীতে প্রযুক্তিগত উন্নতির সাথে সাথে ছাতা তৈরির কাঁচামালে যুক্ত হয় কাপড়, চামড়া, সিল্ক এবং কাগজ। পশুর হাড়ও ব্যবহৃত হত, যা দিয়ে ছাতার বাঁটে বিভিন্ন নকশা করা হত। আজকের যুগে আমরা যেরকম ছাতা দেখতে পাই, সেরকম ছাতা প্রথম তৈরি হয় খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দে।
সেসময়ও চীনে ছাতা ব্যবহার করত রাজবংশ, সমাজের উচ্চপদস্থ ব্যক্তি এবং অভিজাত মহিলারা। ছাতা তখন ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। কম তৈরি হত বলে দামও ছিল চড়া। কাজেই সবার পক্ষে তা কেনাও সম্ভব ছিল না। ত্বকের সুরক্ষার জন্য মহিলাদের মধ্যে তখন ছাতা ব্যবহারের প্রচলন বেশি ছিল।
প্রাচীন গ্রিস এবং রোমে ছাতার ব্যবহার শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দে। এখানেও ছাতা ছিল কেবল মহিলাদের প্রসাধনী সামগ্রীর অন্তর্ভুক্ত। এসময় প্রথম ছাতা বন্ধ করে রাখার কৌশল আবিষ্কৃত হয়। চাকরেরা তাদের মনিবের পাশাপাশি হাঁটত আর তাদের মাথার ওপর ছাতা ধরে রাখত। ব্যবহারের পর ছাতা বন্ধ করে স্টোরে রেখে দিত। আমাদের দেশেও এককালে জমিদারদের মাথায় এমন করে ছাতা ধরার চল ছিল।
এভাবে দীর্ঘকালব্যাপী ছাতা কেবল মহিলাদের প্রসাধনীরূপেই প্রচলিত ছিল। অভিজাত মহিলাদের পাশাপাশি সাধারণ নারীরাও ছাতা ব্যবহার করতে শুরু করল। ১৬০০-১৭০০ খ্রিস্টাব্দে ছাতা ধীরে ধীরে ফ্যাশন থেকে প্রয়োজন হয়ে উঠতে লাগল। কারণ ততদিনে পশ্চিমারাও ছাতা ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে। ইউরোপের অনেক জায়গার আবহাওয়া, বিশেষ করে ইংল্যান্ডের আবহাওয়া, বৃষ্টির জন্য বেশ বিখ্যাত। কাজেই তখন বৃষ্টিতেও ছাতার ব্যবহার হতে লাগল। কিন্তু তখনও ছাতা তৈরিতে ব্যবহার হত সিল্কের কাপড়, যা পানি আটকানোর জন্য আদর্শ ছিল না। এছাড়াও ছাতার হ্যান্ডেল তৈরি হত কাঠ বা তিমি মাছের হাড় দিয়ে, যার জন্য তা ছিল বেশ ভারী। ছাতাকে পানিরোধী করার জন্য তখন তার ওপর তেল ও মোমের প্রলেপ দেয়া শুরু হয়।
পুরুষেরা কখন থেকে ছাতা ব্যবহার শুরু করে? এটা জানতে হলে আগে আমাদের একজন জেদী ভদ্রলোকের কথা জানতে হবে। ভদ্রলোকের নাম জোনাস হ্যানওয়ে, উনি একজন ইংরেজ পরিব্রাজক। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের কিছু পরের কথা, যখন তিনি পুরুষ হয়েও ছাতা মাথায় ইংল্যান্ডের রাস্তায় বেরিয়ে ছিলেন। লোকজন তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করতে লাগল। কারণ তখনকার সময় পুরুষদের ছাতা ব্যবহার করা যে তাদের পৌরুষত্বের অপমান! কিন্তু তিনি গায়ে মাখলেন না। অবাক ব্যাপার, দীর্ঘ ত্রিশ বছর তাকে এরকম গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে শুধুমাত্র ছাতা ব্যবহারের জন্য! পরবর্তীতে অবশ্য মানুষের ধারণায় পরিবর্তন আসতে শুরু করে এবং তারা বুঝতে পারে যে কেবলমাত্র ফ্যাশনের জন্য নয়, বরং নিজের সুরক্ষার জন্যই ছাতা ব্যবহার করা উচিত। ধীরে ধীরে সকল শ্রেণীর মানুষ ছাতা ব্যবহার শুরু করে এবং সতের শতকের মাঝামাঝি সময়ে ছাতা সকলের অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। তবে পৃথিবীতে বিশেষ করে আমাদের দেশে এখনো প্রচুর মানুষ রয়েছেন যারা সেই তিনশ বছর প্রাচীন ধারণা আঁকড়ে ধরে আছেন, যার ফলে প্রয়োজন হলেও তারা ছাতা ব্যবহার করতে কুন্ঠা বোধ করেন।
১৮৫০ সালে,স্যামুয়েল ফক্স নামক এক ব্যক্তির কল্যাণে ছাতায় স্টিলের ব্যবহার শুরু হয়। ফক্স ছিলেন একজন ইংরেজ শিল্পপতি। স্টিল ব্যবহারের ফলে ছাতা আগের চাইতে অনেক হালকা এবং মজবুত হয়ে ওঠে, ফলে তা বহন করা আরও সহজ হয়ে যায়। ছাতার এ বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পর স্যামুয়েল ফক্স গড়ে তোলেন ফক্স আমব্রেলাস লিমিটেড যা আজও ইংল্যাণ্ডের অন্যতম একটি ছাতা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান।
ছাতার উন্নতি সাধন কিন্তু থেমে নেই। ১৯২৮ সালে পৃথিবী প্রথমবারের মতো পেল পকেট ছাতা, যার কৃতিত্ব হ্যান্স হপ্ট নামক এক ব্যক্তির, যিনি যুদ্ধে পায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। যার ফলে তাকে চলাচল করতে হত লাঠি হাতে। কিন্তু একইসাথে হাতে লাঠি এবং ছাতা বহনে তাকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। তাই তিনি ছাতাকে এমনভাবে তৈরি করলেন, যেন ছাতা মুড়িয়ে পকেটে রেখে দেয়া যায়। আমাদের সবার মধ্যেই আজকাল এধরণের ছাতা বেশ জনপ্রিয়। পরবর্তীতে ছাতা বিপরীত দিকে মুড়িয়ে রাখার পদ্ধতিও আবিষ্কৃত হয়। এর আবিষ্কর্তা হলেন জিনান কাযিম। এ ছাতার সুবিধে হলো, বিপরীত দিকে মুড়িয়ে রাখার ফলে ছাতার গায়ে লেগে থাকা পানি ছাতার ভেতরেই রয়ে যায়, যার ফলে ছাতা কোথাও রাখলে তার আশেপাশে ভেজার সম্ভাবনা কমে যায়। ছাতার অগ্রযাত্রায় একে মোটামুটি বৈপ্লবিক এক পরিবর্তনই বলা চলে।
হাজার বছর ধরে ব্যবহার হয়ে আসা এ ছাতা হয়তো আরো হাজার বছর ব্যবহৃত হবে। খুব শীঘ্রই এর কোনো বিকল্প আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে দিন দিন যে ছাতার আরো উন্নতি সাধন হবে তা বলাই বাহুল্য। চারদিকে এখন প্রযুক্তির জয়জয়কার। ছাতার সঙ্গে প্রযুক্তি জুড়ে গিয়ে এটি যে বহুল ব্যবহারের উপযোগী হয়ে উঠবে না তা কে বলতে পারে! এখন দেখার বিষয়, এ জয়যাত্রায় ছাতার মুকুটে আর কী কী পালক যুক্ত হয়!