
আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেছে। দেশের প্রায় এক কোটি কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী তখনো মার্কিন সমাজে খুব একটা প্রতিষ্ঠা পায়নি। এদের নব্বই ভাগই বাস করতো যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে। অধিকাংশ কৃষ্ণাঙ্গদের তখন অল্প মজুরিতে কাজ করতে হতো, জিম ক্রো আইন চালু করে শ্বেতাঙ্গ শাসকরা তাদেরকে অনেক সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছিল। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের কারণে কৃষ্ণাঙ্গদের জীবন তখন দুর্বিষহ। কিন্তু ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা আমেরিকার জনজীবন ও সংস্কৃতিকে পুরোপুরি পাল্টে দিল। এই যুদ্ধের ফলে কৃষ্ণাঙ্গরা নিজেদের অধিকার নিয়ে প্রথমবারের মতো কথা বলার সুযোগ পেল। ব্র্যানডেইস ইউনিভার্সিটির আফ্রিকান স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক চ্যাড উইলিয়ামস মনে করেন, কালোদের স্বাধীনতা ও আধুনিক আফ্রিকান-আমেরিকান ইতিহাস পুরোপুরি বোঝার জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।

দ্য গ্রেট মাইগ্রেশন
১৯১৭ সালের আগপর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি। কিন্তু যুদ্ধের শুরু থেকেই এর আঁচ মার্কিন অর্থনীতিতেও পড়েছিল। যুদ্ধের কারণে ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিক আসা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯১৫ সালের দিকে আমেরিকার জর্জিয়ায় বল উইভল নামক পোকার আক্রমণের কারণে তুলার উৎপাদন মারাত্মক হারে কমে যায়। এসব কারণে হাজারো আফ্রিকান-আমেরিকান দক্ষিণ ছেড়ে উত্তরের রাজ্যগুলোতে চলে যাওয়ার মনস্থির করে। মার্কিন ইতিহাসে এটা ‘গ্রেট মাইগ্রেশন’ নামে পরিচিত। পরবর্তী অর্ধশতাব্দী পর্যন্ত প্রায় সাত মিলিয়ন আফ্রিকান-আমেরিকান আমেরিকার উত্তরাঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় দক্ষিণের প্রায় পাঁচ লাখ আফ্রিকান-আমেরিকান উত্তরের শহরগুলোতে গমন করে। ১৯১০-১৯২০ সালে নিউ ইয়র্ক, শিকাগো, ফিলাডেলফিয়া, ডেট্রয়েট ইত্যাদি শহরে কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়।

কিন্তু এতেও কপাল খুললো না কালোদের। দক্ষিণে থাকার সময় যেমন বৈষম্য ছিল তাদের জীবনের নিত্যসঙ্গী, নতুন জায়গায় এসেও একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হলো তাদেরকে। কর্মক্ষেত্র, বাসস্থান সব কিছুতেই শ্বেতাঙ্গরা কালোদের পৃথকভাবে বিচার করতে শুরু করলো। কৃষ্ণাঙ্গ মহিলারা আগে যেমন গৃহিণীর কাজ বা সন্তান লালনপালন করতো, নতুন জায়গায় এসেও তাদের কপালে একই কাজই জুটলো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসব নিয়ে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ দাঙ্গাও বাঁধলো। ১৯১৭ সালের ইস্ট সেইন্ট লুইস দাঙ্গা এরকম একটি সাদা-কালো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।
যুদ্ধের দামামা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা প্রথমদিকে জড়াতে চায়নি। শ্বেতাঙ্গ বা কৃষ্ণাঙ্গ, কোনো পক্ষই তখন যুদ্ধের ব্যাপারে আগ্রহী ছিল না। ইউরোপের ঝামেলা ইউরোপে থাকুক, এমনটাই ছিল তাদের মনোভাব। কিন্তু ১৯১৭ সালের ২ এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন কংগ্রেসের প্রতি যুদ্ধ ঘোষণার আহ্বান জানান। উইলসনের তত্ত্ব ছিল এই বিশ্বকে ‘অবশ্যই গণতন্ত্রের জন্য নিরাপদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে’। উইলসনের গণতন্ত্রের নিরাপত্তার জন্য এই প্রয়াস আফ্রিকান-আমেরিকানদের কিছুটা অনুপ্রাণিত করেছিল এই ভেবে যে, ইউরোপের গণতন্ত্র উদ্ধারের সাথে সাথে আমেরিকাতে তারাও তাদের নাগরিক অধিকারগুলোর জন্য লড়াই করার একটা সুযোগ পাবে।

বাল্টিমোরভিত্তিক আফ্রো-আমেরিকান পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হলো, ‘আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটা সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশের নিশ্চয়তা দেওয়া হোক, তারপর না হয় আমরা আটলান্টিকের ওপাড়ের (ইউরোপ) সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাবো’।
কিছু আফ্রিকান-আমেরিকান সংবাদপত্র এই মতবাদ প্রকাশ করা শুরু করলো যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক অসমতার কারণে কৃষ্ণাঙ্গদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা উচিত হবে না। অন্যদিকে দ্য ক্রাইসিস নামের একটি পত্রিকায় একটি শক্তিশালী সম্পাদকীয় ছাপা হলো। সেখানে লেখা হলো,
চলুন আমরা আর দ্বিধা না করি। চলুন আমরা আমাদের সব ক্ষোভ, অসন্তুষ্টি ভুলে যাই। আমাদের শ্বেতাঙ্গ ভাই আর বাকিসব মিত্রদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করি।
দে ময়েন ট্রেইনিং ক্যাম্প
বেশিরভাগ তরুণ আফ্রিকান-আমেরিকান তাদের সাহস ও দেশপ্রেমের প্রমাণ দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ছিল। প্রায় দশ লক্ষ কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ যুদ্ধে যাওয়ার জন্য আবেদন করে। এদের মধ্যে ৩,৭০,০০০ জনকে নির্বাচিত করা হয় এবং ২,০০,০০০ জনকে ইউরোপের রণক্ষেত্রগুলোতে পাঠানো হয়। কৃষ্ণাঙ্গ সৈনিকদের পরিচালনা করার জন্য কর্তৃপক্ষ কৃষ্ণাঙ্গ অফিসারের প্রয়োজন অনুভব করে। কারণ কর্তৃপক্ষ মনে করেছিল কৃষ্ণাঙ্গ সৈনিকরা কৃষ্ণাঙ্গ অফিসারদের প্রতিই বেশি অনুগত থাকবে এবং এতে করে কোনো প্রকার বিদ্রোহের আশঙ্কাও থাকবে না। এই কৃষ্ণাঙ্গ অফিসারদের প্রশিক্ষণের জন্য দে ময়েন (Des Moines) দুর্গকে বেছে নেওয়া হয়। দুর্গটি তৈরি করা হয়েছিল ১৯০১ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়াতে অবস্থিত এই ক্যাম্পটি প্রথমদিকে ক্যাভালরি পোস্ট হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

১৯১৭ সালের ০৬ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ঐ বছরের মে মাসের ১৯ তারিখ ফেডারেল সরকার দে ময়েন দুর্গকে ১২০০ কৃষ্ণাঙ্গ অফিসারের ট্রেইনিং গ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহারের ঘোষণা দেয়। এদের মধ্যে ২৫০ জন আগে থেকেই নন-কমিশন্ড অফিসার ছিলেন। বাকিরা ছিলেন সিভিলিয়ান। একই বছরের জুন মাসের ১৭ তারিখ লেফটেন্যান্ট কর্নেল চার্লস সি. ব্যালুর নেতৃত্বে আরও কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গ অফিসারের সহায়তায় প্রশিক্ষণ শুরু হয়।
অস্ত্র প্রশিক্ষণের পাশাপাশি এখানে সিগন্যালিং, ম্যাপ রিডিং ইত্যাদি বিষয়েও প্রশিক্ষণার্থীদেরকে ওয়াকিবহাল করা হয়। ব্যালু অবশ্য এই কৃষ্ণাঙ্গ হবু অফিসারদের প্রশিক্ষণ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছিলেন। যুদ্ধের পর তিনি উল্লেখ করেছিলেন, প্রশিক্ষণার্থীরা পুরো ব্যাপারটাকে খুব একটা গুরুত্বের সাথে নেয়নি। এছাড়া ইউরোপে গিয়ে ঠিক কী ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে সেই সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না কারোরই। ফলে যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান সম্ভব হয়নি বলে মত প্রকাশ করেছিল ওয়ার ডিপার্টমেন্ট। তারপরও এই ক্যাম্প থেকে ‘প্রভিশনাল আর্মি অফিসার ট্রেইনিং স্কুল’ প্রকল্পের আওতায় ৬৩৯ জন কৃষ্ণাঙ্গ গ্র্যাজুয়েটেড হন যাদের মধ্যে ছিলেন ১০৬ জন ক্যাপ্টেন, ৩২৯ জন ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট ও ২০৪ জন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট।
যুদ্ধ শেষে দুর্গটিকে হাসপাতালে পরিণত করা হয়।
বৈষম্যের বেড়াজাল
শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করার কথা থাকলেও বিপত্তি বাধে শুরু থেকেই। শ্বেতাঙ্গদের রক্তে যেন কালোদের জন্য ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। প্রথম থেকেই আফ্রিকান-আমেরিকান সার্ভিসম্যানদের অসম দৃষ্টিতে দেখা হতো। তাদেরকে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় উচ্চ হারে যুদ্ধের জন্য (বাধ্যতামূলক) নির্বাচন (Draft) করা হতো। ড্রাফট বোর্ডগুলো ছিল শ্বেতাঙ্গ নির্ভর। সহজে আলাদা করার সুবিধার্থে কৃষ্ণাঙ্গদের তাদের রেজিস্ট্রেশন কার্ডের কোণার অংশ ছিঁড়ে ফেলতে হতো। পোস্ট অফিসের লোকজন কৃষ্ণাঙ্গদের ড্রাফটের কাগজ ইচ্ছাকৃতভাবে আটকে রাখতো, কিন্তু তার জন্য জবাবদিহি এমনকি কয়েদ খাটতে হতো কৃষ্ণাঙ্গদের।
১৯১৭ সালের এক হিসেব অনুযায়ী, ৫২% কৃষ্ণাঙ্গ ও ৩২% শ্বেতাঙ্গকে যুদ্ধের জন্য ড্রাফট করা হয়েছিল। কখনো কখনো কৃষ্ণাঙ্গ সেনা ইউনিটগুলোকে শ্বেতাঙ্গ সৈন্যদল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রাখা হতো। সেনাবাহিনী পরিচালনার জন্য যে পরিমাণ স্বেচ্ছাসেবকের প্রয়োজন ছিল তার অপর্যাপ্ততার কারণে কর্তৃপক্ষ কৃষ্ণাঙ্গদের রণক্ষেত্রে না পাঠিয়ে ক্যাম্পগুলোতে বিভিন্ন শারীরিক পরিশ্রমের কাজ, যেমন- ট্রাক ড্রাইভার, কুলি, খালাসি, শ্রমিক ইত্যাদিতে নিয়োগ দেওয়া হতো। অবশ্য যুদ্ধে মার্কিন অর্জনে কৃষ্ণাঙ্গদের এই ছোটখাট কাজগুলো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল তা বলা বাহুল্য।

আফ্রিকান-আমেরিকান অফিসারদেরকে শুধু কৃষ্ণাঙ্গ ট্রুপস পরিচালনা করার জন্য নিয়োগ করা হলেও, শ্বেতাঙ্গ অফিসাররা সাদা, কালো উভয় ইউনিটই পরিচালনা করতেন। তখন কোনো কৃষ্ণাঙ্গ সামরিক কর্মকর্তা শ্বেতাঙ্গ রেজিমেন্ট বা ট্রুপ পরিচালনা করছেন, তা কল্পনাও করা যেত না। এমনকি কখনো কখনো শ্বেতাঙ্গ নিম্ন পদমর্যাদার ব্যক্তিরা তাদের চেয়ে উর্ধতন কৃষ্ণাঙ্গ অফিসারকে যথাবিহিত সম্মান বা স্যালুট প্রদানে অসম্মতি জানাতেন। যদিও কখনো জানাতেন, তবুও কালোদের প্রতি তাদের আসল মনোভাব ঠিকই প্রকাশ পেয়ে যেত। স্যালুট করার সাথে সাথে মুখ দিয়ে ‘ড্যাম ইউ’ জাতীয় ইত্যাদি ঘৃণাবাচক শব্দও উচ্চারণ করতো শ্বেতাঙ্গ সৈনিকরা। ব্ল্যাক অফিসারদেরকে শ্বেতাঙ্গ সৈনিকের কাছ থেকে স্যালুট আশা না করার পরামর্শ দেওয়া হতো। এমনকি তাদের অফিসার্স ক্লাব বা কোয়ার্টারগুলোতে কোনো প্রবেশাধিকার পর্যন্ত ছিল না।
কৃষ্ণাঙ্গ সৈনিকদের অনেকসময় কোনো ইউনিফর্ম সরবরাহ করতো না কর্তৃপক্ষ। তাদেরকে গৃহযুদ্ধের সময়কার ইউনিফর্ম পরে থাকতে হতো। শুধু তা-ই নয়, মাঝেমধ্যে রাতের বেলা ব্যারাকে শোবার জায়গাটুকুও পেতেন না অনেক কৃষ্ণাঙ্গ সৈনিক। ফলে অনেক সময় তাঁবুর বাইরে শীতের মধ্যে রাত কাটাতে হতো তাদেরকে। এভাবে পদে পদে শ্বেত-শোষণের শিকার হয়েছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ যোদ্ধারা।
যুদ্ধের প্রথমদিকে কৃষ্ণাঙ্গদের সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে না পাঠিয়ে ক্যাম্পের ভেতর বিভিন্ন শারীরিক শ্রমের কাজ করতে দেওয়া হতো। সময়ের সাথে সাথে যুদ্ধের মাত্রা বেড়ে গেলে অবশেষে যদিও তাদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই সেটা যুদ্ধ করার জন্য নয়, বরং সেখানে তাদের কাজ ছিল পরিখা খনন, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অবিস্ফোরিত গোলা সরানো, যন্ত্রপাতি ঠিক করা, মৃত সৈনিকদের কবর দেওয়া ইত্যাদি।
আটলান্টিকের ওপাড়ে
আগে থেকেই চারটি অল-ব্ল্যাক রেজিমেন্ট থাকলেও সেগুলোকে ইউরোপে না পাঠিয়ে আমেরিকার ভেতরেই বিভিন্ন অঞ্চলে রাখা হয়েছিল। অবশেষে যুদ্ধের জন্য নাইন্টি সেকেন্ড ও নাইন্টি থার্ড ডিভিশন নামে দুটো অল-ব্ল্যাক কমব্যাট ইউনিট গঠন করা হয়।

নাইন্টি সেকেন্ড ডিভিশনের অন্তর্ভুক্ত ছিল চারটি ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্ট, তিনটি ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট, একটি ট্রেঞ্চ মর্টার ব্যাটারি, তিনটি মেশিন গান ব্যাটালিয়ন, একটি সিগনাল ব্যাটালিয়ন, একটি ইঞ্জিনিয়ার রেজিমেন্ট, একটি ইঞ্জিনিয়ার ট্রেন ও আরও কিছু সাপোর্ট ইউনিট। নাইন্টি সেকেন্ড ডিভিশন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কবলে পড়ে। অন্যান্য শ্বেতাঙ্গ ডিভিশনগুলো এই ইউনিটের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়। ফলে এই কৃষ্ণাঙ্গ ইউনিটটি যুদ্ধে নৈপুণ্য প্রদর্শন করার তেমন একটা সুযোগ পায়নি। যে কয়টি যুদ্ধে এই ডিভিশন অংশগ্রহণ করেছিল, সেগুলোতে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি এটি। ১৯১৮ সালের অগাস্টের মাঝামাঝি ঘটা লরেইনের যুদ্ধে কিছুটা সাফল্য অর্জন করে নাইন্টি সেকেন্ড ডিভিশন।
২০ সেপ্টেম্বরে এই ডিভিশন মিউজ-আর্গন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য আর্গন ফরেস্টের উদ্দেশে রওনা দেয়। কিন্তু নিজেদের প্রশিক্ষণের দুর্বলতা, অস্ত্র ও রসদের অপ্রতুলতা ও ফ্রান্সের ভূমিরূপ সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান না থাকার কারণে ফরাসিদের হাতে মার খেয়ে যায় এই ডিভিশনটি। তাদের এই ব্যর্থতাকেই আফ্রিকান-আমেরিকানদের যুদ্ধে অক্ষমতার নিদর্শন হিসেবে পরবর্তী ত্রিশ বছর ধরে পেশ করে সামরিক কর্তৃপক্ষ।

নাইন্টি থার্ড ডিভিশনের কমান্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার রয় হফম্যান। এই ডিভিশনের অন্তর্ভুক্ত ছিল ৩৬৯ ইনফ্যান্ট্রি, ৩৭০ ইনফ্যান্ট্রি, ৩৭১ ইনফ্যান্ট্রি, ৩৭২ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্ট। ন্যাশনাল গার্ড ও ড্রাফট করা সৈনিকদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই ডিভিশনের পর্যাপ্ত কমব্যাট ইউনিট ও সাপোর্ট ইউনিট ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছিল এই ডিভিশনটি। অবশ্য এই অর্জনের পেছনে বেশিরভাগ অবদান ছিল ৩৬৯ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টের। আফ্রিকান-আমেরিকান বাহিনী শ্যাম্পেন-মার্ন, মিউজ-আর্গন, বেলাউ উডস, চ্যাটু-থাইরি ইত্যাদি অপারেশনে অংশগ্রহণ করে।
হারলেম হেলফাইটার্স
৩৬৯ ইনফ্যান্ট্রি ছিল ফ্রান্সে নাইন্টি থার্ড ডিভিশনের প্রথম রেজিমেন্ট। ৩৬৯ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টের ডাকনাম ছিল হারলেম হেলফাইটার্স। হেলফাইটার্স উপাধিটি জার্মান বাহিনীর দেওয়া। প্রাথমিকভাবে এটি ছিল ন্যাশনাল গার্ডের ১৫ নিউ ইয়র্ক (কালারড) ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্ট নামক একটি ইউনিট। নিউ ইয়র্কের হারলেমের ২০০ জন বাসিন্দা এই কোরটি প্রাথমিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। যুদ্ধ শুরু হলে ১৯১৮ সালের পহেলা মার্চ রেজিমেন্টটি নাইন্টি থার্ড ডিভিশনের অংশ হিসেবে ৩৬৯ ইনফ্যান্ট্রিরূপে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়। আফ্রিকান-আমেরিকান সৈন্যের রেজিমেন্ট হলেও এর বেশিরভাগ কমান্ডিং অফিসার ছিলেন শ্বেতাঙ্গ।
নিউ ইয়র্কের ক্যাম্প হুইটম্যানে তাদেরকে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আফ্রিকান-আমেরিকানদের বিদেশে আদৌ যুদ্ধ করতে পাঠানো উচিত কি না এই প্রসঙ্গে যথেষ্ট তর্ক-বিতর্কের পর অবশেষে প্রথম আমেরিকান রেজিমেন্ট হিসেবে হারলেম হেলফাইটার্সকে ফ্রান্সে পাঠানো হয়। রেজিমেন্টটি ফ্রান্সে পৌঁছায় ১৯১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। প্রথম তিন মাস রসদ সরবরাহের দায়িত্বে থাকলেও পরে মার্চ মাসে এই রেজিমেন্টকে ফ্রান্সের ১৬ ডিভিশনের সাথে পুনরায় প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষণ শেষে ফ্রন্টলাইনে পাঠানো হয় সৈন্যদের। ১৮ জুলাই থেকে ৬ অগাস্ট পর্যন্ত এই রেজিমেন্টটি ফ্রান্সের ১৬১ ডিভিশনের সাথে মিলিত হয়ে জার্মান আক্রমণের বিরুদ্ধে দুর্ধর্ষ প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

এ সময় জার্মান বাহিনীর একটি অন্যতম যুদ্ধকৌশল ছিল রাতের বেলা অতর্কিতে মিত্র বাহিনীর ওপর আক্রমণ করা। এরকম একটি আক্রমণের সময় ৩৬৯ রেজিমেন্টের একজন কর্পোরাল, হেনরি জনসন একাকি পুরো একটি জার্মান রেইডিং পার্টির বিরুদ্ধে শুধু পিস্তল ও ছুরি নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তার এই বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধে চারজন জার্মান সৈনিক নিহত হয় এবং মিত্র বাহিনী জার্মান অস্ত্রের একটি বিশাল অংশ হস্তগত করে। জনসন সার্জেন্ট পদে উন্নীত হন এবং প্রথম আমেরিকান হিসেবে ফ্রান্সের ওয়ার ক্রস (French Croix de Guerre) পদক লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে আরও ১৭০ জন কৃষ্ণাঙ্গ যোদ্ধাকে এই পদক প্রদান করে ফরাসি সরকার। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের মেডেল অভ অনার ও ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস ক্রসেস পদকও জোটে এই রেজিমেন্টের কয়েকজন সাহসী যোদ্ধার কপালে।

হারলেম হেলফাইটার্স প্রায় ১৯১ দিন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে যেটি ছিল আর যেকোনো মার্কিন ইউনিটের চেয়ে সবচেয়ে দীর্ঘ যুদ্ধকালীন অবস্থান। যুদ্ধে ১৩০০-এর মতো হেলফাইটার নিহত হন। ১৯১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রেজিমেন্টটি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসে।
যুদ্ধ শেষ
১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর, মিত্রশক্তি ও অক্ষশক্তির মধ্যকার যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।
যুদ্ধে নাইন্টি সেকেন্ড ডিভিশনের ১৬৪৭ জন ও নাইন্টি থার্ড ডিভিশনের ৩,৫৩৪ জন সৈনিক প্রাণ হারান। এতটা ত্যাগের পরও কৃষ্ণাঙ্গ সৈনিকদের কপালে সম্মাননা তো জোটেইনি, বরং আবারও নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছিল তাদেরকে। শ্বেতাঙ্গরা ভাবতে শুরু করল, আফ্রিকান-আমেরিকানরা এই বুঝি তাদের সমাধিকার দাবি করে বসলো। শ্বেতাঙ্গদের মনে আরও ভয় ছিল যে, যুদ্ধফেরত এই সৈনিকরা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য মিলিটারি ট্রেইনিংকে ব্যবহার করবে। ১৯১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছাব্বিশটি শহরে কৃষ্ণাঙ্গ বিরোধী দাঙ্গা শুরু হয়। ১৯১৮ সালে ও ১৯১৯ সালে যথাক্রমে ৫৮ জন ও ৭৭ জন কৃষ্ণাঙ্গকে জনসমক্ষে খুন করা হয় (Lynching)। এদের মধ্যে দশজনের মতো ছিলেন ইউরোপফেরত যোদ্ধা।

এত অত্যাচার সত্ত্বেও আফ্রিকান-আমেরিকানরা পরবর্তীকালেও সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা অনেক কৃষ্ণাঙ্গ সৈনিক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন।
১৯৪৮ সালে প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যান সামরিক বাহিনীগুলোতে জাতিগত বৈষম্য তুলে দিয়ে একীভূত করার একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন। এরপর থেকে ধীরে ধীরে আফ্রিকান-আমেরিকানরা তাদের পূর্ণ মর্যাদা পেতে শুরু করে।