বাবার উপর রাগ করে মেয়েটি যখন বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল, বয়স তার তখন মাত্র ১৩। এত অল্প বয়সে কি আর কেউ শখ করে পালায়? বাবা সোজা বলে দিয়েছেন, ‘পড়াশোনা যা করেছো, এ-ই ঢের। এর বেশি আর পড়ার দরকার নেই বাপু।’ কিন্তু জেদি মেয়ে এসব কথায় কর্ণপাত করার মানুষ নয়, পড়াশোনা তার চালিয়ে যেতেই হবে। এখন তাহলে উপায়? রাস্তা সামনে একটাই খোলা, বাড়ি থেকে সোজা পালানো। অনন্যোপায় হয়ে এই অল্প বয়সেই বাড়ি ছাড়তে হলো মেয়েটিকে। ছাড়তে হলো বললে ভুল হবে, রীতিমতো পালাতে হলো।
ছোট মেয়েটির নাম রোজা শানিনা। শুধুমাত্র পড়াশোনার জন্য সেদিন বাড়ি থেকে পালানো ছোট্ট মেয়েটিই পরবর্তীতে হয়ে উঠেছিল কুখ্যাত নাৎসি বাহিনীর আতঙ্কের নাম।
১৯২৪ সালে রোজা শানিনা সোভিয়েত রাশিয়ার লেনিনগ্রাদ থেকে কয়েকশ’ মাইল দূরের এক কমিউনে জন্মগ্রহণ করে। তখনকার সমাজ নারীশিক্ষার জন্য সহায়ক ছিল না। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর মাধ্যমিক শিক্ষার গ্রহণের জন্য তাকে বাড়ি থেকে প্রতিদিন আট মাইল দূরে যেতে হতো।
আমাদের এই আধুনিক সময়ে যখন পাড়ার বুড়োদের প্রতিদিন দশ-বারো মাইল দূরে অবস্থিত স্কুলে গিয়ে ক্লাস করার গল্পগুলো হাঁ করে শুনি, তখন ছোট রোজা শানিনাকে আজ থেকে আশি বছর আগেই প্রতিদিন আট মাইল দূরে গিয়ে ক্লাস করতে হয়েছে। জেদি মেয়েটি পেরেছিলও বটে!
বাড়ি থেকে পালানোর পর রোজা গিয়ে আরখানজেলোস্ক শহরে একটা মাধমিক স্কুলে ভর্তি হয়। সেখানে তাকে একটি রুম বরাদ্দ দেয়া হয়, কর্তৃপক্ষ তাকে একটি ছাত্রবৃত্তিও প্রদান করে। কিন্তু ১৯৪১ জার্মানরা ‘অনাক্রমণ চুক্তি’ ভঙ্গ করে সোভিয়েত রাশিয়ার পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে আক্রমণ করলে অর্থনীতিতে কিছুটা ধ্বস নামে। তার ছাত্রবৃত্তিটি বাতিল করে দেয়া হয়। এই সময়ে টিউশন ফি জোগাতে বাধ্য হয়েই তাকে একটি কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে হয়।
যুদ্ধের চিরন্তন নিয়ম অনুযায়ী যুদ্ধ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সোভিয়েত রাশিয়াতেও যুদ্ধের পরিসর ক্রমশ বাড়ে। এক সময় নাৎসিরা রোজার শহর আরখানজেলোস্কেও বোমাবর্ষণ করতে শুরু করে।
এর মধ্যে রোজার জন্য দুঃসংবাদ আসে। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে তার ভাই মিখাইল নাৎসিদের বোমাবর্ষণে নিহত হয়। [1]
ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ রোজার মনে নাৎসিদের প্রতি ঘৃণা ও ক্রোধ বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। সে তার ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। কিন্তু নাৎসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হলে তো আগে তাকে সোভিয়েত সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হবে। তারপর সে সেনাবাহিনীর হয়ে নাৎসিদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে যেতে পারবে।
প্রথম দিকে সোভিয়েত মিলিটারি নেতৃবৃন্দ নারীদের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করতে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হয়ে উঠতে থাকায় পরবর্তীতে তারা তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। আরও হাজার হাজার নারীর সাথে রোজা’ও সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য আবেদন করে।
অবশেষে তাকে সেনাবাহিনীর নারী স্নাইপার অ্যাকাডেমিতে তালিকাভুক্ত করা হয়। ১৯৪৪ সালে রোজা সেখান থেকে সফলভাবে স্নাতক সম্পন্ন করে। তার দক্ষতার জন্য তাকে ফ্রন্টে যুদ্ধে যাওয়ার বদলে অ্যাকাডেমিরই একজন শিক্ষক হিসেবে রেখে দেয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু রোজা সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তাকে সেনাবাহিনীর ১৮৪ তম রাইফেল ডিভিশনের নারী স্নাইপার ডিভিশনের কমান্ডার বানানো হয়।
পশ্চিম ফ্রন্টে যোগ দেয়ার তিন দিন পর রোজা তার প্রথম কিলিং সম্পন্ন করে। পরবর্তীতে সে একটি পত্রিকায় তার প্রথম কিলিংয়ের অনূভূতি জানিয়েছিল এভাবে,
‘অবশেষে ট্রেঞ্চের কোণায় একজন জার্মানকে দেখা গেল। আমি ধরে নিয়েছিলাম, টার্গেট সর্বোচ্চ ৪০০ মিটার দুরত্বে আছে। এটি খুবই সাধারণ দুরত্ব। জার্মান সৈন্যটি যখন মাথা নিচু করে কাঠের স্তুপের দিকে যেতে শুরু করল, আমি ফায়ার করলাম। কিন্তু সে যেভাবে পড়ে গেল, তাতে নিশ্চিত ছিলাম, সে মারা যায়নি। এক ঘন্টা ধরে ফ্যাসিস্টটা মাটিতে পরে থাকল, এক চুলও নড়ার সাহস করল না। এক ঘন্টা পর যখন সে মাটিতে হামাগুড়ি দেওয়ার চেষ্টা করল, আমিও আবার ফায়ার করলাম, এবং এইবার আমি আর ভুল করিনি।’
তার স্নাইপার কিলিংয়ের সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে। অ্যাকাডেমিতে যে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে তার পুরোটাই কাজে লাগান। ফলে শত্রুরা তার হাতে একের পর এক ধরা দিতে থাকে। তার কিলিংয়ের সংখ্যা যখন ৪৬, তখন তার যুদ্ধের সময় লেখা ডায়েরিতে পাওয়া যায়,
‘ডিউটি শুরু হতো খুব ভোরে, যখন আবহাওয়া থাকতো কুয়াশাময়। প্রতিদিনের মতো আজও সকালে আমি শুয়ে আছি এমন একটা জায়গায়, যেখান থেকে জার্মান ক্যাম্প পরিষ্কার দেখা যায়।আমি মরার মতো শুয়ে অপেক্ষা করতে থাকি, কখন জার্মান সৈন্য দেখতে পাব। অবশেষে একটাকে দেখতে পেলাম।
জার্মান মেশিন গানচালক পিলবক্সের গেটে এসে অপেক্ষা করতে লাগল। সে যখন আমাদের অরক্ষিত ক্যাম্পের দিকে হামাগুড়ি দিতে শুরু করে, এই সময় আমি ফায়ার করি। এক শটেই ঘায়েল করে ফেলি তাকে। তাকে বাঁচাতে আরও দু’জন জার্মান আসে, তাদেরকেও আমি পরপর দু’শটে কাবু করে ফেলি। এরপর আবার দু’জন আসে, আর তাদেরকেও একই পরিণতি বরণ করতে হয়।’
এই ঘটনা দিয়েই বোঝা যায়, ম্যানমার্কিংয়ে তার কতটা দক্ষতা ছিল। রাশিয়ার গণমাধ্যমগুলো মুখরোচক শিরোনামে রোজা শানিনাকে নিয়ে প্রতিবেদন ছাপাতে শুরু করে।
স্নাইপার হাতে যুদ্ধের সময়গুলো সে ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করেছিল, যেখানে তার একাকীত্ব, আশা প্রভৃতি বিষয়ে সে কথা বলেছে। ১৯৪৫ সালের ২৪ জানুয়ারি তারিখ উল্লেখ করা এক বর্ণনানুযায়ী, সে এক অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হয়। রেজিমেন্টের প্রধান তার সাথে বিছানায় যাওয়ার জন্য তাকে জোরাজুরি শুরু করে, যেন সে এক পতিতালয়ে আছে। একই বর্ণনায় পরে সে লেখেছে, কর্ণেলের মদ্যপ ছেলে তাকে খাটে ফেলে জোরপূর্বক চুমু দেয়। এসব ঘটনা তার হতাশা আরও বাড়িয়ে তোলে। সে ডায়রিতে লেখেছিল,
‘মেয়ে হওয়ার মানে কি এটাই যে, সবাই আমাকে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে চুমু দিতে পারবে?’
ঠিক যখন সে ভবিষ্যতের কথা ভাবছিল, একাকীত্ব বোধ করছিল এবং আরও কিলিংয়ের জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল, তখন শত্রুর শেল তার প্রাণ কেড়ে নেয়। ১৯৪৫ সালের ২৭ জানুয়ারিতে দু’জন সোভিয়েত সৈন্য যুদ্ধের মাঠে তার লাশ খুঁজে পায়। শেলের আঘাতে তার বুক ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। হয়তো আরও আগে খুঁজে পেলে তাকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলা যেত, কিন্তু দেরিতে পাওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি। তাকে পূর্ব জার্মানিতে পূর্ণ সামরিক সম্মানের সাথে সমাহিত করা হয়।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মাত্র দশ মাসের কিংবদন্তিময় ক্যারিয়ারে তার স্নাইপার কিলিংয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৫৯ অবধি! তার ট্রেডমার্ক ছিল পরপর দু’বার খুব দ্রুত শট করা।
রোজা শানিনা-ই প্রথম নারী স্নাইপার, যাকে ‘অর্ডার অফ গ্লোরি’ পুরস্কার দেওয়া হয়, এবং তিনি ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভয়ংকর সোভিয়েত নারী স্নাইপারদের মধ্যে একজন, যাদেরকে স্বয়ং হিটলারও ভয় পেতেন! রাশিয়ার সর্বত্র তার বীরত্বগাঁথা ছড়িয়ে পড়ে।