প্রত্যেকেই বিশ্বকে বদলে দেওয়ার চিন্তা করে, কিন্তু নিজেকে বদলানোর চেষ্টা কেউ করে না।– টলস্টয়
লিও টলস্টয়ের আন্না কারনিনা বইটি পড়ছিলাম। পড়তে পড়তে হঠাৎ লেখক সম্পর্কে জানার আগ্রহ হলো। যেই ভাবা সেই কাজ! টলস্টয়কে নিয়ে লিখতে বসে গেলাম। যতই তার জীবন সম্পর্কে জানলাম এক কথায় অভিভূত হতে হলো। উনবিংশ শতকে জন্ম নেয়া এই খ্যাতিমান রুশ লেখকের জীবনে উত্থান পতনসহ রয়েছে নানা রোমাঞ্চকর ঘটনার হাতছানি।
লিও টলস্টয় রুশ সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক; এমনকি তাকে বিশ্ব সাহিত্যেরও অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। টলস্টয়ের পুরো নাম কাউন্ট লেভ নিকোলায়েভিচ টলস্টয়। টলস্টয় বাস্তবধর্মী উপন্যাস ও সাহিত্য রচনা করতেন। তার সাহিত্যকর্মের কোথাও অবাস্তব রোম্যান্টিক কল্পনা আমরা দেখতে পাই না। বস্তুত মানুষের চিরায়ত কামনা, শান্তির অন্বেষাই টলস্টয়ের সাহিত্যকে অমরত্ব দান করেছে। তিনি Art for Art sake বা ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ এই মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না। তার মতে, ‘সাহিত্য হবে জীবনের জন্য।’ তাই দেখা যায় তার প্রতিটি সাহিত্য জীবন ও নীতিবোধ নিয়ে গড়ে উঠেছে। জীবন ও নীতিবোধ নিয়ে সম্পূর্ণ পরিষ্কার ধারণা গড়ে ওঠার পরই লেখায় হাত দিয়েছেন।
টলস্টয় জন্মগ্রহণ করেছেন সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের তুলা প্রদেশের ইয়াস্নায়ার পলিয়ানায় ১৮২৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর (পুরাতন ক্যালেন্ডার মতে, ২৮ আগস্ট)। টলস্টয়ের জন্ম এক অভিজাত রুশ পরিবারে। তরুণ টলস্টয়ের প্রথম দিকের জীবন ছিল কর্কশ, চরিত্রভ্রষ্ট, নীতিভ্রষ্ট। তাসের জুয়া খেলায় ছিলেন আসক্ত। ‘আ কনফেশন’ বইয়ে তিনি স্বীকার করেছেন
যুদ্ধে মানুষ হত্যা করেছি। তাদের হত্যা করার জন্য দ্বন্দ্বযুদ্ধে লড়েছি। তাসের জুয়া খেলে হেরেছি। কৃষকের শ্রম শোষণ করে ভোগ করেছি। তাদের নানা শাস্তি দিয়েছি। মানুষকে ঠকিয়েছি। মিথ্যা বলা, ডাকাতি, সব ধরনের ব্যভিচার, নেশা পান, সন্ত্রাস, খুন এমন কোনো অপরাধ নেই যা আমি করিনি। এরপরও মানুষ আমার আচরণের প্রশংসা করেছে, আমার সমসাময়িকেরা বারবার আমাকে তুলনামূলকভাবে একজন নীতিবান মানুষ বলেই বিবেচনা করেছে। এভাবেই কেটেছে আমার ১০ বছর।
কিন্তু একটা সময় টলস্টয় ঘুরে দাঁড়ান। অন্ধকার জীবনের মোড় থেকে সরে আসেন। সাহিত্য রচনা করে রুশ সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন আর ইতিহাসে নাম লেখান একজন সফল সাহিত্যিক হিসেবে। চলুন জেনে আসা যাক টলস্টয়ের জীবন থেকে আমরা কী কী শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।
মনকে মুক্ত রাখুন
টলস্টয়ের জীবনের প্রথম শিক্ষা হচ্ছে Keep an open mind; মনকে মুক্ত রাখুন। জীবনের একটি ক্ষেত্রে টলস্টয় নিজেকে উৎকর্ষের পর্যায়ে নিয়ে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেটি হচ্ছে, জীবনে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের সাথে সাথে এই অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে তার মন পরিবর্তন করার ইচ্ছাশক্তি ও সক্ষমতা ছিল। ১৯৫০ এর দশকে যখন তিনি ছিলেন একজন সেনা কর্মকর্তা, তখনই তিনি এ দক্ষতার চর্চা শুরু করেন। ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সময় টলস্টয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লড়াই করেছেন। সেখানে তিনি যে ভয়ানক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, তাই তাকে একজন নিয়মিত সৈন্য থেকে একজন প্যাসিফিস্ট বা শান্তিবাদী করে তোলে।
১৮৫৭ সালে তিনি প্যারিসে গিলোটিনে জনসমক্ষে মানুষ হত্যার দৃশ্য দেখেন। তিনি কখনো ভুলতে পারেননি গিলোটিনে মানুষ হত্যার সেই ঘটনা। সেদিন তিনি দেখেছেন, কি ভয়াবহভাবে সজোরে আঘাত দিয়ে মানুষের হাতে মানুষের মুণ্ডপাতের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় তার বিশ্বাস জন্মে রাষ্ট্র ও এর আইন শুধু নির্মমই নয়, বরং সেই সাথে তা ধনী ও ক্ষমতাসীনদের স্বার্থরক্ষার কাজেই ব্যবহার হয়। রাশিয়ার জারবাদী শাসনের সমালোচনায় তিনি এতটাই সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন যে, শুধু তার সাহিত্যিক খ্যাতির কারণেই তিনি জেল-জুলুম থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। মানুষ যে মৌল বিশ্বাস ও গোঁড়া ধর্মমত নিয়ে বেড়ে উঠছিল, এর বিরুদ্ধে টলস্টয়ই প্রথম আমাদের সাহস জোগান।
অন্যের অনুভূতির সাথে একাত্মতা
টলস্টয় ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর ‘গ্রেট এমপ্যাথিক অ্যাডভেঞ্চারার’ দের মধ্যে অন্যতম একজন। তিনি অস্বাভাবিক মাত্রায় তার জীবনে অন্যান্য লোকের মতো বা অনুভূতির সাথে একাত্মতা প্রকাশের দৃঢ় ইচ্ছা প্রদর্শন করেছেন, যা ছিল তার নিজের মতো বা অনুভূতি থেকে ব্যাপকভাবে আলাদা। ১৮৬১ সালে সার্ফদের মুক্তি এবং রাশিয়া জুড়ে কৃষক সম্প্রদায়ের প্রতি সশ্রদ্ধ ব্যাপক আন্দোলনের পর টলস্টয় শুধু কৃষকদের প্রচলিত পোশাকই পরতেন না, সেই সাথে তার এস্টেটে কৃষি-শ্রমিকদের সাথে থেকে তাদের মতোই কাজ করতেন। নিজে লাঙল চালাতেন, নিজ হাতে কৃষকদের ঘর মেরামত করে দিতেন।
নিজেকে অন্যদের থেকে ভিন্নতর রাখুন
Make Difference বা নিজেকে ভিন্নতর করে তুলুন- টলস্টয় এই মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। অন্যের দুর্ভোগ লাঘব করার জন্য একজন উঁচু মাপের সাহিত্যিক হিসেবে টলস্টয় উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। দুর্ভিক্ষের সময় তিনি কৃষকদের ত্রাণ কার্যে যে আত্মত্যাগ দেখিয়ে গেছেন, তা আর কোথাও দেখা যায়নি। ১৮৭৩ সালে ফসল বিনষ্ট হওয়ার পর টলস্টয় তার বিখ্যাত উপন্যাস আন্না কারেনিনা লেখা এক বছর বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তিনি এই উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে ‘দ্য রাশিয়ান মেসেঞ্জার’ সাময়িকীতে প্রকাশ করেন ১৮৭৩-৭৭ সালের মধ্যকার সময়ে। এই উপন্যাসের শেষ পর্বে এসে এর সম্পাদকের সাথে টলস্টয়ের মতবিরোধ দেখা দেয় রাজনীতিকে কেন্দ্র করে। এর ফলে পুরো উপন্যাসটি প্রকাশ পায় এক বছর দেরিতে, ১৯৭৮ সালে।
সে যা হোক, দুর্ভিক্ষের সময় তিনি এই জনপ্রিয় একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লেখা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়ার মাধ্যমে নিজের মহত্ব প্রকাশ করেন এবং সমসাময়িক অন্যান্য লেখকদের চেয়ে ভিন্নতর হয়ে ওঠেন। তার আত্মোপলব্ধি ছিল, তিনি নিজেকে জীবন্ত প্রাণীগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে কাল্পনিক চরিত্র সৃষ্টির পেছনে লেগে থাকতে পারেন না। তার এ সিদ্ধান্তকে তার পরিবার ও বন্ধুবান্ধবেরা পাগলামি বলেই ধরে নেন। কারণ বিশ্বের মানুষ অন্যতম একজন ঔপন্যাসিকের লেখা পড়া থেকে এই এক বছর বঞ্চিত থাকবে; কিন্তু টলস্টয় ছিলেন সিদ্ধান্তে অটল।
তিনি একই কাজ আবার করেন ১৮৯১ সালের দুর্ভিক্ষের সময়। তখন তিনি দু’বছর দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের জন্য গোটাবিশ্ব থেকে অর্থ সংগ্রহ করেন। আমরা কি কল্পনা করতে পারি, বেস্ট সেলার বইয়ের একজন লেখক তার সর্বশেষ বইটির লেখা বন্ধ করে এভাবে দুই বছর ধরে ব্যস্ত থাকতে পারেন মানবিক ত্রাণকার্যে?
নিজেকে পরিবর্তনের মানসিকতা
রুশ সাহিত্যিকদের মধ্যে টলস্টয়, দস্তয়ভস্কি, পুসকিন, গোগল, চেখভ, গোর্কি প্রমুখের বিশ্বব্যাপী খ্যাতি রয়েছে। এদের মধ্যে টলস্টয়ের মহিমা ও সুনাম সর্বাগ্রে। সাহিত্যবোদ্ধাদের মতে, টলস্টয়ের তিনটি রচনা ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’, ‘আন্না কারেনিনা’ ও ‘রেজারেকশন’ মহত্তম উপন্যাসের জ্বলজ্বলে দৃষ্টান্ত। বিশেষ করে ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ উপন্যাসের বিষয় ও শিল্পরীতির সর্বোত্তম রূপসৃষ্টি। এ বইটিকেই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস বলা হয়। এগুলোর সঙ্গে নিশ্চয়ই যুক্ত হবে তার ‘২৩টি গল্প’ এবং ‘হোয়াট ইজ আর্ট’ নামের তাৎপর্যপূর্ণ রচনাগুলো। অথচ এই টলস্টয়েরই প্রথম জীবনের বড় সমস্যা ছিল যে তিনি তার ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত স্থির করতে পারছিলেন না, তিনি কী লিখবেন, কী করবেন।
এমন প্রবল সংশয়ের ভেতর তিনি বিখ্যাত লেখক ইভান তুর্গেনেভকে একটা চিঠিতে লিখেছিলেন,
আমি সাহিত্য চর্চার যোগ্য নই, তাই লিখব না।
তুর্গেনেভ সস্নেহে জবাব দিয়েছিলেন,
কী আর বলব, আমি তো অতীত। আমাকে ভাঙিয়ে তো তোমার চলবে না, কিন্তু তুমি তো ভবিষ্যৎ। তোমাকে না ভাঙিয়ে আমার চলবে কী করে? সুতরাং লেখো। তুমি লেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারো না।
আর এভাবেই এক অভিভাবক লেখকের ইতিবাচক আশার বাণী টলস্টয়কে পথ দেখায়, স্বপ্ন আলোর পথে চলতে দিকনির্দেশনা দেয়। সেই তিনিই আবার ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ উপন্যাসটি লেখার সময় ১৮৬৬ সালের নভেম্বরে তার সাগরেদ ফেটকে একটা চিঠিতে লিখছেন,
আমি তো শুধু চরিত্রগুলোর চেহারা, কাজকর্মের কথা লিখতে চাই না। আমি চাই তাদের ইতিহাস বদলে দিতে।
অথচ অভিজাত রুশ পরিবারের তরুণ কাউন্ট টলস্টয়ের প্রথম দিকের জীবন ছিল কর্কশ, চরিত্রভ্রষ্টতা ও গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত।
সরল জীবনযাপন করা
টলস্টয় বিশ্বাসী ছিলেন Master the art of simple living নীতিতে। টলস্টয়ের সবচেয়ে বড় মাপের অবদানগুলোর অন্যতম এবং একই সাথে বিরক্তির উৎস হচ্ছে- জীবনের অর্থ সম্পর্কে তার প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পেছনে লেগে থাকা। কেন ও কিভাবে তার বাঁচা উচিত এবং তার অর্থবিত্ত ও খ্যাতিই বা কেন? নিজেকে এসব প্রশ্ন করা থেকে কখনোই তিনি বিরত থাকেননি। ১৮৭০ এর দশকের প্রথম দিকে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে না পেয়ে তার মানসিক বিপর্যয় ঘটে। তখন তিনি প্রায় আত্মহত্যার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
এরপর নিজেকে জার্মান দার্শনিক শপেনহাওয়ার, বৌদ্ধধর্মীয় গ্রন্থ, বাইবেলের মধ্যে ডুবে তিনি খ্রিষ্টান ধর্মের বৈপ্লবিক এক ব্র্যান্ড ধারণ করেন, যেখানে তিনি বাতিল করেন সব সংগঠিত ধর্ম। এমনকি তিনি যে অর্থোডক্স চার্চ পরিবেশে গড়ে উঠেছিলেন, তাও বাতিল করে দেন এবং ঝুঁকে পড়েন এক আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত অনাড়ম্বর জীবনের প্রতি। ধূমপান ও মাদকের নেশা ছেড়ে দেন। হয়ে ওঠেন নিরামিষভোজী। তিনি অন্যদের উৎসাহিত করেন সরল ও স্বনির্ভর জীবনযাপন করার প্রতি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি সরল জীবনযাপন করে গেছেন।
একজন মানুষের ঠিক কতটুকু জমির দরকার?
হিংসা, লোভ, ঘৃণায় ভরা এই পৃথিবীতে টলস্টয় আজও সেই চিরায়ত প্রশ্নটিরই পুনরাবৃত্তি করেন, ‘How much land does a man require?’ আসলেই আমাদের আর কতটুকু জমি দরকার? অথচ নানা বৈপরীত্যে ভরা সেই টলস্টয়েরই জীবন ছিল রোমাঞ্চকর পরিব্রাজকের। ভ্লাদিমির শের্টকভ `লাস্ট ডেজ অব লিও টলস্টয়’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘১ নভেম্বর, ১৯১০ তারিখে আলেকজান্দ্রার মাধ্যমে টলস্টয় তার ডায়েরিতে লেখেন :
সবার মধ্যে ঈশ্বর হচ্ছেন অনন্ত অসীম। মানুষ হচ্ছে তার সসীম প্রকাশ। কেবল ঈশ্বর সত্যিকারভাবে বিরাজমান। মানুষ নিজেকে সময়, স্থান ও বস্তুর মধ্যে প্রকাশ করে। অন্যান্য সত্তার সঙ্গে যত বেশি মানুষের প্রকাশ ঘটে মানুষের অস্তিত্ব তত বেশি বিরাজমান থাকে। অন্য প্রাণীর সঙ্গে জীবনের এই ঐক্য ঘটে ভালোবাসার মাধ্যমে।
লিও টলস্টয় তার জীবদ্দশায় যে জাগতিক সুখ, ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়েছিলেন সেজন্য সারাজীবন তার বিবেকের দংশন ছিল। তিনি কখনো ভুলে যাননি, সাধারণ মানুষের কারণেই বিলাস-ব্যসন পূর্ণ জীবনযাপন করতে পেরেছিলেন, তাদের শ্রম আর ঘামের বিনিময়েই লাভ করেছিলেন বিলাসী জীবন।
নিজের সিদ্ধান্ত ও মূল্যবোধে অবিচল থাকা
লিও টলস্টয় প্রচণ্ড একরোখা মানুষ ছিলেন। কোনো সরকার ব্যবস্থাকেই তিনি ঠিক পছন্দ করতেন না। কিন্তু যে অঢেল রত্নের প্রাচুর্য তিনি রাশিয়াকে দিয়ে গেছেন তার সুবিশাল মহৎ সৃষ্টি, সমুদয় সাহিত্যকর্মের দ্বারা, তা অমূল্য। টলস্টয় একবার তার সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য নিয়ে যান। সেখানে ভর্তি ফরমে এই মর্মে পিতার অঙ্গীকার করতে হয় যে, সন্তান স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে কোনো সময় অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যবহার করবে না। টলস্টয় বেঁকে বসলেন, তার পরিষ্কার জবাব, নিজের ব্যবহার বিষয়ে অঙ্গীকার করা যায়, কিন্তু অন্যের ক্ষেত্রে কিভাবে সম্ভব? স্কুল কর্তৃপক্ষ যতই টলস্টয়কে বোঝায়, এটা তাদের ফর্মাল নিয়ম, টলস্টয় বুঝতে নারাজ। শেষ পর্যন্ত তার সন্তানকে সেই স্কুলে আর ভর্তি করালেন না।
তার জীবনী শক্তি ও কর্মোদ্যম ছিল দানবীয় রকমের। তিনি ভালো শিকারি ছিলেন এবং ছিলেন ভয়ংকর একগুঁয়ে স্বভাবের। একবার টলস্টয় ভালুক শিকারে গিয়েছিলেন, একটা ভালুক থাবা মেরে চোখের নিচে থেকে বাঁ দিকের গাল ছিড়ে নামিয়ে দেয়; দুই সপ্তাহ পরে ভালো হয়ে তিনি আবার শিকারে যান এবং ঐ ভালুকটিকে বধ করেন। বন্ধু-বান্ধব বা সমাজ কী বলবে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজে যা উচিত এবং ন্যায্য বলে ভেবেছেন তাই করেছেন সবসময়।
অন্যদিকে, জার সম্রাটের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে তিনি সর্বদাই মুখর ছিলেন, স্বনামে ও বেনামে দেশের ভিতরে ও বাইরে জার-শাসনের সমালোচনা করে লেখা ছাপিয়েছেন। আবার আইনের নামে বিচারের প্রহসন কিভাবে হয় তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য দিনের পর দিন আদালত আর জেলখানায় ঘুরেছেন।
গভীর জীবনবোধ
সবাই নিজের বুদ্ধিতে সন্তুষ্ট, কিন্তু কেউ নিজের অবস্থার ওপর সন্তুষ্ট নয়।- টলস্টয়
লিও টলস্টয় যে অবস্থাতেই থাকতেন না কেন, নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতেন। যেমন কাজী নজরুল ইসলাম নিজের ক্ষেত্রে বলেছিলেন, আমার কবিতা ও গান আমার জীবনের মধ্য থেকে জন্মলাভ করেছে। সমালোচকদের দৃঢ় মত, টলস্টয় নোবেল পুরস্কার না পাওয়ার ব্যর্থতা নোবেল কমিটির, টলস্টয়ের নয়। এর কলঙ্ক বয়ে বেড়াতে হবে নোবেল কমিটির আজীবন। ঠিক এই কারণে বার্নাড শ’ প্রথমে নোবেল পুরস্কার নিতে চাননি বলেও জানা যায়। তার একাগ্রতা ও পরিশ্রম করার শক্তি ছিলো অসাধারণ, তিনি মেধাবীও ছিলেন।
বলা হয়ে থাকে, তিনিও রবীন্দ্রনাথের মতো স্বশিক্ষিত ছিলেন। লিও টলস্টয় অনেক ভাষা শিখেছিলেন। তিনি লাতিন, ইংরেজি, আরবি, তুর্কো-তাতার, ইতালীয়, গ্রিক এবং হিব্রু। সঙ্গীতশাস্ত্র এবং চিত্রাঙ্কণেও মোটামুটি পারদর্শী ছিলেন তিনি। লেখক টলস্টয়ের অভিজ্ঞতার পরিধি ছিলো বিশাল। সমাজের সবচেয়ে নিচু তলার মানুষ থেকে শুরু করে রাজদরবারের লোকজনের সাথে তিনি মিশতে পারতেন। তিনি তার উপন্যাস বা গল্পের কাহিনীতে সেসব মানুষ, সামাজিক সত্য বা জীবনযাত্রার ছবি এঁকেছেন; যা তিনি নিজে দেখেছেন।
তিনি দীর্ঘজীবন লাভ করেছিলেন কিন্তু নানা কারণে তার শিল্পী জীবনের অনেকটাই অশান্তির মধ্যে কেটেছে। এই অশান্তির একটি প্রধান কারণ ছিলো সমাজে বা সভ্যতায় প্রচলিত কোনো বিশ্বাস বা রীতিনীতি তিনি বিনা প্রশ্নে মেনে নেননি বলে। তার জীবনের দিকে ফিরে তাকালে, দেখা যায় নানা ঘটনা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তবে প্রগাঢ় আত্মোপলব্ধি আর প্রবল অনুশোচনা ও বোধশক্তি তাকে এক অনন্য মানুষ বানিয়েছিল; নবজন্ম ঘটিয়েছিল।
টলস্টয়কে নিয়ে ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছিলেন,
টলস্টয় নিজেই একটি পৃথিবী।
দস্তয়ভস্কি মনে করতেন,
জীবিত সকল সাহিত্যিকদের মধ্যে টলস্টয় সর্বশ্রেষ্ঠ।
অন্নদাশঙ্কর রায়ও টলস্টয়ের সাহিত্যাদর্শে প্রভাবিত হয়েছিলেন। টলস্টয়কে নিয়ে তিনি অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন বিভিন্ন সময়ে। টলস্টয়ের জন্মবার্ষিকী উদযাপনের বছরে (১৯৭৮) তার প্রবন্ধগুলো ‘টলস্টয়’ নামে সংবলিত হতে থাকে এবং প্রকাশ পায় ১৯৮০ সালে। এটি ছিল মোট ১৩টি ছোট-বড় প্রবন্ধের সঙ্কলন। এ সঙ্কলনের ভূমিকায় অন্নদাশঙ্কর রায় জানাচ্ছেন যে, টলস্টয়ের কাছেই তার সাহিত্যিক শিক্ষানবিশির সূচনা হয়।
টলস্টয়ের সততা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ ছিলো বিস্ময়কর। তার মনের গড়ন ছিলো ভাবুকের, দার্শনিকের। তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১৯১০ সালের ২০ নভেম্বর। খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক টলস্টয় বেঁচেছিলেন প্রায় ৮৩ বছর। কিন্তু সাহিত্যস্রষ্টা টলস্টয় মানব সমাজে আজও বেঁচে আছেন এবং চিরকাল থাকবেন তার অমর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে।