Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আগুন এবং বিশ্বাস: জরথ্রুষ্টের শিক্ষা

প্রায় ৩ হাজার বছর আগের কথা। পারস্যের প্রান্তরে আগমন ঘটলো এক রহস্যময় পুরুষের। তিনিই পৃথিবীর বুকে জরথ্রুষ্টবাদের আগুন জ্বালিয়ে দিলেন। নাম তার জরথ্রুষ্ট, আর তার নামানুসারেই প্রবর্তিত হলো অন্যতম প্রাচীন একেশ্বরবাদী এই ধর্ম। গ্রিকদের কাছে জোরোআস্টার নামে পরিচিত এই ধর্মপ্রচারক প্রচার করতে থাকলেন মাত্র একজন সৃষ্টিকর্তার বাণী, যিনি হলেন আলো আর স্বর্গের প্রভু, আর এই একমাত্র সৃষ্টিকর্তার নাম হলো ‘আহুরা মাজদা’। জরথ্রুষ্টবাদ ছড়িয়ে পড়লো পুরো পারস্যের এ মাথা থেকে ও’মাথা, পারস্যবাসীরা আলিঙ্গন করে নিলো নতুন ধর্মকে, পারস্যের রাজারা একে ঘোষণা করলো নতুন রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে, রাজধানী পারসারগেড আর পার্সেপোলিসের দেয়ালে শোভা পেতে থাকলো জরথ্রুষ্টবাদের প্রতীক। পারস্যের রাজাদের সমাধিতে খোদাই করে দেওয়া হলো জরথ্রুষ্টের বাণী। এটি ছিল সেই সময়কার কথা যখন পারস্যের আকেমেনিড সাম্রাজ্য তার শীর্ষ সময় অতিক্রম করছে, এবং তৎকালীন সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী রাজ্য হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছে পারস্যবাসীরা।

সাসানিডদের সময় থেকেই জরথ্রুষ্টবাদের আচার-অনুষ্ঠান-উপাসনা ছিল আগুনকে কেন্দ্র করে। জরথ্রুষ্টবাদীদের কাছে আগুনের শিখার অর্থ হচ্ছে শুদ্ধতা, উষ্ণতা, আলো আর জ্ঞানের উৎস, যেগুলো আহুরা মাজদার প্রধান গুণ। জরথ্রুষ্টবাদ যত ছড়িয়ে যেতে থাকলো, পারস্যের আনাচে-কানাচে গড়ে উঠতে থাকলো আগুনের মন্দির, আর এগুলোই হয়ে উঠলো পারস্যবাসীদের ধর্মচর্চার প্রধান কেন্দ্র।

জরথ্রুষ্টবাদীদের বিশ্বাসের সাথে অন্যান্য একেশ্বরবাদী ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলিমদের বিশ্বাসের প্রচুর মিল রয়েছে। একজন সৃষ্টিকর্তা, ভালোর সাথে খারাপের যুদ্ধ, একজন ত্রাতার আবির্ভাব কিংবা শেষ বিচারের দিনে ভালো-খারাপের পরিমাপ; এমনই সামান্য কিছু জিনিস যা জরথ্রুষ্টবাদীরাও মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে। তবে এত মিল থাকা সত্ত্বেও জরথ্রুষ্ট স্বয়ং নিজেই রহস্যময় হয়ে উঠেছেন। প্রাচীন ইরানের ইতিহাসে জরথ্রুষ্ট এখনও একজন ধোঁয়াশাময় ব্যক্তিত্ব।

দেয়ালে খোদিত জরথ্রুষ্টবাদের প্রতীক; Image Source: National Geographic

জরথ্রুষ্টের ধর্মগ্রন্থ

জরথ্রুষ্টের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে ঐতিহাসিক কিংবা প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া খুব কঠিন। তার সম্পর্কে যা জানা যায় তার বেশিরভাগই এসেছে ধর্মগ্রন্থ আর তার মৃত্যুর কয়েকশত বছর পরে লেখা ইতিহাসের বই থেকে, ফলে তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। এমনকি ইতিহাসবিদরাও একমত হতে পারেনি, ঠিক কোন সময়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন কিংবা মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

জরথ্রুষ্টের শিক্ষা লিপিবদ্ধ করা হয়েছিলো বিশাল পেটমোটা এক বইয়ে, যা কম করে হলেও ১২ হাজার পৃষ্ঠা ছিল বলে মনে করা হয়। কিন্তু এই বিশাল ‘আবেস্তা’ ধর্মগ্রন্থের সামান্য কিছু অংশই এখনো পর্যন্ত টিকে রয়েছে। বইটির বেশিরভাগই হারিয়ে গিয়েছে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের পারস্য আক্রমণ করার পর। যেটুকু টিকে রয়েছে তাকে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। মূল অংশটূকু হলো ‘গাঁথা’, যেটি মূলত প্রার্থনা সংগীতের সংকলন। ধারণা করা হয়, জরথ্রুষ্ট নিজেই এগুলো নিজ হাতে লিখে গিয়েছিলেন। আবেস্তার বাকি অংশগুলোতে বর্ণনা করা হয়েছে প্রার্থনা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের রীতি-নীতি, সৃষ্টিজগতের বর্ণনা আর জরথ্রুষ্টবাদের আইন-কানুন।

আবেস্তার পৃষ্ঠা; Image Source: AWOL – The Ancient World Online

প্রাচীন গ্রিক আর রোমানদের মতে, জরথ্রুষ্ট ছিলেন মূলত একজন পাদ্রী, যিনি ইন্দো-ইরানীয়দের বহু-ঈশ্বরবাদকে মেনে নিতে পারেননি। আবার অনেক গ্রিকের কাছে জরথ্রুষ্টের পরিচয় ছিল একজন আলকেমিস্ট হিসেবে, কেউ কেউ জাদুবিদ্যার আবিষ্কারক হিসেবেও দাবি করেছেন। জরথ্রুষ্টের জীবনকাল নিয়েও মতভেদ রয়েছে গ্রিক-রোমানদের মধ্যে। গ্রেকো-রোমান লেখক প্লুটার্ক দাবি করেছেন, জরথ্রুষ্ট ট্রয় অবরোধের ৫ হাজার বছর আগে জন্মেছিলেন! অন্যান্য ইতিহাসবিদদের মতে, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট পার্সেপোলিস জয় করার আড়াইশো বছর আগে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে তিনি পারস্যের বুকে চলাফেরা করতেন।

দেনকার্ত, জরথ্রুষ্টবাদী আইন-কানুনের সারমর্ম ব্যাখ্যা করা এই বইয়ে তুলে ধরা হয়েছে সৃষ্টিজগতের সৃষ্টি আর পরিণতি আর এসব ঘটনাগুলোতে জরথ্রুষ্টের অংশগ্রহণ। সৃষ্টির শুরুতে ভালোর প্রতিনিধি আর খারাপের প্রতিনিধি আহরিমানের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল, আর চুক্তিটি হচ্ছে ৯ হাজার বছর ধরে ভালো আর খারাপের যুদ্ধ। ৬ হাজার বছর পর জন্ম হবে জরথ্রুষ্টের, আর তার কাজ হবে এক ও অবিনশ্বর আহুরা মাজদার প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীর বুকে ভালোর বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। ৯ হাজার বছর শেষ হওয়ার পর পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটবে ৩ জন ত্রাতার, এবং তারা এসে পৃথিবীর বুক থেকে খারাপের রাজত্বকে ঝেটিয়ে বিদায় করবে। শেষ যুদ্ধের সময়ে মৃতরাও জীবিত হয়ে উঠবে, আর জরথ্রুষ্টের জ্যেষ্ঠ সন্তান ইসাতবাস্ত্রা শেষ বিচারের তত্ত্বাবধান করবে।

পাকিস্তানের করাচিতে অবস্থিত জরথ্রুষ্টবাদীদের উপাসনালয়; Image Credit: Bashir Osman’s Photography

একজন নবী, একজন শিক্ষক

বাইবেলে বর্ণিত যীশু খ্রিস্টের মতো জরথ্রুষ্টও ৩০ বছর বয়সে ‘পবিত্র জ্ঞান’-এর সন্ধান পান। নিজেকে পবিত্র করতে তিনি নদীতে ডুব দেন এবং পানির উপরে মাথা তুলতেই আহুরা মাজদার শক্তিশালী উপস্থিতি টের পান। পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে সৃষ্টিকর্তা আহুরা মাজদার সাথে যোগাযোগ হয় তার, এবং তাকে ধীরে ধীরে ঐশ্বরিক জ্ঞান দান করা হয়। মানুষের আত্মার বিচার, দুনিয়াতে ভালো-খারাপ কাজকর্মের জন্য পরকালে পুরষ্কার-শাস্তি প্রদান সম্পর্কে জানতে পারেন তিনি। আর এরপরেই শুরু হয় দুনিয়াতে তার মিশন, জরথ্রুষ্টবাদ ছড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু প্রথম ১০ বছরে মাত্র একজনকে নিজের ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করতে পারেন তিনি, আর তা-ও সেই মানুুষটি তার চাচাতো ভাই। একেশ্বরবাদ প্রচার করতে থাকায় তৎকালীন পারস্য সমাজে রাজত্ব করতে থাকা বহু-ঈশ্বরবাদী পুরোহিতদের খড়গ নেমে আসে তার উপর।

এদিকে হঠাৎ করেই সুযোগ পেয়ে যান জরথ্রুষ্ট। পারস্যের তৎকালীন রাজার প্রিয় ঘোড়া অসুস্থ হয়ে পড়ে। পুরোহিতরাও এর নিরাময় খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়েছিল। জরথ্রুষ্টকে সুযোগ দেওয়া হলো এবং অলৌকিকভাবেই তিনি ঘোড়াকে সুস্থ করে তুললেন। জরথ্রুষ্টের কাজে প্রভাবিত হয়ে রাজা বিশতাসপা নতুন ধর্ম গ্রহণ করলেন, এবং জরথ্রুষ্টের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিলেন। তার ছত্রছায়ায় ৪০ বছর বয়স থেকে জরথ্রুষ্ট দেশব্যাপী তার ধর্মপ্রচারের কাজ শুরু করলেন।

তবে রাজার নাম আসলেই বিশতাসপা ছিল কি না তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। কারণ বাস্তবে দারিউস দ্য গ্রেটের বাবার নাম ছিল বিশতাসপা, এবং তার শাসনামলের অনেক আগে থেকেই পারস্যে জরথ্রুষ্টবাদ প্রচলিত ছিল। সুতরাং রাজার নামকে ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে না ধরে বরং উপকথা হিসেবে ধরলেই তা বেশি যুক্তিযুক্ত হবে।  

ইরানের ফারস প্রদেশে অবস্থিত দ্বিতীয় দারিউসের সমাধি এবং তার সামনে ‘কাবা-ই-জারদুশত’; Image Credit: Jennifer Lavoura

ছড়িয়ে পড়া বিশ্বাস

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে পারস্যে উত্থান ঘটে জরথ্রুষ্টবাদের। ৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে আকেমেনিড সাম্রাজ্যের পত্তনকারী সাইরাস দ্য গ্রেট ব্যবিলন জয় করেন এবং প্রায় একশ বছর ধরে বন্দী থাকা ইসরায়েলি ইহুদিদেরকে উদ্ধার করেন। আর এ সময়েই জেরুজালেম আর ব্যবিলনের ইহুদি পণ্ডিতরা হিব্রু বাইবেলের ধর্মশাস্ত্র প্রণয়ন করছিলেন। পারস্যের সংস্পর্শে আসার পর দেখা গেল জরথ্রুষ্টবাদীদের বিশ্বাসের সাথে ইহুদিদের বিশ্বাসের সাথে অদ্ভুত মিল রয়েছে। ইহুদিদের ইয়াহওয়েহ আর জরথ্রুষ্টবাদীদের আহুরা মাজদা যেন সমার্থক।

সাইরাসের উত্তরসূরীরাও জরথ্রুষ্টবাদী বিশ্বাস নিয়ে তাদের সাম্রাজ্য চালিয়ে যেতে থাকলো। সবকিছু ঠিকঠাক ভাবেই চলছিলো, কিন্তু হঠাৎ করেই তার ফ্যালানক্স বাহিনী নিয়ে হাজির হলেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। একের পর এক শহরের পতন হতে থাকলো, আর একইসাথে হারিয়ে যেতে থাকলো আবেস্তার গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো। তবে জরথ্রুষ্টবাদীরা পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি, পারস্যের আনাচেকানাচে তখনো প্রচুর জরথ্রুষ্টবাদীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তৃতীয় শতাব্দীতে সাসানিড সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটলে পুনরায় জরথ্রুষ্টবাদ তার রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা ফিরে পায়।

আর এই পর্যায়েই জরথ্রুষ্টবাদের সাথে আগুনের সম্পর্ক তৈরি হয়। পুরোহিতরা গড়ে তুলতে থাকে একের পর এক আগুনের মন্দির। এখনো ইরানের প্রান্তরে সাসানিডদের সময়ের আগুনের মন্দির খুঁজে পাওয়া যাবে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘তাখত-ই সুলেয়মান’ বা ‘সুলেইমানের সিংহাসন’। পঞ্চম শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত এই মন্দির জরথ্রুষ্টবাদীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান। এরকম কয়েকশ আগুন মন্দির কালের আবর্তে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, টিকে রয়েছে শুধু সেগুলোর ধ্বংসাবশেষ। ২০০৩ সালে ইউনেস্কো এই আগুন মন্দিরগুলোকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করে।

মধ্য ইরানে অবস্থিত আতাশকুহ অগ্নিমন্দির; Image Credit: Ali Majdfar

জরথ্রুষ্টবাদীদের আধিপত্যের কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, কিন্তু হঠাৎ করেই সপ্তম শতাব্দীতে মুসলিম আরবদের আগমনে মুখ থুবড়ে পড়ে তারা। জরথ্রুষ্টবাদীরা পারস্য আর আজারবাইজান থেকে ভারতে পালিয়ে চলে আসে এবং তাদের ধর্মচর্চা চালিয়ে যেতে থাকে। ভারতে এসে তাদের পরিচয় হয় ‘অগ্নিউপাসক পার্সি’ হিসেবে।

জাজ্বল্যমান আগুন

কালের আবর্তে জরথ্রুষ্টবাদের আগুন স্তিমিত হলেও পুরোপুরি নিভে যায়নি। বর্তমানে ইরান, ভারত, উত্তর আমেরিকা, ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ায় অনেক অগ্নিউপাসকের দেখা মিলবে। এখনো জরথ্রুষ্টবাদীদের দেখা যাবে আগুনের মন্দিরে, যেখানে তাদেরকে শেখানো হয় হাজার বছরের পুরোনো জরথ্রুষ্টবাদের শিক্ষা: হুমাতা, হুখতা, ভারশতা (ভালো চিন্তা, ভালো কথা, ভালো কাজ); জরথ্রুষ্টের ব্যক্তিগত জীবন নিজেদের মধ্যে ধারণ করার চেষ্টা করে, সৎ, নীতিবান আর দয়ালু হওয়ার মাধ্যমে; আর বিশ্বাস করে একদিন আহুরা মাজদার রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে খারাপকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়ে, যেমনটা সৃষ্টিকর্তা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। 

This article is in Bengali Language. It is about Zoroaster, the preacher of Zoroastrianism. Necessary links are hyperlinked.

Feature Images: Pixel Chrome Inc.

Related Articles