Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আলেক্সজান্ডার দ্য গ্রেটের মৃতদেহ: রাজনীতির ঘুঁটি থেকে হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাস

জুন ১১, খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ সাল। ব্যাবিলনে মারা যান আলেক্সজান্ডার দ্য গ্রেট। মৃতদেহ কোথায় সমাহিত করা হবে সেটা ঠিক করতে না পারায় প্রায় দুই বছর ব্যাবিলনেই রাখা হয় তার মৃতদেহ। প্রধান সেনাপতি পারডিকাসের নির্দেশে মেসোডোনিয়ার অ্যাগাইতে সমাহিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহ সেখানে পৌঁছায়নি কখনোই, বরং একপর্যায়ে তার মৃতদেহ হারিয়ে যায় ইতিহাস থেকেই। আলেক্সজান্ডারের মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ নিয়ে চলা রাজনীতি আর তার ফলে সেটি হারিয়ে যাওয়ার গল্প নিয়ে আজকের আয়োজন।

আলেক্সজান্ডারের মৃত্যুর কারণ নিয়ে বিতর্ক আছে। তিনি মারা যাবার আগে কাউকে তার বিশাল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার হিসেবে ঘোষণা দিয়ে যাননি। ঘোষণা যে দিয়ে যাননি এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক বা সন্দেহ নেই। ফলে মারা যাবার সাথে সাথেই তার সেনাপতিদের মাঝে লেগে যায় দ্বন্দ্ব, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে বিদ্রোহ। যার সম্পদ নিয়ে নিজেদের বিরোধ, তার মৃতদেহের কথাই ভুলে যায় সবাই! যখন মৃতদেহের কথা মনে পড়ে তারা গিয়ে হতবাক হয়ে দেখে ব্যাবিলনের গরমেও আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহের কোনো ক্ষতি হয়নি। এমনিতেই বিশাল সাম্রাজ্য জয়ের কারণে আলেক্সজান্ডার নিজেকে ঈশ্বর বলে দাবি করতো, সেই সাথে তার মৃতদেহের এরকম অস্বাভাবিক ঘটনা দেখে সবাই পুরো ব্যাপারটিকে একপ্রকার অলৌকিক ঘটনা হিসেবে মনে করতে শুরু করে।

এরপর পারডিকাসের নির্দেশে আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহ মমি করা হয় এবং সোনার তৈরি সারকোফেগাসে (মমি রাখার কফিন) রাখা হয়। পারডিকাস ও তার অধীনস্থদের নির্দেশে ব্যাবিলনে আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহ নিয়ে যাবার জন্য তৈরি করা হয় এক বিশেষ বাহন। বিশাল এই বাহনটি ছিল একটি মন্দিরের মতো, যাতে ছিল আলেক্সজান্ডার আর সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ছবি আর ভাস্কর্যযুক্ত কলাম। তবে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, পুরো বাহনটি ছিল সোনা দিয়ে তৈরি করা! এই বিশাল বাহনটি টানার জন্য দরকার হতো ৬৪টি গাধা, যেগুলোর প্রত্যেকটির মাথায় ছিল সোনার মুকুট আর গলায় ঝোলানো সোনার ঘন্টা। এককথায়, চাকচিক্যের কোনো অভাব রাখেননি পারডিকাস। নির্মাণ শেষে পারডিকাসের নির্দেশে আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহ রওনা হয় মেসোডোনিয়ার উদ্দেশ্যে।

Diodorus Siculus এর কল্পনায় আঁকা আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহ বহনকারী বাহন; Image Source: Wikimedia Commons

ঠিক সেসময়েই মিশরে থাকা টলেমি আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহকে দেখেন নিজের জন্য এক আশীর্বাদ হিসেবে। টলেমি ছিলেন আলেক্সজান্ডার আরেকজন সেনাপতি, যিনি শুরু থেকেই আলেক্সজান্ডারের অভিযানের সঙ্গী ছিলেন। আলেক্সজান্ডারের মৃত্যুর পর তিনি মিশরের শাসনভার নেন। আলেক্সজান্ডার মৃত্যুর পর তার মৃতদেহের অস্বাভাবিক ঘটনাটির কারণে সবাই ভাবতে শুরু করেছিল, যার অধীনে এই মৃতদেহ থাকবে সেই সব ক্ষমতার অধিকারী হবে। আর এ কারণেই পারডিকাস এতদিন ক্ষমতা ভোগ করেছেন। সব কিছু বিবেচনা করে টলেমি সিদ্ধান্ত নেন, মৃতদেহটিকে তিনি নিজের কব্জায় নেবেন আর পারডিকাসকে সরিয়ে দিয়ে মেসোডোনিয়ানদের একচ্ছত্র শাসক হিসেবে ক্ষমতা ভোগ করবেন।

তবে পুরো ব্যাপারটি মোটেও সহজ ছিল না। মেসোডোনিয়া যাবার পথে হামলা হতে পারে ভেবে পারডিকাস যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। যথেষ্ট নিরাপত্তা দিয়েছিলেন রাজকীয় মৃতদেহ বহনকারী বাহনটিকে। কিন্তু সিরিয়া পৌঁছতেই টলেমি মৃতদেহের নিরাপত্তায় থাকা সেনাদের ঘুষ দিয়ে নিজের পক্ষে করে নেন! সেই সাথে মৃতদেহটি মেসোডোনিয়ার পরিবর্তে নিয়ে আসেন মিশরের তখনকার রাজধানী মেমফিসে! মৃতদেহ নিয়ে আসার পরিকল্পনার সাথে টলেমির ক্ষমতার পরিকল্পনাও সফল হতে থাকে। কারণ মেসোডোনিয়ার সেনাবাহিনীর সেনাপতিরা একে একে টলেমির অধীনে যোগদান করতে থাকে।

ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা প্রথম টলেমির মূর্তি; Source: Wikimedia Commons

অন্যদিকে পরিস্থিতি পুরো উল্টে যায় পারডিকাসের। টলেমির মৃতদেহ চুরির ঘটনা শুনে পারডিকাস রেগে যান। আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহ আর নিজের কর্তৃত্ব ফিরিয়ে নেবার জন্য ব্যাবিলন থেকে রওনা দেন মিশরের উদ্দেশ্যে। কিন্তু টলেমির সাথে যুদ্ধে পারডিকাস পেরে উঠেননি। যুদ্ধে পারডিকাস শুধু পরাজিতই হননি, সেখানেই হত্যা করা হয় তাকে। এর ফলে টলেমিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর আর কেউ থাকলো না। আর এরপরেই শুরু হলো আলেক্সজান্ডারকে নিয়ে নতুন এক রাজনীতির খেলা।

পারডিকাসের সাথে বিজয়ের পর থেকেই টলেমি নিজেকে আলেক্সজান্ডারের সাথে নানাভাবে যুক্ত করার মিশন শুরু করেন। টলেমি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন, সরাসরি নিজের নামে ক্ষমতা দখলের চেয়ে নিজেকে আলেক্সজান্ডারের সাথে যুক্ত করতে পারলে সবদিক থেকে সমর্থন পাওয়া যাবে। আর সেই অনুযায়ী নিজের চাল দেয়া শুরু করেন টলেমি। নিজেদের মাঝে বিবাদে জড়িয়ে থাকা আলেক্সজান্ডারের সেনাপতিদের মধ্যে টলেমি প্রথম আলেক্সজান্ডারের ছবিযুক্ত মুদ্রা চালু করেন। সেই সাথে প্রচার করতে থাকেন, আলেক্সজান্ডারের এশিয়া আর ভারত অভিযানে টলেমি ছিলেন আলেক্সজান্ডারের সবচেয়ে প্রিয় সেনাপতি।

তবে টলেমির সব থেকে বড় চাল ছিল আলেক্সজান্ডারের জন্ম নিয়ে গুজব রটিয়ে। টলেমি গুজব রটিয়ে দেন, আলেক্সজান্ডার আসলে দ্বিতীয় ফিলিপের ছেলে না, বরং মিশরের তৎকালীন শেষ ফারাও দ্বিতীয় নেক্টানিবোর ছেলে! খ্রিস্টপূর্ব ৩৪৩ সালে পার্সিয়ানদের হাতে নেক্টানিবো পরাজিত হন আর পার্সিয়ানরা তাকে পাঠায় নির্বাসনে আর সেখানেই মৃত্যু হয় তার। মেমফিসে তার জন্য তৈরি করে রাখা রাজকীয় সারকোফেগাসে সমাহিত হবার ভাগ্য হয়নি আর। ধারণা করা হয়, নেক্টানিবোর সেই ফাঁকা সারকোফেগাসেই টলেমি আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহ রাখেন। এতে টলেমির দুটি স্বার্থ ছিল।

রোমান টাইলসে আলেক্সজান্ডারের ছবি; Image Source: Wikimedia Commons

প্রথমত, মিশরের বৈধ ফারাও হতে হলে তাকে পূর্বের কোনো ফারাওয়ের সাথে রক্তের সম্পর্ক থাকতে হবে। টলেমির গুজব ছড়িয়ে পড়ার কারণে সবাই আলেক্সজান্ডারকে নেক্টানিবোর ছেলে হিসেবেই ধরে নিয়েছিল। ফলে ফারাও হিসেবে আলেক্সজান্ডারকে সহজেই প্রতিষ্ঠা করা যায়। আর দ্বিতীয় স্বার্থটি ছিল নিজেকে আলেক্সজান্ডারের উত্তরাধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। আর সেই কারণে এবার নিজের জন্ম নিয়েই গুজব রটিয়ে দেন টলেমি। নিজেকে দ্বিতীয় ফিলিপের অবৈধ ছেলে হিসেবে দাবী করেন, সেই সাথে প্রতিষ্ঠা করতে চান আলেক্সজান্ডারকে নিজের সৎভাই হিসেবে। গুজবগুলো খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় টলেমি হয়ে ওঠেন বিশ্বাসযোগ্য। ফলে খুব দ্রুতই মিশরের ক্ষমতা নিজের করেন নেন টলেমি।

৩০১ সালে ইপসাসে (বর্তমান তুরস্কে) যুদ্ধ বাঁধে আলেক্সজান্ডারের কয়েকজন সাবেক সেনাপতির। কিন্তু ততদিনে মিশরের ক্ষমতা নিজের কুক্ষিগত করে ফেলেছেন টলেমি। আর পুরোটাই আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহকে ব্যবহার করে। ইপসাসের যুদ্ধে অন্যান্য সেনাপতিদের লড়তে দেখে নিজের ক্ষমতা আরো গ্রহণযোগ্য করার জন্য এবার টলেমি তার রাজধানী নিয়ে যান আলেক্সজান্দ্রিয়াতে। সেই সাথে আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহ নিতে ভোলেননি। বরং সেই মৃতদেহকেই আবার ব্যবহার করবেন নিজের ক্ষমতা আরো সুদৃঢ় করতে। প্রথমেই আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহের জন্য তৈরি করা হয় এক সুন্দর কবরের। ৩৩১ সালে আলেক্সজান্দ্রিয়া শহরের নির্মাণ শুরু করেছিলেন আলেক্সজান্ডার। আর সে কারণে আলেক্সজান্ডারকে শহরের নির্মাতা হিসেবে ঘোষণা দেন টলেমি।

অ্যাসাসিন ক্রিড অরিজিন গেমসে আলেক্সজান্দ্রিয়া; Image Source: Self Sceenshot

শুধু ঘোষণা দিয়েই থেমে যাননি টলেমি, বরং রাষ্ট্রীয় খরচে আলেক্সজান্ডারের স্ট্যাচু ছড়িয়ে দেয়া হয় মিশরের প্রতিটি কোণায়। চালু করা হয় আলেক্সজান্ডারের নামে বিভিন্ন উৎসব। আলেক্সজান্ডারকে প্রমোট করার বিন্দুমাত্র সুযোগ হাতছাড়া করেননি টলেমি। ফলে মিশরে তার শাসনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেনি। খ্রিস্টপূর্ব ২৮৩ সালে টলেমি মারা গেলে ক্ষমতায় আসে তার ছেলে দ্বিতীয় টলেমি ফিলাডালফাস। ফিলাডালফাস বাবার থেকেও একধাপ উপরে উঠে যান, আলেক্সজান্ডারের সাথে তার বাবাকেও বানিয়ে দেন ঈশ্বরতুল্য এক চরিত্র। বাবার নামে চালু করেন নতুন এক ধর্মীয় উৎসবের- টলেমিয়া। চার বছর পর পর অনুষ্ঠিত এই উৎসব ছিল নিজেদের শক্তি আর সামর্থ্য প্রদর্শনের এক উৎসব। এই উৎসবের খ্যাতি মিশর ছাড়িয়ে গ্রিসেও ছড়িয়ে পড়ে। আলেক্সজান্ডার আর টলেমি বংশের মাঝে বন্ধন দেখানোর সুযোগও ছিল এই উৎসব। ফলে টলেমি বংশের শাসন নিয়ে কেউই প্রশ্ন ওঠাতে সাহস করেনি।

চতুর্থ টলেমি খ্রিস্টপূর্ব ২১৫ সালে আলেক্সজান্ডার আর তার পূর্ব পুরুষদের মৃতদেহ রাখার জন্য নির্মাণ করেন আরেকটি রাজকীয় কবরস্থানের। মিশরসহ আশেপাশের মানুষদের জন্য এক দর্শনীয় স্থান হিসেবে খ্যাতি পায় ‘দ্য সোমা’। আলেক্সজান্ডার আর পূর্ব পুরুষদের মৃতদেহ রাখা হয় মাটির নিচে এক কক্ষে। এটিও ছিল আলেক্সজান্ডারের সাথে টলেমি বংশের বন্ধন দেখানোর এক সুযোগ। এই রাজকীয় কবরস্থানটির নাম হয়ে উঠে ‘দ্য সোমা’। সেই সাথে প্যাগান ধর্মের একটি তীর্থযাত্রার স্থান হিসেবেও প্রতিষ্ঠা পায় ‘দ্য সোমা’।

অ্যাসাসিন ক্রিড অরিজিন গেমসে ‘দ্য সোমা’; Image Source: Self Sceenshot

কিন্তু রাজার ধনও একদিন ফুরিয়ে যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৮৯ সালে দশম টলেমি অর্থের অভাবে আলেক্সজান্ডারের সোনার সারকোফেগাস গলিয়ে ফেলেন। সোনার পরিবর্তে নতুন একটি কাঁচের সারকোফেগাস জোটে আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহের জন্য। পরবর্তী ৭০ বছরে টলেমি রাজবংশে দেখা দেয় অন্তর্দ্বন্দ্ব। ফলে একসময়ের প্রশ্নাতীত ক্ষমতার অধিকারী টলেমিদের ক্ষমতা কমতে থাকে। আর একপর্যায়ে টলেমিদের শাসনেরও পতন ঘটে এমন এক সাম্রাজ্যের হাতে যাদেরও আগ্রহ ছিল আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহ নিয়ে, তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। সেই সাম্রাজ্য সে সময়কার প্রবল প্রতাপশালী রোমান সাম্রাজ্য।

গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়া টলেমি রাজবংশের পতন ঘটে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের হাতে। সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত ক্লিওপেট্রা ছিলেন টলেমি বংশের শেষ স্বাধীন শাসক। টলেমি রাজবংশের পতনের কাহিনীর সাথে এ লেখার সম্পর্ক না থাকায় সেদিকে আর আলোচনা করা হচ্ছে না। সম্রাট জুলিয়াস সিজার আর তার পরবর্তী সম্রাট অগাস্টাস সিজার দুজনই আলেক্সজান্ডারের ভক্ত ছিলেন। বাস্তবে রোমানরা বেশ আগে থেকেই আলেক্সজান্ডারকে সম্মান করতো, তবে গ্রিক বা মিশরীয়দের মতো ঈশ্বর হিসেবে নয়। বরং একজন বহু রাজ্যবিজয়ী রাজা হিসেবে। তবে টলেমি রাজবংশের প্রতি রোমানদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। ধারণা করা হয়, অগাস্টাস সিজারের আমলে ‘দ্য সোমা’ থেকে টলেমি রাজাদের মৃতদেহ সরিয়ে ফেলে শুধুমাত্র আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহ রাখা হয়।

পরবর্তী রোমান সম্রাটরাও নিজেদের আলেক্সজান্ডারের ভক্ত হিসেবে প্রচার করতেন, একেকজন একেকভাবে। তবে সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন সম্রাট ক্যারাকেলা। তিনি দাবী করতেন, আলেক্সজান্ডারের পুনর্জন্ম হয়েছে এবং তিনি সেই নতুন রূপ! তিনি এই ব্যাপারটি নিয়ে এতটাই মগ্ন ছিলেন যে নিজেকে আলেক্সজান্ডার গ্রেট হিসেবে প্রচার করতেন। আলেক্সজান্ডারের মেসোডোনিয়ান সেনাবাহিনীর মতো করে নিজের রোমান সেনাবাহিনী সাজিয়িছিলেন। কিন্তু অল্প দিন পরেই আততায়ীর হাতে মারা যেতে হয় তাকে।

সম্রাট ক্যারাকেলার মূর্তি; Image Source: Wikimedia Commons

তৃতীয় শতাব্দীতে আলেক্সজান্দ্রিয়া শিকার হয় একের পর এক যুদ্ধের। স্থানীয় শাসকদের নিজেদের যুদ্ধ, রোমান সম্রাটদের সাথে যুদ্ধ, কিন্তু সব কিছুর পরেও টিকে ছিল ‘দ্য সোমা’। তবে সেসময়ের ইতিহাসে ধীর ধীরে আলেক্সজান্ডারের কবরস্থান ‘দ্য সোমার’ স্থান কমতে থাকে। তবে ৩৯০ খ্রিস্টাব্দে ঐতিহাসিক লিবানিয়াসের লেখায় পাওয়া যায় আলেক্সজান্দ্রিয়ায় আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহ প্রদর্শনের। কিন্তু তিনি তখনো জানতেন না যে তিনিই শেষ ব্যক্তি যিনি আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহ নিয়ে শেষবারের মতো লিখে যাচ্ছেন। মাত্র দশ বছরের মধ্যে ইতিহাস থেকে হারিয়ে যায় আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহের সব চিহ্ন! প্রায় ছয়শো বছর ধরে রাজনীতির কেন্দ্র হয়ে থাকা মৃতদেহটি হারিয়ে যায়, যেন এর কোনো অস্তিত্বই ছিল না! ৪০০ খ্রিস্টাব্দের আলেক্সজান্দ্রিয়াতে খ্রিস্টান পাদ্রী জন ক্রিসোসটম বিদ্রুপ করে বলেন, “আমাকে দেখাও, কোথায় সেই আলেক্সজান্ডারের কবর?”

কিন্তু কী হলো আলেক্সজান্ডারের কবরের? এর উত্তর খুব সম্ভবত রয়েছে চতুর্থ শতাব্দীর শুরুতে রোমে উত্থান হওয়া এক নতুন ধর্মে: খ্রিস্টধর্ম। ৩৩০ খ্রিস্টাব্দের পর রোমসহ রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টধর্মের অনুসারী বাড়তে থাকে বহুগুণে। আলেক্সজান্দ্রিয়াতে ইহুদী ও খ্রিস্টানরা আগে থেকেই বাস করত, তবে প্যাগানদের তুলনায় একেবারেই অল্প। কিন্তু খ্রিস্ট ধর্ম রোমের রাষ্ট্রধর্মে পরিণত হলে খ্রিস্টানদের সংখ্যা ও ক্ষমতা বাড়তে থাকে। প্যাগানদের বিভিন্ন উপাসনালয় কিংবা প্রতীকে হামলা চালানো খ্রিস্টানদের নিত্যদিনের কর্মে পরিণত হয়। পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে ৩৯১ খ্রিস্টাব্দে, যখন রোমান সম্রাট থিওডিসিয়াস রোমে প্যাগান ধর্ম ও প্রতীক নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

৩৯১ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টানদের হাতে ধ্বংস হওয়া সেরাপিসের মন্দির; Image Source: Wikimedia Commons, Photographer: Daniel Mayer 

অতি উৎসাহী জনতা একের পর এক হামলা চালাতে থাকে প্যাগান মন্দির ও তীর্থযাত্রার স্থানগুলোতে। রোমান সাম্রাজ্যের অন্যান্য স্থানের মতো আলেক্সজান্দ্রিয়াতেও ছোঁয়া লাগে এই ধর্মীয় উন্মাদনার। বিভিন্ন প্যাগান ধর্মীয় স্থাপনা আগুনে পুড়িয়ে দেয় জনতা। ধারণা করা হয়, ৩৯১ সালের ধর্মীয় উন্মাদনার সময় ইতিহাস থেকে হারিয়ে যায় ‘দ্য সোমা’। আলেক্সজান্ডারের কবরস্থানটি কয়েক শতাব্দী ধরে ধর্মীয় উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহার করত প্যাগানরা। সেই সাথে আলেক্সজান্ডারকে ঈশ্বর হিসেবেও মানতো তারা। ফলে খ্রিস্টানদের হাতে ধ্বংস হবার সম্ভাবনা থেকেই যায়। কিন্তু আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহের কী হলো, সেটা আজ পর্যন্ত অজানাই রয়ে গেছে।

বেশ কয়েকটি সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু কোনোটিই সুনিশ্চিত নয়। প্রথমত, যদি ‘দ্য সোমা’ ধ্বংস করা হয়ে থাকে, তাহলে হয়তো এখনো এর মাটির নিচের কক্ষে রয়ে গিয়েছে আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহ। আবার কেউ মৃতদেহটিকে ধ্বংস করে থাকতে পারে, কিংবা ‘দ্য সোমা’ ধ্বংস হবার আগেই কেউ নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে ফেলতে পারে আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহ। কিন্তু কোনটি ঘটেছে কেউই বলতে পারবে না। এখানেও কিন্তু থেকে যায়, কারণ খ্রিস্টানরা সব প্যাগান স্থাপনা ধ্বংস করত না। কিছু স্থাপনাকে তারা চার্চে রূপান্তর করে ফেলত। ঐতিহাসিক অ্যান্ড্রু চাগের ধারণা অনুযায়ী খ্রিস্টানরা ‘দ্য সোমা’ ধ্বংস করেনি, বরং আলেক্সজান্দ্রিয়ার প্রথম চার্চ ‘সেইন্ট মার্ক চার্চ’ হচ্ছে ‘দ্য সোমার’ রূপান্তরিত রূপ। এই চার্চটির কথা প্রথম জানা যায় ৩৯০ খ্রিস্টাব্দে, ঠিক যে বছরে শেষ জানা গিয়েছিল আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহের কথা।

Gentile Bellini ও Giovanni Bellini এর কল্পনায় আলেক্সজান্দ্রিয়ায় সেইন্ট মার্কের ধর্ম প্রচার; Image Source: pinacotecabrera.org

সেইন্ট মার্ক চার্চ আলেক্সজান্দ্রিয়ার একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত, ঠিক যেমনটা ছিল দ্য সোমা। গুজব প্রচলিত আছে, সেইন্ট মার্ক মারা যাবার পর তার মৃতদেহ মমি করে চার্চের নিচে সমাহিত করা হয়। ৮২৮ সালে একদল ভেনিসিয়ান নাবিক চার্চ থেকে একটি মৃতদেহ চুরি করে নিয়ে যায়, যেটি সেইন্ট মার্কের বলে দাবী করা হয়। সেই মৃতদেহটি এখনো ভেনিসের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ব্যাসিলিকা অব সেইন্ট মার্কে রয়েছে। এমন তো হতে পারে, মৃতদেহটি বাস্তবে আলেক্সজান্ডারেরই? ড্যান ব্রাউনের গল্পের মতো শোনালেও এ তত্ত্বে অসংখ্য ফাঁক-ফোঁকর রয়েছে। ফলে খুব একটি বিশ্বাসযোগ্য থিওরি হয়ে উঠতে পারেনি।

এরপর দীর্ঘদিন আলেক্সজান্ডারের কথা সবাই ভুলে যায়। মুসলিমদের মিশর বিজয়ের পর নতুন করে শুরু হয় আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহের খোঁজ। বেশ কিছু সারকোফেগাস পাওয়া গেলেও কোনোটাই নিশ্চিতভাবে আলেক্সজান্ডারের বলা যায় না। তবে গত কয়েকশ বছরে বেশ কয়েকটি চমকপ্রদ আবিষ্কার হয়েছে, যদিও সেগুলো থেকেও কিছুই নিশ্চিত হওয়া যায় না।

১৭৯৮ সালে নেপোলিয়ান মিশর অভিযান শুরু করেন আলেক্সজান্দ্রিয়া থেকে। সেখানে এক মসজিদের ভূগর্ভস্থ কক্ষ থেকে নেপোলিয়ানের সেনারা একটি ফাঁকা সারকোফেগাস উদ্ধার করে। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা ১৮০১ সালে মিশর দখল করলে সারকোফেগাসটি চলে যায় তাদের দখলে। উভয় পক্ষই ভেবেছিল এটি আলেক্সজান্ডারের সারকোফেগাস। ব্রিটিশরা সারকোফেগাসটি নিয়ে যায় ব্রিটিশ মিউজিয়ামের জন্য। কিন্তু কয়েক বছর পরেই হায়ারোগ্লিফ পড়ার পদ্ধতি আবিষ্কার হলে দেখা যায় সারকোফেগাসটি ছিল দ্বিতীয় নেক্টোনিবোর, যার কফিনে আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহ টলেমি স্থানান্তর করেছিল বলে প্রথম দিকে বলা হয়েছিল। ফাঁকা সারকোফেগাসের অর্থ এই না যে আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহ সেখানে কখনোই ছিল না। টলেমি যেভাবে ক্ষমতা দখল করেছিল তাতে ধারণা করা হয় কিছু সময়ের জন্য হলেও আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহ সেই সারকোফেগাসে ছিল, অন্তত টলেমির নিজের ক্ষমতা পুরোপুরি শক্ত করা পর্যন্ত।

দ্বিতীয় নেক্টোনিবের সারকোফেগাস; Image Source: alexanderstomb.com

শেষপর্যন্ত আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহের কী হলো সেটা আজও অজানাই রয়ে গেছে। ঐতিহাসিক আর আর্কিওলজিস্টরা এখনো বিভিন্ন থিওরি দিচ্ছেন আবার কেউবা খুঁজে বেড়াচ্ছেন আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহ। হতে পারে আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহ একদিন আবিষ্কার হবে, কিংবা অসংখ্য অজানা উত্তরের মতো আলেক্সজান্ডারের মৃতদেহও অজানাই থেকে যাবে।

Webtitle: Tomb of Alexander: A pawn of politics to lost in the history

Reference: Alexander's Tomb: The Two-Thousand Year Obsession to Find the Lost Conqueror by Nicholas Saunders.

Featured Image: Alexanderstomb.com

Related Articles