পায়ের নীচে একটানা ‘ধপ ধপ’ শব্দ হয়ে চলছে, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়ে আসছে, ঘাড় আর গলা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঘাম। অবিরামভাবে দৌড়ে চলেছেন একই জায়গায় একটি ট্রেডমিলের উপর। আর আপনার পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে ঘুরে চলছে ট্রেডমিলের বেল্টটি। একঘেয়েমি লাগতে শুরু করল। মনে হল এক ঘণ্টা ধরে দৌড়ে চলেছেন, কিন্তু আদতে তা দশ মিনিট ধরে। তবু এখন একটু বিশ্রাম দরকার। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া ঘাম তোয়ালে দিয়ে মুছতে গিয়ে কখনও কি মনে হয়েছে কেন এভাবে নিজের প্রতি অত্যাচার করে চলেছেন?
ট্রেডমিলে দৌড়ানোর অভ্যাস বা অভিজ্ঞতা আছে আমাদের অনেকেরই। কিন্তু দৌড়াতে গিয়ে কখনো কি মনে হয়েছে নিজেকে কেন এভাবে কষ্ট দিচ্ছেন! মনে হতে পারে, কেবলমাত্র শরীরচর্চাই নয়, এটা নিজেকে শাস্তি দেবার বেশ অনন্য একটি উপায়! যদি এমন মনে হয়ে থাকে তবে সেই ভাবনা মনে আসাটায় খুব একটা অযৌক্তিকতা নেই। কারণ ট্রেডমিলের শুরুর গল্পটার সাথে জড়িয়ে আছে এক নিষ্ঠুর ইতিহাস, যার ব্যবহার ছিল মানুষকে কষ্ট আর শাস্তি দেয়ার জন্য। ট্রেডমিলের শুরুর গল্প আর সেই কালো অধ্যায় নিয়ে আজকের এই আয়োজন। পাশাপাশি আজকের এই আধুনিক ট্রেডমিল কিভাবে এলো তা-ও জানার চেষ্টা করবো আমরা।
ট্রেডমিলের শুরুটা যখন শাস্তির জন্য
ঘরের মধ্যে কিংবা জিমনেশিয়ামে আজকের যুগের এই শরীরচর্চার যন্ত্রগুলোর রাজা ট্রেডমিলের সূচনাটা কিন্তু শরীরচর্চার উদ্দেশ্যে হয়নি, হয়েছিল কারাবন্দীদের শাস্তি দেয়ার একটি উপায় হিসেবে। যদিও সেই সময়ের ট্রেডমিলগুলো এখনকার মত ততটা উন্নত বা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি ছিল না।
এবারে ফিরে যাওয়া যাক ভিক্টোরিয়ান যুগেরও আগে উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের সেই সময়টাতে যখন ইংরেজ কয়েদখানাগুলোর শাসন ব্যবস্থা ছিল অসম্ভব রকমের খারাপ। মৃত্যুদণ্ড দেয়া কিংবা নির্বাসিত করার ব্যবস্থাগুলো সবই ছিল কর্তৃপক্ষের ইচ্ছাধীন। আর বন্দিদের দিনের পর দিন একা রাখা হত নোংরা কারাগারগুলোতে, যেখানে একাকীত্ব জেঁকে বসতো তাদের উপর। কিন্তু এমন মানবতা বিরোধী কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলেন সামাজিক আর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো, এমনকি চার্লস ডিকেন্সের মতো জনপ্রিয় একজন লেখকও। তাদের উদ্দেশ্য ছিল কারাবন্দীদের নতুন করে সংশোধনের সুযোগ করে দেয়া। তাদের সেই প্রতিবাদ সফলতার মুখ দেখে আর কারাগারগুলোতে নতুন নিয়ম আর কারাবন্দীদের সংশোধনের জন্য সুযোগ করে দেয়া হয়। সংশোধনের জন্য ট্রেডমিলের মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। আর আজকের দিনের ট্রেডমিলের শুরুটা হয় এখান থেকেই।
১৮১৮ সালে ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার স্যার উইলিয়াম কিউবিট এই ট্রেডমিল আবিষ্কার করেন, যা সে সময় এর কাজের জন্য ব্রিটিশ কয়েদখানাগুলোতে বেশ সাড়া ফেলে দেয়। তখনও কিন্তু কেউ ভাবেনি একদিন এই যন্ত্র ব্যবহার করেই মানুষ স্বেচ্ছায় শরীরচর্চা করবে। তৎকালীন সময়ে ‘ট্রেডহুইল‘ নামেই বেশি পরিচিত ছিল যন্ত্রটি। আবারা অনেকে ‘Everlasting Staircase’ বা অনবরত ঘূর্ণায়মান সিঁড়িও বলত। একজন মিল শ্রমিকের পুত্র হওয়ার দরুন কিউবিট জানতেন কারখানার মিলগুলো কীভাবে কাজ করে এবং সে পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করে তিনি ট্রেডমিলের নকশা প্রস্তুত করেন। অনুভূমিক অক্ষ বরাবর ঘুরত যন্ত্রটি, আর তাতে একসাথে উঠে হাঁটতেন অনেকজন মিলে। তার আবিষ্কৃত যন্ত্রটিতে ২৪টি ধাপ ছিল যেগুলো প্যাডেলের মত কাজ করত। ফলে হুইলটি অনবরত ঘুরতে থাকত যখন কয়েদীরা সেটির উপর উঠে হাঁটতো। কেউ থেমে থাকতে পারত না। সবাইকে একইসাথে তাল মিলিয়ে হাটতে হত, নতুবা পড়ে যেতে হত।
আপনি ট্রেডমিলে একটানা কতক্ষণ দৌঁড়াতে পারেন? ১৫ মিনিট? ৩০ মিনিট? নাকি ১ ঘণ্টারও বেশি? আপনি যতক্ষণই দৌঁড়াতে পারেন না কেন, একটানা ৬ ঘণ্টার বেশি দৌঁড়ানোর কষ্টটা যে কেউ আঁচ করতে পারেন। সে সময় বন্দীদের ১ ঘণ্টা কিংবা ২ ঘণ্টা নয়, কমপক্ষে দৈনিক ৬ ঘণ্টা একটানা দৌঁড়ানো লাগতো, কখনও কখনও তারও বেশি। শোনা যায়, কখনো কখনো সপ্তাহে পাঁচ দিন করে তাদের এই অদ্ভুত শাস্তির ব্যবস্থা করা হত, কখনোবা চলত পুরো সপ্তাহ জুড়ে। আর তাদের পর্যবেক্ষণের জন্য সবসময় কড়া নজর রাখতো কারাপুলিশেরা। কারো ফাঁকি দেয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ ছিল না।
কিন্তু শুধুমাত্র শাস্তিই উদ্দেশ্য ছিল না, ট্রেডহুইলের ঘূর্ণনকে কাজে লাগিয়ে গিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে পানি তোলা, গম ভাঙ্গানো কিংবা পাওয়ার-মিলে শক্তির জোগান দেয়া হতো। আর পাওয়ার-মিলগুলোতে শক্তি সরবরাহ করার উদ্দেশ্য বেশি ব্যবহার হওয়াতে ট্রেড এর সাথে মিল শব্দটি যোগ করে এটির নাম ট্রেডমিল রাখা হয়। একদিক থেকে শাস্তি দেয়া অন্য দিক থেকে ওয়াইন্ড মিলগুলোতে শক্তির যোগান আর আরো সব কাজ হাসিল করায় ব্রিটিশ সরকারের বেশ লাভই হচ্ছিল বলা চলে। আর নেপোলিয়নিক যুদ্ধের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতেও কিন্তু এটির অবদান ছিল অনেকটা। কয়েদিদের পাখি বানিয়ে এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি মেরে সব দিক থেকে বেশ ভালোই হচ্ছিল।
পায়ে হাঁটা পথ বিবেচনা করলে একেকজন কয়েদি দিনে ৫,০০০-১৪,০০০ ফুট পথ অতিক্রম করতেন। ১৪,০০০ ফুট মানে ৪,২৬৭ মিটার। বলতে পারবেন মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা কত? বন্দীরা ট্রেডমিলে যতটুকু পায়ে হাঁটা পথ হাঁটতেন তার দ্বিগুণ হলো এভারেস্টের উচ্চতা। এবার একটু কল্পনা করুন তো ২ দিনে এভারেস্ট জয় করতেন কিনা বন্দীরা! আরেকটু ভাবুন, দিনের পর দিন এরকম অত্যাচার আর সাথে তাদের জীবিত রাখতে অল্প কিছু খাবার কতটা যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে। কখনোবা কয়েদিরা এর থেকে মৃত্যুদন্ডও কামনা করতেন। শুধু এটুকুই নয়, বন্দীদের ট্রেডমিলগুলো সেলের মতো ভাগ করা থাকত। ফলে একজন আরেকজনকে দেখতেও পেতেন না। এটাতে কেবলই যে শক্তি লাগত তা নয়, ধৈর্য্যের ঘাটতি থাকা চলবে না এই শাস্তিতে। দিনের পর দিন এমন একঘেয়েমি আর ক্লান্তি যেকোনো মানুষকে বিনা দ্বিধায় বিদ্রোহের দিকে ঠেলে দিবে।
কিউবিটের এই আবিষ্কারের প্রায় এক দশকের মধ্যেই তা গোটা ব্রিটিশ রাজ্য আর আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। প্রায় ৫০টির মতো ইংরেজ কারাগারে ট্রেডমিল স্থাপন করা হয়। আর আমেরিকাতে অল্প কিছু সংখ্যক কারাগারে এর প্রচলন ঘটতে শুরু করে। আর ফলাফল হিসেবে অপুষ্টি আর স্বাস্থ্যহানি ঘটতে শুরু করে বন্দীদের। অনেকে প্রায় মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যান। এমন অবস্থাতেও কারারক্ষীরা তাদের প্রতি কোনো প্রকার ভ্রুক্ষেপ করতেন না। ১৮২৪ সালে নিউইয়র্কের এক কারারক্ষী জেমস হার্ডি তার জেলের সবচেয়ে হৈ-হল্লাকারী কয়েদিদের বশীভূত করার জন্য যন্ত্রটিকে কৃতিত্ব দেন।
প্রথম ট্রেডহুইলটি স্থাপন করা হয় নিউইয়র্কের বেলেভিউ কাউন্টির একটি কারাগারে ১৮২২ সালে। ৩২ জন আসামি একসাথে সেই ট্রেডমিলটিতে শাস্তি পেতেন। আর এই নিষ্ঠুরতার শেষ হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। ততদিনে যথেষ্ট পরিমাণে কুখ্যাতি আর সমালোচনার বিষয় হয় এই কারাগারের ট্রেডমিল বা ট্রেডহুইল। বিভিন্ন পত্রিকা আর মানুষের মুখে মুখে এটির নিষ্ঠুরতার কথা ছড়িয়ে পড়ে। মাত্রাতিরিক্ত নিষ্ঠুরতার জন্য ১৮৯৮ সালের কারাগারের আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয় ট্রেডমিলের ব্যবহার।
নিষিদ্ধ হলেও হারিয়ে যায়নি ট্রেডমিল
শাস্তি দেয়ার নিষ্ঠুরতার জন্য কারাগারগুলোতে ট্রেডমিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও পুরোপুরিভাবে হারিয়ে যায়নি ট্রেডমিল। কারণ এই যন্ত্রটিকে মানুষের কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে ১৯১১ সালে যুক্তরাজ্যে ট্রেডমিলের একটি প্যাটেন্ট নিবন্ধন করা হয়। আর এই ট্রেডমিলের লক্ষ্য কারাবন্দী নয়, সাধারণ মানুষ।
বিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে শরীরচর্চার যন্ত্র হিসেবে ট্রেডমিল নতুন করে পরিচয় পায়। কিন্তু সে সময় শরীরচর্চার জন্য ট্রেডমিলে দৌঁড়ানোটা ছিল কেবলই বিলাসিতা। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে ছিল চড়া দামের কারণে। খুব একটা বেশি টাকা-পয়সা না থাকলে কেউ যেচে পড়ে ট্রেডমিলে দৌড়ানোর কথা ভাবতেন না। বিশের দশকে যে সকল ট্রেডমিল পাওয়া যেত সেগুলোতে কোনো মোটর ছিল না। আর পাটাতন ছিল কাঠের।
১৯৩০ এর দশকে কিছুটা উন্নত করা হলেও তখনও মোটরের ব্যবহার শুরু হয়নি। এতে সংযোগ করা হয়েছিল কাঠের বদলে ফেব্রিক বেল্ট।
আমাদের দৌড়াদৌড়ির এই যাত্রায় এবারে পা বাড়ানো যাক ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। ১৯৫২ সালে আন্তর্জাতিক হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রবার্ট ব্রুস ও তার সহকর্মী ওয়াইন কুইনটন হৃদরোগ এবং ফুসফুসের রোগ নির্ণয়ের জন্য একটি ট্রেডমিল রিমডেল করেন। এর আগে সরাসরি এসব রোগ নির্ণয়ের কোনো উপায় ছিল না। ৫০-এর দশকে, রোগীদের চর্চা করার জন্য কার্ডিয়াক ফাংশন পরীক্ষা এবং নিরীক্ষণ করার কোনো নিরাপদ উপায় ছিল না। তাই ডা. ব্রুস ইসিজি সেন্সর রোগীর গায়ে লাগিয়ে তাদের ট্রেডমিলের ওপর দৌড়াতে বলতেন। আর এভাবেই পরীক্ষা করা হত। সারা বিশ্বজুড়ে বর্তমানে হাসপাতাল, শারীরিক থেরাপি ক্লিনিকগুলোতে মেডিকেল ট্রেডমিল ব্যবহার করা হয়।
পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে, যান্ত্রিক প্রকৌশলী এবং ফিটনেস বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম স্টাব, ডা. কেনেথ এইচ কুপারের “অ্যারোবিক্স” নামের ব্যায়াম ও শরীরচর্চা বিষয়ক একটি বই পড়ার পর বাড়িতে ব্যবহারের জন্য প্রথম ট্রেডমিল ডিজাইন এবং আবিষ্কার করেন। তার আবিষ্কৃত ট্রেডমিলটির নাম ছিল ‘পেসমাস্টার-৬০০’।
স্টাব লক্ষ্য করছিলেন যে, বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য কোনো সাশ্রয়ী মূল্যের ট্রেডমিল ছিল না, তাই নিজেই তৈরি করার তিনি ডা. কুপারকে একটি প্রোটোটাইপ পাঠিয়ে দিলেন। আর ডা. কুপারের সহযোগীতায় প্রতিষ্ঠা করেন তার নিজের কোম্পানী, অ্যারোবিক্স ইনকর্প. আর এর মাধ্যমে খুলে দেন বর্তমান সময়ের আধুনিক ট্রেডমিলের দ্বার। ১৯৭০ এর দশকের পর থেকে এর জনপ্রিয়তা কেবল বাড়তেই থাকে শরীরচর্চাপ্রিয় মানুষগুলোর কাছে।
এখন থেকে ট্রেডমিলে উঠে দৌড়ানোর সময় আপনার নিজেকে বেশ ভাগ্যবান মনে করা উচিত। কারণ চাইলে আপনি সেটি থামিয়ে নিজের মতো করে বিশ্রাম নিতে পারছেন, যা করতে পারতেন না ঊনবিংশ শতাব্দীর কারাবন্দীরা। সাথে সাথে আপনি ঋণী স্যার উইলিয়াম কিউবিট আর উইলিয়াম স্টাবের কাছেও এমন একটি যন্ত্রের জন্য, যা আপনার স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে আর ঘরের মধ্যেই দৌড়াদৌড়ির এত সুবিধা এনে দেয়ার জন্য।