ইসলামের আবির্ভাবের শুরু থেকেই পৌত্তলিক কুরাইশরা মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর প্রচারিত ধর্মের বিরোধীতা করে এসেছে। কুরাইশদের ইসলামের বিরোধীতা করার প্রধান কারণই ছিল রাজনৈতিক। ইসলামের উত্থান আরবে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। ফলে কুরাইশদের চক্ষুশূলে পরিণত হন মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর অনুসারীরা। মক্কায় মুসলিমদের উপর কুরাইশদের অত্যাচার একসময় চরমে পৌঁছায়। তখন মহান আল্লাহর নির্দেশে মুহাম্মদ (সা.) মক্কা ছেড়ে ইয়াসরিবে (মদিনা) চলে যান। মদিনায় গিয়ে মুহাম্মদ (সা.) একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরি করেন এবং ধীরে ধীরে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। হিজরতের পরবর্তী কয়েক বছরে কুরাইশদের সাথে মদিনার মুসলিমদের কয়েকটি যুদ্ধও হয়েছে। মক্কার কুরাইশদের সাথে মদিনার মুসলিমদের তখন টান টান উত্তেজনা চলছিল।
ষষ্ঠ হিজরির (৬২৮ খ্রিস্টাব্দ) জিলক্বদ মাসের কথা। একদিন মুহাম্মদ (সা.) স্বপ্ন দেখেন যে তিনি পবিত্র কাবাঘর জিয়ারত করছেন। এটা নিছক কোনো স্বপ্ন ছিল না, এটা ছিল মহান আল্লাহর সাংকেতিক নির্দেশনা। ফলে তিনি স্থির করলেন যে উমরার উদ্দেশ্যে মক্কা যাত্রা করবেন। কিন্তু এত বৈরি সম্পর্ক যে কুরাইশদের সাথে তারা কি এত সহজে কাবা জিয়ারতের অনুমতি দেবে মুসলিমদের! মুহাম্মদ (সা.) বুঝতে পেরেছিলেন যে কুরাইশরা তাকে শান্তিপূর্ণভাবে মক্কায় প্রবেশ করতে দেবে না। তবে এসময় যুদ্ধ করার কোনো ইচ্ছা তাঁর মধ্যে ছিল না। পরিস্থিতি যেমনই হোক মক্কা যাত্রার এই সিদ্ধান্তে অটল তিনি। প্রায় ১,৪০০ সফরসঙ্গী এবং ৭০টি কোরবানীর উটসহ উমরার উদ্দেশ্যে মক্কার অভিমুখে যাত্রা করলেন। তখন তিনি উমরার ইহরাম বেঁধে নিলেন যেন কুরাইশরা মুসলিমদের পক্ষ থেকে যুদ্ধের আশঙ্কা না করে। কারণ এই যাত্রার একমাত্র লক্ষ্য ছিল কাবাঘর জিয়ারত করা। মদিনার মুসলিমদের মক্কাযাত্রার এই সংবাদ ইতোমধ্যে কুরাইশদের কাছে পৌঁছে যায়। ফলে কুরাইশরা মুসলিমদের মক্কায় প্রবেশ প্রতিহত করতে উঠে-পড়ে লাগে।
কুরাইশরা যেকোনো মূল্যে প্রয়োজনে যুদ্ধ করে হলেও মুসলিমদের মক্কায় প্রবেশ করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে তারা মুসলিমদের পথ রোধ করার জন্য সৈন্যদল প্রেরণ করে। মক্কার কাছাকাছি উসফান নামক স্থানে পৌঁছানোর পর মুহাম্মদ (সা.) খবর পান যে কুরাইশদের একটি সৈন্যদল কুরাউল গামীম উপত্যকায় এগিয়ে এসেছে মুসলিমদের প্রতিহত করার জন্য। ফলে মুহাম্মদ (সা.) মুসলিমদের নিয়ে অন্য পথে মক্কার দিকে অগ্রসর হতে থাকলেন। মুসলিমরা যখন হুদাইবিয়ার প্রান্তরে প্রবেশ করে, তখন একপর্যায়ে মহানবীর (সা.) উট সেখানে থেমে যায়, এবং মুহাম্মদ (সা.) এর নির্দেশে মুসলিমরা সেখানেই যাত্রাবিরতি করে। কিন্তু সমস্যা হলো, সেখানে পানির কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তখন মুহাম্মদ (সা.) এক সাহাবীকে একটি তীর দেন এবং সেই সাহাবী একটি শুকনো কুয়ার মধ্যে তীরটি নিক্ষেপ করলে সেখান থেকে পানি বেরিয়ে আসে।
অপরদিকে কুরাইশরা কঠোর অবস্থান নিয়েছে যেকোনোভাবেই মুসলিমদের মক্কায় প্রবেশ করতে দেবে না। পরিস্থিতি যখন এমন উত্তেজনাপূর্ণ, তখন মক্কার খুযাআ গোত্রের নেতা বুদায়েল ইবনে ওয়ারাকা কয়েকজন লোক নিয়ে মুহাম্মদ (সা.) এর কাছে আসেন। বুদায়েলের সাথে কথা বলার সময় মুহাম্মদ (সা.) তাকে জানান যে মুসলমানরা কোনো যুদ্ধের জন্য নয়, বরং শান্তিপূর্ণভাবে কাবাঘর দর্শনের উদ্দেশ্যে এসেছে। বুদায়েল মক্কায় গিয়ে এই কথা কুরাইশদের জানায়। তার কথা শুনে কিছু কুরাইশ নেতা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়।
কাবাঘর জিয়ারত করা সমগ্র আরবদের অধিকার ছিল। কুরাইশরা যদি যুদ্ধের মাধ্যমে মদিনাবাসীদের কাবা জিয়ারত প্রতিহত করে, তাহলে গোটা আরবের কাছে কুরাইশদের নৈতিক অবস্থান দুর্বল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। এমতাবস্থায় বিচলিত কুরাইশরা বুঝে উঠতে পারছিল না কী করবে। পরিস্থিতি যখন এমন, তখন কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানো ছাড়া এই সমস্যা সমাধানের আর কোনো উপায় ছিল না। কুরাইশরা ধাপে ধাপে তাদের কয়েকজন প্রতিনিধিকে মুসলিম শিবিরে পাঠায় কথা বলার জন্য। তারা মুহাম্মদ (সা.) এর সাথে কথা বলা শেষে মক্কায় ফিরে জানায় যে মুসলিমরা মূলত কাবা জিয়ারত করতে এসেছে, যুদ্ধ করার কোনো মনোভাব তাদের নেই। কিন্তু কুরাইশরা অনড় যে তারা এভাবে মুসলিমদের মক্কায় প্রবেশ করতে দেবে না।
কুরাইশরা একপর্যায়ে উরওয়া ইবনে মাসউদকে হুদাইবিয়াতে মুহাম্মদ (সা.) এর কাছে প্রেরণ করে। উরওয়া রাসূল (সা.) এর নিকট এসে কথা বলতে থাকলে তার বাঁকা কথাবার্তা শুনে আবু বকর (রা.) রেগে যান। একপর্যায়ে আবু বকর (রা.) এর সাথে তার বাকবিতন্ডা হয়। এরপর উরওয়া মক্কায় ফিরে গিয়ে মহানবী (সা.) এর উপর তার অনুসারীদের যে প্রগাঢ় ভক্তি, ভালোবাসা ও আস্থা দেখেছেন তা কুরাইশদের অবহিত করেন।
এরপর মুহাম্মদ (সা.) তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার জন্য খিরাস ইবনে উমাইয়াকে কুরাইশ নেতাদের কাছে পাঠান। কিন্তু কুরাইশরা তার সাথে দুর্ব্যবহার করে এবং তার উটের পায়ের রগ কেটে দেয়। রাসূল (সা.) চেয়েছিলেন শান্তিপূর্ণ সমাধান। তারপর তিনি উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-কে মক্কায় পাঠানোর কথা ভাবেন। কিন্তু উমর (রা.) কুরাইশদের বৈরি মনোভাব বুঝতে পেরে তাকে না পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেন। তিনি জানান যে কুরাইশদের সবার সঙ্গেই তার সম্পর্ক খারাপ, তদুপরি তার গোত্রের এমন কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী নেই যে তাকে কুরাইশদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। তিনি তার পরিবর্তে উসমান ইবনে আফফান (রা.)-কে পাঠানোর প্রস্তাব করেন। অনেক প্রভাবশালী কুরাইশ নেতার সাথে উসমান (রা.) এর সম্পর্ক ছিল।
রাসূল (সা.) উসমান (রা.) এর প্রভাব-প্রতিপত্তির কথা চিন্তা করে শান্তি আলোচনার জন্য তাকে কুরাইশদের নিকট প্রেরণ করেন। উসমান (রা.) মক্কায় গিয়ে কুরাইশ নেতাদের কাছে বার্তা পৌঁছে দেন। কুরাইশরা উসমান (রা.) এর সাথে অনেকক্ষণ কথা বলে এবং কোনো কারণে তিনি মক্কায় বেশিক্ষণ সময় ব্যয় করেন। তার ফিরে আসতে বিলম্ব হওয়ার কারণে মুসলিম শিবিরে গুজব রটে যে, কুরাইশরা উসমান (রা.)-কে হত্যা করেছে। এই খবর শুনে মুহাম্মদ (সা.) ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং মুসলিমদেরকে এর প্রতিশোধ নিতে লড়াই করার জন্য শপথ করান। এই শপথ ইতিহাসে ‘বাইয়াতুর রিদওয়ান’ নামে পরিচিত। কিন্তু তারপর মুসলিমরা জানতে পারে যে উসমানের (রা.) নিহত হওয়ার খবর ভুল ছিল।
এরপর সুহাইল ইবনে আমর কুরাইশদের প্রতিনিধি হিসেবে হুদাইবিয়াতে হাজির হয়। সুহাইলকে দেখেই রাসূল (সা.) বুঝতে পারেন যে কুরাইশরা শান্তি আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুহাইল এসে মহানবীর সামনে বসে আলাপ শুরু করলো। অনেকক্ষণ আলোচনা শেষে সুহাইল ও মুহাম্মদ (সা.) এই সমস্যা সমাধানের জন্য কয়েকটি শর্তে একমত হয়।
মহানবী (সা.) হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)-কে চুক্তিপত্র লেখার নির্দেশ দেন। তিনি আলী (রা.)-কে বলেন, “লেখ, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” এবং সাথে সাথেই আলী (রা.) তা লিখলেন। কিন্তু পরক্ষণেই সুহাইল আপত্তি জানিয়ে বলল, “আমি এ বাক্যের সাথে পরিচিত নই। তুমি বরং লেখ, বিসমিকা আল্লাহুম্মা” অর্থাৎ “হে আল্লাহ্, তোমার নামে”। মহানবী (সা.) সুহাইলের কথা মেনে নিয়ে অনুরূপ লিখতে বললেন। এরপর মহানবী বললেন, “লেখ, এ চুক্তি আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ এবং কুরাইশ প্রতিনিধি সুহাইলের মধ্যে সম্পাদিত হচ্ছে।” আলী (রা.) তেমনটাই লিখলেন। সুহাইল আবারো আপত্তি জানিয়ে বলল, “আমরা তোমার রাসূল ও নবী হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করি না। যদি তা স্বীকারই করতাম, তবে তোমার সাথে যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত হতাম না। শুধু তোমার নাম ও পিতার নাম লেখ।“
মুহাম্মদ (সা.) সুহাইলের দাবী মেনে নিয়ে হযরত আলীকে (রা.) ‘আল্লাহর রাসূল’ শব্দটি মুছে ফেলতে নির্দেশ দিলেন। আলী (রা.) স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন এই লেখা মুছে ফেলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তারপর মুহাম্মদ (সা.) আলীকে (রা.) উক্ত লেখাটা দেখিয়ে দিতে বললেন এবং নিজের হাতে তা মুছে দিলেন। অতঃপর তিনি আলীকে (রা.) বললেন, “লেখ, আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ নিম্নলিখিত মর্মে আমরের পুত্র সুহাইলের সঙ্গে এই চুক্তি সম্পাদনে সম্মত হয়েছেন।” আলী (রা.) মুহাম্মদ (সা.)-এর কথামতো লিখতে থাকলেন। সেদিন যেসব শর্তে সুহাইল ও মুহাম্মদ (সা.) সম্মত হয়েছিলেন সেগুলো নিম্নরূপ:
১. কুরাইশ ও মুসলিমরা সমগ্র আরব ভূখণ্ডে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা ও শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে এ মর্মে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হচ্ছে যে, আগামী দশ বছর তারা একে অপরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে না এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে সব ধরনের আক্রমণ থেকে বিরত থাকবে।
২. যদি কুরাইশদের কেউ তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া মক্কা থেকে পালিয়ে মুহাম্মদের (সা.) কাছে আসে তাহলে মুহাম্মদ (সা.) অবশ্যই তাকে কুরাইশদের কাছে ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু যদি কোনো মুসলমান মদীনা থেকে মক্কায় পালিয়ে আসে, কুরাইশরা তাকে মুসলমানদের কাছে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে না।
৩. মুসলমান ও কুরাইশরা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে যেকোনো গোত্রের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে পারবে।
৪. মুহাম্মদ (সা.) ও মুসলিমরা এ বছর এখান থেকেই মদীনায় ফিরে যাবেন। আগামী বছর কুরাইশরা মক্কার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়ে তিন দিনের জন্য অন্যত্র চলে যাবে। তখন মুসলিমরা তাদের সঙ্গে কোষবদ্ধ তরবারী বহন করতে পারবে।
এরপর কয়েকজন কুরাইশ ও মুসলিম প্রতিনিধি সাক্ষী হিসেবে তাতে স্বাক্ষর করেন। উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) প্রথমে এই চুক্তিতে মনঃক্ষুন্ন ও ক্ষুব্ধ হলেও পরে তিনি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। চুক্তির শর্তগুলো উমর (রা.) কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তার কাছে কিছু শর্ত অপমানজনক ঠেকে। প্রথমদিকে কুরাইশদের শর্ত শুনে এবং মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক সেসব শর্ত মেনে নেওয়া দেখে উমর (রা.) এতই রাগান্বিত হন যে তিনি ভ্রান্ত আচরণ শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি তার ভুল বুঝতে পারেন।
যে শর্তের কারণে এই চুক্তিকে মুসলিমদের স্বার্থবিরোধী বলে মনে হয় সেই শর্ত অর্থাৎ যেখানে বলা হয়েছে যে, কোনো কুরাইশ তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া মদিনায় গেলে মুহাম্মদ (সা.) তাকে কুরাইশদের কাছে ফিরিয়ে দেবে কিন্তু কোনো মুসলিম মদিনা ছেড়ে মক্কায় গেলে কুরাইরা তাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে না। এখানেই ছিল আসল রাজনীতি কিংবা কূটনীতি। আপাতদৃষ্টিতে একে মুসলিমদের স্বার্থবিরোধী মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এই শর্তের ফলে মুসলিমদের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী কোনো কুরাইশ মক্কা ছেড়ে মদিনায় যেতে না পারলেও অন্য কোথাও যেতে তো কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। ফলে এই চুক্তির পর নওমুসলিম কুরাইশরা মদিনার পরিবর্তে লোহিত সাগরের তীরবর্তী মক্কা থেকে সিরিয়া যাওয়ার বাণিজ্যপথে আশ্রয় নেয়। ফলে কুরাইশরা আরো বেশি বিপদে পড়ে। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে এই শর্ত মুসলিমদের জন্য সুবিধা বয়ে আনে।
মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন অত্যন্ত প্রখর ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। তিনি ছিলেন অতীব দূরদূষ্টিসম্পন্ন এবং সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনার মালিক। এই চুক্তির মাধ্যমে মুহাম্মদ (সা.)-এর কূটনৈতিক জ্ঞান স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হুদাইবিয়ার সন্ধির শর্তগুলো আপাতদৃষ্টিতে মুসলিমদের জন্য তেমন লাভজনক নয় বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি মুসলিমদের জন্য ব্যাপক সুবিধা বয়ে আনে। কোনো একটা ঘটনা বা কর্মের লাভ কিংবা ক্ষতি নির্ভর করে তার ফলাফলের উপর। সুদূরপ্রসারী ও সার্বিক ফলাফল দেখলে বোঝা যায় যে হুদাইবিয়ার সন্ধি মুসলিমদের জন্য ব্যাপক লাভজনক ছিল। এই সন্ধির ফলাফল শেষ পর্যন্ত মুসলিমদের পক্ষেই গিয়েছিল। দশ বছরের শান্তি চুক্তির ফলে মুসলিমরা স্বাধীনভাবে সর্বস্তরে ইসলাম প্রচারের সুযোগ পায় এবং দ্রুতই মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ হুদাইবিয়ার সন্ধিকে ‘প্রকাশ্য বিজয়’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
এই সন্ধির ফলে কুরাইশ ও মুসলিমদের মধ্যে মোটামুটি ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। মুসলমানদের সাথে ওঠাবসার কারণে কুরাইশরা ইসলাম সম্পর্কে আরো বেশি জানতে পারে এবং ইসলামের সুমহান বার্তা তাদের মধ্যে পৌঁছে তাদের হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ফলে এই চুক্তির পরবর্তী দুই বছরে অনেক প্রভাবশালী কুরাইশ ইসলাম গ্রহণ করে।
এতদিন পর্যন্ত কুরাইশরা মুসলিমদের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল এবং যেকোনো মুহূর্তে কুরাইশদের সঙ্গে মুসলিমদের যুদ্ধের আশঙ্কা ছিল। এই চুক্তির ফলে কুরাইশদের সঙ্গে যুদ্ধের সম্ভাবনা কমে যাওয়ায় অন্য শত্রুদের ব্যাপারে মনোনিবেশের সুযোগ পায় মুসলিমরা। এতদিন কুরাইশদের সঙ্গে মুসলিমদের বৈরি সম্পর্ক থাকায় আরবের অনেক গোত্র মুসলিমদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে দ্বিধায় ছিল। এই চুক্তির ফলে মুসলিমরা স্বাধীনভাবে আরবের যেকোনো গোত্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি ও চুক্তি করার অধিকার পায়। হুদাইবিয়ার সন্ধির পর মক্কার বনু খুযাআ গোত্র মুসলিমদের সঙ্গে এবং বনু বকর গোত্র কুরাইশদের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে। এই চুক্তির মাধ্যমে কুরাইশরা মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রকে একপ্রকার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়ে দেয়। এর ফলে আরবে মদিনা রাষ্ট্রের আবেদন ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়।
এতদিন কুরাইশদের বিরোধীতার জন্য মুসলিমরা চাইলেও কাবা জিয়ারত করতে পারতো না। এই চুক্তির ফলে মুসলিমরা হজ্ব পালনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়। হুদাইবিয়ার সন্ধির ফলে পরবর্তী বছরই রাসুল (সা.) নিরাপদে সাহাবীদের নিয়ে উমরাতুল কাযা পালন করেন। প্রকৃতপক্ষে হুদাইবিয়ার সন্ধিই মক্কা বিজয়ের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিল।
হুদাইবিয়ার সন্ধি কুরাইশ তথা আরবদের ওপর এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে এরপর তেমন কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই মুসলিমরা মক্কা বিজয়ে করতে সক্ষম হয়। এর পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যেই সমগ্র আরব ভূখন্ড মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এটি ছিল কুরাইশদের উপর মুসলিমদের কূটনৈতিক বিজয়। হুদাইবিয়ার সন্ধি মূলত ইসলামের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এই সন্ধির পর সমগ্র আরব ভূখন্ড এক নতুন রূপ ধারণ করে। এক শান্তিপূর্ণ আরব যে রুপ এর আগে আরবরা বহুদিন ধরে দেখেনি। এই আরবের সাথে আগের আরবের মিল নেই। হুদাইবিয়ার সন্ধি ছিল শান্তির মহান দূত মুহাম্মদ (সা.)-এর পক্ষ থেকে আরবদের জন্য শান্তির এক সুমহান বার্তা।