গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে বিশ্বজুড়ে দেখা দেয় অর্থনৈতিক মহামন্দা। সেই ধাক্কা এসে লাগে অস্ট্রেলিয়াতেও। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো তখন ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছিল। এমনই এক প্রতিষ্ঠান ছিল ‘কুজি অ্যাকুরিয়াম এন্ড সুইমিং বাথ’। সিডনির অন্যতম এই বিনোদন কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয় ১৮৮৭ সালে। এর ছিল ১,৪০০ সিটের থিয়েটার, বিশাল বলরুম ও রেস্টুরেন্ট। কিন্তু ত্রিশের দশকে এসে এটি দর্শকদের কাছে আবেদন হারাতে শুরু করে। তখনকার মালিক বার্ট হবসনের মাথায় চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করল। তবে তখনই তিনি পেয়ে গেলেন একটি সুযোগ।
১৯৩৫ সালের ১৮ এপ্রিল। বার্ট হবসন তার ছেলে রনকে সঙ্গে নিয়ে সমুদ্রে গেলেন মাছ শিকার করতে। সাগরের কূল থেকে তিন কিলোমিটার দূরে তাদের কাছে একটি বিশাল হাঙর ধরা পড়ে। হাঙরটির দৈর্ঘ্য ছিল চার মিটার এবং ওজন ছিল প্রায় এক টন। হবসন মনে করেন, এটি তার কুজি অ্যাকুরিয়ামে নিয়ে গেলে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে। ফলে তার হারানো গৌরব আবার ফিরে আসবে এবং ব্যবসা লাভজনক হবে। এসব চিন্তা করে তিনি হাঙরটিকে নিয়ে আসেন। একে তখন তার পুলে এনে ছেড়ে দেন। কিন্তু তিনি জানতেন না, এক সপ্তাহ পরেই তার বিনোদন কেন্দ্রটি পুরো অস্ট্রেলিয়ারই দৃষ্টি কেড়ে নিবে। এ-ও হয়তো কল্পনা করেননি যে, হাঙরের সাথে জড়িয়ে যাবে একটি খুনের রহস্য, যার সমাধান আজও হয়নি।
দিনটি ছিল ২৫ এপ্রিল, সরকারি ছুটির দিন। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে এই দিনটি ‘অ্যানজেক দিবস’ (ANZAC Day) হিসেবে পালন করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের নিহত সৈন্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৯১৬ সাল থেকে দুই দেশেই প্রতি বছর এই দিবসটি পালন করা হয়। ১৯৩৫ সালের ছুটির এই দিনে কুজি অ্যাকুরিয়ামে ঘুরতে আসে অনেক পর্যটক। হাঙরের আকর্ষণে পরিবার-পরিজন নিয়ে আসা মানুষ দিয়ে সারাদিনই মুখরিত থাকে হবসনের অ্যাকুরিয়াম। সারা দিন গড়িয়ে বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটের দিকে হাঙরটি হঠাৎ অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করলো।
হাঙরটি সাঁতার কাটতে কাটতে হঠাৎ এর খিঁচুনি শুরু হলো। তারপর বমি করা শুরু করল। প্রথমে একটি ইঁদুর, তারপর একটি পাখি এবং শেষে পেট থেকে বেরিয়ে এলো মানুষের বাহুযুক্ত একটি বাম হাত। আগত দর্শকরা এই হাত দেখে ভয় পেয়ে গেল এবং চিৎকার-চেচামেচি শুরু করল। রবসন তখন অবস্থা বেগতিক দেখে পুলিশে খবর দেন। পুলিশ মনে করলো, এটি হয়তো সেখানকার কর্মচারী বা মেডিকেল শিক্ষার্থীদের করা কোনো প্র্যাংক।
কিন্তু এই ধারণা মিথ্যে হয়ে গেল, যখন পানি থেকে হাতটি এনে দেখা গেল বাহুতে একটি ট্যাটু আঁকা, যাতে দুজন বক্সারের বক্সিং করার দৃশ্য। এর কবজির সাথে একটি দড়ি বাঁধা ছিল। আরো ভয়ংকর ব্যাপার হলো যখন পরীক্ষা করে জানা গেল, হাতটি হাঙরের কামড়ে কাটা যায়নি! বরং এটি কোনো অস্ত্র দিয়ে কাটা হয়েছে এবং এর মানুষকে খুন করা হয়েছে। হাঙরের পেট পরীক্ষা করে কোনো মানবদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তখন পুলিশ ও জনগণের কাছে দুটি প্রশ্ন খুব ঘোরপাক খেল। এই হাতটি কার? এই হাঙরের পেটেই বা কী করে এলো এটি? তখন ফরেনসিক প্রযুক্তি আজকের মতো উন্নত ছিল না। তাই হাতের মালিককে খুঁজে বের করা অনেক কঠিন ছিল। শেষ পর্যন্ত তখনকার নতুন ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রযুক্তির সাহায্যে যে ব্যক্তির হাত, তার পরিচয় বের করা সম্ভব হয়। তার নাম জিম স্মিথ। তিনি ছিলেন একসময়ের বক্সার ও পুলিশের তথ্যদাতা। ৪৫ বছর বয়সী ইংরেজ বংশদ্ভূত এই ব্যক্তি সিডনির গ্ল্যাডসভিলে বাস করতেন। স্থানীয় ‘ট্রুথ’ পত্রিকায় তাকে নিয়ে বলা হয়, তিনি একসময়ের প্রতিভাবান বক্সার ছিলেন এবং তার কোনো শত্রু থাকার কথা না। কিন্তু পত্রিকায় তার অনেক অজানা অধ্যায় সম্পর্কে বলা হয়নি। পত্রিকার ছবিতে হাতের ট্যাটু দেখে স্মিথের ভাই তার পরিচয় নিশ্চিত করেন।
স্মিথ ত্রিশের দশকের শুরুর দিকে বক্সার হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু যখন বুঝতে পারেন পেশাগতভাবে তিনি এই খেলার জন্য দক্ষ নন, তখন তিনি বক্সার হওয়ার স্বপ্ন ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর তিনি বিভিন্ন চাকরি করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত একটি পাবের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। এসময় তার সাথে আন্ডারওয়ার্ল্ডের বিভিন্ন ক্রিমিনাল বা অপরাধী ব্যক্তিদের সাথে পরিচয় হতে থাকে। তাদের একজন ছিলেন রেজিনাল্ড হোমস। স্মিথ তখন হোমসের জন্য বিভিন্ন কাজ করে দিতে থাকেন।
রেজিনাল্ড হোমস ছিলেন পারিবারিকভাবে একজন নৌ-নির্মাতা। তার দাদা আর বাবা দুজনই সফল নৌকা নির্মাতা ছিলেন। ১৮৫০ সাল থেকেই তার পরিবার নৌযান নির্মাণ করে আসছিল। তাদের পথ ধরে হোমসও সেদিকে আগান। তিনি তার প্রতিষ্ঠান থেকে স্পিডবোট নির্মাণ করে আসছিলেন। তিনি সমাজের কাছে একজন পরিবার অন্তপ্রাণ হিসেবে সম্মাননীয় ব্যক্তি ছিলেন। এছাড়া চার্চে নিয়মিত দানও করতেন। কিন্তু এসবের আড়ালে তিনি অনেক অপরাধমূলক কাজে জড়িত ছিলেন।
হোমস তার স্পিডবোটগুলোকে মাদকদ্রব্য চোরাচালানে ব্যবহার করতেন। সমুদ্রের জাহাজ থেকে কোকেন, হিরোইন তার স্পিডবোটে করে শহরে এনে বিক্রি করতেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন বীমা কেলেঙ্কারির সাথেও জড়িত ছিলেন। তার এসব কাজে সাহায্য করতেন জিমি স্মিথ। ‘প্যাথফাইন্ডার’ নামে একটি প্রমোদতরীও ছিল তার, এর দেখাশোনা করতেন স্মিথ। স্মিথ ও হোমসের সাথে জড়িত ছিলেন আরেক মাস্টারমাইন্ড, প্যাট্রিক ব্র্যাডি।
প্যাট্রিক ব্র্যাডি সভ্য পরিবারের সন্তান ছিলেন। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বিশ্বযুদ্ধের সময় নিজের একটি ‘প্রতিভা’ আবিষ্কার করেন। তিনি সেখানের মিলিটারি জেনারেলদের স্বাক্ষর নকল করতে পারতেন। তিনি দেখলেন তার এই দক্ষতা কাজে লাগিয়ে অনেক প্রতারণা করতে পারবেন। ব্র্যাডি স্মিথের দীর্ঘদিনের পুরনো বন্ধু ছিলেন। ব্র্যাডির সাথে হোমসের পরিচয় করিয়ে দেন স্মিথ। তারা তিনজন মিলে তখন হোমসের ক্লায়েন্টদের চেক জাল করতে থাকেন। এদিকে স্মিথ একসময় হোমসের সাথে প্রতারণা শুরু করেন।
সমাজের কাছে হোমসের ভাবমূর্তি ছিল আলাদা। তাই স্মিথ হোমসকে ব্ল্যাকমেইলের হুমকি দিতেন। স্মিথ মনে করতেন তার হারানোর কিছু নেই। কিন্তু নিজের প্রাণটাই হারিয়ে বসবেন তা হয়তো ভাবেননি। এক রাতে স্ত্রীকে বললেন, মাছ শিকার করতে যাচ্ছেন। এরপর কয়েকদিন পেরিয়ে গেলেও যখন বাড়ি ফেরেননি, তখন স্মিথের স্ত্রী চিন্তিত হয়ে পড়েন। এসময় তার কাছে একটি রহস্যজনক ফোন আসে। এতে বলা হয়, “চিন্তা করবেন না। জিমি তিন দিনের মধ্যেই বাড়ি ফিরবে”। কিন্তু জিমি স্মিথ আর কোনোদিন বাড়ি ফিরেননি।
এবার আবার খুনের প্রসঙ্গে আসা যাক। সেদিন ছিল ৭ এপ্রিল, হাঙর ধরা পড়ার এগার দিন আগের কথা। সেদিন জিমি স্মিথ ও প্যাট্রিক ব্র্যাডি সেসিল হোটেলে পানাহার করছিলেন এবং তাস খেলছিলেন। এরপর তারা দুজন ব্র্যাডির ভাড়া করা কটেজে যান। কটেজটি ছিল ক্রনুলা অঞ্চলের সমুদ্র সৈকতের কাছে। ধারণা করা হয়, সেদিন এখানেই স্মিথকে খুন করা হয়। একটি ট্যাক্সি ক্যাব চালক সাক্ষ্য দেন, সেদিন রাতে কটেজ থেকে ব্র্যাডি অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় হোমসের বাড়িতে যান। ঐ চালক এটাও বলেন, ব্র্যাডিকে খুব ভীত দেখাচ্ছিল এবং তিনি যে তার জ্যাকেটে কিছু একটা লুকিয়ে রাখছিলেন সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু পুলিশের তদন্তে পুরো ঘটনাটি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছিল।
১৭ মে ব্র্যাডিকে জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। স্মিথের খুনের সাথে এর সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু এটি ছিল তাকে আটকে রাখার একটি কৌশল। তাকে তখন ছয় ঘন্টা যাবত জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু তিনি কিছুই স্বীকার করেননি। এরপর পুলিশ তার স্ত্রীর সাথে কথা বললে তিনি বিবৃতি দিতে সম্মতি জানান। ব্র্যাডি তখন হোমসকে স্মিথের খুনি বলে সাব্যস্ত করেন। কিন্তু হোমস পুলিশকে জানান, তিনি ব্র্যাডিকে চেনেন না।
এর কিছুদিন পর হোমস সিডনি পোতাশ্রয়ে একটি অ্যালকোহলের বোতল ও পিস্তল নিয়ে স্পিডবোট চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তার স্পিডবোটের এই ঘটনাটি বিভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। মূল ঘটনাটি সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো এখানে।
স্মিথ মাতাল হয়ে স্পিডবোট চালাচ্ছিলেন। এসময় নিজের মাথায় পিস্তল দিয়ে গুলি করেন তিনি। আশ্চর্যজনকভাবে গুলি করার পরও হোমস মারা যাননি। গুলিটি তার কপালের অস্থি ছেদ করে বেরিয়ে যায় এবং তিনি পানিতে পড়ে যান। এরপর তিনি আবার বোটে ওঠেন। তখন অন্য আরেকটি বোটে এক ব্যক্তি তার সন্তানদের নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। তিনি এসব দেখতে পান।
এরপর হোমস আবার স্পিডবোট চালাতে থাকেন। তখন পুলিশ তার পিছু নেয়। চার ঘন্টা ধরে সমুদ্রে ছোটাছুটি করার পর তিনি পুলিশের কাছে ধরা দেন। তিনি পুলিশের কাছে বলেন, তার মাথায় কয়েকজন অজ্ঞাত ব্যক্তি গুলি করেছে। তিনি মনে করেছিলেন পুলিশরাই তাকে গুলি করেছে, তাই তিনি পালাচ্ছিলেন। হোমস তখন পুলিশের কাছে আরো বলছিলেন,
“জিমি স্মিথ মারা গেছে। এখন আর একজন বাকি আছে। তোমরা যদি আমাকে ছেড়ে দাও তবে আজ রাতেই আমি তাকে শেষ করে দেব”।
হোমসের কথাবার্তা তখন অসংলগ্ন মনে হলেও তার বোটে রাখা অ্যালকোহলের খালি বোতলটিই বলে দিচ্ছিল সব। কিন্তু পরবর্তীতে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি যা বলেন, তাতে ঘটনা নতুন মোড় নেয়।
হোমস পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বলেন, তিনি নন, বরং ব্র্যাডিই স্মিথকে খুন করে তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন। হোমস আরো বলেন, ব্র্যাডি স্মিথের কাটা হাতটি নিয়ে তার বাড়িতে আসেন এবং তাকে ব্ল্যাকমেইলের হুমকি দেন। হোমস বলেন, ব্র্যাডি স্মিথকে খুন করেন এবং তার শরীর কেটে টুকরা টুকরা করে বাম হাত বাদে বাকি অংশ একটি ট্রাংকে ভরে ফেলেন। তারপর ট্রাংকটি গানাম্যাটা উপসাগরে ফেলে দেন। বিশের দশক ও ত্রিশের দশকে এটি ছিল খুব সাধারণ ঘটনা। একে বলা হতো ‘দ্য সিডনি সেন্ড অফ’।
হোমস বলেন, তিনি ব্র্যাডির হুমকির কারণে তাকে কিছু অর্থ দেন। বিনিময়ে ব্র্যাডি তাকে স্মিথের কাটা হাতটি দিয়ে যান। হোমস দাবি করেন, তিনি তখন এই কাটা হাত দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাই হাতটি সাগরে ফেলে দিয়ে আসেন। সেখানে হয়তো সেই হাঙর হাতটি খেয়ে ফেলে আর পরে বমি করে জনসম্মুখে নিয়ে আসে।
পুলিশ তখন হোমসকে জানায়, তিনি যদি ব্র্যাডির বিপক্ষে আদালতে এই সাক্ষ্য না দেন তবে তাকে খুনের সহায়তার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হবে। আদালতে আসার কথা ছিল জুনের ১২ তারিখ। হোমস তখন সাক্ষ্য দিতে রাজি হন। কিন্তু ১৯৩৫ সালের ১২ জুন সকালে পুলিশ হোমসকে তার গাড়ির মধ্যে দেখতে পায়। তার বুকে ছিল তিনটি গুলির চিহ্ন। এবার তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
ব্র্যাডির মামলা তখনো চলতে থাকে। কিন্তু হোমস যেহেতু আর সাক্ষী হতে পারেননি তাই এই মামলাও দুর্বল হয়ে যায়। ব্র্যাডির পক্ষের উকিল বলেন, ব্রিটিশ আইনের ১২৭৬ ধারা অনুযায়ী আইনগত অনুসন্ধানের জন্য লাশের উপস্থিতি থাকতে হবে। একটি হাতকে লাশ হিসেবে উপস্থাপন করা যায় না। এছাড়া আরো বলা হয়, হাঙর সাধারণত ২৪ ঘন্টার মধ্যে খাবার হজম করে ফেলে। কিন্তু এই অভিযোগ সত্য হলে হাতটি হাঙরের পেটে আট থেকে সতের দিন থাকার কথা। এটাও বলা হয়, হয়তো কেউ কুজি অ্যাকুরিয়ামের সেই পুলে হাতটি ফেলে দেয় যেখানে হাঙরটিকে রাখা হয়। হয়তো এটি হাঙরের পেটে কখনো ছিলই না।
তখন প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে মৎস্য বিজ্ঞানীদের নিয়ে আসা হয়। তারা বলেন, হাতটি হয়তো হাঙরের হজম প্রক্রিয়াকে বিপর্যস্ত করে তুলছিল এবং এর কাজে বাধা দিচ্ছিল। এছাড়া সেদিন কুজিতে উপস্থিত ১৪ জন দর্শককে সাক্ষী হিসেবে আনা হয়। তারা সবাই সাক্ষী দেন যে, হাঙরটিকে বমি করে হাতটি বের করতে দেখেছে। কিন্তু ব্র্যাডির বিপক্ষে শক্ত কোনো প্রমাণ না থাকায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। এরপর আজ আশি বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেলেও এই খুনের রহস্য আনুষ্ঠানিকভাবে সমাধান করা সম্ভব হয়নি। কী হতে পারে সেই খুনের রহস্য সেটি নিয়ে বিভিন্ন তত্ত্ব প্রচলিত আছে। সেই তত্ত্বগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক।
প্রথম তত্ত্ব
হোমস পুলিশের কাছে সত্য কথা বলেছিলেন। ব্র্যাডি স্মিথকে খুন করে হোমসকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু এখানে কিছু সংশয় রয়েছে। ব্র্যাডি স্মিথকে মারার জন্য অন্য কাউকে ভাড়া করতে পারতেন। তাছাড়া ব্র্যাডির উচ্চতা ছিল মাত্র ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। অন্যদিকে জিমি স্মিথ ছিলেন লম্বা ও একসময়ের বক্সার। তাই ব্র্যাডির পক্ষে একা হোমসকে খুন করা সম্ভব ছিল না। ব্র্যাডি পিস্তল দিয়েও খুন করে থাকতে পারেন। কিন্তু স্মিথের মরদেহ কখনো পাওয়া যায়নি। তাই নিশ্চিত বলা সম্ভব নয় তিনি কীভাবে খুন হয়েছেন।
দ্বিতীয় তত্ত্ব
এই তত্ত্বানুযায়ী স্মিথকে কেউই খুন করেননি। কারণ স্মিথের মরদেহ পাওয়া যায়নি। তাই এটি নিশ্চিত নয় যে, স্মিথ আসলেই খুন হয়েছিলেন কি না। জিমি স্মিথ সম্ভবত অপরাধমূলক কার্যক্রম থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু এটা নিরাপদভাবে করা সম্ভব ছিল না। তাই তিনি নিজের মিথ্যা মৃত্যুর নাটক সাজিয়েছেন। তিনি হয়তো জীবিতই ছিলেন। কিন্তু এই তত্ত্ব দুর্বল হয়ে যায় তার কাটা হাতের অংশ দেখে। তিনি কবজির নিচের অংশটুকু কেটে নিলেই পারতেন, পুরো হাত কেটে ফেলার দরকার ছিল না।
তৃতীয় তত্ত্ব
এই তত্ত্বটি দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ান আইন বিষয়ক ইতিহাসবিদ অ্যালেক্স ক্যাসলস। ক্যাসলসের মতে, স্মিথ ব্র্যাডির কটেজে খুন হন, কিন্তু ব্র্যাডি এর সাথে জড়িত ছিলেন না। সেই ঘটনার কয়েক বছর পর ব্র্যাডির স্ত্রী বলেন, সেই রাতে তিনি সেই কটেজে গিয়েছিলেন। তিনি সন্দেহ করেন, ব্র্যাডি হয়তো সেখানে অন্য কোনো নারীর সাথে সময় কাটাচ্ছেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি কয়েকজন পুরুষের তাস খেলা আর পানাহার করার শব্দ পান।
ক্যাসলস মনে করেন, সেই রাতে ব্র্যাডি গিয়েছিলেন মাছ ধরতে আর ফিরে এসে দেখেন স্মিথ ইতোমধ্যে মৃত। এই তত্ত্বাঅনুযায়ী ব্র্যাডি ভয়ে কখনো স্মিথের প্রকৃত খুনিদের পরিচয় প্রকাশ করেননি।
চতুর্থ তত্ত্ব
এই তত্ত্ব অনুযায়ী হোমসের পরিকল্পনায় স্মিথের মৃত্যু হয়েছে। হোমসের প্রমোদতরী ‘প্যাথফাইন্ডার’ রক্ষণাবেক্ষণ করতেন স্মিথ। হোমস ও তার সহযোগীরা এই প্রমোদতরীটি কেনেন এবং বীমা করেন। হোমস বীমা কেলেঙ্কারির অংশ হিসেবে এতে আগুন লাগিয়ে দেন ইচ্ছা করেই। এদিকে স্মিথ ছিলেন পুলিশের তথ্যদাতা। তিনি পুলিশ ও বীমা কর্তৃপক্ষের কাছে জানিয়ে দেন প্রমোদতরী পুড়ে যাওয়ার ব্যাপারটি সন্দেহজনক। তাই হোমস আর প্রমোদতরী ধ্বংস হওয়ার কোনো বীমা পাননি।
স্মিথ একইসাথে হোমসকে তার জালিয়াতির বিষয় ফাঁস করে দেয়ার হুমকিও দেন। হোমস তখন ব্র্যাডিকে বলেন স্মিথকে মেরে ফেলতে। ব্র্যাডি স্মিথকে মেরে ফেলার পর হোমসের কাছে প্রমাণস্বরূপ তার কাটা হাত পাঠান। হোমস তখন স্মিথের হাতটি সমুদ্রে ফেলে দেন আর এটি চলে যায় হাঙরের পেটে।
এই তত্ত্বাঅনুযায়ী হোমস আরো একবার তার বীমা কেলেঙ্কারি থেকে বেঁচে যান। পুলিশ সন্দেহ করে, হোমস একটি জীবন বীমা পরিকল্পনা গ্রহণ করার পর হিটম্যান ভাড়া করেন তাকেই খুন করার জন্য। এতে তার স্ত্রী-সন্তানরা বীমার অর্থ পায় এবং তার অপরাধমূলক কার্যক্রমের জন্য লজ্জায়ও থাকতে হয় না। হোমসের স্ত্রী জানতেন তার আসলে কী হয়েছিল। তিনি ১৯৫২ সালে এটি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখনই রহস্যজনকভাবে তিনি আগুনে পুড়ে মারা যান। আরো রহস্যজনক বিষয় হলো, প্যাট্রিক ব্র্যাডি ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। ব্র্যাডি এই ঘটনা নিয়ে একটি সাক্ষাতকারে বলেন,
শার্ক আর্ম কেস কখনো কেউ ভুলবে না। আমার মৃত্যুর পরও এই ঘটনা মানুষ মনে রাখবে।