![](https://assets.roar.media/assets/VoOmeHVG6PG2ATJC_wp3503032.jpg?w=1200)
ধুপধুপ শব্দে বাতাসে শিষ কাটছে হেলিকপ্টারের রোটর ব্লেড। ভেতরে বসা রুক্ষ চেহারার কয়েকজন যুবক। শরীরে মার্কিন সামরিক বাহিনীর ইউনিফর্ম, হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও কমব্যাট গিয়ার দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে এরা স্পেশাল ফোর্সের সদস্য। বাহুতে থাকা ইনসিগ্নিয়া দেখে বোঝা যাচ্ছে কেউ নেভি সিল, কেউ আর্মি রেঞ্জার। পাশে একজন এয়ারফোর্স প্যারা রেসকিউ কমান্ডোকেও দেখা যাচ্ছে! পাইলটদের ইনসিগ্নিয়া বলছে তারা ন্যাশনাল গার্ড থেকে আগত।
সব মিলিয়ে হেলিকপ্টারের ভেতর মার্কিন সামরিক বাহিনীর প্রায় সকল শাখার সদস্যদের ছোটখাট এক সমাবেশ। তাদের সঙ্গী হিসেবে আছেন আফগান স্পেশাল ফোর্সের কয়েকজন সদস্য। আছে কে-৯ ইউনিটের একটি প্রশিক্ষিত কুকুর। সবাই যাচ্ছে আফগানিস্তানের তালেবান নিয়ন্ত্রিত এলাকায়, যুদ্ধ করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়া আমেরিকান সেনাদের সাহায্যকারী হিসেবে।
এতটুকু লেখা পড়ে কী মনে হচ্ছে?
হলিউড মুভির চিত্রনাট্য। মনে হচ্ছে দুর্ধর্ষ মার্কিন স্পেশাল ফোর্সের রোমাঞ্চকর মিশন, যেখানে তাদের সামনে দাঁড়াতেই পারবে না শত্রুরা, তাই না? কিন্তু সেটি নয়, আজকে আপনাদের শোনান হবে ২০০৫ ও ২০১১ সালে ঘটে যাওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে এলিট স্পেশাল ফোর্সের দুটি ভয়াবহ ব্যর্থ মিশনের কাহিনি। এই দুই মিশনে এত বেশি সংখ্যক নেভি সিল ও অন্যান্য মার্কিন সেনা মারা গেছে যে একে মার্কিন স্পেশাল ফোর্সের ইতিহাসে কালো রাত হিসেবে ধরা হয়! প্রথমেই ২০০৫ সালের ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক।
![](https://assets.roar.media/assets/OrFNm41kTxNqzoDB_sss.jpg)
অপারেশন রেড উইংস
২০০৫ সালের জুন-জুলাই মাসে আফগানিস্তানের কুনার প্রদেশের ২০ মাইল পশ্চিমের দারা-আই-পেচ জেলায় সংঘটিত হয় ‘ব্যাটল অফ আব্বাস ঘার’। একে সামরিকভাবে Operation Red Wings বলা হয়। এটি একটি জয়েন্ট মিলিটারি অপারেশন যেখানে ইউএস মেরিনের সহায়ক বাহিনী হিসেবে ইউএস আর্মির ১৬০তম স্পেশাল অপারেশন এভিয়েশন রেজিমেন্ট (এয়ারবোর্ন) ও ইউএস নেভি সিল টিম ১০ এর কমান্ডোরা অংশ নিয়েছিল। তালেবান এন্টি-কোয়ালিশন মিলিশিয়া (ACM) গ্রুপের যোদ্ধারা এই অঞ্চলে সক্রিয় ছিল। এই গ্রুপের নেতা ছিলেন আহমাদ শাহ। তার উপর নজরদারি ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে চারজন নেভি সিল সেনাকে হেলিকপ্টার থেকে এই এলাকায় দড়ি দিয়ে র্যাপলিং করে নামিয়ে দেয়া হয়।
ঘটনাক্রমে দুজন রাখাল শিশু তাদের গোপন ক্যাম্পের পাশ দিয়ে ছাগল নিয়ে যাওয়ার সময় তাদের দেখে ফেলে। উক্ত চারজন নিজেদের মধ্যে তর্ক করে শেষ পর্যন্ত দলনেতা লেফটেন্যান্ট মাইকেল মারফি রাখালদের মেরে ফেলা/বন্দী করে রাখার বদলে ছেড়ে দেয়। ১৯৯১ সালে ব্রিটিশ স্পেশাল এয়ার সার্ভিস কমান্ডোদের অপারেশন যে কারণে ব্যর্থ হয়েছিল, সেই ঘটনাই নেভি সিলদের সাথে ঘটল। রাখালদের মাধ্যমে খবর পেয়ে আহমাদ শাহ প্রায় ৭০-১০০ জন নিয়ে হামলা করে। এ সময় শাহ ভিডিও করার জন্য নিজের সাথে দুজন ক্যামেরাম্যানও রেখেছিলেন! এই হামলা থেকে বাঁচতে পালাতে গিয়ে তিনজন সিল সেনা মারা যায়, আরেকজন গুরুতর আহত হয়। তাদের উদ্ধার করতে পাঠানো পাঠানো চিনুক হেলিকপ্টারটি তালেবানের রকেট প্রপেলড গ্রেনেড (RPG) দ্বারা ভূপাতিত হয়! এতে ভেতরে থাকা পাইলট, ক্রুসহ আটজন আর্মি স্পেশাল অপারেশন এভিয়েশন সদস্য ও আটজন নেভি সিল কমান্ডো সাথে সাথে নিহত হন। মার্কোস লুট্রেল নামক সেই আহত সিল সেনার সাথে বাকি হেলিকপ্টারগুলো যোগাযোগ করতে না পেরে ফিরে যায়।
![](https://assets.roar.media/assets/mfGHGelOODxtTLfI_1381px-Navy_SEALs_in_Afghanistan_prior_to_Red_Wing.jpg)
তাকে গুলাব খান একজন হৃদয়বান আফগানি ব্যক্তি মেহমান হিসেবে আশ্রয় দেয়। আহমাদ শাহ আমেরিকান সেনাকে হস্তান্তর/হত্যা করতে চাপ দিলে গুলাব খান তা করতে অস্বীকৃতি জানান (আফগানিরা জীবনবাজি রেখে মেহমান সমাদরের জন্য বিখ্যাত)।
পরবর্তীতে এই অপারেশনের একমাত্র জীবিত নেভি সিল মার্কোস লুট্রেল উদ্ধার হন। এই ঘটনায় হামলার ভিডিও প্রকাশ করে এবং সিল সেনাদের অস্ত্র ও অত্যাধুনিক ইকুইপমেন্ট হস্তগত করে আহমাদ শাহের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। পরের মাসে তাকে ধরতে ‘অপারেশন হোয়েলারস’ পরিচালনা করা হয়। এতে আহমাদ শাহ আহত হয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যান। তিন বছর পর, ২০০৮ সালে পাকিস্তানি পুলিশের সাথে গোলাগুলিতে তিনি নিহত হন। সাংবাদিক প্যাট্রিক রবিনসন পরবর্তীতে মার্কোস লুট্রেলের দেয়া সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে Lone Survivor নামে একটি বই প্রকাশ করেন। উক্ত বইয়ের উপর ভিত্তি করে ২০১৩ সালে একই নামে একটি মুভি নির্মিত হয় যেখানে লুট্রেলের তিন সঙ্গী নিহতের ঘটনা ছাড়াও হেলিকপ্টার ভূপাতিত হওয়ার ঘটনাটির দৃশ্যায়ন ঘটানো হয়েছে।
![](https://assets.roar.media/assets/Ox1LtIBMaVtRkBrl_lon.jpg)
২০১১ সালের চিনুক হেলিকপ্টার শুটডাউন
৬ আগস্ট, ২০১১। আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের দক্ষিণ-পশ্চিমে ওয়ার্দাক প্রদেশের ট্যাঙ্গি ভ্যালিতে জয়েন্ট স্পেশাল অপারেশন কমান্ড (JSOC) এর অন্তর্গত ৭৫ তম রেঞ্জার রেজিমেন্টের একদল সৈনিক তালেবানদের উপর হামলা করতে গিয়ে দ্বিধায় পড়েছে। তাদের রিএনফোর্সমেন্টের আবেদনে সাড়া দিয়ে টেকঅফ করলো CH-47D Chinook হেলিকপ্টার। ভেতরে কুইক রিয়েকশন ফোর্স (QRF) এর সেনা ও ক্রু মিলিয়ে মোট যাত্রী ৩৮ জন।
অদ্ভুত ডিজাইনের এই আকাশযানটি নিয়ে আগে কিছু বলে নেয়া যাক। হেভি লিফট ইউটিলিটি হেলিকপ্টারটি মূলত যুদ্ধক্ষেত্রে সেনা ও রসদ সাপ্লাই এর কাজ করে। ৯৮ ফুট লম্বা হেলিকপ্টারটি ৩৩-৫৫ জন সেনা অথবা প্রায় ১১ টন রসদ বহন করতে পারে। এতে কোনো অস্ত্র নেই, প্রয়োজন হলে ডোর মাউন্টেড হেভি মেশিনগান বা গ্রেনেড লঞ্চার লাগানো হয়। MH-47 মডেলের চিনুক হেলিকপ্টারগুলো স্পেশাল ফোর্সের সেনাদের অপারেশনের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত। এতে দড়ি বেয়ে সেনা নামানো ও মাঝ আকাশে ট্যাংকার বিমান থেকে জ্বালানি তেল সংগ্রহের সুবিধা যুক্ত করা হয়েছিল।
এই মিশনে ব্যবহৃত হেলিকপ্টারটির রেডিও কলসাইন ছিল এক্সটর্শন ওয়ান-সেভেন। যাত্রীদের মধ্যে ছিল ২৩ জন ইউএস নেভি সিল সদস্য, ইউএস এয়ারফোর্সের একজন প্যারা রেসকিউ কমান্ডো ও কমব্যাট কন্ট্রোল টিমের একজন সদস্য। হেলিকপ্টারের একজন পাইলট এবং দুজন ক্রু ছিল ইউএস আর্মির। অপর পাইলট ও আরেকজন ক্রু ছিলেন আর্মি ন্যাশনাল গার্ডের (এটি মূলত রিজার্ভ ফোর্স)। এছাড়া আফগান ন্যাশনাল সিকিউরিটি ফোর্সের সাতজন সদস্য এবং একজন কমব্যাট ইন্টারপ্রেটার (অনুবাদক)। কমান্ডোদের একজন চার পেয়ে সঙ্গী ছিল। এটি একটি প্রশিক্ষিত সামরিক কুকুর।
![](https://assets.roar.media/assets/6XlS7CiN5PvXNn4n_imgonline-com-ua-twotoone-ECudGoYnhGtwEwh.jpg)
![](https://assets.roar.media/assets/SwVqLguuNfPbZzZO_ch47.jpg)
প্রেক্ষাপট
মূল ঘটনায় যাওয়ার আগে একটু পেছনের ঘটনায় চোখ বুলাতে হবে। ২০০৯ সালের মার্চে ট্যাঙ্গি ভ্যালিতে তালেবানদের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় ১০ম মাউন্টেন ডিভিশনের ঘাঁটি স্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্র। আফগান ন্যাশনাল পুলিশের সাথে মিলে তিন দিন ধরে অভিযান চালায় যুক্তরাষ্ট্র-ফ্রান্স। ২০১১ সালের এপ্রিলে ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ আফগান কর্তৃপক্ষের কাছে ছেড়ে দিয়ে মার্কিনিরা এলাকা ত্যাগ করে। কিন্তু আফগান সরকার ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ নেয়নি। ফলে কোয়ালিশন ফোর্সের এলাকা ত্যাগের খবর পেয়েই তালেবান সেটি দখল করে নেয়।
যুক্তরাষ্ট্র এই এলাকায় হেলিকপ্টারের মাধ্যমে স্পেশাল ফোর্স পাঠিয়ে নিয়মিত অপারেশন চালাত। তবে মিশনগুলো ছিল খুবই কঠিন। যেমন ৮ জুন, ২০১১ সালে ৫টি মিশনে চিনুক হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে ১৪ বার আরপিজি ফায়ার করা হয়! প্রতিবারই বেঁচে যায় মার্কিনিরা। তাই ট্যাঙ্গি ভ্যালিতে বড় ধরনের অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এছাড়া মাওলানা ক্বারী তাহির নামক একজন সিনিয়র তালেবান নেতা এই এলাকায় আছেন বলে খবর পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছা ছিল তাকে জীবিত গ্রেফতার করা, একান্ত বাধ্য না হলে হত্যা না করা। ৫ আগস্ট, ২০১১ সালের রাত সাড়ে দশটায় ৪৭ জন ইউএস আর্মি রেঞ্জার দুটো চিনুক হেলিকপ্টারে করে ঘাঁটি ত্যাগ করে। (এদের একটি হেলিকপ্টারই পরবর্তীতে ভূপাতিত হয়) ২০ মিনিট ফ্লাইটের পর চিনুক দুটো মিশন এলাকায় পৌঁছে যায়। রেঞ্জারদের নামিয়ে দিয়ে তারা ঘাঁটিতে ফিরে আসে।
![](https://assets.roar.media/assets/F5hTh4zPvrTpR4yZ_imgonline-com-ua-twotoone-bfeewfcS82.jpg)
ভেতরে সিল ও আফগান সেনা এবং তাদের বেরিয়ে আসার মুহূর্ত (নিচে); Image Source : chinook234.com
ক্বারী তাহিরের অনুসারী সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। মার্কিন বিরোধী যুদ্ধে তিনি তালেবানদের একটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তাছাড়া রাত্রিকালীন এই মিশনটি ছিল হাই রিস্ক অপারেশন (HRO)। তাই দুটো AH-64 Apache এট্যাক হেলিকপ্টার ও AC-130 গানশিপের পাশাপাশি ড্রোন দিয়ে তাদেরকে সার্ভেইলেন্স সাপোর্ট দেয়া দেয়া হয়। ১৭ জন ইউএস নেভি সিল কমান্ডো ঘাঁটিতে রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে অপেক্ষা করছিলেন। এখানে জেনে রাখা ভালো যে, HRO টাইপের সামরিক অপারেশনে কোনো টিম পাঠানো হলে কমান্ড সেন্টার কুইক রিয়েকশন ফোর্স (QRF) হিসেবে একদল সৈনিক রিজার্ভে রাখে যেন জরুরি প্রয়োজনে প্রথম সৈনিক দলকে দ্বিতীয় দল সাহায্য করতে পারে।
রেঞ্জাররা ক্বারী তাহিরের সম্ভাব্য লোকেশন ঘিরে ফেলে। ড্রোন সার্ভেইলেন্স বলছে উক্ত কম্পাউন্ডে বেশ কয়েকজন মানুষ রয়েছে। রাতের মধ্যেই সেখানে আরো কয়েকজন যোগ দেয়। এরই মধ্যে রাত সাড়ে এগারোটায় একটি এপাচি উক্ত কম্পাউন্ডের ৪০০ মিটার উত্তরে আটজন তালেবান যোদ্ধার একটি ছোটদলকে শনাক্ত করে মিসাইল হামলা চালিয়ে ছয়জনকে হত্যা করে। এরই মধ্যে ড্রোন থেকে কম্পাউন্ডে ৮-৯ জন অস্ত্রধারীর উপস্থিতি কনফার্ম করা হয় যাদের একজন ক্বারী তাহির!
রাত একটায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তারা নেভি সিল কমান্ডোদের সাথে একযোগে হামলা শুরু করবে। ১:৫০ মিনিটে এভিয়েশন ব্রিগেড কমান্ডার সিল সেনাদের নতুন ল্যান্ডিং জোন নির্ধারণ করেন। এটি আগে মিশনে রেঞ্জারদের জন্য নির্ধারিত হলেও ব্যবহার করা হয়নি। তবে সার্ভেইলেন্স বিমান/ড্রোন দিয়ে দ্বিতীয়বার চেক করাও হয়নি। রাত ২:২৩ মিনিটে দুটো চিনুক হেলিকপ্টার টেকঅফ করে। ১৭ জন রিজার্ভ সিল সেনার সাথে আরো ৬ জন অফ ডিউটি নেভি সিল যোগ দেয়। এছাড়া অন্যান্য আফগান ও মার্কিন সেনা মিলিয়ে QRF টিমের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩৩ জনে।
সিল কমান্ডোরা সাধারণত এভাবে অন্য বাহিনীর সাথে মিলে অপারেশন চালায় না। তবে ব্যাকআপ ফোর্সের যেন আবার ব্যাকআপ না লাগে সেজন্য এই আয়োজন। তালেবানদের আরপিজি হামলার কথা চিন্তা করে সবাইকে একটি হেলিকপ্টারে ওঠান হয়। অপর খালি হেলিকপ্টারটি ডিকয় হিসেবে আগে আগে ল্যান্ডিং জোনের আশেপাশে ঘুরঘুর করবে যেন তালেবানরা আরপিজি ফায়ার করলে সৈন্যবিহীন হেলিকপ্টারেই করে।
![](https://assets.roar.media/assets/UIiNtGyl9qWZ4XhC_imgonline-com-ua-twotoone-xDpcKMWMrfJkk.jpg)
এদিকে এপাচির হামলার খবর পেয়ে সোয়া দুটোয় তালেবানরা দু’ভাগে ভাগ হয়। তিনজন কম্পাউন্ডের সামনের দিকে গাছের নিচে পজিশন নেয়। বাকিরা টার্গেট কম্পাউন্ডের পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে প্রায় দুই কি.মি. দূরে আরেকটি ভবনে প্রবেশ করে। দুটো এপাচি হেলিকপ্টার তাদেরকে অনুসরণ করতে শুরু করে হারিয়ে ফেলে। তারা টার্গেট খুঁজে পেতে আকাশে চক্কর দিতে শুরু করে। ফলে তারা চিনুক দুটো ল্যান্ড করার সময় প্রয়োজনীয় সার্ভেইলেন্স সাপোর্ট দিতে পারবে না।
উল্লেখ্য, এপাচি হেলিকপ্টারে উন্নত নাইটভিশন ও ইনফ্রারেড প্রযুক্তি থাকায় এটি অনেক দূর থেকে মানুষ শনাক্ত করতে সক্ষম ছিল। এই ঘটনার ছয় মিনিট পর সৈন্যবিহীন প্রথম চিনুক হেলিকপ্টারটি ডিকয় হিসেবে সামনের দিকে এগোতে শুরু করে যেন তালেবানরা একে টার্গেট করে। অপর হেলিকপ্টারটি ল্যান্ডিং ও নেভিগেশন লাইট বন্ধ রাখে এগিয়ে যায় যেন রাতের আকাশে এই হেলিকপ্টারটি দেখা না যায়। একটু আগে রেঞ্জারদের ল্যান্ড করানোর সময় এটি দক্ষিণ দিক থেকে এসেছিল, এবার এসেছে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে। ফলে অন্ধকারে হেলিকপ্টার ল্যান্ড করানো চ্যালেঞ্জিং হলেও পাইলট কিছুটা সুবিধা পান। তিনি ধীরে ধীরে ১০০-১৫০ ফুট উচ্চতায় নেমে আসেন এবং স্পিড কমিয়ে ৫০ নট (৯৩ কি.মি./ঘন্টা) করে ফেলেন। রাত ২:৩৮ মিনিটে হঠাৎ করে মিসাইল ওয়ার্নিং রিসিভার বিপদ সংকেত বাজাতে শুরু করে। একটু আগেই পিছু হটা সেই তালেবান টিম হেলিকপ্টারের ২২০ মিটার দক্ষিণ দিকে দোতলা ভবনের ছাদ থেকে একযোগে ২/৩ টি আরপিজি ফায়ার করে!
![](https://assets.roar.media/assets/Xsmuqer1d3DOzvym_rpg.jpg)
এটি একটি আনগাইডেড ওয়েপন। ফলে পাইলট ফায়ারিং লাইন থেকে সামান্য সরে যাওয়াতে সেটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। দ্বিতীয়টি কপ্টারের পেছনের রোটর ব্লেডে আঘাত করে। ফলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চরকির মতো পাক খেতে শুরু করে চিনুক হেলিকপ্টারটি। ৫ সেকেন্ডের মধ্যেই এটি মাটিতে আছড়ে পড়ে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। এতে হেলিকপ্টারের পাইলট-ক্রু-সিল সেনাসহ সকলেই ঘটনাস্থলে নিহত হন! হেলিকপ্টার ভূপাতিত হয়েছে শুনে রেঞ্জাররা নিজেরাই অপারেশন শুরু করে। ছয় মিনিটের মধ্যে পুরো কম্পাউন্ড সার্চ করে বেশ কয়েকজন আফগানি বেসামরিক গ্রেফতার শেষে ক্র্যাশ সাইটের দিকে পায়ে হেঁটে রওনা দেয়।
এপাচি হেলিকপ্টারগুলো ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে ঘটনাস্থলের আকাশে উদয় হলেও আরপিজি ফায়ার করা তালেবান দলটিকে খুঁজে পায়নি। ক্বারী তাহির পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। ভোর সোয়া চারটায় রেঞ্জাররা ক্র্যাশ সাইটে পৌঁছে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া সিল সেনাদের লাশ বাদে কিছুই পায়নি। এর বিশ মিনিট পর মার্কিন বিমানবাহিনীর একটি পাথফাইন্ডার টিম (যারা ভূপাতিত হওয়া বিমান/পাইলট উদ্ধারকাজে দক্ষ) সেখানে পৌঁছায়। পরদিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত সিল সেনাদের দেহাবশেষ উদ্ধারের কাজ চলে। হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারের কাজ ৯ আগস্ট পর্যন্ত চলে। তালেবান মুখপাত্র এই অপারেশনে তাদের আটজন সদস্য নিহত হওয়ার পাশাপাশি হেলিকপ্টার ভূপাতিত করার ঘটনা ফলাও করে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্র তার আগেই সংবাদটি ছোট্ট করে সংবাদ সম্মেলন করে সেটি স্বীকার করে। তবে উক্ত হেলিকপ্টারে ব্ল্যাকবক্স (ফ্লাইট ডাটা ও ককপিট ভয়েস রেকর্ডার) ছিল না বলে হাস্যকর দাবি করা হয়।
![](https://assets.roar.media/assets/78nXCAuaqW800Daw_imgonline-com-ua-twotoone-KhSyRvTZL1.jpg)
![](https://assets.roar.media/assets/CLGggOdDpwiTWvbW_imgonline-com-ua-twotoone-2uaqJLne1YCy.jpg)
এই ঘটনায় বেশ কিছু ষড়যন্ত্র তত্ত্ব শোনা যায়। উক্ত নেভি সিল সেনাদের বেশিরভাগই তিনমাস আগে ওসামা বিন লাদেন হত্যা মিশনে অংশ নিয়েছিলেন! তাদের স্বজনদের কেউ কেউ বলেন মার্কিন সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে এক্সটর্শন ওয়ান-সেভেনের ফ্লাইট প্যাথ তালেবানের কাছে ফাঁস করে দিয়েছে। কেউ কেউ তথ্য ফাঁসের পেছনে আফগানি সেনারা দায়ী বলে বিশ্বাস করেন। তা না হলে ‘একদম সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে আরপিজি নিয়ে তারা উদয় হলো কীভাবে? ডিকয় হেলিকপ্টারে টার্গেট করা হলো না কেন?’ এ ধরনের প্রশ্ন অনেকেই তুলেছেন।
ইউএস মিলিটারির সেন্ট্রাল কমান্ড এই ঘটনাকে তালেবানের একটি ‘Lucky Shot‘ হিসেবে বর্ণনা করেছে। তবে গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে জানা যায়, ক্বারী তাহির তার মিটিং নিয়ে ভুয়া সংবাদ ছড়িয়ে ফাঁদ পেতে ছিলেন। তিনি পাহাড়ের দুই দিকে আরপিজিসহ একাধিক তালেবান সদস্য মোতায়েন করে হেলিকপ্টারের আগমনের জন্য অপেক্ষা করতে বলেন। এই ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা ২০০৫ সালের ঘটনাকে ছাড়িয়ে যায়। এক্সটর্শন ওয়ান-সেভেন শুটডাউন আফগানিস্তান যুদ্ধে আজ অবধি একক ঘটনায় সর্বোচ্চ সংখ্যক মার্কিন সেনা নিহত হওয়ার ঘটনা। আবার স্পেশাল ফোর্সের প্রাণহানির দিক দিয়ে এটি বিশ্বের বৃহত্তম ঘটনা। তবে ২০০২ সালে চেচনিয়ান গেরিলাদের মিসাইল হামলায় হেলিকপ্টার ভূপাতিত হয়ে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর ১২৭ জন সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনাটি হেলিকপ্টার ভূপাতিত হয়ে প্রাণহানির ঘটনায় বিশ্বে সর্বোচ্চ।