Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

১৯৬৮ সালের ঘটনাবহুল মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

১৯৬০ এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনজীবন ছিল দাঙ্গা, খুন, রাহাজানি এবং সরকারবিরোধী আন্দোলনে জর্জরিত। কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া দশকটি শেষ হয়েছিল ভিয়েতনামে মার্কিন যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ১৯৬০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়েও যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের প্রভাব ছিল লক্ষণীয়। কারণ তখনও নাগরিকদের মাঝে সরকারবিরোধী মনোভাব কাজ করছিল। ছোট ছোট দাঙ্গা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এরই মাঝে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র অংশগ্রহণ দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো নাড়িয়ে দেয়। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিসহ নানারকম সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ে দেশটি।

১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা দুই পক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তরুণদের যুদ্ধে যোগদানে প্ররোচিত করাসহ নানারকম কারণে যুব-বিদ্রোহ গড়ে ওঠে শহরগুলোতে। ১৯৬৭ সালে নিউ ইয়র্ক এবং নিউ জার্সিতে এক দাঙ্গায় ২৬ জন তরুণ নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এই অবস্থায় নির্বাচন যত কাছে ঘনিয়ে আসছিল, দেশের সার্বিক অবস্থা ততটাই খারাপ হয়ে উঠছিল। ঐ মুহূর্তে ক্ষমতার পালাবদলই মার্কিন নাগরিকদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারত বলে মনে করতেন সে সময়ের সাংবাদিকেরা। এই সংক্রান্ত সংবাদসমূহ ছাপান হতো তৎকালীন পত্রপত্রিকার প্রথম পাতায়।

ভিয়েতনাম যুদ্ধ; Image Source: Bettmann/Corbis

 

হোয়াইট হাউজে তখনও প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন ডেমোক্রেট নেতা লিন্ডন বি. জনসন। নিউ ইয়র্ক টাইমসের সূত্রমতে, ১৯৬৮ সালের শুরুর দিকে বেশিরভাগ মার্কিন নাগরিক মনে করতেন- রিপাবলিকান নেতা নেলসন রকফেলার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে আনতে পারবেন। অনেক ডেমোক্রেট সমর্থকও এই যুক্তিতে বিশ্বাস করতেন। রকফেলার তখন নিউ ইয়র্কের গভর্নর হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। যদিও রিপাবলিকানদের পক্ষ থেকে মনোনয়ন কাকে দেয়া হবে সেটা নিয়ে বিতর্ক চলছিল দীর্ঘদিন। কারণ রকফেলার ছাড়াও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর রোনাল্ড রেগান ছিলেন মনোনয়ন প্রত্যাশী।

রিপাবলিকানদের দিকে মুখিয়ে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ নাগরিকের জন্য ১৯৬৮ সালের নির্বাচনের বছরটি ছিল খুবই স্মরণীয়। কারণ দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন, কাজের সুযোগ বৃদ্ধি কিংবা জাতীয় নিরাপত্তার মতো বিষয় সেবার ভোটের পার্থক্যে প্রভাব ফেলত। শুধুমাত্র ভিয়েতনাম যুদ্ধ বন্ধ এবং নাগরিক অধিকারের আইনসমূহ বাস্তবায়ন করাই ছিল অধিকাংশ রিপাবলিকান সমর্থকের চাওয়া। দেশের তরুণ সমাজও এই দুটি বিষয়ের পক্ষে ছিল। যার কারণে এই নির্বাচনকে ঘিরে যে উত্তেজনা এবং আগ্রহ তৈরি হয়েছিল সেটি এখন অবধি সংবাদমাধ্যমে আলোচিত হয়। মূলত এই এক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মার্কিনিরা তাদের দেশের নীতিগত ভবিষ্যৎ অনেকটাই পাল্টে দিয়েছিল। আজ আমরা আলোচনা করব ১৯৬৮ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে।

রিপাবলিকান মনোনয়ন গুঞ্জন

মনোনয়ন চূড়ান্ত করার সন্ধিক্ষণে ডেমোক্রেটরা দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ধামাচাপা দিয়ে ভিন্নমত অপসারণে ব্যস্ত সময় পার করছিল। পত্রপত্রিকাসহ জনমানুষের মাঝে উৎসাহ কাজ করছিল রিপাবলিকান প্রার্থীদের নিয়ে। কারণ ডেমোক্রেটদের কারণে শুরু হওয়া ভিয়েতনাম গণহত্যা বন্ধের জন্য মার্কিন নাগরিকদের একাংশ আরো একবার ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতে মোটেও ইচ্ছুক ছিল না। সম্ভবত এই কারণেই দলে প্রার্থীতা নিয়ে ব্যাপক প্রতিযোগিতা হয়।

রোনাল্ড রেগান এবং নিক্সন; Image Source: Bettman Archive/Getty Images

 

রিপাবলিকানদের মধ্যে নাগরিক সমাজে সর্বাধিক পছন্দের ছিলেন রকফেলার। তিনি ছিলেন তৎকালীন বিলিয়নিয়ার তেল ব্যবসায়ী জন ডেভিসন রকফেলারের নাতি। মার্কিন রাজনীতিতে রকফেলার পরিবার যুক্ত ছিল ১৯১০ এর দশক থেকেই। ডেভিসন রকফেলার ছিলেন নীতিগতভাবে লিবারেল রিপাবলিকান। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী পরিবার হিসেবে মার্কিন রাজনীতিতে সে সময় ব্যাপক ক্ষমতাধর ছিল তারা। অন্ততপক্ষে উত্তরাঞ্চলে মোট ভোটের অর্ধেকেরও বেশি পড়ত রিপাবলিকানদের বাক্সে। কারণ রকফেলার পরিবারের কল্যাণে সেখানকার মানুষজন কর্মসংস্থান পেয়েছিল।

কিন্তু তখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি মনোনয়নের ব্যাপারে। কারণ রিচার্ড নিক্সন আরো একবার প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করছিলেন। রিপাবলিকানদের উপরমহলের এই নেতা নিজেকে বেশ ভালো প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করাতে পেরেছিলেন। ১৯৬০ এর নির্বাচনে পরাজয়ের পর তিনি যতটা পিছিয়ে গিয়েছিলেন, ঠিক ততটাই সামনে এগিয়ে আসেন ১৯৬৬ সালে। মূলত সেবার রিপাবলিকান কংগ্রেস প্রার্থীদের হয়ে প্রচারণা চালান নিক্সন যা তার অবস্থান ও ভাগ্য দুটোই বদলে দেয়। তবে এই দুজনের তুলনায় পিছিয়ে ছিলেন মিশিগানের গভর্নর এবং অটোমোবাইল ব্যবসায়ী জর্জ রমনি। তিনি রিপাবলিকান হলেও আদর্শিকভাবে ছিলেন কনজারভেটিভ।

প্রার্থী হিসেবে ম্যাকার্থির উত্থান

কম্যুনিজমের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম খুব দৃঢ়ভাবে যুক্ত নয়। এর কৃতিত্ব অবশ্য ক্যাথলিক শিক্ষক এবং সিনেটর জোসেফ ম্যাকার্থির। রাজনৈতিক জীবনে তিনি তার কর্মের জন্য সুখ্যাতি-কুখ্যাতি উভয়ই অর্জন করেছিলেন। মিনেসোটা স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষকতা ছেড়ে তিনি মার্কিন রাজনীতিতে প্রবেশ করেন ১৯৪৮ সালে। সেবার হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভে নিযুক্ত হন। কংগ্রেসে তিনি সুপরিচিত ছিলেন শ্রমপন্থী উদার প্রকৃতির রাজনীতিবিদ হিসেবে। ১৯৫৮ সালে তিনি সিনেটর হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়লাভ করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন রাজনীতিতে ম্যাকার্থি যুগের সূচনা ঘটে। তিনি একে একে কাজ করেন জন এফ. কেনেডি এবং লিন্ডন জনসন প্রশাসনের পররাষ্ট্র দপ্তরে।

পত্রিকা হাতে ম্যাকার্থি; Image Source: History on the net

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কম্যুনিজমের যে আদর্শ প্রবেশ করেছিল তা শক্তহাতে দমন করেন ম্যাকার্থি। মূলত কম্যুনিজমের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কারণেই তিনি মার্কিন তরুণদের মাঝে কুখ্যাতি লাভ করেন। ১৯৬৮ সালের নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অথচ তরুণ প্রজন্মের নিকট তার গ্রহণযোগ্যতা একেবারেই ছিল না। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে অন্য যেকোনো দলের যেকোনো প্রার্থীর তুলনায় সামর্থ্যপূর্ণ ছিলেন ম্যাকার্থি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রথম ধাপ হিসেবে ১৯৬৮ সালের মার্চ মাসে নিউ হ্যাম্পশায়ারে ক্যাম্পেইন করেন তিনি। কলেজ ছাত্ররা তার পক্ষে প্রচারণা চালায় এবং তিনি সেখানে বক্তৃতা দেন। যদিও ম্যাকার্থি তার বক্তৃতায় বরাবরই আক্রমণাত্মক ছিলেন এবং প্রচণ্ড রিপাবলিকান বিরোধী কথাবার্তা বলতেন।

রবার্ট এফ. কেনেডির ঘোষণা

ডেমোক্রেট মনোনয়ন দৌড়ে নিউ হ্যাম্পশায়ারের নির্বাচনে দুই প্রার্থীর মধ্যে ৪৯ শতাংশ ভোটে এগিয়ে ছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন। যদিও ম্যাকার্থিকে যতটা পিছিয়ে থাকবে বলে ধরে নেয়া হয়েছিল ততটাও পিছিয়ে ছিলেন না। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ ভোট পান তিনি। মনোনয়ন দৌড়ে না থেকেও এই ভোটাভুটিতে সবচেয়ে বেশি লালসার শিকার হন সিনেটের রবার্ট এফ. কেনেডি। এই ভোটাভুটির পর শুক্রবারে ক্যাপিটল হিলে এক সংবাদ সম্মেলনের ডাক দেন তিনি। সেখানেই আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি ডেমোক্রেট দলের মনোনয়ন দৌড়ে নিজেকে যুক্ত করবেন বলে ঘোষণা দেন।

প্রচারণায় রবার্ট কেনেডি; Image Source: WALTER J. ZEBOSKI/AP/REX/Shutterstock

 

শুধুমাত্র প্রার্থীতা ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হননি রবার্ট কেনেডি। বরঞ্চ এগিয়ে থাকা প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসনের তীব্র সমালোচনা করেন। জনসন প্রশাসনের কার্যক্রমকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিপর্যয়কর এবং বিভ্রান্তিকর বলে উল্লেখ করেন। সেই সাথে তিনটি প্রাইমারির ভোটাভুটিতে তিনি ম্যাকার্থির প্রতি সমর্থন দেবেন বলেও জানান। এতে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে ডেমোক্রেট পার্টি। দল থেকে অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে পড়ে পরবর্তীতে রবার্ট কেনেডি প্রেসিডেন্ট জনসনের পক্ষে কথা বলার প্রতিশ্রুতি দেন। বিনিময়ে তাকে ডেমোক্রেট পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিতে হবে বলেও দাবি করেন।

প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসনের প্রার্থীতা প্রত্যাহার

নিউ হ্যাম্পশায়ার প্রাইমারিতে জয়ের পর রবার্ট কেনেডির প্রার্থীতা ঘোষণার বিষয়টি তেমন প্রভাব ফেলেনি প্রেসিডেন্ট জনসনের কার্যক্রমে। কারণ তিনি তখনও পুরোপুরি মনোযোগী ছিলেন ভিয়েতনাম যুদ্ধের দিকেই। শুধু তিনিই নন, হোয়াইট হাউস তখন কর্মব্যস্ত ভিয়েতাম যুদ্ধ ঘিরে। অতঃপর, ১৯৬৮ সালের ৩১ মার্চ তারিখে জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণে ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বোমা হামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন তিনি। প্রথম ঘোষণার পরেই জনসন জানান তিনি ডেমোক্রেট পার্টির মনোনয়ন দৌড় থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছেন। প্রথম তথ্যের চেয়েও দ্বিতীয় তথ্যটি মোটামুটি পুরো বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল।

প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন; Image Source: Bob Daugherty/AP

 

জনসনের এমন সিদ্ধান্ত সম্পর্কে পরদিনের পত্রিকায় লিখেছিলেন বিখ্যাত সাংবাদিক ওয়াল্টার ক্রোনকাইট। তার ভাষ্যমতে, প্রেসিডেন্ট জনসন বুঝতে পেরেছিলেন ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ অযৌক্তিক ছিল। যার ফলে তার প্রশাসনের অনুমতিতে ঘটা বোমা হামলার দায় সম্পূর্ণ নিজের কাঁধে নিতে চেয়েছিলেন জনসন। প্রকৃতপক্ষে, এখানে ওয়াল্টার ক্রোনকাইট ছিলেন মূলধারার মার্কিন মতবাদের প্রতিনিধি।

রবার্ট কেনেডি; Image Source: times.com

 

ততদিনে জনসন এবং কেনেডির মধ্যকার মতপার্থক্য, বিদ্বেষ জনসম্মুখে এসে পড়ে। আর এরই মাঝে ভিয়েতনামে বোমা হামলার ঘটনায় মার্কিন নাগরিকদের নিকট জনসনের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পেতে থাকে। এমতাবস্থায় প্রচারণায় গেলে ক্যালিফোর্নিয়া এবং ওরেগোনে বেশ ভালো জনসমর্থন পান রবার্ট কেনেডি। বয়সে ছোট এবং প্রফুল্ল কেনেডির জনসমর্থন একটু হলেও প্রেসিডেন্ট জনসনের মনে নাড়া দিয়েছিল। কারণ ততদিনে শারীরিকভাবে অনেকটাই ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। জনসনের পরিবারের সদস্যরা চেয়েছিলেন তিনি রাজনৈতিক জীবন থেকে ইস্তফা দিক। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তখন এমন গুঞ্জনও রটে।

হত্যাযজ্ঞের মৌসুম

একদিকে চলছিল ডেমোক্রেট পার্টির মনোনয়ন নিয়ে ভোটাভুটি, অন্যদিকে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা নানাভাবে নিজেদের অধিকারসমূহ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাস্তবায়নের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট জনসন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না এমন ঘোষণা দেয়ার এক সপ্তাহের মাথায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আবারও দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। দেশটির কৃষ্ণাঙ্গ নেতা, মার্টিন লুথার কিং ঐ সপ্তাহে টেনেসিতে এক হোটেলে অবস্থান করছিলেন। ৪ এপ্রিল তারিখ সন্ধ্যায় তিনি হোটেলের ব্যালকনিতে পায়চারী করছিলেন। এমন সময় একজন বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন তিনি।

মার্টিন লুথারের মরদেহ; Image Source:Charles Kelly/Associated Press

 

দেশের এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে মার্টিন লুথার কিংয়ের মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত নেতাকর্মীরা। নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটনসহ বেশ কিছু বড় শহরে আন্দোলন শুরু হয়। দাঙ্গার ফলে ব্যাপক হতাহতের ঘটনাও ঘটে। যদিও থেমে থাকেনি ডেমোক্রেট পার্টির মনোনয়ন নিয়ে ভোটাভুটির কার্যক্রম। এর পরের দুই মাসে ক্যালিফোর্নিয়াসহ কয়েকটি প্রাইমারিতে ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যদিও প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যাকার্থির ৬ প্রাইমারির বিপরীতে রবার্ট কেনেডির জয়ী প্রাইমারির সংখ্যা ছিল ৪টি।

১৯৬৮ সালের ৪ জুন রবার্ট কেনেডি ক্যালিফোর্নিয়া প্রাইমারিতে জয়ী হন। সেদিন রাতে তিনি তার সমর্থকদের সঙ্গে হোটেলে বিজয় উদযাপন করেন। হোটেল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় একজন অস্ত্রধারী ব্যক্তি তাকে হোটেলের রান্নাঘরে নিয়ে যায়। দুজনের মধ্যে ধ্বস্তাধস্তির একপর্যায়ে মাথার ঠিক পেছনে গুলিবিদ্ধ হন রবার্ট কেনেডি। গুলিবিদ্ধ হয়েও ২৫ ঘন্টা বেঁচে ছিলেন তিনি। মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ নিউ ইয়র্কে নিয়ে যাওয়া হয় শেষকৃত্য সম্পাদনের জন্য। কারণ তিনি নিউ ইয়র্কের সিনেটর ছিলেন। সেখান থেকে মরদেহ নেয়া হয় ওয়াশিংটনে। সেখানে তার ভাই, সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডির পাশে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। ওয়াশিংটনের আর্লিংটন ন্যাশনাল সিমেট্রিতে সেদিন হাজারো মানুষের সমাগম হয়েছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে ডেমোক্রেটদের মনোনয়ন দৌড় থেকে রবার্ট কেনেডি বাদ পড়েন।

মার্কিন সাংবাদিকদের মতে, রবার্ট কেনেডিকে হত্যার মধ্য দিয়ে ডেমোক্রেট পার্টির মনোনয়ন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শেষ হয়। শোকগ্রস্ত ডেমোক্রেট নেতারা তখন আর প্রাইমারিগুলোর জনপ্রিয়তা বা ফলাফলের উপর নির্ভর করতে রাজি হননি। বরঞ্চ পার্টির উপরমহল থেকে মনোনয়ন প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। কম্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে সর্বদা আক্রমণাত্মক বক্তৃতা দেয়া ম্যাকার্থি মনোনয়ন-বঞ্চিত হন। ডেমোক্রেট পার্টির পক্ষ থেকে হুবার্ট হামফ্রেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেট দলের মনোনয়ন দেয়া হয়। জন এফ. কেনেডি এবং জনসন প্রশাসনের হয়ে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কাজ করা ম্যাকার্থির অনানুষ্ঠানিক পতন ঘটে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তার লাগাম টেনে ধরা দরকার ছিল মার্কিন রাজনীতির স্বার্থে।

তৃতীয় প্রতিদ্বন্দ্বীর আবির্ভাব

ততদিনে রিপাবলিক পার্টিও মনোনয়ন চূড়ান্ত করে ফেলে। দলের পক্ষ থেকে মনোনয়ন পান সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। এছাড়াও তার রানিংমেট হিসেবে তিনি বেছে নেন স্পিরো অ্যাগ্নিওকে। স্পিরো তখন তার জন্মস্থান মেরিল্যান্ডের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। অন্যদিকে ডেমোক্রেট পার্টির মনোনয়নপ্রাপ্ত হুবার্ট হামফ্রে রানিংমেট হিসেবে বেছে নেন এডমুন্ড মুস্কিকে। তিনি ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সেক্রেটারি অব স্টেট। কিন্তু এখানেই শেষ হয়নি প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ইন্ডিপেন্ডেন্ট হিসেবে সাবেক এক ডেমোক্রেট পার্টির গভর্নরের আবির্ভাব ঘটে।

জর্জ ওয়ালেস; Image Source: Bettmann Archive/Getty Images

 

জর্জ ওয়ালেস ছিলেন আলবামার গভর্নর। যদিও তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিচিতি পেয়েছিলেন এর ৫ বছর আগে। শ্বেতাঙ্গ এই নেতা বরাবরই কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের বিরুদ্ধাচরণ করতেন। তিনি আলবামা ইউনিভার্সিটিতে কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রদের সীমিতকরণ করার মধ্য দিয়ে কুখ্যাতি অর্জন করেন। আর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঢাল হিসেবে তিনি নাগরিক অধিকার আন্দোলন এবং কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন শুরু করেন। তার পক্ষ নেয় দক্ষিণাঞ্চলীয় শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত রাজ্যগুলো। ইন্ডিপেন্ডেন্ট হিসেবে মনোনয়ন নিয়ে তিনি তার রানিংমেট হিসেবে বেছে নেন সাবেক বিমান বাহিনীর কমান্ডার কার্টিস লেমায়কে। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান বাহিনীর উপর বিমান হামলার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এছাড়াও জাপানে পারমানবিক বোমা হামলায় সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের মাঝে তিনি ছিলেন অন্যতম।

মূল নির্বাচনী প্রচারণা

প্রার্থিতা নিশ্চিত হওয়ার পর সবাই নিজ নিজ প্রতিশ্রুতি মার্কিন নাগরিকদের মাঝে পৌঁছে দিতে নেমে পড়েন। ডেমোক্রেট প্রার্থী হামফ্রে শুরু থেকেই প্রেসিডেন্ট জনসনের নীতিকে সমর্থন জানাতে শুরু করেন। বলতে গেলে, জনসন প্রশাসনের বাকি থাকা কাজগুলোকে নিজের কাজ হিসেবে উল্লেখ করতে থাকেন। হামফ্রে বিভিন্ন ক্যাম্পেইনে ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিনিদের তৎপরতা আরো বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি দেখান। অন্য দিকে রিপাবলিকান প্রার্থী রিচার্ড নিক্সনের প্রতিশ্রুতি ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের ‘সম্মানজনক সমাপ্তি’।

ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টি; Image Source: Stock Montage/Getty Images

 

যদিও নিক্সনের প্রচারণায় ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো সময়ের উল্লেখ ছিল না। বরঞ্চ তিনি শান্তিপূর্ণ সমাপ্তি ঘটিয়ে সেখানে মার্কিন বলয় ধরে রাখার মতো অস্পষ্ট একটি বিষয় প্রচার করছিলেন যাতে অনেক মার্কিন নাগরিক সমর্থন জানায়। যদিও অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে একে অপরের বিপরীতে মতামত জানান তারা। হামফ্রে ‘গ্রেট সোসাইটি’ উদ্যোগেই সীমাবদ্ধ ছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট জনসনের এই উদ্যোগকে শুধুমাত্র নতুনত্ব দেয়ার বিষয়ে প্রতিজ্ঞা করেন। অন্য দিকে, দেশে বছরের পর যাবত চলমান দাঙ্গা, অস্থিরতা স্থায়ীভাবে নিরসন করার লক্ষ্যে রিচার্ড নিক্সন আইন প্রয়োগের বিষয়ে গুরুত্ব দিবেন বলে জানান।

সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও রিপাবলিকান এবং ডেমোক্রেট উভয় দলেন জন্যেই মাথাব্যথার কারণ ছিল দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো। কারণ সেখানে ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টির প্রার্থী ওয়ালেসের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। তবে অভিজ্ঞ নিক্সন ঠিকই কৌশলে সেখানকার ভোটারদের একাংশকে রিপাবলিকানদের ক্যাম্পেইনে আনতে পারেন। আর এই কৌশল তাকে নির্বাচনে দারুণ সাহায্য করে। এমনকি ঐ অঞ্চলের অনেক ডেমোক্রেট ভোটারও তখন রিপাবলিকান প্রার্থীদের পক্ষ নিয়েছিল। কারণ যুদ্ধবিগ্রহ থেকেও দেশের শান্তি মোটামুটি বেশিরভাগ মার্কিনিদের প্রত্যাশা ছিল।

রিপাবলিকান পার্টির কনভেনশন; Image source: Pictorial Parade / Staff/Getty Images

 

ওয়ালেসের প্রচারণা ছিল অন্য দুজনের তুলনায় একেবারে ভিন্ন। কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুযোগ কমানোসহ নানারকম উষ্কানিমূলক কথাবার্তা ছড়িয়ে শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের আকৃষ্ট করেছিলেন তিনি। যদিও তার রানিংমেট শেষেদিকে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। যুদ্ধবাজ কমান্ডার কার্টিস লেমায় ভিয়েতনাম যুদ্ধে সমর্থন জানিয়ে সেখানে পারমাণবিক বোমা হামলার পক্ষে বক্তৃতা দেন। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বহির্বিশ্বে ব্যাপক সমালোচিত হন তিনি।

নিক্সনের ঐতিহাসিক বিজয়

১৯৬৮ সালের ৫ নভেম্বর নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়। ৩০১টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট অর্জন করে ৩৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন রিচার্ড নিক্সন। অন্যদিকে, জর্জ ওয়ালেস দক্ষিণাঞ্চলের ৫টি অঙ্গরাজ্যে জয়লাভ করেন। তিনি সর্বমোট ৪৬টি ইলেক্টোরাল ভোট পান। তবে ভালোই ধস নামে ডেমোক্রেট শিবিরে। দলটি ১৯১ ইলেক্টোরাল ভোট পায়। পপুলার ভোটের পার্থক্যে তেমন একটা পিছিয়ে ছিলেন না ডেমোক্রেটরা। তবে শেষেদিকে হোয়াইট হাউসে তখনও দায়িত্বরত প্রেসিডেন্ট জনসনের একটি সিদ্ধান্ত নির্বাচনের ফলাফল বদলে দিয়েছিল বলে ধারণা করেন বিশেষজ্ঞরা।

রিচার্ড নিক্সন; Image Source: varsity.com

 

১৯৬৮ সালের শুরুর দিকে ভিয়েতনামে বোমা হামলা শুরু করে মার্কিন বাহিনী। এই কৌশলটি নির্বাচনে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে বলে ভেবেছিলেন প্রেসিডেন্ট জনসন। তবে কোনো এক অজানা কারণে নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তে বোমা হামলা বন্ধ করে দেয় জনসন প্রশাসন। এতে মোটামুটি অবাক হন হামফ্রে। যদিও প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়ে মারাত্মক ঝামেলার সম্মুখীন হন নিক্সন। নির্বাচনের মাসখানেক পরে ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে মার্কিনিদের মধ্যকার বিভাজন ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায়। এগুলো সামাল দিয়ে ভিয়েতনামে যুদ্ধ বন্ধ করতে মোটামুটি কয়েকবছর সময় নেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন। তবে ডেমোক্রেটদের যুদ্ধবাজ নীতি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নীতিগতভাবে বেরিয়ে আসার যে প্রচেষ্টা ছিল সেটা থেকে অনেকটাই বেরিয়ে আসতে পেরেছিল এই নির্বাচনে রিপাবলিকানদের জয়ের কারণে।

The election of 1968 was bound to be significant. The United States was bitterly divided over the seemingly unending war in Vietnam. A youth rebellion was dominating society, sparked, in large measure, by the draft that was pulling young men into the military and sending them off to the violent quagmire in Vietnam.

Feature Image Source: CSU Archives/Everett Collection

Related Articles