‘ভাইকিং’ শব্দটির উৎপত্তি প্রাচীন নর্স টার্ম ‘ভিকিঙ্গর’ থেকে। ‘ভিকিঙ্গর’ শব্দটির অর্থ জলদস্যু। ভাইকিং বলতে বোঝায় স্ক্যানডিনেভিয়ান পুরুষদের, যারা ইউরোপ, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, রাশিয়া ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতো।
আগে ছোট্ট করে বলে দেয়া ভাল, স্ক্যানডিনেভিয়া অঞ্চলগত প্রধান তিনটি দেশ হচ্ছে সুইডেন, ডেনমার্ক ও নরওয়ে। তবে অনেকেই ওলান্ড দ্বীপপুঞ্জ, ফারো দ্বীপপুঞ্জ, ফিনল্যান্ড ও আইসল্যান্ডকেও স্ক্যানডিনেভিয়ান দেশের কাতারে ফেলেন।
মূল কথায় আসা যাক। টেকনিক্যালি নারীদের ‘ভাইকিং’ হবার অধিকার ছিল না। ১৯৯১ সালে প্রকাশিত ‘ওম্যান ইন দ্য ভাইকিং এজ’ বইয়ের লেখিকা জুডিথ জেশ্চের মতে, ভিকিঙ্গর বলতে বোঝানো হতো স্রেফ পুরুষদের। লম্বা নৌকায় পাল তুলে স্ক্যানডিনেভিয়ান পুরুষরা ছুটে বেড়াতো ব্রিটেন, ইউরোপ, রাশিয়া, উত্তর আমেরিকা আর উত্তর আটলান্টিকের দ্বীপগুলোতে। সময়টা তখন ৮০০-১০০০ খ্রিস্টাব্দ।
দুনিয়াজুড়ে ভাইকিংরা কুখ্যাত তাদের যুদ্ধংদেহী মনোভাব আর মুখোমুখি লড়াইয়ে নিষ্ঠুরতার জন্য। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে, তারা কিন্তু সফল ব্যবসায়ীও ছিল। পৃথিবীব্যাপী ভাইকিংরা আবিষ্কার করেছে বাণিজ্যিক চলাচলের পথ, স্থাপন করেছে বসতি, প্রতিষ্ঠা করেছে বিভিন্ন শহর (উদাহরণ হিসেবে ডাবলিনের কথাই বলা যায়)। শুধু তা-ই না, যেখানেই তাদের জাহাজ পৌঁছাতে পেরেছে, সেখানকার ভাষা আর সংস্কৃতিতেও তাদের প্রবল প্রভাব পড়েছে।
তৎকালীন সমাজে নারীদের ভূমিকা
কিছুদিন আগেও ইতিহাসবিদরা মনে করতেন, দলবেধে জাহাজে করে সমুদ্র পাড়ি দিত কেবল নর্স পুরুষরাই। তবে সম্প্রতি এক গবেষণা বলছে ভিন্ন কথা। ২০১৪ সালে গবেষকরা জানান, তারা মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণ পেয়েছেন, নর্স নারীরাও সমানতালে যোগ দিত সমুদ্রযাত্রায়। ভাইকিং যুগের প্রাক্কালে তারা ইংল্যান্ড, শেটল্যান্ড আর অর্কনি দ্বীপপুঞ্জ ও আইসল্যান্ডে অভিযান চালিয়েছে পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। শুধু তা-ই না, ভিনদেশে এসে বসতি গড়বার সময় মহিলারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আইসল্যান্ডের মতো জনমানবহীন জায়গায় নর্স রমণীরা অবদান রেখেছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বিকাশে।
অন্যান্য সভ্যতার মতো ভাইকিংদের সমাজও ছিল পুরুষ-প্রধান। শিকার, লড়াই, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষিকাজ তারাই করতো, অন্যদিকে নারীরা রান্না-বান্না, ঘর সামলানো ও বাচ্চা-কাচ্চা লালন-পালনে ব্যস্ত থাকত। তবে ভাইকিং যুগের স্ক্যানডিনেভিয়ার নারীদের বেশ কিছু স্বাধীনতা বজায় ছিল। তারা বিষয়-সম্পত্তির মালিক হতে পারত, প্রয়োজনে বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারত, বকেয়া যৌতুক আদায়ও করতে পারত। সাধারণত মেয়েদের ১২-১৫ বছরের মধ্যে বিয়ে দেয়া হতো। বিয়ের সময় পারিবারিকভাবে প্রস্তাব পাঠানো হত, মেয়েদের পছন্দ-অপছন্দ জানাবারও সুযোগ ছিল।
বাইরে লঙ্কাকাণ্ড করে আসলেও গৃহকর্তার উপর খবরদারি ঠিকই ছিল স্ত্রীদের। শিকার বা রেইডের কাজে অনুপস্থিত থাকলে কিংবা অকালে স্বামীর মৃত্যু হলে ঘর চালাবার দায়-দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে দেরি করতো না নর্স রমণীরা। ফার্ম কিংবা ব্যবসা চালাতেও পটু ছিল তারা। ভাইকিং যুগে স্ক্যানডিনেভিয়ান অনেক মহিলাকেই চাবির গোছাসহ কবর দেয়া হতো। ঘরের কর্ত্রী হিসেবে তাদের মৃত্যুর পরেও সম্মান জানানো হত এভাবে।
কেউ কেউ অবশ্য গৃহকর্ত্রী থেকে রূপান্তরিত হয়েছিলেন শাসকে। তবে সেটা হাতেগোণা দুয়েকজন। স্ক্যানডিনেভিয়ায় একবার এক বিশাল কবর খুঁজে পেয়েছিলেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা। কবরটা ছিল ওসবার্গ রানীর। ওসবার্গ হচ্ছে একধরনের ভাইকিং জাহাজ। ৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর পর তাকে মূল্যবান জিনিসপত্রসহ বিশাল এক ওসবার্গের ভেতর ঢুকিয়ে মাটিচাপা দেয়া হয়।
নবম শতাব্দীর শেষদিকে এক নরওয়েজিয়ান সর্দারের মেয়ে অউড দ্য ডিপ-মাইন্ডেড ডাবলিনে ওলাফ দ্য হোয়াইট-কে বিয়ে করে। স্বামী ওলাফ আর একমাত্র ছেলে থোরস্টেইনের মৃত্যুর পর অউড তার সংসারের জিনিসপত্র গুছিয়ে নাতি-নাতনিসহ আইসল্যান্ডের উদ্দেশ্যে জাহাজে চেপে বসেন। পরবর্তীতে আইসল্যান্ডে উপনিবেশ পত্তনকালে তিনি খুবই প্রভাবশালী একজন ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
ঘরের গিন্নি নাকি রণাঙ্গনের সহযোদ্ধা
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নারীরা কি শুধুই ঘর সামলেছে সে যুগে? গুটিকয়েক ঐতিহাসিক দলিলপত্র সাক্ষ্য দেয় যুদ্ধে নারীদেরও ভূমিকা ছিল।
বাইজেন্টাইন যুগের ইতিহাসবিদ জোহানেস কাইলিটযসের লেখা থেকে জানা যায়, ৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বুলগেরিয়ানদের বিরুদ্ধে ভারাঙ্গিয়ান ভাইকিংদের সাথে মিলে নারীরাও হাত রাঙাতে নেমেছিল। এছাড়াও দ্বাদশ শতাব্দীর খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ড্যানিশ ইতিহাসবিদ স্যাক্সো গ্রামাটিকাস লিখে গিয়েছেন অস্ত্র চালনায় পারদর্শী একদল নারী যোদ্ধার কথা। তাদের ডাকা হতো ‘শিল্ডমেইডেন’ নামে। পুরুষদের মতোই বর্ম পরিধান করত তারা, শিখত তলোয়ার চালনা ও অন্যান্য যুদ্ধকৌশল।
শিল্ডমেইডেন লাগার্থা
স্যাক্সো তার জেস্টা ড্যানোরাম নামের ইতিহাস কর্মের নবম বইয়ে লিখে গেছেন লাগার্থা নামের এক দুঃসাহসী শিল্ডমেইডেনের কথা। এখানে উল্লেখ্য, স্যাক্সো লাগার্থা নয়, শিল্ডমেইডেনটির নাম লিখে গেছেন ‘লাথগার্থা’ (কোথাও কোথাও লাডগার্থা কিংবা লাজেরডাও বলা হয়) হিসেবে। কালের পরিক্রমায় ইংরেজি ভাষায় তা রূপ নেয় লাগার্থায়।
জেস্টার বক্তব্য অনুযায়ী লাগার্থার যোদ্ধা জীবনে প্রবেশের শুরুটা হয় সুইডেনের রাজা ফ্রোর হাতে নরওয়েজিয়ান সম্রাট সিওয়ার্ডের হত্যার পর। ফ্রো মৃত রাজপরিবারের নারী সদস্যদের পতিতালয়ে ছুঁড়ে ফেলেন, তাদের মান-সম্মান ধূলিস্মাৎ হতে দেখে পৈশাচিক আনন্দ লাভ করেন তিনি। এই নিষ্ঠুরতার কথা শুনে প্রতিশোধ নিতে ছুটে আসে তৎকালীন দুর্ধর্ষ ভাইকিং যোদ্ধা র্যাগনার লথব্রক। তার এভাবে হুংকার ছেড়ে আসাটা অযৌক্তিক ছিল না। কারণ নিহত সিওয়ার্ড সম্পর্কে ছিল তার দাদা। র্যাগনারের তাঁবুতে এসে সাথে দেখা করে অপমানিত-লাঞ্ছিত নারীদের একটা দল। তারা যোগ দেয় সুইডিশ রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে। আর তাদের বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে লাগার্থা নামের এক অকুতোভয় নারী যোদ্ধা। স্যাক্সোর মুখ থেকেই শোনা যাক,
লাডগার্থা, এক দক্ষ আমাজন। শিল্ডমেইডেন হওয়া সত্ত্বেও তার সাহস কোনো পুরুষের চেয়ে কম ছিল না। সম্মুখ সমরে সে ছিল একমেবাদ্বিতীয়ম, সবাই তার দক্ষতায় প্রবল বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে ছিল। তবে তার পিঠে বাড়ি খেতে থাকা চুল বিশ্বাসঘাতকতা করতো- চটকা ভাঙিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিল এই যোদ্ধা একজন মেয়ে।
যুদ্ধে লাগার্থার পারদর্শিতা দেখে র্যাগনার মুগ্ধ হয়ে যায়। শুধু তা-ই না, মেয়েটি সম্ভ্রান্ত বংশের জানার পর তাকে একান্ত করে পাবার বাসনা জেগে ওঠে তার মাঝে। র্যাগনার লাগার্থার বাসায় একের পর এক বার্তা পাঠাতে থাকে। স্যাক্সো বলেন, লাগার্থা তখন স্রেফ প্রেমে পড়ার ভান করছিল, র্যাগনারকে কামনার ফাঁদে ফেলে ডেকে আনছিল নিজের কাছে। লাগার্থা এসময় একটা উদ্ভট কাজ করে বসে, গলারডাল উপত্যকার (বর্তমানে নরওয়ে) অবস্থিত নিজের বাসায় একটা ভালুক আর কুকুরকে পাহারা বসায়। প্রেমিক-প্রবর আসা মাত্রই ভয়ঙ্কর জন্তু দুটো তাকে ছিঁড়ে ফেলবে। ওদিকে প্রেমে অন্ধ র্যাগনার নিশ্চিন্ত মনে পাড়ি জমায় ভালোবাসার মানুষটির উদ্দেশ্যে, জানে কোনো বাধা নেই তাদের দুজনের মাঝে। আর তখনই বোকা বনে যায় দুই পাহারাদারকে দেখে। তবে র্যাগনারের মতো প্রতাপশালী যোদ্ধার সামনে টিকতে পারেনি প্রাণী দুটো। ভালুকটিকে বর্শা ছুঁড়ে ও কুকুরটিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে সে। আর এভাবেই রক্ত ঝরিয়ে জিতে নেয় প্রিয়তমার মন। তাদের ঘরে জন্ম নেয় একমাত্র পুত্র ফ্রিডলেইফ ও দুই মেয়ে। তবে মেয়েদের নাম সম্পর্কে ইতিহাসবিদরা অবগত নন।
লাগার্থার সাথে নরওয়েতে তিনটি বছর কেটে যায়। এরপর গৃহযুদ্ধ সামাল দেবার জন্য র্যাগনার ডেনমার্কে ফিরে আসে। তবে সে মনে মনে ক্ষুণ্ন হয়েছিল তখনও, লাগার্থা এভাবে ভালুক-কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিল- এটা সে হজম করতে পারছিল না। এরপর স্যাক্সো মনোযোগ দেন র্যাগনারের বীরগাথা বর্ণনায়, যার ফলে কিছুটা চাপা পড়ে যায় লাগার্থার চরিত্র।
একদিন র্যাগনারের সাথে পরিচয় ঘটে গোৎল্যান্ডের আর্ল (সর্দার) হেরড-এর সাথে। হেরডের মেয়ে থোরার অনেকগুলো পোষা সাপ ছিল। একসময় সাপগুলো এত বড় হয়ে যায় যে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না। বিষাক্ত প্রাণীগুলো চারদিকে তাণ্ডব চালাতে শুরু করে। আর্ল হেরড র্যাগনারকে প্রস্তাব দেন- সে যদি এই সাপের সমস্যা বিদেয় করতে পারে, তাহলে নিজের মেয়ে থোরাকে তুলে দেবেন তার হাতে। আর তখনই-
… থোরাকে দেখে তার মনে জেগে উঠল এক অভূতপূর্ব ভালোবাসা, কাছে পেতে চাইল তাকে। লাজেরডার জীবন থেকে সরিয়ে নিল নিজেকে; লাজেরডার উপর কাজ করছিল তার অবিশ্বাস, কারণ র্যাগনার ভোলেনি কীভাবে সে লেলিয়ে দিয়েছিল হিংস্র প্রাণী।
বিষাক্ত সাপের ছোবল থেকে বাঁচতে র্যাগনার পশমী পাজামায় পা মুড়িয়ে নেয়, তারপর তরুণ ফ্রিডলেইফকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে রওনা দেয় সর্পকূল ধ্বংসের উদ্দেশ্যে। সাপের বংশ নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে বিয়ে করে থোরাকে। ছেড়ে আসে প্রথম স্ত্রী লাগার্থাকে।
তবে এসময় পাদপ্রদীপের কিছুটা আড়ালে চলে গেলেও শেষ হয়নি লাগার্থার কাহিনী। র্যাগনারের সাথে বিচ্ছেদ হবার পর সে আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসে, বিয়ে করে স্থানীয় আর্লকে।
থোরাকে নিয়ে সংসার শুরু করতে না করতেই আবারও গৃহযুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠে র্যাগনারের রাজ্যে, এবার দেশের অভ্যন্তরে শত্রুদের প্রতিহত করার জন্য সাহায্য চেয়ে বার্তা প্রেরণ করে সে। আর সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসে তারই প্রাক্তন সহধর্মীনি লাগার্থা। ১২০টা জাহাজ নিয়ে রওনা দেয় সাবেক অর্ধাঙ্গকে যুদ্ধ জিততে সহায়তা করতে। নৌ-বহর নিয়ে পৌঁছে দেখে যুদ্ধে লথব্রক বাহিনীর টালমাটাল অবস্থা; র্যাগনারের সন্তান সিওয়ার্ড গুরুতর আহত, যুদ্ধজয়ের আশা নিভু নিভু প্রায়। তার তখনই ত্রাতা হয়ে আরও একবার মঞ্চে আগমন ঘটে লাগার্থার। যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয় সে প্রবল বিক্রমে।
স্যাক্সো এরপর লাগার্থার কৃতকর্মের ইতি টেনেছেন তার নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়ে। র্যাগনারকে যুদ্ধে সাহায্য শিল্ডমেইডেন নরওয়েতে ফিরে আসে স্বামীর কাছে। একদিন ঝগড়া করার সময় আচমকা কাপড়ের ভেতর লুকানো বর্শার ডগা দিয়ে হত্যা করে তাকে। তারপর প্রয়াত স্বামীর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে আসীন হয় আর্লের আসনে। স্যাক্সো গ্রামাটিকাসের ভাষায় লাগার্থা ছিল ‘অহঙ্কারী নারী।’
দুর্ভাগ্যবশত ইতিহাসবিদরা লাগার্থার মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল তা স্পষ্ট করে জানেন না। ধারণা করা হয় তার জন্ম ৭৯৫ সালে, মৃত্যু নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে।
লাগার্থার ইতিহাস যেমনই রক্তক্ষয়ী আর নিষ্ঠুর হোক, সে ভাইকিং যুগের অন্যতম সেরা যোদ্ধা ছিল- এটা মানতে বাধ্য হবে অনেকেই। তার মতো নিজের গুণ আর সাহসের জোরে এতদূর উঠে আসতে পেরেছিল খুব কম নারীই।
তথ্যের উৎস
ভাইকিং নারী যোদ্ধাদের সম্পর্কে আমরা যা কিছু জানতে পেরেছি তার বেশিরভাগ তথ্যের উৎসই হচ্ছে নর্স সাহিত্যকর্ম (দ্য সাগা অফ র্যাগনার লথব্রক, দ্য টেল অফ র্যাগনার’স সনস, দ্য পোয়েম অ্যাবাউট র্যাগনার, দ্য ডেথ-সং অফ র্যাগনার লথব্রক)।
প্রাচীন নর্স পুরাণে ভ্যালকেরি নামের আরেকদল নারী যোদ্ধার কথা শোনা যায়, যাদের চরিত্রের উৎপত্তি হয়েছিল শিল্ডমেইডেনদের থেকে। নর্স পুরাণ থেকে জানা যায় ভ্যালকেরিরা ঠিক করতো কে মারা যাবে যুদ্ধক্ষেত্রে আর কে বেঁচে ফিরবে। তারপর মৃতদের অর্ধেককে তারা নিয়ে যেত ভালহাল্লায় আর বাকি অর্ধেক যেত দেবী ফ্রেয়ার কাছে।
ভালহাল্লা হচ্ছে যুদ্ধে নিহত সৈন্যদের উৎসব করবার হলঘর, যেখানে রাজত্ব করেন স্বয়ং ওডিন। ভালহাল্লায় পৌঁছে যাওয়া যোদ্ধাদের ডাকা হয় এনহেরেয়ার নামে। ভালহাল্লায় পানরত এনহেরেয়ারদের মদ পরিবেশন করে ভ্যালকেরিরা। র্যাগনারক তথা নর্স পুরাণ অনুযায়ী পৃথিবী ধ্বংস হবার আগপর্যন্ত এভাবেই উল্লাসে মেতে থাকবে তারা।
লাগার্থাদের উপস্থিতি প্রমাণিত হলো যেভাবে
স্যাক্সোর লেখা জেস্টা ড্যানোরাম আর কয়েকটি নর্স-গাথা ছাড়া বৈজ্ঞানিকভাবে যোদ্ধা মহিলাদের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়নি কিছুদিন আগেও। আগের যুগে ইতিহাসবিদরা সম্ভবত পুরুষ জাতিকে বড় করে দেখাবার মানসিকতা ধারণ করতেন বলেই অবহেলা করে গেছেন নারীদের ভূমিকা প্রমাণে। তবে দৃশ্যপট বদলে গেছে এখন।
সুইডিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ ইয়ালমার স্টোপল ১৮৮৯ সালে সুইডেনের বিরকা শহরে একটি কবর আবিষ্কার করেন। তখন ইয়ালমার খুব একটা মাথা ঘামাননি কবরটি নিয়ে। কারণ বিরকা শহরটি তৎকালীন ভাইকিংদের পদচারণায় মুখর ছিল। ইয়ালমারের দল ভেবে নিয়েছিল কঙ্কালটি আর কোনো উঁচু পর্যায়ের পুরুষ যোদ্ধার শেষ আশ্রয় হবে। তবে এই ধারণায় ধাক্কা লাগে ২০১৭ সালে। স্টকহোম ও আপসালা ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক উক্ত কবর থেকে পাওয়া কঙ্কালের দাঁত ও বাহু থেকে সংগৃহীত ডিএনএ’র নমুনা পরীক্ষা করে ওয়াই ক্রোমোজমের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন। আর এভাবেই ইয়ালমারের ‘পুরুষ যোদ্ধার কবর’ থিওরিকে ভুল প্রমাণিত করেন গবেষকরা।
কঙ্কালটির উচ্চতা ছিল উচ্চতা ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি, মারা যাবার সময় বয়স আনুমানিক ৩০ বছর ছিল বলে গবেষকরা ধারণা করেন। মৃতদেহের পাশে বেশ কিছু অস্ত্র-শস্ত্র পেয়েছিলেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা, যার মধ্যে ছিল একটি তলোয়ার, তীর, ব্যাটল নাইফ, কুড়াল, বর্শা ও দুটো ঢাল, যা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় প্রয়াত মানুষটি একজন যোদ্ধা ছিল।
আধুনিক যুগে ভাইকিংদের জনপ্রিয়তা
টিভি সিরিজ দেখেন অথচ হিস্টোরি চ্যানেলের ভাইকিংস নামের টিভি শো-র নাম শোনেননি এমন দর্শক পাওয়া মুশকিল। সিরিজটির সৃষ্টির পেছনের কারিগর মাইকেল হার্স্ট। শুটিং হয়েছে আয়ারল্যান্ড, পাইলট এপিসোড অন-এয়ার হয় মার্চ ৩, ২০১৩ সালে। দুনিয়া জুড়ে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠে সিরিজটি; একে একে সম্প্রচারিত হয় ৫টি সিজন, এই মুহূর্তে ষষ্ঠ সিজন চলছে যা ইতি টেনে দেবে সিরিজটির। র্যাগনার লথব্রকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ট্র্যাভিস ফিম্মেল ও আলোচ্য লাগার্থার ভূমিকায় রয়েছেন ক্যাথেরিন উইনিক।
উইনিকের দুর্দান্ত অভিনয়ের কল্যাণে মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছে বহুদিন পাদপ্রদীপের আড়ালে থাকা লাগার্থা চরিত্রটি। সোনালি চুলের এই অভিনেত্রীর রূপে-গুণে মুগ্ধ হয়েছে দর্শক। যুদ্ধংদেহী লাগার্থা কিংবা ঘরকান্নায় ব্যস্ত সাধারণ ভাইকিং নারী- দুই ভূমিকাতেই চমৎকারভাবে উতরে গেছেন তিনি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ২০১৩ সালে শোটি শুরু হবার আগে নারীদেরও ভাইকিং যোদ্ধা রূপে দেখানোয় বেশ সমালোচনার শিকার হতে হয় পরিচালককে। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা জানতে পারি, ভাইকিং যুগে শুধু অভিবাসন নয়, রণাঙ্গনেও সমান পারদর্শী ছিল রমণীকুল। তবে একথাও সত্যি যে সিরিজটি ইতিহাসকে অনুসরণ করেনি পুরোপুরি। পর্দায় এনেছে মনগড়া কিছু চরিত্র ও অদলবদল করেছে সময়ের ব্যাপ্তি। যেমন: সিরিজের মতো বাস্তবে র্যাগনারের ‘রোলো’ নামের কোনো ভাই ছিল না। তবে এসব কারণে জনপ্রিয়তার স্রোতে ভাটা পড়েনি কখনো।
শেষকথা
ইতিহাসের পাতা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ভাইকিং সমাজে নারীদের স্রেফ উচ্চ আসনেই স্থান ছিল না, বরং তারা সম্মান-পদমর্যাদাও উপভোগ করতো পুরুষদের মতো। আর জানতো কীভাবে প্রয়োজনের সময় অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে নিজের পরিবার, সম্পত্তি আর রাজ্য রক্ষা করতে হয়।