সাংবাদিকতা এক মহান পেশার নাম। সমসাময়িক দেশ, কাল, সময়ের চিত্র বস্তুনিষ্ঠভাবে সাধারণ মানুষের সামনে উপস্থাপনই সাংবাদিকদের কাজ। আর এই কাজের মাধ্যমে তারা অনেক অন্যায়-অনাচার, অপরাধ, ভয়াবহতার বিষয়ে বিশ্বকে অবগত করতে পারেন, এবং তাদের করা সংবাদ অনেক সময় আপাত অসম্ভব অনেক সমস্যারও সমাধান বয়ে আনতে পারে। কথায় আছে, আজকের বর্তমানই আগামী দিনের ইতিহাস। সেই ইতিহাস যাতে কোনোভাবেই বিকৃত না হয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন তাদের অতীত সম্পর্কে সঠিক তথ্য জেনেই বড় হয়, তা নিশ্চিত করা সাংবাদিকদের নৈতিক দায়িত্ব।
নিঃসন্দেহে অধিকাংশ সাংবাদিকই তাদের পেশার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে সচেতন, এবং এই মহান পেশার গায়ে যেন কখনো কালির ছিটা না লাগে, সে ব্যাপারে তারা সদা সচেষ্ট। কিন্তু একটি গাছের সবগুলো ফলই যে ভালো হবে, তা তো আর সম্ভব না। দুই একটি ফল পোকার আক্রমণে নষ্ট হয়ে যেতেই পারে। ঠিক তেমনই সব পেশাতেই দুই-একজন মন্দ মানুষ থাকে। ব্যতিক্রম নয় সাংবাদিকতা পেশাও। এই পেশাতেও এমন অল্প কিছু মানুষ আছে, যাদের অনৈতিক, বিবেকবোধ বিবর্জিত কর্মকান্ডের ফলে সাধারণ মানুষ ভুল পথে পরিচালিত হয়, এবং সামগ্রিকভাবে সাংবাদিকতা পেশার ব্যাপারে মানুষের মনে ভুল ধারণার সঞ্চার হয়।
তবে আরো ভয়াবহ বিষয় হলো, একজন মানুষ যখন ভুল কাজ করেও তার জন্য পুরস্কৃত হয়। এবং সেই ভুল কাজ করে পুরস্কৃত হওয়া মানুষটি যদি হয়ে থাকে একজন সাংবাদিক, তাহলে তো আর কথাই নেই। চারিদিক থেকে তখন ‘গেল গেল’ রব উঠতে বাধ্য। এমনিতেই সাংবাদিকদের করা অনেক সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে জনমনে থাকে দ্বিধা ও বিভ্রান্তি। আর যদি মিথ্যা ও ভুলে ভরা সংবাদের জন্যই একজন সাংবাদিক সম্মানসূচক পুরস্কার পেয়ে যায়, তাহলে সাংবাদিকদের উপর থেকে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস পুরোপুরি উঠে গেলেও করার কিছু থাকে না।
এমনই একটি লজ্জাজনক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল ১৯৩২ সালে, যখন একের পর এক মিথ্যা প্রতিবেদন তৈরির পরও সাংবাদিকতা জগতের নোবেলখ্যাত, সবচেয়ে সম্মানসূচক পুরস্কার পুলিৎজার পেয়ে যান নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক ওয়াল্টার ডিউরান্টি। তার মিথ্যা প্রতিবেদন ও সেজন্য প্রাপ্ত পুলিৎজার সাংবাদিকতা পেশাকে যে ঠিক কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল, এবং এর ফলে এক ভয়াবহ মানবসৃষ্ট ট্র্যাজেডির সঠিক ইতিহাসও কতটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
ডিউরান্টি ছিলেন একজন অ্যাংলো-আমেরিকান। তার জন্ম হয়েছিল ১৮৮৪ সালের ২৫ মে, লিভারপুলে। ১৯২২ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ রাশিয়ার গৃহযুদ্ধে বলশেভিকদের বিজয়ের পর একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তিনি নিউ ইয়র্ক টাইমসের মস্কো ব্যুরো চিফ হিসেবে কাজ করেন।
ডিউরান্টি সোভিয়েত ইউনিয়নে যান ১৯২১ সালে। পরের বছর সেখানে নিউ ইয়র্ক টাইমসের হয়ে কাজ শুরু করেন। তবে ১৯২৪ সালে ফ্রান্সে ছুটি কাটাতে গিয়ে রেল দুর্ঘটনায় বাঁ পায়ে চোট পান তিনি। অস্ত্রোপচারের পর সেখানে গ্যাংগ্রিন আবিষ্কার করেন সার্জন। ফলে কেটে ফেলতে হয় সেই পা। সেরে ওঠার পর আবারও সোভিয়েত ইউনিয়নে সাংবাদিকতা শুরু করেন ডিউরান্টি। তখনকার দিনে সোভিয়েত ইউনিয়নের নতুন অর্থনৈতিক পলিসি ও মিশ্র অর্থনীতি বিষয়ক প্রতিবেদন বেশি তৈরি করতেন তিনি। তবে মস্কো থেকে পাঠানো তার সেসব সংবাদ খুব একটা জনপ্রিয় ছিল না।
তবে ১৯২৮ সাল থেকে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে এক নতুন পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্প হাতে নেয়া হলো দেশের শিল্প ও কৃষি ক্ষেত্রকে বদলে দেয়ার লক্ষ্যে, তখন ডিউরান্টি পেয়ে যান অবশেষে নিজেকে মেলে ধরার এক সুবর্ণ সুযোগ। ১৯২৯ সালে জোসেফ স্ট্যালিন সম্মত হন তার কাছে একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার দিতে। এর কারণ, তিনি ছিলেন স্ট্যালিনের একজন বিশাল বড় ভক্ত। এমনকি স্ট্যালিনকে “শ্রেষ্ঠ জীবন্ত স্টেটসম্যান” খেতাব দেয়া এবং “স্ট্যালিনিজম” টার্মটিকে জনপ্রিয় করার নেপথ্যেও ছিলেন তিনিই। আর তার সাংবাদিকতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন স্বয়ং স্ট্যালিনও।
কিন্তু স্ট্যালিনকে খুশি করতে গিয়ে, ১৯৩১ সালে ডিউরান্টি শুরু করেন এক চরম নির্লজ্জের মতো কাজ। ইউক্রেনে তখন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে দুর্ভিক্ষে, যে দুর্ভিক্ষের প্রধান কারণ স্ট্যালিনের পাঁচ বছর মেয়াদি নীতি ও কৃষকদের কাছ থেকে তাদের জমি ও ফসল ছিনিয়ে নেয়া। অথচ ডিউরান্টি উঠেপড়ে লাগেন সেই দুর্ভিক্ষের সত্যতা ধামাচাপা দিতে।
১৯৩১ সালের ১৫ নভেম্বর নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয় তার জঘন্যতম প্রতিবেদন, যেখানে তিনি লেখেন, “এখানে কোনো দুর্ভিক্ষ বা অনাহারের ঘটনা ঘটছে না, এমন কিছুর সম্ভাবনাও নেই।”
শুধু এটুকুতেই থেমে থাকেননি তিনি। স্ট্যালিনের রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা সফল করতে একের পর এক মিথ্যাচার চালিয়ে যান নিজের প্রতিবেদনের মাধ্যমে।
১৯৩৩ সালের ২৩ আগস্ট তিনি লেখেন, “আজকের দিনে রাশিয়ার দুর্ভিক্ষ বিষয়ক যেকোনো প্রতিবেদনই হয় অতিরঞ্জন, নয়তো বিদ্বেষপূর্ণ প্রোপাগান্ডা।” অথচ বাস্তবতা হলো, ইউক্রেনে তখন হলোদোমোরে দৈনিক মারা যাচ্ছে ২৫,০০০ মানুষ।
এছাড়া ১৯৩৩ সালের ৩১ মার্চ নিউ ইয়র্ক টাইমসের ১৩ পাতায় তিনি লেখেন, “এখানে আসলে কেউ অনাহারে নেই। অনাহারে কারো মৃত্যুও হচ্ছে না। তবে পুষ্টিহীনতার কারণে সৃষ্ট রোগে প্রচুর মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।”
১৯৩৩ সালের ১৪ মে নিউ ইয়র্ক টাইমসের ১৮ পাতায় তিনি প্রকাশ করেন আরো একটি কদর্য, দ্ব্যর্থবোধক বিবৃতি, “ডিম না ভেঙে আপনি অমলেট বানাতে পারবেন না।”
এভাবেই ১৯৩২-৩৩ সালে যখন ইউক্রেনসহ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন জায়গায় এক ভয়াবহ মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ চলছিল, তখন নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো একটি প্রভাবশালী পত্রিকার হয়ে দুর্ভিক্ষকে অস্বীকার করে একের পর এক প্রতিবেদন তৈরি করে যাচ্ছিলেন ডিউরান্টি। এ কাজের জন্য তার চরম নিন্দিত হওয়ার কথা। অথচ বাস্তবতা হলো, সেই সময়ে তার করা প্রতিবেদনগুলোকেই সত্যি বলে মনে করছিল অনেকে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীও ইউক্রেনের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ না নিয়ে ডিউরান্টির করা প্রতিবেদনগুলোকেই বিশ্বাস করে যাচ্ছিল। তারা বুঝতেও পারছিল না যে, ডিউরান্টি আসলে স্ট্যালিনের নির্দেশে মনগড়া সংবাদ লিখে চলেছেন। বরং তারা এতটাই প্রভাবিত হয়েছিল যে, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে ১৯৩২ সালে তাকে সাংবাদিকতায় পুলিৎজার পুরস্কারেও ভূষিত করা হয়।
১৯৩২-৩৩ সালের দুর্ভিক্ষে ইউক্রেনের অন্তত ৭০ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল। আর এই ৭০ লক্ষ মানুষের মৃত্যুকে স্রেফ অস্বীকার করে পুলিৎজার পুরস্কার জিতে নিয়েছিলেন ডিউরান্টি। নিঃসন্দেহে সাংবাদিকতা জগতের সবচেয়ে লজ্জাজনক অধ্যায়গুলোর একটি এটি। কারণ ডিউরান্টি ও তার মতো আরো কিছু সাংবাদিকের মিথ্যাচারকে বিশ্বাস করার ফলেই তৎকালীন সময়ে ইউক্রেনের দুর্ভিক্ষ ও এত বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুকে অবিশ্বাস করেছিল সাধারণ মানুষ। এমনকি ইউক্রেনেও ২০০৬ সালের আগপর্যন্ত এই দুর্ভিক্ষকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি।
যা-ই হোক, ১৯৩৪ সালে মস্কোর পাট চুকিয়ে ফেলেন ডিউরান্টি। তিনি ফিরে আসেন যুক্তরাষ্ট্রে। এমনকি একবার সোভিয়েত অফিসিয়ালদের সাথে হোয়াইট হাউজেও ঘুরে আসেন। ১৯৪০ সাল পর্যন্ত তিনি বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিউ ইয়র্ক টাইমসেই কর্মরত থাকে। ১৯৪০ সালের পর তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে বেশ কিছু বইও লেখেন। জর্জ অরওয়েল তার লেখা বইগুলোকে “অগ্রহণযোগ্য” আখ্যা দেন, কেননা তিনি ছিলেন কম্যুনিজমের সহমর্মী, কিংবা কম্যুনিস্টদের “পেইড এজেন্ট”। ১৯৫৭ সালে অরলান্ডো, ফ্লোরিডায় মৃত্যু হয় তার।
১৯৯০ সালে স্যালি জে টেইলর প্রকাশ করেন ডিউরান্টির জীবনী বিষয়ক বই “স্ট্যালিন’স অ্যাপোলজিস্ট”। এই বইটির প্রতিক্রিয়া হিসেবে নিউ ইয়র্ক টাইমস তাদের এডিটোরিয়াল বোর্ডের একজন সদস্য, কার্ল মায়ারকে নিযুক্ত করে ডিউরান্টিকে নিয়ে একটি সম্পাদকীয় লেখার জন্য। ১৯৯০ সালের ২৪ জুন প্রকাশিত হয় সেই সম্পাদকীয়টি, যেখানে মেয়ার বলেন, “ডিউরান্টির আর্টিকেলগুলো এই পত্রিকায় প্রকাশিত সবচেয়ে বাজে প্রতিবেদনগুলোর মধ্যে কয়েকটি।”
২০০৩ সালে ইউক্রেনিয়ান কানাডিয়ান সিভিল লিবার্টিজ অ্যাসোসিয়েশন বিশ্বব্যাপী একটি ক্যাম্পেইন চালায়, এবং তাদের দাবি ছিল ডিউরান্টির পুলিৎজার পুরস্কার প্রত্যাহারের। তখন নিউ ইয়র্ক টাইমসও কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির রুশ ইতিহাসের অধ্যাপক মার্ক ভন হ্যাগেনকে নিয়োগ দেয় নতুন করে ডিউরান্টির প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা করার।
ভন হ্যাগেন ডিউরান্টির প্রতিবেদনগুলোকে একপেশে, ভারসাম্যহীন হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তার মতে, সেসব প্রতিবেদনের মাধ্যমে স্ট্যালিনিস্ট প্রোপাগান্ডা চালানোর চেষ্টা করেছিলেন ডিউরান্টি। তাই তিনি বলেন, “নিউ ইয়র্ক টাইমসের সম্মান রক্ষার্থেই তাদের উচিত পুরস্কারটি ফিরিয়ে নেওয়া।” নিউ ইয়র্ক টাইমস ভন হ্যাগেনের প্রতিবেদনটি পুলিৎজার কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেয়, যাতে তারা যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে। এছাড়া পত্রিকাটির তৎকালীন প্রকাশক আর্থার ওকস সালজবার্জার ডিউরান্টির প্রতিবেদনগুলোর সমালোচনা করে বলেন, “সাত দশক আগেই সম্পাদক ও পুলিৎজার বিচারকদের বোঝা উচিৎ ছিল এই প্রতিবেদনগুলো আসলে কতটা অগোছালো।“
কিন্তু শেষ পর্যন্ত, পুলিৎজার প্রাইজ বোর্ডের পরিচালক সিগ গিসলার ডিউরান্টির পুরস্কার প্রত্যাহারের ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, “১৯৩১ সালে প্রকাশিত যে ১৩টি প্রতিবেদনের (১১টি নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত, আর দুইটি নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনে) জন্য ডিউরান্টিকে পুরস্কার দেয়া হয়েছিল, ঐ প্রতিবেদনগুলোতে ইচ্ছাকৃতভাবে তথ্য বিকৃতির সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাছাড়া পুরস্কার বিজয়ী ও বিচারক সকলেই যেহেতু এখন মৃত, তাই এখন পুরস্কারটি প্রত্যাহার করাও সম্ভব নয়।”
সুতরাং, ডিউরান্টির মিথ্যাচার প্রমাণিত হয়ে যাওয়ার পরও, এখনো তার নামের পাশে রয়েছে সাংবাদিকতায় পুলিৎজার পুরস্কার প্রাপ্তির গৌরব। কিন্তু তার এই প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে সাংবাদিকতা পেশার জন্য কোনো গৌরবের বিষয় নয়।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/