মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের নামের সাথে জড়িয়ে আছে বিখ্যাত ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি। তিনিই হলেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি বিরোধী দলের উপর নজরদারীর কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। চীন-রাশিয়ার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন আর অর্থনীতিতে ব্যাপক সংস্কার করে প্রথম মেয়াদে ব্যাপকভাবে সফল এ প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয় মেয়াদের নির্বাচনেও জয়ী হয়েছিলেন ৫০টি রাজ্যের ৪৯টিতেই।
কিন্তু তার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায় নির্বাচন পূর্ববর্তী এ ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি। বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে রাশিয়ার যোগাযোগ এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের ঘটনার সামনে নাকি নিক্সনের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নস্যির কৌটা! এমনটাই দাবি করেছেন আমেরিকার জাতীয় গোয়েন্দাসংস্থার সাবেক পরিচালক জ়েমস ক্লেপার। তাই এই প্রেক্ষাপটে আবার আলোচনায় এসেছে ১৯৭০ এর দশকের সেই ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি। আজকে থাকছে সেই ঘটনার আদ্যোপান্ত।
কী এই ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি?
সময় ১৯৭২ সাল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বইছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের হাওয়া। ওয়াশিংটন ডিসির ওয়াটারগেট হোটেলের ছয় তলায় ছিলো ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির কার্যালয়। এখান থেকেই ডেমোক্র্যাটদের নির্বাচনী কৌশল আর প্রচারণার সবকিছু নির্ধারণ করা হতো। ডেমোক্র্যাটদের নীতিনির্ধারকদের নিয়মিত আনাগোনায় মুখরিত এ অফিসেই ১৯৭২ সালের ১৭ই জুন খুব ভোরে ঢুকে পড়েন পাঁচ ব্যক্তি।
তারা সেই অফিসে থাকা টেলিফোনে ছোট মাইক্রোফোন লাগাতে শুরু করেন যার মাধ্যমে নজরদারি করার পরিকল্পনা করা হয় ডেমোক্র্যাটদের নির্বাচনী কৌশলের উপর। পাশাপাশি দরকারি কাগজপত্রের ছবি তুলতে গিয়ে অফিসে থাকা ফাইল ক্যাবিনেট তছনছ করে অনুপ্রবেশকারীরা। সেদিন ভোরে নিরাপত্তাকর্মী ফ্রাঙ্ক উইলস তার রুটিন টহল দিচ্ছিলেন। ছয় তলায় টহল দিতে গিয়ে তিনি খেয়াল করলেন ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির অফিসের দরজায় লাগানো লক ডাক্ট টেপ। এই টেপ লাগানো থাকলে দরজা এমনভাবে বন্ধ হয় যাতে লকটা আটকে না যায়। সেটা দেখে সহজেই বোঝা যায় ভিতরে কেউ আছে। কিন্তু এত ভোরে কারো অফিসে থাকার কথা নয়। তাই উইলস কেবল এই টেপটা খুলে দিলেন দরজার লক থেকে। গুরুতর কিছু মনে না হওয়ায় তিনি চলে যান তার রুটিন টহলে। ঘন্টাখানেক পরে দরজায় আবার সেই একই টেপ দেখতে পেয়ে তিনি খবর দেন পুলিশকে। এরপরই পুলিশ আটক করে সেই দলটিকে। ৫ জনের সেই দলের কাছে পাওয়া যায় নগদ ২৩০০ ডলার, যার প্রায় সবই ১০০ ডলারের। পরবর্তী সময়ে এই ১০০ ডলারের নোট নিয়ে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে অনেক কিছু।এই ঘটনা নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলো সন্দেহবাণে জর্জরিত করেন রিপাবলিকান প্রার্থী রিচার্ড নিক্সনকে। ওয়াশিংটন পোস্টের দুই তরুণ সাংবাদিক কার্ল বার্নস্টেইন আর বব উডওয়ার্ড পাঁচ অনুপ্রবেশকারী আর এই ১০০ ডলার নোটের সিরিয়াল নিয়ে রীতিমত তদন্ত শুরু করেন।
১০ অক্টোবর ১৯৭২, ওয়াশিংটন পোস্টে ‘Deep Throat’ গোপন সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয় প্রেসিডেন্ট নিক্সন ওয়াটারগেটের এই ঘটনার জন্যে দায়ী। প্রথম মেয়াদের দায়িত্বের শেষপ্রান্তে থাকা নিক্সন এই ঘটনাকে অস্বীকার করেন এবং পুরো ঘটনাটা ষড়যন্ত্র বলেই চালিয়ে দেন। এই ঘটনাকে নিক্সন তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার বলে আখ্যা দেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে একই বছরের ৭ নভেম্বর রিচার্ড নিক্সন ৫০ রাজ্যের ৪৯টিতেই জয়ী হয়ে দ্বিতীয়বার মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
‘নিক্সন বনাম প্রেস’
বার্নস্টেইন আর উডওয়ার্ড কিন্তু থেমে যাননি। প্রেসিডেন্ট নিক্সন নির্বাচিত হবার পরেও রীতিমতো ওয়াশিংটন পোস্টে তাদের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করতে থাকেন।
চাঞ্চল্যকর তথ্যগুলোর সূত্র হিসেবে ‘Deep Throat’ ছদ্মনামের এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন তারা। কে এই ‘Deep throat’ তা-ও জানা যাবে পুরো ঘটনার শেষে। তাদের রিপোর্টে বেরিয়ে আসে ওয়াটারগেটে ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির অফিসে মোট চারবার ঢুকেছিলো অনুপ্রবেশকারী সেই দলটি। পুলিশের হাতে ধরা পড়া সেই দলের অনেকেরই পরিচয় প্রকাশের সাথে সাথে মিডিয়ায় সাড়া পড়ে যায়। অনুপ্রবেশকারীদের একজন ছিলেন জ়েমস ম্যাককর্ড। অবসরপ্রাপ্ত এই সিআইএ কর্মকর্তা ছিলেন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের নিরাপত্তা কর্মকর্তা! তাদের কাছে ১০০ ডলারের যে নোট পাওয়া যায় সেগুলোর সিরিয়াল নাম্বার নিয়ে তদন্ত শুরু করেন দুই সাংবাদিক। দেখা যায় এই সিরিয়াল নাম্বারের নোটগুলো ব্যাংক থেকে নিক্সনের নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের ব্যয় নির্বাহের জন্য তোলা নোটগুলোর সাথে মিলে যাচ্ছে। সন্দেহ আরো জোরালো হতে থাকে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের প্রশাসনের দিকে। নিক্সন প্রশাসনের মুখপাত্ররা বরাবর একে ষড়যন্ত্র বলেই উল্লেখ করছিলেন। সংবাদপত্রের সাথে নিক্সনের মুখপাত্রদের এই লড়াই পরিচিত ‘নিক্সন বনাম প্রেস’ নামে। সিআইএ আর এফবিআই তদন্ত শুরু করে এই ঘটনার। নিক্সন প্রশাসনের ধামাচাপা দেবার সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে এ ঘটনা গড়ায় সিনেট পর্যন্ত। ওয়াটারগেটের কীর্তিকলাপ নিয়ে সিনেটে তদন্ত কমিটি গঠিত হবার প্রস্তাব ৭৭-০ ভোটে গৃহীত হয়। মিডিয়াতে ব্যাপক প্রচার পাওয়ায় এই ঘটনা জনমনে ব্যাপক আগ্রহের জন্ম দেয়। প্রথমে রুদ্ধদ্বার শুনানির ব্যবস্থা করলেও পরে টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের সিদ্ধান্ত নেয় মার্কিন সিনেট।
নিজেরই পাতা ফাঁদ নিজেই পড়েন নিক্সন
প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের সময়কাল থেকেই মার্কিন প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের ওভাল অফিস সহ হোয়াইট হাউজের গুরুত্বপূর্ণ সব টেলিফোন আলাপ রেকর্ড করে গোপনে সুরক্ষিত রাখা হতো। কিন্তু নিক্সন ক্ষমতায় আসার পর থেকে তিনি হোয়াইট হাউজের যাবতীয় কথা রেকর্ড করার ব্যবস্থা চালু করেন। আর তখন কে জানতো নিজেরই পাতা ফাঁদে তিনি নিজেই জড়িয়ে পড়বেন?
১৯৭৩ সালে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের রেকর্ড করা কিছু টেপ ফাঁস হয়ে যায়। প্রায় একই সময় এটর্নি জেনারেল এলিয়ট রিচার্ডসন এ মামলায় প্রসিকিউটর হিসেবে আর্চিবাল্ড কক্সকে নিয়োগ দেন। কক্স মামলার তদন্ত কাজ করার জন্য নিক্সনের কাছে ১৯৭২ সালের নির্বাচন পূর্ববর্তী সকল টেপ চান। তবে নিক্সন টেপ না দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না, বরং কক্সের পদত্যাগের আদেশ জারি করলেন। ফলক্রমে ঐদিন রাতেই এটর্নি জেনারেল এলিয়ট রিচার্ডসন স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলেন আর আর্চিবাল্ড কক্স চাকরিচ্যুত হলেন। মিডিয়াতে ফলাও করে এটর্নি জেনারেল সহ বেশ কয়েকজনের পদত্যাগের কথা প্রচার করা হয়। এই রাতের ঘটনাটিকে আমেরিকান মিডিয়া নাম দেয় ‘Saturday Night Massacre’ হিসেবে। এ ঘটনার ফলে নিক্সন পরিণত হলেন সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দুতে।
১৮ মিনিট গায়েব
টেপ না দিয়ে আর যাবেন কোথায় নিক্সন! তদন্তকারীদের চাপে শেষ পর্যন্ত হোয়াইট হাউজের টেপ হস্তান্তর করতে বাধ্য হন তিনি। তবে সেই টেপের ১৯৭২ সালের ২০ জুন তারিখের একটি সংলাপে ১৮ মিনিট গায়েব করে দেন নিক্সনের সেক্রেটারি রোজ মেরি ওডস। এই ঘটনাকে ঐতিহাসিকেরা নাম দিয়েছেন ‘রোজ মেরি স্ট্রেচ’। এটিই নিক্সনকে এনে ফেলে একেবারে খাদের কিনারায়।
ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট
বাকি টেপগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজে তদন্ত কমিটি ওয়াটারগেটের ঘটনার সাথে প্রেসিডেন্টের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়। ১৯৭৪ সালের ২৭ জুলাই নিক্সনের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকার নিশ্চিত প্রমাণ পাবার পর তদন্ত কমিটি সুপারিশ করে রিচার্ড নিক্সনকে তার প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অভিশংসন করার পার্লামেন্টে বিল আনার জন্য।
কিন্তু তার আগেই ৯ আগস্ট তিনি তার পদত্যাগপত্র জমা দেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পান। দায়িত্ব পেয়ে তিনি সাবেক প্রেসিডেন্টের ক্ষমার আদেশ জারি করেন। নিক্সন প্রশাসনের এক ডজনের বেশি কর্মকর্তার বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি হয়। কার্ল বার্নস্টেইন আর বব উডওয়ার্ড সাহসী সাংবাদিকতার জন্যে পুলিৎজার পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। সর্বশেষ ২০০৫ সালে বার্নস্টেইন আর উডওয়ার্ডকে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য দেওয়া মার্ক ফেল্ট নামের এক সাবেক সিআইএ এজেন্ট ‘Deep Throat’ হিসেবে নিজের পরিচয় দেন।