ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে চলমান যুদ্ধ আবারও আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে যে যুদ্ধ কতটা নির্মম আকার ধারণ করতে পারে। অত্যাধুনিক রুশ মারণাস্ত্র ইউক্রেনের ভূখন্ডে আঘাত হানছে, বহুতল ভবন ধসে পড়ছে সেই মারণাস্ত্রের আঘাতে– এরকম বেশ কিছু ভিডিও ক্লিপ ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেকোনো যুদ্ধে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের অনুপাতে বেসামরিক মানুষ হতাহত হয় সবচেয়ে বেশি। ইউক্রেনে রুশ সামরিক আগ্রাসনের একটি বড় দিক হলো, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও পুতিনের সেনাবাহিনী এখনও পর্যন্ত দেশটির বেসামরিক জনগণের উপর পূর্ণমাত্রায় আক্রমণ শুরু করেনি। নয়তো যে ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা বেড়ে যেত আরও বহুগুণে। মানবতা কিংবা আন্তর্জাতিক আইনের বুলি যতই আওড়ানো হোক না কেন, দিনশেষে যুদ্ধ শুরু হলে এসব বেমালুম চেপে যাওয়া হয়। সম্প্রতি ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন কিংবা অতীতের যেকোনো যুদ্ধ আমাদের এই উপসংহারে পৌঁছাতে বাধ্য করে যে, যুদ্ধ মানেই ধ্বংসলীলা।
যেকোনো যুদ্ধের সময়ই বিবদমান দেশগুলোর অর্থনীতিতে বেশ বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। গতানুগতিক সময়ে যেভাবে অর্থনীতি পরিচালিত হয়, যুদ্ধের সময়ও যদি সেভাবেই পরিচালিত হতে থাকে, তাহলে বিপর্যয় নেমে আসা অনিবার্য। আবার বিপরীতভাবে, যদি যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি সঠিকভাবে বুঝে নিয়ে যথাযথ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হওয়া যায়, তাহলে যুদ্ধে জয়লাভ তো বটেই, অর্থনৈতিকভাবেও বেশ লাভবান হওয়া সম্ভব। সাধারণত আমরা দেখতে পাই, যুদ্ধের সময়ে যে খাতগুলো যুদ্ধে আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোর সাথে জড়িত থাকে, সেই খাতগুলোতে বেশি করে বিনিয়োগ করা হয়। একটি উদাহরণ দেয়া যাক। যুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষের উপর আক্রমণ চালাতে কিংবা প্রতিপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদের। স্বাভাবিকভাবেই যদি যুদ্ধ বেধে যায়, তাহলে বিবদমান দেশগুলোর সরকারকে অন্যান্য খাতের চেয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নির্মাণখাতে বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। সরকারগুলো এই কাজটিই করে থাকে৷ মূলত যুদ্ধের সময় যে বিশেষ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়, সেটিই হচ্ছে ‘ওয়ার ইকোনমি’ (War Economy)।
প্রতিটি রাষ্ট্রই বিপদের সময় ব্যবহারের জন্য অস্ত্র মজুদ করে রাখে। কিন্তু যুদ্ধের ব্যাপ্তি বাড়তে থাকলে আরও বেশি পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদের প্রয়োজন হয়। যখন বাইরের কোনো রাষ্ট্রে সামরিক হামলা চালানো হয় কিংবা নিজ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নির্বিঘ্ন রাখার জন্য সীমান্তে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়, তখন বিভিন্ন ইউনিট পরিচালনা করতে প্রচুর অস্ত্র, গোলাবারুদ, যানবাহনের প্রয়োজন হয়। আগেই বলা হয়েছে, যুদ্ধ মানে ধ্বংস। দেখা গিয়েছে, বাইরের রাষ্ট্রে আক্রমণ চালানোর ফলে সরাসরি সংঘর্ষে অনেক সামরিক যানবাহন, সরঞ্জাম ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে; বিপুল পরিমাণ অস্ত্রবারুদ ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে ফুরিয়ে এসেছে। এরকম পরিস্থিতিতে অবশ্যই পর্যাপ্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদ নতুন করে সরবরাহ করতে হবে, সামরিক যানবাহনের নতুন বহর পাঠাতে হবে, এবং যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পুনরুৎপাদন করে রণক্ষেত্রে প্রেরণ করতে হবে। সুতরাং, সেই দেশের সরকারের হাতে যদি পর্যাপ্ত অর্থ না থাকে পুনরুৎপাদন ও পুনরায় যুদ্ধক্ষেত্রে সরবরাহের জন্য, তাহলে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বিবদমান দেশগুলো যুদ্ধের সময় অন্যান্য খাতের ব্যয় কমিয়ে যুদ্ধাস্ত্র, যানবাহন, অস্ত্র ও গোলাবারুদ নির্মাণের জন্য বেশি অর্থ ব্যয় করে থাকে।
যুদ্ধের সময় যে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হয়, সেটি সংগ্রহের জন্য সরকার বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে। সবচেয়ে সাধারণ একটি পদ্ধতি হচ্ছে করের হার বাড়িয়ে দেয়া। বাড়তি করের মাধ্যমে বিশাল পরিমাণ অর্থ আয় করা সম্ভব হয়, যেটি যুদ্ধক্ষেত্রের ব্যয় মেটাতে ব্যবহার করা যায়। এছাড়া অনেক সময় ‘ওয়ার বন্ড’ ছাড়া হয়, যার মাধ্যমে জনগণকে বাড়তি আয়ের সুযোগ দিয়ে সরকার কিছু অর্থ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। তবে এছাড়াও অন্যান্য পদ্ধতিতে অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হয়। অনেক সময় মিত্র রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে ঋণ নেয়া হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে আমেরিকা তৎকালীন পরাশক্তি ইংল্যান্ডের কাছ থেকে বড় অংকের অর্থ ঋণ নিয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর দেখা গেল, অক্ষশক্তির সাথে লড়াই করতে গিয়ে ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যে অর্থ জমা আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। তখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল আমেরিকা। দেখা গেল, যে আমেরিকা যুদ্ধের আগে ইংল্যান্ডের কাছে ঋণগ্রস্ত ছিল, সেই ঋণ শোধ তো হলোই, উল্টো আমেরিকার বিশাল অংকের অর্থ পাওনা হলো ইংল্যান্ডের কাছে।
যুদ্ধ শুরু হলে সৈন্য ও যুদ্ধের সাথে জড়িত বিভিন্ন পেশার মানুষের খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বিশাল চাহিদা তৈরি হয়। যদি লড়াই করতে করতে অস্ত্র শেষ হয়ে যায়, তাহলে পশ্চাদপসরণ করে টিকে থাকা সম্ভব। কিন্তু যদি খাদ্য শেষ হয়ে যায়, তাহলে কোনোভাবেই টিকে থাকা সম্ভব নয়। এজন্য যুদ্ধের সময় সৈন্যদের খাবারের কোনো সংকট যেন দেখা না দেয়, সরকারকে এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হয়। যদি কোনো দেশের কৃষিখাত শক্তিশালী থাকে, তাহলে খাবারের পর্যাপ্ত যোগান নিশ্চিত করতে বেগ পেতে হয় না। এর পাশাপাশি উন্নত শিল্পকারখানাগুলো কাজে লাগিয়ে অনায়াসে অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য তৈরি করা যায়। এরপরও যদি ঘাটতি দেখা দেয়, তাহলে সর্বশেষ উপায় হিসেবে বাইরের দেশ থেকে খাদ্যশস্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানি করা হয়ে থাকে। কিন্তু এটা করতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে, কারণ খাদ্যশস্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানি করতেও বেশ বড় অংকের অর্থের প্রয়োজন হয়। অন্য সময়ে যে প্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য প্রস্তুত করে থাকে, যুদ্ধের সময় তাদের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের চাহিদা মেটাতে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদন করার দায়িত্ব পালন করতে হয়। এছাড়াও সরকারকে খেয়াল রাখতে হয়, দেশের মানুষের খাবারে যেন ঘাটতি তৈরি না হয়।
যুদ্ধের সময় যখন রণক্ষেত্রের প্রয়োজনে প্রায়শই বাড়তি সৈন্যের প্রয়োজন হয়, তখন সেই চাহিদা মেটাতে সরকার সামরিক বাহিনীর নিয়মিত সৈন্য তো বটেই, এর পাশাপাশি বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণীর মানুষকে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ প্রদানের পরিপ্রেক্ষিতে রণক্ষেত্রে প্রেরণ করে। অনেক সময় দেখা যায়, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পেশাজীবী মানুষকে যুদ্ধে প্রেরণ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে পেশাজীবী পুরুষেরা যুদ্ধক্ষেত্রে গেলে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য কর্মক্ষম জনগণের শূন্যতা তৈরি হয়। এই শূন্যতা পূরণের জন্য সরকার সাধারণত নারী ও বেকার জনগণকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানায়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিবদমান দেশগুলোতে অসংখ্য পুরুষ যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ায় যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, সেই শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে এসেছিল দেশগুলোর নারীরা। এভাবে যুদ্ধের সময় বিভিন্ন পেশাগত দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে নারীরা স্বাবলম্বী ও দক্ষ হয়ে ওঠে। ইউরোপে দেখা গিয়েছে, যুদ্ধের পর বিভিন্ন নারীবাদী আন্দোলন গড়ে তুলতে এই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী ও দক্ষ নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
যুদ্ধের সময় যেসব দেশ নিরপেক্ষতা বজায় রাখে, তাদের অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে। কারণ যুদ্ধে বিবদমান দেশগুলোর অনেক কিছু আমদানি করার প্রয়োজন হয়। সুতরাং, নিরপেক্ষতা বজায় রাখা দেশগুলো যদি চাহিদামতো বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী সরবরাহ করতে পারে, তাহলে বেশ বড় অংকের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করার সম্ভাবনা থাকে। এক্ষেত্রে একটি দেশে অসংখ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারে, যেগুলোতে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। দুটো বিশ্বযুদ্ধেই আমেরিকা এত বেশি পরিমাণ সামরিক অস্ত্র, সরঞ্জাম ও অন্যান্য দ্রব্য রপ্তানি করেছিল যে, পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে এই রপ্তানিবাণিজ্য বিশাল ভূমিকা রেখেছিল। তবে আরেকদিক থেকে চিন্তা করলে দেখা যায়, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি আমেরিকার মতো অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে সমৃদ্ধ একটি দেশকে পাশে না পেত, তাহলে জার্মান নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তির কাছে পরাজয়ের সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দেয়ার উপায় ছিল না। কোরীয় উপদ্বীপের যুদ্ধের সময় দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি রীতিমতো ফুলেফেঁপে উঠেছিল, যাকে ‘মিরাকল অন দ্য হান রিভার’ বলা হয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সঠিক সামরিক পরিকল্পনা থাকলে ‘ওয়ার ইকোনমি’র মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও অর্জন করা যায়।
পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়াকে আমরা বলে থাকি ‘অভিযোজন’। যেসব প্রাণী পরিবেশের পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে না, সেগুলো বিলুপ্ত হয়ে যায়। যুদ্ধের সময় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যদি কোনো বিবদমান দেশের সরকার খাপ খাইয়ে নিতে না পারে, তাহলে বিপর্যয়ের মুখে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার সঠিক পরিকল্পনা করে এগিয়ে যেতে পারলে অর্থনৈতিক দিক থেকে সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়ারও সুযোগ রয়েছে।