নারীর গর্ভধারণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর একটি। আর এই বিষয়টিই আরও বেশি সৌন্দর্যের জন্ম দেয় যখন সন্তান জন্মদানের সুতীব্র বাসনা থেকে কোনো নারী ৬০ বছর বয়সেও গর্ভধারণ করেন এবং মা হন। শুধুমাত্র একটিবার নিজের সন্তানের মুখে ‘মা’ ডাক শুনতেও অনেকে স্বাভাবিক বয়স পার করে এসেও বৃদ্ধকালে বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে মা হচ্ছেন। এমনই একটি প্রযুক্তি হলো IVF। এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে মূলত দেহের বাইরেই, যেমন- টেস্টটিউবে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু নিষিক্ত করা হয়। তারপর সেটি মায়ের জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়। এভাবে IVF চিকিৎসাপদ্ধতিতে একজন নারীকে বাচ্চা ধারণে উপযুক্ত করা হয়। তাহলে চলুন আজ জানা যাক এভাবে বেশি বয়সে মা হওয়া কিছু নারীর সম্পর্কে।
রাজো দেবী লোহান
রাজো দেবী বাস করতেন ভারতের হিসসার নামক এলাকার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। তিনি ২০০৮ সালে একটি কন্যাসন্তানের মা হবার মাধ্যমে বিশ্বে নতুন একটি রেকর্ডের সৃষ্টি করেন। কারণ, সে সময়ে তার বয়স হয়েছিলো ৬৯ বছর এবং তিনিই সেখানকার প্রথম নারী, যিনি IVF চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করে এতো বেশি বয়সে বাচ্চার মা হতে সক্ষম হয়েছিলেন। জন্মের পর তিনি তার মেয়ের নাম রাখেন ‘নভিন’।
তবে এই বয়সে মা হতে গিয়ে তাকে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। ডেলিভারির পর তিনি তো একপ্রকার মারা যেতেই বসেছিলেন! বর্তমানে তিনি তার স্বামী বাল্লো এবং বাল্লোর অপর এক স্ত্রী উমির সাথে বসবাস করছেন। ২০১২ সালে লোহান বলেছিলেন,
“আমার শারীরিক অসুস্থতা থাকা সত্ত্বেও আমি আমার মেয়ে নভিনের জন্য বেঁচে আছি। ঈশ্বর তাকে উপহারস্বরূপ আমাকে দিয়েছেন এবং তার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আমি বেঁচে থাকতে চাই!”
তিনি আরো বলেন,
“নভিনের বয়স ১৫ হলেই তাকে আমি বিয়ে দেবো। তার বিয়ের আগে আমি মারা যেতে চাই না। নভিনের তার নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করারও কোনো প্রয়োজন নেই, কারণ তার আরেকটি মা উমি রয়েছে। তাছাড়া তার চাচা, আত্মীয় স্বজন এবং আপন বাবা তো আছেই তার দেখাশোনা করার জন্য।”
দালজিন্দার কৌড়
এই ঘটনাটিও ভারতের। ২০১৬ সালে একটি বাচ্চা ছেলের জন্ম দেওয়ার মাধ্যমে, রাজো দেবী লোহানকে সরিয়ে দালজিন্দার কৌড় পৃথিবীর সবচাইতে বেশি বয়সে মা হবার রেকর্ড গড়ে ফেলেন। কারণ সে সময়ে তার বয়স হয়েছিল ৭২ এবং তার স্বামীর ৭৯। তারা প্রায় ৪৬ বছর ধরে সংসার করে আসছিলেন কিন্তু সে সময়ে বাচ্চা জন্মদানে সক্ষম ছিলেন না।
তাই শেষ পর্যন্ত তারা IVF এর মতো বিতর্কিত চিকিৎসাপদ্ধতির শরণাপন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং হরিয়ানা রাজ্যের ‘ন্যাশনাল ফার্টিলিটি সেন্টারে’ চিকিৎসা গ্রহণ করেন। এ সম্পর্কে দালজিন্দার কৌড় বলেন,
“সবাই আমাকে বলতো কোনো বাচ্চা পালক নিতে, কিন্তু আমি তা কখনোই চাইতাম না। এখন আমার নিজেরই সন্তান রয়েছে। আমরা তাকে বড় করবো এবং সঠিক শিক্ষা প্রদান করবো। ঈশ্বরের প্রতি আমার বিশ্বাস ছিল তিনি আমাকে বাচ্চা প্রদান করবেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি আমার প্রার্থনা শুনেছেন।”
ওমকারি পানওয়ার
ওমকারি পানওয়ারের দুটি মেয়ে এবং পাঁচজন নাতি-নাতনি থাকা সত্ত্বেও শুধু নিজেদের সম্পত্তির ভার অর্পণ করার জন্য একটি ছেলেসন্তান পাবার আশায় মরিয়া হয়ে ছিলেন তিনি। তাই তার বয়স যখন প্রায় ৬০, তখন তিনি তার স্বামীর সাথে বসে সিদ্ধান্ত নেন IVF করাবেন। এজন্য তারা তাদের সমস্ত সঞ্চয় এবং ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে চিকিৎসা শুরু করেন। ফলে ২০০৮ সালে ৭০ বছর বয়সে ওমকারির স্বপ্ন পূরণ হয়। তিনি একই সাথে একটি ছেলে ও একটি মেয়ের জন্ম দেন। তবে জন্মের সময় বাচ্চা দু’টির প্রত্যেকের ওজন এক কেজিরও কম ছিল।
বাচ্চা দুটি জন্ম দেওয়ার পর খুশিতে আত্মহারা ওমকারি বলেন,
“আমাদের ইতোমধ্যে দুটি মেয়ে আছে, কিন্তু আমাদের সম্পত্তি দেখাশোনা করার জন্য একটি ছেলের প্রয়োজন ছিল। এই ছেলে এবং মেয়ে হলো আমাদের কাছে ঈশ্বরের দেয়া সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার।”
তার স্বামী ছরাম সিং বলেন,
“আমাদের ভেতর সব সময়েই একটি পুত্রসন্তান পাবার আকাঙ্ক্ষা ছিল, কিন্তু ঈশ্বর আমাদের সে সময় পুত্র সন্তান দেননি। কিন্তু আজ আমরা ঈশ্বরের প্রতি খুবই কৃতজ্ঞ যে তিনি অবশেষে আমাদের ডাক শুনেছেন।”
আদ্রিয়ানা ইলেস্কু
২০০৫ সালে ৬৬ বছর বয়সে আদ্রিয়ানা গর্ভবতী হন। তবে তার এত বেশি বয়সে সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্তকে তখনকার ধর্মীয় এবং নৈতিক সংগঠনগুলো কোনোভাবেই মেনে নেয়নি। তারা আদ্রিয়ানার এই সিদ্ধান্তকে ‘বিদঘুটে’, ‘ভয়ংকর’ এবং ‘স্বার্থপরতার চূড়ান্ত রূপ’ হিসেবে আখ্যা দেন।
তবে পেশায় রোমানিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আদ্রিয়ানা কোনো ভ্রূক্ষেপই করেননি এসবে। কারণ তিনি প্রথম থেকেই শারীরিকভাবে ব্যর্থ ছিলেন গর্ভধারণে এবং মা হবার ইচ্ছা খুব তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল তাকে। তাই প্রায় ৯ বছর ধরে IVF এর মাধ্যমে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত তিনি গর্ভধারণে সক্ষম হন। তবে জন্মের পর তার বাচ্চা এলিজার ওজন ছিল মাত্র ১.৩ কেজি, এজন্য তাকে আইসিইউ’তেও রাখতে হয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে এলিজা সুস্থ হয়ে যায় এবং স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে শুরু করে।
পরবর্তীতে আদ্রিয়ানা তার এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বলেন,
“এলিজা একটি চঞ্চল এবং হাসিখুশি মেয়ে। আমার কাছে সে-ই সবকিছু এবং অন্য কোনোকিছুকে আমি আর তোয়াক্কা করি না। এই সন্তানটি আমার এবং এটিই আমার কাছে এখন সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি ধূমপান বা মদ্যপান কোনোটাই করি না। তাই আমার পিতামাতা যত বছর বেঁচেছিলেন, আমিও যদি তত বছর বাঁচি, তাতেও এলিজার বয়স ২০ বছর হয়ে যাবে। আমি মনে করি এখনো আমার এলিজাকে অনেক কিছু দেওয়ার আছে।”
মারিয়া দেল কারমেন বুসাদা দে লারা
মূলত স্পেনের অধিবাসী এবং পেশায় একজন দোকানী মারিয়াও ছিলেন বিশ্বের বেশি বয়সে মা হওয়া নারীদের মধ্যে একজন। ২০০৬ সালে ৬৬ বছর বয়সে তিনি দুই জমজ সন্তানের মা হন। তিনি স্পেন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়িই জমিয়েছিলেন শুধু IVF চিকিৎসা গ্রহণ করার জন্য। পরবর্তীতে তিনি স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি নিজের বয়স লুকিয়েছিলেন যাতে তার IVF চিকিৎসার জন্য ৩৫,০০০ ডলার জোগাড় করতে পারেন। এমনকি তিনি তার পরিবারের কাউকেই তার এমন সিদ্ধান্তের কথাও জানাননি। কারণ, সে সময়ে এত বেশি বয়সে বাচ্চা নেওয়ার এমন পদ্ধতি বেশ বিতর্কিত একটি বিষয় ছিল।
যদিও এত শ্রম এবং ত্যাগ স্বীকারের পরে তিনি দুটি ফুটফুটে বাচ্চার মা হয়েছিলেন, তবুও তিনি বেশি দিন নিজের বাচ্চাদের সাথে আনন্দে সময় কাটাতে পারেননি। কারণ, মা হবার পরপরই তার ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং এজন্য তাকে চিকিৎসাও নিতে হয়। ২০০৯ সালে প্রায় তিন বছর ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি আশা করতেন, তার মা যেমন ১০১ বছর বেঁচে ছিলেন, তিনিও হয়তো এতো বছর বেঁচে থেকে নিজের সন্তানদের বেড়ে উঠতে দেখবেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তা আর হয়ে ওঠেনি। বর্তমানে তার ছেলে ক্রিশ্চিয়ান এবং পাউকে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা দেখাশোনা করছে।
ফিচার ইমেজ: gettyimages.co.uk