ঘটনার শুরু সত্তরের নির্বাচন থেকে, পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়, ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহা থেকে বাঙ্গালীর অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। জন্মের শুরু থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের ক্ষমতার কেন্দ্রটি নানাভাবে পশ্চিম পাকিস্তানীরা দখল করে রাখে। সামরিক বাহিনী থেকে শুরু করে সর্বত্র এই বৈষম্যের প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছিলো সত্তরের নির্বাচন। ভোটের বিশাল বিজয়ের পর গণমাধ্যম আর পত্রিকায় শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও আখ্যা দিয়েছিলেন ক্ষমতা আকড়ে বসে থাকা ইয়াহিয়া খান। ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙ্গালীকে শায়েস্তা করার অভিযানে নামে পাকিস্তানী সামরিক শাসকেরা।
সামরিক প্রশাসনের খুব কাছ থেকে ঘটনা দেখেছেন এমনই একজন হলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন ‘চিফ অব জেনারেল স্টাফ’ (সিজিএস) লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসান খান। তার সামরিক জীবনের নানা ঘটনাবহুল দিক নিয়ে লিখেছেন আত্মজীবনী। সেই আত্মজীবনীতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনাবলি।
তবে বলে রাখা ভালো, রাজনীতিবিমূখ পেশাদার এই সৈনিক অন্য অনেক পাকিস্তানী সেনার মতোই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ঘটনাকে মেনে নিতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের উত্থানকেও ভালো চোখে দেখেননি তিনি। ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’য় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ছাড় দেওয়া, পরবর্তীতে তার দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়াকে মোটেই সহ্য করতে পারেননি গুল হাসান। তবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে তারই সহকর্মী এবং মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার ব্যাপারে তার মূল্যায়ন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে আরো গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।
দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া প্রতিবাদের মুখে আইয়ুব খানকে সরিয়ে যখন ইয়াহিয়াকে ক্ষমতায় বসানোর মঞ্চ তৈরি হচ্ছে, ঠিক তখনই গুল হাসানকে ‘চিফ অব জেনারেল স্টাফ’ হিসেবে নিয়োগ দিয়ে নিয়ে আসা হয় সেনা সদরে। ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রধান সামরিক শাসক হিসেবে দায়িত্ব নেন এবং উপ-প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান জেনারেল হামিদ। প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার হিসেবে নিযুক্ত হন জেনারেল পীরজাদা।
এই কাঠামো ব্যবস্থায় সকল সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা চলে যায় এই তিনজনের হাতে। জেনারেল গুল হাসান সিদ্ধান্ত গ্রহণের দৌড়ে বাকিদের চেয়ে পিছিয়ে পড়েন। গুল হাসানের ভাষ্য অনুযায়ী, সামরিক আইনে প্রয়োজন মোতাবেক বিধিবিধান জারি করা সম্ভব। সুতরাং, দেশের বেসামরিক প্রশাসনকে সামরিক আইন দিয়ে চালাতে দুই পক্ষের সমন্বয় প্রয়োজন। কিন্তু ইয়াহিয়া সর্বত্র এত বেশি সামরিক কর্তৃপক্ষ তৈরি করায় দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়।
সামরিক শাসকদের চেয়ে তার কাছে রাজনৈতিক নেতাদের আরো বেশি অদক্ষ মনে হয়েছে। তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদেরকে তার মনে হয়েছে অদূরদর্শী এবং পুরো পাকিস্তানের স্বার্থ বাদ দিয়ে নিজেদের প্রদেশের গণ্ডির বদ্ধ পাঁকে বন্দী। অন্যদিকে ইয়াহিয়া তার দেশ পরিচালনার জন্য জেনারেল পীরজাদা আর হামিদের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। এই ব্যাপারটি নিয়ে বেশ ঝাঁঝালো মন্তব্য করেছেন গুল হাসান। তার মতে,
সেনাবাহিনীর পেশাদার চাটুকাররাই ইয়াহিয়ার কাছে যাবার সহজ সুযোগ পায় এবং মদ্যপ অবস্থায় তাকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে।
নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের সামগ্রিক বিজয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ন্যূনতম একটি আসন লাভেও ব্যর্থ। আর ঠিক প্রায় উল্টোটা ভুট্টোর জন্য, পশ্চিমে সংখ্যাগরিষ্ঠতা, কিন্তু পূর্বে একটিও না। ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে নাটক শুরু হয়। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। ফেব্রুয়ারির শেষদিকেই জেনারেল হামিদ জেনারেল গুল হাসানকে বলে রাখেন, সাঁজোয়া কিংবা ভারী সরঞ্জাম ছাড়াই দুই ডিভিশন সৈন্য বিমানযোগে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত রাখতে। ২৭ তারিখ থেকে ২ মার্চ পর্যন্ত সৈন্য পাঠানো অব্যাহত থাকে পূর্ব পাকিস্তানে।
অন্যদিকে মার্চের তিন তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য সংসদের অধিবেশনও বাতিল করা হয়। পুরো পূর্ব পাকিস্তান ফুঁসে উঠায় সমস্ত কর্তৃত্ব চলে যায় শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে। গুল হাসানের ভাষ্যমতে, সেনাবাহিনী আর জনতাকে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দেন শেখ মুজিব। পূর্বাঞ্চলীয় বেসামরিক প্রশাসনের পুরোটাই শেখ মুজিবের হাতে চলে যাওয়ায় শেখ মুজিবের নির্দেশ অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তান হাই কমান্ড পশ্চিম থেকে সেনাসদস্য আনা বন্ধ রাখে। এই ব্যাপারগুলোকে তিনি উল্লেখ করেছেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াকুব খানের ব্যর্থতা হিসেবে। গুল হাসানের মতে শেখ মুজিবের নির্দেশ অনুযায়ী সেনা ব্যারাকে সরিয়ে নেওয়া এবং পশ্চিম থেকে সেনা আনা বন্ধ করে দেওয়ায় আসল বিজয়ী হয় শেখ মুজিব।
ইয়াকুব খানের ব্যর্থতার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসনের ভিত্তি নড়ে যায়। কিছুদিন আগেই এডমিরাল আহসানকে সরিয়ে ইয়াকুব খানকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তাকেও সরিয়ে সেই পদে টিক্কা খানকে বসানো হয়। তবে বারবার এই পরিবর্তন প্রশাসনের ব্যর্থতার স্পষ্ট ইঙ্গিত হয়ে ওঠে। তাই যাবার আগেই গুল হাসানকে টিক্কা খান আরো দুই ডিভিশন সেনা প্রস্তুত রাখতে বলে গিয়েছিলেন। তখন থেকেই বাঙ্গালীকে সামরিকভাবে শায়েস্তা করার চিন্তা চলতে থাকে বলে গুল হাসান অভিমত দিয়েছেন।
তবে ১৯৭১ সালে জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারির দিকেই সামরিক শাসনের বেড়াজাল আরো দৃঢ় করতে কঠোর সামরিক অভিযান ‘অপারেশন ব্লিৎস’ নামেও একটি পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এটি অবশ্য পরে বাদ দেওয়া হয়। তবে গুল হাসানের মতে পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেওয়া হয় ‘অপারেশন সার্চলাইটে’র পরিকল্পনা করে। ইয়াহিয়ার সাথে দেখা করে ভুট্টো মতামত দেন ‘সংক্ষিপ্ত কিন্তু প্রচণ্ড’ কোনো সামরিক ব্যবস্থা নেওয়ার, যেন শেখ মুজিব আর তার অনুগামীদের সম্বিত ফিরে। এই প্রস্তাবে ইয়াহিয়ার কাছের দুই পরামর্শক জেনারেল হামিদ আর পীরজাদা সম্মতি দিলে তা বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যায়।
২৫ মার্চের নৃসংশতার ঘটনা ঘটার পরে তা সম্পর্কে তা জানতে পারেন গুল হাসান। তবে চীফ অব জেনারেল স্টাফ হওয়া সত্ত্বেও তাকে এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে পুরোপুরি অন্ধকারে রাখা হয়। তাকে বাদ দিয়ে ঢাকায় গোপন মিটিংয়ে যোগ দেন টিক্কা খান, পাকিস্তান থেকে উড়ে আসা জেনারেল মিঠা আর ইফতিখারও। গণহত্যার চেয়ে এই মিটিংয়ে না রাখার ক্ষোভই তার কাছে প্রাধান্য পেয়েছে।
সদ্য নিয়োগ পাওয়া পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক নিয়াজী সামরিক বাহিনীতে ছিলেন গুল হাসানের জুনিয়র। তার নিয়োগের ব্যাপারেও সন্তুষ্ট ছিলেন না গুল হাসান। তবে সামরিক ব্যাপারে সব সিদ্ধান্ত, গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয়েছিলো জেনারেল হামিদের কাছের ব্যক্তিদের। এই নিয়ে চাপা অসন্তোষও প্রকাশ পেয়েছে গুল হাসানের বক্তব্যে।
টিক্কা খান গভর্নর থাকাকালীন খুব অল্প সময়ের জন্য গুল হাসান ঢাকা ভ্রমণে গিয়েছিলেন। তার দৃষ্টিতে টিক্কা খানের আমলে সেনাবাহিনীর মানসিক অবস্থায় পরিবর্তন এসেছিল। টিক্কা খান তাকে জানান, সৈন্যরা ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় চলছে খণ্ডযুদ্ধ। ট্রেন, বাস, স্টিমার সব থেমে আছে। তারা কেউ কেউ অসহযোগ করছে আর অন্যরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পালাচ্ছে।
আগস্টে টিক্কা খানকে অপসারণ করে এ এম মালিককে গভর্নর নিয়োগ দেওয়ায়ও তার ছিল হতাশা। তার পর্যবেক্ষণ অনুসারে টিক্কা খান অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ‘ত্বরিত আর প্রচণ্ড’ সামরিক অভিযান পরিচালনা করে যাচ্ছিলেন। তবে গুল হাসানের মতে, বেসামরিক গভর্নর, সাধারণ ক্ষমা দিয়ে রাজনৈতিক সমাধানের পথে পাকিস্তান এগিয়ে যেতে পারেনি ভারতের প্রচারণার কারণে! ভারতে গঠিত আস্থায়ী সরকারের সাথে যোগাযোগ করে সমাধান বের করার চেষ্টাও তার মনে হয়েছে ‘শিশুসুলভ আচরণ’। তার বইতে তিনি বারবার উল্লেখ করার চেষ্টা করেছেন ভারত পাকিস্তানের বিরোধ নিরসনের চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে নানাভাবে।
তার মতে ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট ভারতের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের চুক্তিটি ছিল পাকিস্তানের জন্য হুমকি। মূলত পাকিস্তান তখন চীন আর আমেরিকার মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসেবে কাজ করছিল।
গুল হাসানের অভিমত ছিল, এই কাজে ব্যাঘাত ঘটাতেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে সামরিক সহায়তা করতে উদ্যত হয়। সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ হয়েও কূটনৈতিক অনেক খবর ছিল তার অজানা। ইয়াহিয়া আর হামিদ তাদেরকে কূটনৈতিক সিদ্ধান্তের অংশ করলে ব্যাপারটি অনেক বেশি ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল বলেই তিনি মনে করেন। গুল হাসানের মতে ইয়াহিয়া খানের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে শোচনীয় অধঃপতনের জন্য দায়ী ছিলেন হামিদ আর পীরজাদা। জেনারেল হামিদ সব গুরুত্বপূর্ণ পদে তার আস্থাভাজন ‘মাফিয়া’ সদস্যদের নিয়োগ দিতে থাকেন। সেনা হেডকোয়ার্টারে চলতে থাকে নেতৃত্বের কোন্দল।
গুল হাসান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অক্টোবরে পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে বেশ অবাক হয়েছিলেন। পত্রিকা আর খবরাখবর পড়ে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা তখনো তার কাছে নিয়ন্ত্রণযোগ্য মনে হয়েছিল। কিন্তু সরেজমিনে এসে দেখলেন, পাকিস্তানি গোয়েন্দা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ কুপোকাত, গেরিলা আক্রমণের কাছে পেশাদার বাহিনী নাস্তানাবুদ। সীমান্তজুড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মুক্তিফৌজের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত পাকিস্তানি সেনারা।
তবে গুল হাসানের মতে, নিয়াজীর তখন ঢাকা রক্ষার দিকেই বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত ছিল। ভারত কখনোই পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করবে না এমন দৃঢ় মনোভাব নিয়ে অগোছালো এক যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে নিয়াজী লড়াই করে যাচ্ছিলেন। গুল হাসান নিজে নিয়াজীকে অনুরোধ করেছিলেন তার পরিকল্পনা পুনর্বিন্যাসের জন্য, খুব একটা লাভ হয়নি।
পূর্ব পাকিস্তানে শেষবার অক্টোবরে সফরে আসেন গুল হাসান। তার তখনকার বর্ণনায় ফুটে উঠে মক্তিযুদ্ধের কারণে দেশের অভ্যন্তরে সাধারণ মানুষের কতটা ব্যাঘাতগ্রস্ত হয়েছিল,
আমি সবসময় আকাশপথে ভ্রমণ করেছি। খুব নিচু দিয়ে উড়ে যেতাম। কিন্তু নীচের সেই পরিচিত দৃশ্য, মাঠে কর্মরত চাষী, মাছ ধরায় মগ্ন পুরুষ-নারী, আগে যা দেখা যেত সেসব সাধারণ দৃশ্য দেখতে পাইনি। এটা অদ্ভুত লাগে, কারণ পূর্ব পাকিস্তান পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল এলাকাসমূহের একটি। অথচ, জনগণের চলাচল, ব্যস্ততা কিছুই নেই।
গুল হাসান টের পেয়েছিলেন দেশের ভেতর ছড়িয়ে থাকা সড়কপথ তখন অনেকটাই মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে, সামরিক বাহিনীকে সাধারণ স্থানীয় মানুষ শত্রু হিসেবে গণ্য করছে। এই অবস্থায় যুদ্ধ পরিচালনা করা প্রতিদিন আরো কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। সীমান্ত লক্ষ্য করে ভারতীয় সেনা সমাবেশ বেড়েই যাচ্ছিল। পাশাপাশি দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে ভারতীয় নৌবাহিনীর অবস্থানকে করা হচ্ছিলো সুদৃঢ়। ভারত যখন এই যুদ্ধের জন্য আটঘাট বেঁধে প্রস্তুতি নিচ্ছে তখনো নিয়াজীর কাছ থেকে পশ্চিমে বার্তা যাচ্ছে, “পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, সব ঠিকঠাক চলছে।”
গুল হাসানের তথ্য অনুযায়ী, ২১ নভেম্বর ভারত পূর্ব পাকিস্তানের ছিটমহল এলাকা আক্রমণ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কি করা যেতে পারে গুল হাসানের কাছে জানতে চান ইয়াহিয়া খান। গুল হাসান জানান, পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই পাকিস্তানের মৌলিক সামরিক পরিকল্পনাই ছিল ভারত যদি পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করে তবে তার প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিম পাকিস্তান ভারতের পশ্চিম অংশে হামলা চালাবে। আর যেহেতু ভারত তাদের সামরিক বাহিনীর ফর্মেশনগুলো পূর্বে সরিয়ে নিয়ে গেছে তাই পশ্চিমে আক্রমণ করলে তাদের সেনাদেরকে পশ্চিমে মোকাবেলার জন্য সরিয়ে আনতে হবে, পূর্বে চাপ কমে যাবে। আর পশ্চিমে পাকিস্তান বাহিনী তাদের শক্ত ঘাঁটিগুলো গড়ে তুলেছে। ফলে সেখানে ভারতীয় ভূমি দখল করে ফেলতে পারলে সেটি পাকিস্তানকে দরকষাকষির সুযোগ দেবে। তাই সারাদেশ থেকে বিছিন্ন সৈন্য সরিয়ে নিয়ে ঢাকা রক্ষা করতে পূর্বে সংকেত দেওয়া এবং পূর্বে আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমে আক্রমণই ছিল তার লক্ষ্য।
তবে পূর্ব পাকিস্তান থেকে নিয়াজীর রিপোর্ট অনুযায়ী জেনারেল হামিদ জানালেন তখনো পরিস্থিতি নিয়াজীর নিয়ন্ত্রণে। এখনই পশ্চিমে আক্রমণের দরকার হবে না। গুল হাসানের অনুমান ছিল এই রিপোর্টগুলো জেনারেল হামিদ এবং প্রেসিডেন্টকে খুশি রাখার জন্যই পাঠানো হয়েছিল। অনুমান সত্যি করে দিয়ে ডিসেম্বরের ছয় তারিখ যখন পুরোদমে যুদ্ধ বেঁধে গেল তখন দেখা গেল নিয়াজীর কোনো ডিভিশনেরই রিজার্ভ সৈন্য নেই। সবাইকে ইতোমধ্যেই যুদ্ধে নিয়োজিত করে দেওয়া হয়েছে। নয় ডিসেম্বর নিয়াজী তার অবস্থার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে রিপোর্ট করেন। সেদিন তিনি পূর্ব পাকিস্তানকে ভারতীয় বিমান হামলা থেকে রক্ষার জন্য বিমানবাহিত ‘রিইনফোর্সমেন্ট’ চান। যা ঐ অবস্থায় মোটেই সম্ভব ছিল না। তাই পরাজয় যে ঘনিয়ে আসছে তা টের পাওয়া যাচ্ছিল।
১৬ ডিসেম্বর হার মেনে পূর্ব পাকিস্তান ছাড়তে হয় পাকিস্তানীদের। এরপর পাকিস্তানে দ্রুত রাজনৈতিক পরিবর্তন চলতে থাকে। ইয়াহিয়া পদত্যাগ করেন, ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। জেনারেল হামিদকে বরখাস্ত করা হয় এবং জেনারেল গুল হাসানকে তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও কমান্ডার-ইন-চীফ অর্থাৎ সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন ভুট্টো।
তবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কার্যকলাপ এবং যুদ্ধে হারের কারণ অনুসন্ধানের লক্ষ্যে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে গঠন করা হয় ‘হামুদুর রহমান কমিশন’। সেখানে বিভিন্ন অপরাধে ইয়াহিয়া, হামিদ, পীরজাদার পাশাপাশি দায়ী করা হয় গুল হাসানকেও। বাংলাদেশে চালানো গণহত্যার পরিকল্পনার পেছনে তারও অনুমোদন ছিল বলে মনে করেন। হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের ব্যাপারে যে তদন্ত রিপোর্ট দেওয়া হয়েছিল তা এখনো জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। তবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যার জেরে ভুট্টো ১৯৭২ সালের মার্চেই পদচ্যুত করেন গুল হাসানকে।