জুলাই মাস থেকে মুক্তিবাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামোতে পরিবর্তন আসে। কামালপুর ১১ নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত হয়। মেজর আবু তাহের (পরে কর্নেল এবং বীর উত্তম) সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পান। কামালপুর ঘাঁটিতে নিয়মিত হামলার পরিকল্পনা হয়। এ সময় ছোট ছোট হামলা করে কামালপুরের পাক ঘাঁটিকে কাবু করার সিদ্ধান্ত হয়।
৯ আগস্ট কামালপুরের টেলিফোন লাইন কেটে দেয় মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোরা। অপারেশন শেষ করে আসার পথে তারা দুই রাজাকারকে ধরে নিয়ে আসে।
১৫ আগস্ট ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা হালকা অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে কামালপুর। পরের দিন সুবেদার মনসুরের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর আরেকটি দল আঘাত হানে এই ঘাঁটিতে।
১৭ আগস্ট মেজর তাহের নিজে কামালপুর আক্রমণ করেন। ১৫-২০ জন পাকসেনা খতম হয় এদিন।
২০ আগস্ট মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশে পড়ে পাক পেট্রোল পার্টি। নিহত হয় ২ জন।
৬ সেপ্টেম্বর কামালপুর বিওপিকে বনজঙ্গলপূর্ণ পথ দিয়ে এগিয়ে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে আক্রমণ করা হয়। পিছু হটে পাকবাহিনী। বকশীগঞ্জ থেকে তাদের সাহায্য করতে আসা দলটিও অ্যামবুশে পড়ে। তবে তীব্র মেশিনগানের গুলিতে মুক্তিবাহিনী আবার পিছু হটে। সকাল সাতটায় অ্যামবুশ পয়েন্ট পাকিস্তানি রিইনফোর্সমেন্ট আসতে গিয়ে একটি ট্রাক মুক্তিবাহিনীর পাতা ল্যান্ডমাইনে ধ্বংস হয়। আরো দুটি থেকে শক্রসেনারা নেমে রাস্তার পাশে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করে, এতে আরও পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। ৩৩ জন পাকসেনা নিহত হয়।
পাক বাহিনীকে একটা দিনও শান্তিতে ঘুমাতে না দেয়ার কৌশলে যায় মুক্তিবাহিনী।
৭ সেপ্টেম্বর থেকে কয়েকদিন মেজর তাহের সব হামলা বন্ধ রাখেন। কামালপুর-বকশীগঞ্জ সড়কটি ব্যবহারের অবাধ সুযোগ দেন। পরদিন ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি ক্যাপ্টেন বজলুল গণি পাটোয়ারীর নেতৃত্বে মহেন্দ্রগঞ্জে আসে। ১ ইস্ট বেঙ্গলের কমান্ডার ছিলেন মেজর মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন আহমেদ। মেজর তাহের কামালপুরকে ঘিরে ধরার সিদ্ধান্ত নেন। সামরিক পরিভাষায় যাকে বলে Encirclement। মুক্তিযোদ্ধারা কামালপুর-বকশীগঞ্জ সড়কে ব্যাপকভাবে অ্যান্টি-ট্যাংক ও অ্যান্টি-পারসোনাল মাইন স্থাপন করেন।
মেজর জিয়াউদ্দিনের সেনাদের ধানুয়া, কামালপুর ও খাসের গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দিতে বলা হয়। পূর্ব পাশেও মুক্তিবাহিনীর একটি দল অবস্থান নেয়।
১০ তারিখ সূর্যোদয়ের আগেই মুক্তিবাহিনী কামালপুর বিওপি চারদিক থেকে অবরুদ্ধ করে ফেলে। কামালপুর বিওপিতে অবস্থানরত শত্রুর জন্য কেবল দুটি পথই খোলা থাকে; হয় রাতের অন্ধকারে ছোট ছোট দলে পলায়ন করা অথবা একত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে আক্রমণ করা।
মুক্তিযোদ্ধারা রাতারাতি বেশ কিছু বাংকার তৈরি করে তাদের অবস্থান আরও মজবুত করেন। তাদের অবস্থানের সামনে থেকেই ১-৩ ফুটের গভিরতার জলো মাঠের শুরু। মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ১০০ গজের মধ্যে এলে গুলিবর্ষণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। পরিকল্পনা ছিল শত্রুসেনারা কামালপুর ঘাঁটি থেকে বের হয়ে এসে যখন আক্রমণ চালাবে, তখন সম্পূর্ণ কিংবা আংশিক পরিত্যক্ত কামালপুর ঘাঁটিটি দখলে নেবে আরেক কোম্পানি সেনা। এ জন্য এক কোম্পানি মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে তৈরি থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়।
১১ তারিখ দুপুর থেকে পাক বাহিনী মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে হামলা শুরু করে। দুপুরবেলা মেজর তাহেরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে ১৮ মাইল দূরে মাইনকার চর সাব-সেক্টরের দিকে রওনা হয়। মাইনকার চরে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে মেজর তাহের খবর পান যে ধানুয়া ও খাসের গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ করেছে। খবর পেয়েই তিনি মহেন্দ্রগঞ্জে রওনা দেন।
বেলা আড়াইটার সময় মেজর তাহের মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার পরপরই কামালপুর থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একদল সেনা আক্রমণের উদ্দেশ্যে খাসের গ্রামের দিকে এগোতে থাকে। খাসের গ্রামে অবস্থিত প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানিটি উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে শত্রু নির্দিষ্ট স্থানে আসার আগেই গুলিবর্ষণ শুরু করে। পাকিস্তানি সেনারা এই গুলিবর্ষণ উপেক্ষা করে ভারী অস্ত্রসহ বেপরোয়াভাবে এগোতে থাকে। তাদের পাল্টা গুলিতে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন নায়েব সুবেদার ও অপর একজন জোয়ান নিহত হন। সে সময় পেছন দিক থেকে কেউ একজন চিৎকার করে বলে যে বকশীগঞ্জ থেকেও আরেক দল সেনা আক্রমণ করতে আসছে। এতে কোম্পানিতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং নিজ স্থান ছেড়ে তারা পিছিয়ে যেতে থাকে।
মুক্তিযোদ্ধাদের ধানুয়া-কামালপুর অবস্থানের দক্ষিণ দিক থেকে একটি মেশিনগান গুলি শুরু করতে থাকলে খাসের গ্রামের ওপর আক্রমণরত পাকিস্তানি সেনারা হতাহত হতে থাকে এবং শেষপর্যায়ে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। মেশিনগানার ব্যারেল ধরে হাত পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। মেজর তাহের বেলা সাড়ে চারটার মধ্যে মহেন্দ্রগঞ্জে ফিরে আসেন। ক্যাম্পে পৌঁছে যে কোম্পানিকে তিনি কামালপুর বিওপি আক্রমণের জন্য তৈরি থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন তাদের খোঁজ করেন। এই কোম্পানিকে কামালপুর বিওপির চারদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের ডিফেন্স সুদৃঢ় করার জন্য প্রেরণ করা হয়। এদের ডিফেন্স লাইনে পাঠানোর ফলে আক্রমণের জন্য আর বাড়তি কোনো সেনা থাকে না। ফলে ঘাঁটি পুরোপুরি দখল করতে আর হামলা চালানো যায়নি সেদিন। এদিনের যুদ্ধে কামালপুরের পতন না হলেও মুক্তিবাহিনীর মনোবল চাঙ্গা হয়।
চূড়ান্ত লড়াই: রোড টু ঢাকা
নভেম্বর মাস থেকে শক্রদের ওপর আঘাতের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়া হয়।
১৪ নভেম্বর রাত ১২টা থেকে কামালপুরের ওপর সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করে মুক্তিবাহিনী। পরিকল্পনা আগের মতোই। এদিন রিজার্ভ হিসেবে ভারতীয় বাহিনীর ১৩ গার্ড রেজিমেন্ট এবং ১ মারাঠা রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানি মোতায়েন ছিল। কামালপুরকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরতে শুরু করে মুক্তিবাহিনী। ভারতীয় বাহিনী তাদের সীমানা থেকে আর্টিলারি সাপোর্ট দেয়। যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মেজর তাহের। সেদিন তার জন্মদিনও ছিল। অগ্রবর্তী দলের কমান্ডার ছিলেন লে. মিজান।
নিজের জন্মদিনে কেক কাটার বদলে পাক ঘাঁটিতে গোলা নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে মেজর তাহের জন্মদিন পালন সূচনা করলেন। পাকিস্তানিদের পতনই হবে তার উপহার।
রাত ৩টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা ঘাঁটি মাত্র ৩০০ মিটার দূরে। তীব্র হামলায় পাকিস্তানি সৈন্যরা বাংকার ছেড়ে আখ ক্ষেতে পালিয়ে যাচ্ছিল। তাদের টার্গেটে আনার জন্য তখন রাতের আকাশে ফ্লেয়ার ছোড়া হচ্ছিল। “জয় বাংলা, জয় বাংলা” ধ্বনি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ আরও শক্তিশালী করে তুলছিলেন। এ সময় কোম্পানি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট মিজান ওয়াকিটকিতে মেজর তাহেরকে জানান, তিনি পাকিস্তানিদের বাংকারের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই মেজর তাহেরের সঙ্গে লেফটেন্যান্ট মিজানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
সকাল প্রায় সাড়ে ৮টার দিকে মেজর তাহের তার অবস্থান থেকে মূল যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে অগ্রসর হলেন। তার জিপ গাড়িতে করে সামনে ফায়ার করতে করতে সামনে এগিয়ে যেতে শুরু করেন তিনি। মিজানকে পাওয়া না যাওয়াতে তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন। মূল যুদ্ধক্ষেত্রে পাওয়া যায় তাকে। মেজর তাহের একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সৈন্যদের নির্দেশ দিচ্ছিলেন। পাকঘাঁটি পতন তখন সময়ের ব্যাপার।
ন’টার দিকে একটি ল্যান্ডমাইনে বা কামানের শেলে আবু তাহের আহত হন। তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন, কিন্তু জ্ঞান হারালেন না। তার দিকে সবাই এগিয়ে আসতে শুরু করলে তিনি সবাইকে শুয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। এত লোক এক জায়গায় ভিড় করলে শত্রুরা আবার সেখানে গোলা ফেলবে, এতে হতাহত আরো বাড়বে। পরে তাকে ভারতের গৌহাটির এক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। একটি পা কেটে ফেলতে হয় তার। সেদিন ঘাঁটি না দখল করেই ফেরত আসেন মুক্তিযোদ্ধারা। এদিকে হাসপাতাল থেকে মেজর তাহের লেফটেন্যান্ট মান্নানকে চিঠি লেখেন। তাতে বলা ছিল,
CLEAR THE ROAD FROM HERE TO DACCA. LOOK AFTER MY BOYS. I LEAVE EVERYTHING TO YOU. GOD BLESS YOU
২৪ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটানা ১১ দিন এ পাক ছাউনি অবরুদ্ধ রাখা হয়। এ সময় ব্রিগেডিয়ার ক্লের নেতৃত্বে মিত্র বাহিনীও যোগ দেয়। উল্লেখ্য, ভারত সরাসরি পাকিস্তানের সাথে ডিসেম্বরে যুদ্ধে জড়ালেও মার্চ-এপ্রিল থেকেই সীমান্তে ছোট ছোট সংঘর্ষ বা Border Skirmish-এ জড়িয়েছিল।
২৮ নভেম্বর ভারতীয় সেনারা নিঃশব্দে পাক ঘাঁটির খুব কাছে চলে যায়। কিন্তু একজনের কাশির শব্দ পেয়ে পাকবাহিনী ফায়ার করে। ২০ জন নিহত হয়। দেখা যাচ্ছিল ১০০ জন ভারতীয় সেনা আক্রমণ করতে গেলে ৩৩ জন হতাহত হচ্ছে। ব্রিগেডিয়ার ক্লে এত ক্ষয়ক্ষতি চাইছিলেন না।
মুক্তিবাহিনীর সাথে পরামর্শ করে ব্রিগেডিয়ার ক্লে আক্রমণ না করে মেজর তাহেরের কৌশল Encirclement প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন। মুক্তিবাহিনী কামালপুরকে চারদিক থেকে শক্তভাবে ঘিরে ধরে। বাইরে থেকে সাহায্য আসার চেষ্টা করলেও সেগুলোকে প্রতিহত করে তারা। এরই মধ্যে কয়েক দফা বিমান হামলাও চালানো হয়। ২৯ নভেম্বরের দিকে ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান মাহমুদ কামালপুরে রিইনফোর্সমেন্ট পাঠানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধা বশীর আহমদ ও আনিসুর রহমান সঞ্জু পাকবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের বার্তা নিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী ঘাঁটিতে ঢুকে পড়লে তাদের কপালে বড় দুঃখ আছে এটা বুঝতে পারে তারা।
পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ক্যাপ্টেন আহসান মালিক সাদা পতাকা নিয়ে বের হয়ে আসেন। যৌথ বাহিনী তাদের সাথে সদয় আচরণ করে। বিবিসিতে এ খবর প্রচার করা হয়। ক্যাপ্টেন আহসান মালিক পরে মুক্তিবাহিনীর বীরত্বের প্রশংসা করেন।
পুরো মুক্তিযুদ্ধে কামালপুর অভিযানে সর্বমোট ১৯৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, আহত হন অসংখ্য। অন্যদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর আইয়ুবসহ অন্তত ২২০ জন সেনা নিহত হয়। বীর উত্তম থেকে বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ২৯ জন মুক্তিযোদ্ধা সাহসিকতা পদক পেয়েছেন কেবল কামালপুর যুদ্ধের জন্যই; মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এমন উদাহরণ আর একটিও নেই। আর্টিলারি এবং এয়ার সাপোর্ট ছাড়া এরকম দুর্গে হানা দেয়ার ইতিহাস বিশ্বে বিরল।
১৯৭১ সালের আর কোনো যুদ্ধে কামালপুরের মতো এত সময় ও অস্ত্র ব্যবহার হয়নি। পাকবাহিনী যে কৌশলে প্রতিরক্ষা দুর্গ নির্মাণ করেছিল এবং বারবার মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করেছিল সেটা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু মুক্তিবাহিনী যেভাবে কামালপুরের পতন ঘটায়, সেটা এক মহাকাব্য এবং ইতিহাসের অন্যতম বীরত্ব। তবে এ মহাকাব্য লিখতে প্রচুর রক্ত খরচ হয়েছে। আর এই রক্ত দিয়েই এসেছে স্বাধীনতা।