মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি
মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি
একটি দেশকে স্বাধীন করার জন্য আমাদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান আর ২ লাখ মা-বোনের ত্যাগ-তিতিক্ষা, কোটি কোটি বাঙালির আত্মনিবেদন ও সংগ্রামের ইতিহাস অতিক্রম করে আমরা পেয়েছি লাল-সবুজের পতাকা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। এখানে সকল পেশা ও শ্রেণির মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তি-সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল। ন’মাসের ক্লান্তিহীন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়েছে স্বাধীনতা। যে যুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এবং তাঁরই নেতৃত্বে স্বাধিকার আন্দোলনে অন্যদের মতোই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের মুক্তিকামী নেতাকর্মীরাও।
আজকের লেখাতে তাদেরই এক যুদ্ধের ঘটনা তুলে ধরা হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যেটি বেতিয়ারা যুদ্ধ নামে পরিচিত। যুদ্ধের সময় তাদের একটি গেরিলা দল বাংলাদেশে প্রবেশের সময় কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রামের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বেতিয়ারা নামক স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর অ্যাম্বুশের মুখে পড়ে। সেদিন নয়জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বাংলাদেশের বাম দলগুলোর প্রতি আওয়ামী লীগ সরকার এবং ভারত কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। যুদ্ধের নেতৃত্ব যাতে বেহাত না হয় সেদিকে আওয়ামী লীগ ছিল খুব সচেষ্ট। পরবর্তীতে ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর হবার পর এই বাধা কেটে গেল। ভারত পুঁজিবাদী দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের বামপন্থী দলগুলোকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করল। সবাই দলে দলে ভারতের আগরতলায় পৌঁছান শুরু করল।
আগরতলায় বাম দলগুলোর নেতাকর্মীরা ক্র্যাফস হোস্টেলে থাকতেন। এখান থেকে যারা মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার জন্য সক্রিয় ছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন কমরেড মণি সিংহ, মোজাফফর আহমদ, মোহাম্মদ ফরহাদ, মতিয়া চৌধুরী, জ্ঞান চক্রবর্তী, অনিল মুখার্জি, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, মতিউর রহমান, শেখর দত্ত, আবদুল হাদী প্রমুখ। নারী নেত্রী বেগম মুসতারী শফি ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী মোহাম্মদ বেলালও এই হোস্টেলে কিছুদিন ছিলেন।
এরপর রিক্রুটিং সেন্টার হিসেবে আগরতলার কর্তাবাড়িকে গড়ে তোলা হয়। বাংলাদেশ থেকে পৌঁছানো কর্মীরা এই কেন্দ্রে আশ্রয় পেতেন। প্রাথমিক বাছাইয়ের পর তাদের মৌলিক প্রশিক্ষণ ছিলো বাধ্যতামূলক। এরপর তাদের মধ্য থেকে গেরিলা যুদ্ধের জন্য যোদ্ধা বাছাই করা হতো। পরবর্তী ধাপে তাদের গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য আসামের তেজপুর ক্যাম্পে পাঠানো হতো। প্রশিক্ষণ শেষে তারা আবার এই ক্যাম্পে ফিরে আসতেন এবং এখান থেকেই দেশের ভেতর তাদের ইন্ডাকশনের (দেশে ফেরত) ব্যবস্থা করা হতো।
ওই সময় আরো একটি ক্যাম্প তৈরি করা হয়। এই নতুন ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় মুনজুরুল আহসান খান, ইয়াফেস ওসমান, নিজামুদ্দিন ও মাহবুবুল হককে। এখানে নতুন রিক্রুটদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। এই ক্যাম্প থেকেই গেরিলা ট্রেনিং শেষে দেশের ভেতরে ইন্ডাকশনের সময় বেতিয়ারায় গেরিলারা শহীদ হন।
১০ নভেম্বর ১৯৭১
আগরতলার অদূরে মুক্তিযোদ্ধাদের বেইস ক্যাম্পে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। প্রত্যেকটি তাঁবুতে আলো জ্বালানো হয়েছে। তাঁবুর ভেতরের আলো ঠিকরে বের হয়ে অন্ধকার হঠানোর চেষ্টা করছে। পুরো ক্যাম্প জুড়েই আজ একটা সাজ সাজ রব বিরাজমান। আসামের তেজপুর থেকে উচ্চতর ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা মুখিয়ে আছেন কখন বাংলাদেশে প্রবেশ করবেন। টিম লিডার ইয়াফেস ওসমান ঘন ঘন এদিক সেদিক পায়চারী করছেন। উত্তেজনার বারুদ তখন তুঙ্গে। পরদিন সকালে ইন্ডাকশন হবে, অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনীর দলটি সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের ভেতরে প্রবেশ করার জন্য, যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার জন্য অস্থির হয়ে আছে। দলটির সামগ্রিক দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তৎকালীন বুয়েটের ভিপি ও প্রথিতযশা কবি, কালজয়ী কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের পুত্র ইয়াফেস ওসমানকে (বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী)। ডেপুটি কমান্ডার নিয়োগ করা হলো তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা নিজামুদ্দিন আজাদকে।
১১ নভেম্বর ১৯৭১
দুপুরের খাবার খেয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ট্রাকে করে গেরিলারা রওনা দিলেন সীমান্তের দিকে। সন্ধ্যার দিকে সীমান্তের খুব কাছাকাছি এসে জঙ্গলের ভেতর সাময়িক অবস্থান নিলেন তারা। কিছুক্ষণ পর মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের শেষ সীমান্ত ভৈরব টিলায় এসে অবস্থান নিলেন; এটি বাংলাদেশের সীমান্ত গ্রাম বেতিয়ারার খুব নিকটেই অবস্থিত। এখানে অবস্থান নিয়ে টিম লিডার ইয়াফেস ওসমান প্রফেশনাল গাইডকে পাঠালেন রেকি করতে। ভৈরব টিলা থেকে নেমেই বেতিয়ারা গ্রাম। সেই গ্রাম ভেদ করে চলে গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। মহাসড়কের একপাশে জগন্নাথ দীঘি আর অন্যপাশে শর্শাদি নামক স্থান। পাকিস্তান বাহিনী এই দুই স্থানেই ঘাঁটি গেড়ে আছে। রাতের বেলা দুটো ঘাঁটি থেকে হানাদার বাহিনী জিপযোগে টহল দিয়ে থাকে। দুই টহল দলের মাঝে ৪৫ মিনিট সময় পাওয়া যায়। এই সুযোগেই গেরিলাদের মহাসড়ক পার হতে হবে।
গেরিলাদের লক্ষ্য হলো গুণবতী-নোয়াখালী ও চাঁদপুর হয়ে ঢাকায় পৌঁছান। ইতোমধ্যে রেকি টিম থেকে খবর চলে এলো মহাসড়ক ফাঁকা, টহল টিমের অস্তিত্ব নেই; তৎক্ষণাৎ ইয়াফেস ওসমান ভৈরব টিলা থেকে গেরিলাদের মুভ করার সবুজ সঙ্কেত দিলেন। সতর্কতা হিসেবে দুটি অ্যাসল্ট পার্টি মোতায়েন করা হলো যেন আঘাত আসলে প্রত্যুত্তর দেয়া যায়। ভৈরবটিলা থেকে নেমে মুক্তিযোদ্ধারা সমতলের ক্ষেত-খামারের আইলের পথ ধরে এগোতে থাকে। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে সিঙ্গেল ফাইলে এগিয়ে যেতে থাকে গেরিলা দল। সবচেয়ে সামনে লোডেড স্টেনগান নিয়ে এগিয়ে চলেছেন ডেপুটি লিডার নিজাম উদ্দিন আজাদ। তার পরপরই অস্ত্র রেডি পজিশন নিয়ে কয়েকজন যোদ্ধা তাকে অনুসরণ করছে। তাদের পেছনে প্যাকিং করে অস্ত্রের বোঝা কাঁধে নিয়ে বাকি যোদ্ধারা সন্তর্পনে এগিয়ে চলেছেন। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে তখন নিজ মাতৃভূমি হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
হাই কমান্ড ৭৮ জনের এই গেরিলা দলকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছে। গ্রুপ আকারে এই গেরিলা দলগুলো হলো ১) কৃষক গেরিলা গ্রুপ, ২) শ্রমিক গেরিলা গ্রুপ, ও ৩) ছাত্র গেরিলা গ্রুপ; সবগুলো গ্রুপই সম্মিলিতভাবে ঢাকায় অপারেশন চালাবে।
কৃষক গেরিলা গ্রুপের লিডার নিজাম উদ্দিন আজাদ আবার পুরো টিমের ডেপুটি লিডার। তার নেতৃত্বে অগ্রগামী দলের সম্মুখে আছে এক স্কাউট বাহিনী। নিজাম উদ্দিন আজাদ সিভিলিয়ান গাইডকে সঙ্গে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলছেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই সীমান্ত অতিক্রম করে মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। গ্রামের মেঠো পথ ধরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার বেতিয়ারা গ্রামের পাশ দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিএন্ডবি রোড পার হয়ে যাবে গেরিলারা- এটাই ছিল পরিকল্পনা। প্রফেশনাল গাইড ও রেকি টিমের ভাষ্য অনুসারে, তখন মহাসড়ক নির্বিঘ্ন থাকার কথা। অন্ধকারের জন্য সামনের পথ দেখা যায় না এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে চলছে গেরিলাদের দলটি। সতর্কতাস্বরূপ দলের চৌকস ১০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে মহাসড়কের পূর্ব পাশে দুটি অ্যাসল্ট পার্টিতে বিভক্ত করা হলো। দুটি পার্টি ডানদিক ও বামদিকে কভার করবে। মাঝে সরু রাস্তা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে গিয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেবে। ডানদিকের বাহিনী ডানদিকের টহল জিপের আক্রমণ ঠেকাবে; বামদিকের বাহিনী ঠেকাবে বামদিকের আক্রমণ।
গেরিলারা গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে পায়ে পা টিপে এগিয়ে যাচ্ছিল। বাঁশঝাড় ও গাছ গাছালীতে ভরপুর গ্রামের ভেতরটা মনে হচ্ছে রাতের অন্ধকার গিলে খাবে। জোনাকিরা আলো জ্বেলে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তাদের। প্রায় মূল রাস্তার কাছে চলে এসেছে মুক্তিযোদ্ধারা। আর মাত্র ২০ গজের মতো বাকি। অদূরে একটি কালভার্ট। এটা পার হলেই পাকা রাস্তা। পাকা রাস্তা পার হলেই গ্রামের পথ ধরে পূর্ব নির্ধারিত নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়া যাবে।
মুক্তিযোদ্ধা দলটির সম্মুখে দুজন সিভিলিয়ান গাইড পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পেছনে কমরেড নিজাম উদ্দিন আজাদ এবং তার পেছনে বিশাল গেরিলা বাহিনী চোখ-কান খোলা রেখে এগিয়ে চলছে। গাইড দুজন গ্রামের পথ দেখিয়ে নির্ধারিত স্থানে নিরাপদে নিয়ে যাবে। যখনই গেরিলা দলের সামনের দুজন কালভার্টের উপর পা রাখলো, তখনই গর্জে উঠলো হানাদার বাহিনীর অস্ত্র। অ্যাম্বুশ বাহিনী ‘হল্ট’ বলে চিৎকার দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে পুরো দলের উপর বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়তে শুরু করল। সর্বনাশ! পাকবাহিনী তাদের ইন্ডাকশনের আগাম খবর পেয়ে গেছে!
সামনে থাকা কমরেড আজাদ সঙ্গে সঙ্গে তার স্টেনগান থেকে পাল্টা ফায়ার ওপেন করলেন। তার স্টেনগান গর্জে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে খোলা অস্ত্র বহনকারী অন্য গেরিলারাও ফায়ারিং শুরু করে দিল। বিভ্রান্ত হয়ে গেল দুই দিকে মুখ করা দুটি অ্যাসল্ট বাহিনীর সদস্যরা। উপায় না দেখে যোদ্ধারা বুদ্ধি করে গুলির উৎসের দিকে এলএমজির ব্রাশফায়ার শুরু করে দিল। গেরিলারা অন্ধকারের মধ্যে ক্ষেতের আইলের পেছনে অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করতে থাকে। পাক হানাদার বাহিনীর দূরে জগন্নাথ দীঘি এলাকা থেকে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর উপর্যুপরি হামলা করতে থাকে। প্রচন্ডভাবে গুলি আসতে থাকে তিন দিক থেকে। এই অবস্থায় কোনো রকমে ‘রিট্রিট’ বলে চিৎকার দিয়ে সবাইকে ক্রল করে পেছনে ফিরে আসতে বলা হলো। পেছনের সহযোদ্ধা, কমরেড, সাথীরা যেন নিরাপদে পিছু হটতে পারে সেজন্য সম্মুখের অস্ত্র বহনকারীরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গুলি চালিয়ে যেতে লাগল।
সবার সামনে অবস্থান নেয়া নিজামুদ্দিনের স্টেনগান একসময় থেমে যায়। পাকিস্তানি মিলিটারি নিজামুদ্দিনকে ধরে ফেলে। হানাদার অফিসারদের সাথে নিজামুদ্দিনের ইংরেজিতে তর্ক-বিতর্ক হয় এবং পাকসেনারা তাকে হত্যা করে। শত্রুর প্রচন্ড আঘাতের পরও পেছনের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা ক্রলিং করে প্রাণ নিয়ে পিছু হটতে সক্ষম হয়। এরকম অ্যাম্বুশে দলের প্রায় সকলেরই প্রাণ হারানোর কথা। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলে সেদিন।
গোলাগুলি একপর্যায়ে থেমে যাওয়ার পর পাকবাহিনী পাশের ধানক্ষেতে অবস্থান নেয়। টর্চ লাইট জ্বালিয়ে খুঁজে খুঁজে বের করে আনে যুদ্ধাহত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তাদের। সেদিন বেতিয়ারার ঘটনাস্থলেই ছয়জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, এবং তিনজনকে হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে পরবর্তীতে নির্মমভাবে হত্যা করে। পাকিস্তানি আর্মির ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জানা যায়নি।
বেতিয়ারা যুদ্ধের বাকি ঘটনার বিস্তারিত আলোচনা থাকবে এই সিরিজের ২য় পর্বে।