বিপর্যয় কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো
১১ নভেম্বর ১৯৭১ বেতিয়ারায় পাক-হানাদার বাহিনীর অ্যামবুশের পর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের এপার-ওপার প্রচন্ড শেলিং শুরু হয়। উভয়পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে জীবিত ও আহত যোদ্ধারা পিছু হটতে থাকেন। এভাবে মুক্তিযোদ্ধারা একে একে ফিরে আসতে থাকেন তাদের সীমান্তের মিটিং পয়েন্টে। একজন গেরিলাও তার অস্ত্র ফেলে আসেননি। প্রত্যেকেই বিধ্বস্ত, কিন্তু মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় অমিত তেজে দীপ্ত। এ ধরনের ঘটনায় দল থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রচুর ঘটে থাকে। কিন্তু বেতিয়ারায় এমন ঘটনা ঘটেনি। অপরিচিত ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আচমকা হামলার মুখেও কীভাবে এত সংখ্যক গেরিলা যোদ্ধা আত্মরক্ষা করতে পেরেছিলেন এবং কীভাবে মিটিং পয়েন্টে ফিরে আসতে পেরেছিলেন, তা ছিল সত্যিই এক বিস্ময়। পরবর্তীতে কয়েক সপ্তাহ পর গেরিলাদের দলটি পুনরায় সাহস ও শক্তি সঞ্চয় করে বাংলাদেশে প্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।
বেতিয়ারা শহীদদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হলো
০১) শহীদ নিজাম উদ্দিন আজাদ
শহীদ নিজাম উদ্দিন আজাদ, ঢাকাস্থ রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। তিনি একসময় ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। কলেজ ছাত্রাবস্থায় নিজ মেধা ও যোগ্যতায় অল্পদিনেই সংগঠনের নেতৃত্বের প্রথম সারিতে উঠে আসেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি সংগঠনের ঢাকা জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রাবস্থায় দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক আসে। সব কিছু পেছনে ফেলে তিনি এগিয়ে যান সামনে। যোগ দেন ছাত্র ইউনিয়ন-ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির গেরিলা বাহিনীতে। যৌথ গেরিলা দলের যোদ্ধাদের রক্ষার জন্য বেতিয়ারায় অস্ত্র হাতে সবার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। অসীম সাহসী এই বীরের রক্তে বাংলার মাটি সেদিন রঞ্জিত হয়েছিল।
০২) শহীদ বশির মাস্টার
মো. বশিরুল ইসলামের জন্ম ১৯৪৯ সালে। শহীদ বশির ১৯৬৪ সালে ঢাকা গভ. মুসলিম হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৬৬ সালে এইচএসসি পাশ করেন। একই কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে বিএসসি পাশ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি সেন্ট্রাল ল কলেজে আইনের প্রথম পর্বের ছাত্র ছিলেন। তিনিও বেতিয়ারায় পাকসেনাদের সাথে গেরিলা বাহিনীর সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন।
০৩) শহীদ সিরাজুম মুনীর জাহাঙ্গীর
শহীদ মো. সিরাজুম মুনীর জাহাঙ্গীর ১৯৭১ সালে এমএ শেষ পর্বের ছাত্র ছিলেন। তিনি ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা মহানগর কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। পরে ঢাকা জেলা কৃষক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দেশমাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন-ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির যৌথ গেরিলা বাহিনীর নেতৃত্বে বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেন। শহীদ মো. সিরাজুম মুনীর জাহাঙ্গীর সাহিত্য চর্চা করতেন। ১৯৭১ সালে তাঁর ছোট গল্প ‘শিল্পী’ প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সিরাজুম মুনীরের দাদী, ফুপা. ফুপু এবং ফুপাতো ভাইবোনসহ মোট ৯ জন সৈয়দপুরে শহীদ হন।
০৪) শহীদ শহীদুল্লাহ্ সাউদ
২ নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলের কর্মচারী মো. জাবেদ আলী সাউদ ও মোসাম্মৎ জাবেদা খাতুনের চার সন্তানের মধ্যে শহীদুল্লাহ সাউদ ছিলেন তৃতীয়। গোদানাইল প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে তিনি ভর্তি হন গোদানাইল হাই স্কুলে। এরই মধ্যে তিনি জড়িয়ে যান ঝিলিমিলি খেলাঘর আসরের সাথে। স্কুলজীবন থেকেই তিনি ছাত্র ইউনিয়ন শুরু করেন। শহীদুল্লাহ সাউদ যখন ক্লাস নাইনের ছাত্র তখন শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। মাত্র ১৪ বছর বয়সে দেশকে ভালোবেসে তিনি যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। যুদ্ধে যাওয়ার পরেও বাড়ির সাথে তার যোগাযোগ ছিল। তিনি বাড়ির সবাইকে কেবলই জানাতেন, ভাল আছি, কাজ শেষ হলেই ফিরব। অসীম সাহসে লড়াই করতে করতে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বেতিয়ারায় আরো ৮ জন সহযোদ্ধার সাথে তিনিও শহীদ হন।
০৫) শহীদ আব্দুল কাইউম
শহীদ আব্দুল কাইউম, পিতা- মৃত ছানাউল্লাহ মিয়া, মাতা- মৃত হালিমা খাতুন, গ্রাম- চর শোলাদি, থানা- হাইম চর, জেলা- চাঁদপুর। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ শিক্ষার্থী ছিলেন। দেশমাতৃকার ডাকে তিনি গেরিলা বাহিনীতে যোগ দেন। বেতিয়ারার অন্যান্য শহীদের সাথে তিনিও পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন।
০৬) শহীদ আওলাদ হোসেন
শহীদ আওলাদ হোসেনের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনাচড়া গ্রামে। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এসসির ছাত্র। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানেও তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ-কমিউনিস্ট গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং ১৯৭১ সালে বেতিয়ারায় সম্মুখ সমরে শহীদ হন।
০৭) শহীদ আব্দুল কাদের
কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার গুণবতী স্টেশনের নিকটবর্তী সাতবাড়িয়া গ্রামের সন্তান আব্দুল কাদের। ১৯৭১ সালে তিনি সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এসময় তিনি ভারতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে দেশের অভ্যন্তরে রণক্ষেত্রে নিরাপদে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা বাহিনীকে স্বদেশে পৌঁছে দেয়ার সময় কুমিল্লার বেতিয়ারায় পাকসেনাদের সাথে সম্মুখ সমরে শহীদ হন।
০৮) শহীদ মোহাম্মদ শফিউল্লাহ
নোয়াখালীর সাহসী সন্তান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ শফিউল্লাহ, প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই তিনি প্রতিরোধ সংগ্রমে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে আসেন এবং নিজ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে শক্ত ভিত্তি গড়ে তোলেন। মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার জন্য তিনি গেরিলা বাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে এই বীর দেশপ্রেমিক বেতিয়ারায় শহীদ হন।
০৯) শহীদ জহিরুল হক ভুঁইয়া (দুদু মিয়া)
কৃষক পরিবারে জন্ম নেয়া শহীদ জহিরুল হক ভুঁইয়া (দুদু মিয়া) অল্প বয়সেই তাঁর বাবাকে হারান। জীবিকার্জনের তাগিদে তিনি শৈশব থেকেই কৃষিকাজ করতেন। কিছুদিন কোহিনুর জুট মিলে কাজ করার সময় তিনি শ্রমিক আন্দোলনের ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠেন। পশ্চিমা শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের কথা, শ্রমিক নেতাদের বক্তব্যে শুনে তাঁর মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তাই পরবর্তীতে রায়পুরা থানার বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতেন।
জহিরুল হক ভুঁইয়া অত্যন্ত পেশিবহুল এবং সুঠামদেহী ছিলেন। তিনি বেতিয়ারায় বিশেষ গেরিলা বাহিনীর অগ্রগামী গেরিলা দলের সদস্য ছিলেন। পাকবাহিনীর আক্রমণের মুখে তিনিও শহীদ নিজামউদ্দিন আজাদের সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর বিপক্ষে প্রতিরোধ ব্যূহ রচনা করে নিজের সহযোদ্ধাদের নিরাপদে পশ্চাদপসরণের সুযোগ করে দেন। শত্রুবাহিনীর সাথে হাতাহাতি যুদ্ধের একপর্যায়ে শত্রুর হাতে ধরা পড়ে যান। শত্রুরা তাকে উর্দুতে বলতে বলেছিলেন, “বোলো, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’।” দুদু মিয়া উচ্চস্বরে বলেছিলেন, “জয় বাংলা।”
ভারত কেন কমিউনিস্টদের সহায়তা করল
মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই বামপন্থী দলগুলো মুজিবনগর সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। তাদের দলীয় কর্মীরাও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল। আর এই সিদ্ধান্তের পেছনের খুটি ছিল সত্তরের নির্বাচন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব বামপন্থী দলের হাতে চলে যাবার আশঙ্কাও কম ছিল না। পাকিস্তানের পক্ষে মার্কিন-চীনের সোচ্চার অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে মুজিবনগর সরকারের জন্য অন্যতম পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট স্বাক্ষর হয় ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি। চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘নবম’ ধারাটি, যাতে বলা হয়, দুই দেশের কারও বিরুদ্ধে যদি বহিরাক্রমণের বিপদ দেখা দেয়, তবে এই বিপদ অপসারণের জন্য উভয় দেশ অবিলম্বে পারস্পরিক আলোচনায় প্রবৃত্ত হবে এবং তাদের শান্তি ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য যথোচিত ব্যবস্থা অবলম্বন করবে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সামনে রেখে মার্কিন ও চীনের হুমকি মোকাবেলায় ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এই চুক্তি করে। এই চুক্তিকে হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, “বারুদের স্তূপে একটি জ্বলন্ত শলাকা নিক্ষেপ।” এই চুক্তির পর থেকেই পূর্ব জার্মানিসহ অন্যান্য সোভিয়েত-বলয়ভুক্ত দেশগুলো অনেক বেশি খোলামেলাভাবে বাংলাদেশকে সামরিক ও অন্যান্য ত্রাণ দেয়া শুরু করে। আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল দশ হাজারের কাছাকাছি। অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে স্থির করা হয় নভেম্বর নাগাদ আরো ষাট হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। ভারত একটি পুঁজিবাদি দেশ হয়েও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে এই চুক্তির কারণেই বাংলাদেশের বাম-দলগুলোর প্রশিক্ষণে এগিয়ে এসেছিল।
বর্তমানে বেতিয়ারা
২৮ নভেম্বর ১৯৭১ চৌদ্দগ্রামের জগন্নাথদীঘি অঞ্চল শত্রুমুক্ত হয়। সহযোদ্ধারা এই বীর-শহীদদের কবরের ওপর স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় বেতিয়ারা গ্রামটি মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে তেমন পরিচিতি ছিল না। আজ দেশ-বিদেশের অনেকের কাছেই নামটি পরিচিত। এখানে অবস্থিত শহীদদের গণকবর ও স্মৃতিসৌধটি পথিককে অশ্রুসিক্ত করে তোলে এবং সবাই আজ বেতিয়ারাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে মহাসড়ক পুনর্নির্মাণকালে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে গণকবরটি পাকা করে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। প্রতিবছর বেতিয়ারা দিবসে ‘বেতিয়ারা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি রক্ষা পরিষদ’ এর উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়ে থাকে।