দ্য শিভালরাস স্যাপার ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর

মার্চ, ১৯৭১
কারাকোরাম, পশ্চিম পাকিস্তান।

পাকিস্তান-চীন সংযোগ সড়কের কাজ চলছে। ভারতের সাথে টেক্কা দিতে আপাতত চীনের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানো ছাড়া পাকিস্তানের আর উপায় কই? কারাকোরাম আগাগোড়াই পার্বত্য এলাকা, ভয়াবহ রকমের দুর্গম। তাই যথারীতি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন এই কাজের তদারকি করছে।

ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেই কারাকোরামে বসেই ২৫ মার্চের কথা শুনে সাত দিনের ছুটি নিয়ে করাচিতে বোনের বাসায় এসে বিশদ জানলেন। এরপর বুকের ভেতরে ফুঁসে ওঠা ক্রোধ ধামাচাপা দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন চাকরি ছেড়ে দেওয়ার, কিন্তু তার পদত্যাগপত্র কত দিনে গৃহীত হবে অথবা আদৌ গৃহীত হবে কি না, সে ব্যাপারে তিনি নিজেই যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন।

অতএব ৩ জুলাই ১৯৭১ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর প্রথম সুযোগেই ক্যাম্প ছেড়ে পালালেন, সাথে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন, ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার আর ক্যাপ্টেন আনাম। শিয়ালকোটের কাছ দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পৌঁছাতেই জেনারেল ওসমানী স্বয়ং এলেন তাদের সাথে দেখা করতে। যুদ্ধের এই পর্যায়ে চার-চারজন সুপ্রশিক্ষিত ক্যাপ্টেনের মর্ম তিনি বোঝেন।

নতুন গন্তব্য ৭নং সেক্টরের মেহেদিপুর সাব-সেক্টর। সাকুল্যে একটা পদাতিক প্লাটুন, একটা মর্টার প্লাটুন, এক কোম্পানি ইপিআর আর চার কোম্পানি গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা; সাথে কিছু আর্টিলারি আর অন্যান্য সার্ভিস কোরের সদস্য নিয়ে তার বাহিনী। এ নিয়েই তার বাহিনী আরগাবাবহাট, শাহপুর আর কানসাটে বেশ কিছু সফল অভিযান পরিচালনা করল। ভারতের শিলিগুড়ি করিডর তার সেক্টরের আওতায়, এই করিডরটা ভূ-রাজনৈতিক কারনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই এখানে একটা মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলার জন্য ফোর্সেস হেডকোয়ার্টার থেকেও চাপ বাড়ছিল।

অবশেষে চাঁপাইনবাবগঞ্জ দখলের আদেশ এল। চাঁপাইনবাবগঞ্জে তখন ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটা কোম্পানি আর ইপিসিএএফ[1]-এর ৭নং উইংয়ের হেডকোয়ার্টার অবস্থান করছিল। ১১ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর জানতে পারলেন যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কানসাট আর শিবগঞ্জ ত্যাগ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জে গিয়ে জমায়েত হয়েছে। গোটা ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট আর ইপিসিএএফ মিলে চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তুলেছে।

লেফটেন্যান্ট কাইউম, লেফটেন্যান্ট রফিকুল ইসলাম আর লেফটেন্যান্ট বজলুর রশিদকে নিয়ে ছোট সোনামসজিদ প্রাঙ্গণে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর আসন্ন যুদ্ধের পরিকল্পনার জন্য জমায়েত হলেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জে আক্রমণ করতে হলে মহানন্দা নদী পেরিয়ে যেতে হবে। তাই পরিকল্পনা হলো লেফটেন্যান্ট রফিক আর লেফটেন্যান্ট বজলুর রশীদ আরও পূর্ব দিকে হেঁটে গিয়ে মহানন্দা অতিক্রম করে পূর্ব দিক থেকে শত্রুকে আক্রমণ করে আটকে রাখবে, যেন পশ্চিমের মূল লক্ষ্যবস্তুর ওপর যখন লেফটেন্যান্ট কাইয়ুমকে নিয়ে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর স্বয়ং হামলে পড়বেন, তখন যেন পাকিস্তানিরা পূর্ব দিকে থেকে সৈন্য এনে নিজেদের রিইনফোর্স করতে না পারে।

ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, বীরশ্রেষ্ঠ। (৭ মার্চ ১৯৪৯–১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১)। অলংকরণ: রহমান আজাদ

১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১, ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতিশ্রুত কাভারিং আর্টিলারি ফায়ার শুরু হলো যথারীতি ধুঁকতে ধুঁকতে। কিন্তু ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর দমলেন না, দমলেন না তার বাঘা বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারাও। যথাসময়ে মহানন্দা পাড়ি দিয়ে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের বাহিনী ঠিকই হামলে পড়ল চাঁপাইনবাবগঞ্জের উপকণ্ঠে। পাকিস্তানিরা আক্রমণের তোড়ে দ্রুত পালিয়ে শহরের ভেতরে কংক্রিটের দেয়ালের আড়ালে আশ্রয় নিল।

ট্রেঞ্চের পর ট্রেঞ্চ দখল করে এগোচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের মুক্তিসেনারা। যুদ্ধ চলল পরদিন সকাল অবধি। সমস্যা শুরু হলো পাকা একটা বাড়ির দোতলায় বসানো পাকিস্তানি মেশিনগান নিয়ে। একে তো কংক্রিটের দেয়াল ভেদ করে শত্রুকে ঘায়েল করা দুঃসাধ্য, তার ওপর দোতলায় থেকে উচ্চতা সুবিধার কারণে পাকিস্তানি মেশিনগানাররা মুক্তিসেনাদের দূর থেকেই দেখে ফেলছিল, আর বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়ে মারছিল।

মহিউদ্দিনের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল। ইতোমধ্যে আক্রমণের বাম প্রান্তে যুদ্ধ করতে করতে এগিয়ে যাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর শাজাহান হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হয়েছেন, গুলির তোড়ে তার প্লাটুনটাও আটকে আছে; সামনে এগোনোর কোনো পথ নেই। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ভালো করেই জানতেন কখনো কখনো এক মেশিনগানের কারণেই যুদ্ধের জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়ে যায়। চলমান আক্রমণ এখন এই মেশিনগানটার জন্য গতি হারিয়ে ফেললে আক্রমণের ধার কমে যাবে, আর একবার আক্রমণের ধারাবাহিকতা হারিয়ে বসলে পালিয়েও আর পথ পাওয়া যাবে না; পাকসেনারা পিছু ধাওয়া করে মহানন্দার পাড়ে নিয়ে গিয়ে কচুকাটা করে মারবে। তাই তিনি মরিয়া হয়ে সেই মেশিনগানটা ধ্বংসের পথ খুঁজলেন।

প্রশিক্ষিত যোদ্ধা হিসেবে তিনি জানেন যে মাটিতে শুয়ে উঁচুতে গুলি লাগানো কঠিন। তা ছাড়া রাইফেলের গুলিতে এই মেশিনগান পোস্ট ধ্বংস করা যাবে না। আর মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তিনি জানেন যে আর্টিলারি গোলা মেরেও কংক্রিটের ওই ছাদ গুঁড়িয়ে দেওয়া কঠিন। তাছাড়া শত্রুর এত কাছাকাছি এসে নিজেদের আর্টিলারির ফায়ার সাপোর্ট কল করলে নিজেদের গোলায় শত্রুর সাথে সাথে নিজেদেরও হতাহতের আশঙ্কা অনেক বেশি।

একমাত্র উপায় মেশিনগান বাংকারের ভেতর গ্রেনেড চার্জ করা। কিন্তু গ্রেনেড চার্জের জন্য বাংকারের ১০ গজের ভেতর পৌঁছানো জরুরি। চেষ্টা করলে হয়তো বাংকারের কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব। কিন্তু গ্রেনেড চার্জ করে জীবিত ফিরে আসার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। এখন প্রশ্ন হলো কে যাবে এই ‘সুইসাইডাল মিশনে?’ কাকে পাঠাবেন মহিউদ্দিন এই নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে? তাছাড়া মৃত্যুর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো মরার আগে ঠিকঠাক গ্রেনেডটা ছুড়ে মেশিনগানটাকে ধ্বংস করা।

অবশেষে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে নিজেই সেই মেশিনগান ধ্বংসের আত্মঘাতী সিদ্ধান্তটা নিলেন। একজন কমান্ডারের জন্য এমন ঝুঁকি হয়তো অনাবশ্যক, হয়তো পিছিয়ে গিয়ে পুনরায় প্রস্তুতি নিয়ে ফিরে এসে আবার যুদ্ধ করা যেত। কিন্তু ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর আসন্ন বিজয়ের গন্ধ পাচ্ছিলেন পরিষ্কারভাবে। জয়ের এতটা কাছে এসে হেরে যাওয়ার পাত্র তিনি নন। মেশিনগানের যন্ত্রণায় সবাই যার যার কাভারের পেছনে থেকে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করছেন। থেমে থেমে বুলেট ছুটছে এদিক-ওদিক।

বাম হাতে এসএমজি আর ডান হাতে পিন খোলা গ্রেনেড নিয়ে মহিউদ্দিন এগোতে লাগলেন। সবাইকে হকচকিত করে দিয়ে তিনি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ক্ষিপ্রতায় ক্রলিং করে রাস্তা পেরিয়ে বাড়িটার গোড়ায় চলে এলেন। তারপর চোখের পলকে গ্রেনেডটা ছুড়ে দিলেন মেশিনগান বাংকারের ভেতরে। প্রচণ্ড শব্দে গ্রনেডটা বিস্ফোরিত হলো আর সাথে সাথেই পাকিস্তানি মেশিনগানারদের ছিন্নভিন্ন দেহ আছড়ে পড়ল মাটিতে। কিন্তু ঠিক তখনই ইপিসিএএফের একদল রাজাকার তাকে দেখে ফেলল আর সবাই একযোগে তার দিকে গুলি ছুড়তে লাগল। কাভার নিতে পারার আগেই ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের দিকে ছুটে এল এক পশলা বুলেট-বৃষ্টি। বুলেটের ধাক্কায় ছিটকে ভারসাম্য হারিয়ে লুটিয়ে পড়লেন তিনি! সবুজ ঘাসের ফাঁক গলে চুইয়ে পরা তার লাল রক্ত পরম মমতায় শুষে নেয় বাংলার পবিত্র মাটি; আসন্ন বিজয়ের ঘ্রাণ নিতে নিতেই শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর…

ঢাকায় তখন জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণের ‘টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন’ নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন।

অলংকরণ: রহমান আজাদ

পুনশ্চ

যুদ্ধে গ্রেনেড মেরে ট্রেঞ্চ আর বাংকার ক্লিয়ারিং[2] অনেকটা রুটিন ড্রিলের মতো বিষয়, আর ট্রেঞ্চ ক্লিয়ারিংয়ের সময় সৈন্য মৃত্যুও যুদ্ধে স্বাভাবিক ব্যাপার। অবশ্য একটা অপারেশনের কমান্ডার স্বয়ং বাংকারে গ্রেনেড চার্জ করতে গিয়ে মারা যাওয়ার ঘটনা নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী আর বিরল।

একটা শত্রু মেশিনগানের ইফেক্টিভ ফায়ারের[3] কারণে এসল্ট কলাম[4] থমকে যেতেই পারে। এমন অবস্থায় এয়ার সাপোর্ট[5], আর্টিলারি সাপোর্ট এমনকি একটা রকেট লাঞ্চারও হাতে না থাকলে যেকোনো কমান্ডারই শেষ চেষ্টা হিসেবে গ্রেনেড চার্জের কথা ভাববেন। তাহলে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর বীরশ্রেষ্ঠ হওয়ার মতো অনন্য কোথায়?

এ ব্যাপারটা বুঝতে আমাকে সাহায্য করেছেন কলিন পাওয়েল। তার বই ‘মাই আমেরিকান জার্নি’তে তিনি বলেছেন, যুদ্ধে প্রাণহানি একটা সহজাত ব্যাপার। কিন্তু একজন কমান্ডারের দায় হলো প্রতিটা মৃত্যু যেন হয় একান্ত প্রয়োজনীয় আর সার্থক।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের যুদ্ধ মহিউদ্দিনকে একটা সিদ্ধান্তের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছিল। তিনি জানতেন মেশিনগান পোস্টটা ধ্বংস করা জরুরি এবং তিনি জানতেন এ কাজটা যে করতে যাবে তার বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এই বাস্তবতা জানার পরেও ওই মেশিনগান পোস্টে গ্রেনেড ছুড়ে মারার মুক্তিযোদ্ধার নিশ্চয় অভাব হতো না, যুদ্ধে এই অভাবটা কখনোই হয় না।

কিন্তু ঐতিহাসিকভাবেই কোনো কমান্ডার কখনোই তার সৈন্যদের নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেননি, অন্তত ৫০-৫০ সুযোগ তিনি খুঁজবেনই। কিন্তু এখানে মৃত্যুর আশঙ্কা ছিল শত ভাগ। ১০ জনের ৯ জন কমান্ডারই হয়তো এক্ষেত্রে নিরাপদ দূরত্বে ফিরে এসে ফের আক্রমণে যেতেন। কামালপুর বিওপিতে মুক্তিসেনারা ১৩ বার আক্রমণ করে ফিরে এসেছেন। কিন্তু ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর তা করেননি। তিনি বিরল দুঃসাহসিক সিদ্ধান্তটিই গ্রহণ করেছিলেন এবং এর দুর্ভোগটা যেন অন্য কাউকে পোহাতে না হয়, সে জন্য কাজটাও নিজেই করে প্রাণ দিয়েছেন। এখানেই তিনি অন্য ৯ জনের চেয়ে ব্যতিক্রম, এ জন্যই তিনি অনন্য। আর এ কারণেই তিনি বীরশ্রেষ্ঠ!

বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সংক্ষিপ্ত জীবনী

মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের জন্ম ৭ মার্চ ১৯৪৯, বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার রহিমগঞ্জ গ্রামে। পিতা আব্দুল মোতালেব হাওলাদার ছিলেন কৃষক ও শৌখিন কণ্ঠশিল্পী এবং মা সাফিয়া বেগম ছিলেন গৃহিণী। পিতার আর্থিক দৈন্যের কারণে মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সে মামার বাড়ি মুলাদি উপজেলার পাতারচর গ্রামে গমন করেন। ১৯৫৩ সালে পাতারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়। ১৯৬৪ সালে মুলাদি মাহমুদ জান পাইলট হাই স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি এবং ১৯৬৬ সালে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে অধ্যয়নরত অবস্থায় ১৯৬৭ সালের ৩ অক্টোবর তিনি ১৫তম ওয়ার কোর্সে নির্বাচিত হন এবং কাকুলে পাকিস্তানি মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালের ২ জুন ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে কমিশন্ড পদ লাভ করে তিনি ১৭৩ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়নে যোগ দেন। তিনি ১৯৬৮ সালের ৩ ডিসেম্বর লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি লাভ করেন। মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ১৯৬৯-৭০ সালে রিসালপুরে মিলিটারি কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং, রিসালপুর থেকে অফিসার বেসিক কোর্স-২৯ এবং পরে ইনফ্যান্ট্রি স্কুল অব ট্যাক্টিকস থেকে অফিসার উইপন কোর্স-১৩ সম্পন্ন করেন। ১৯৭০ সালের ৩০ আগস্ট তিনি ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সোয়াতের সাইদুর শরীফে ১৭৩ নম্বর ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়নে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে তিনি তার তিনজন সহকর্মী ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন, ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার ও ক্যাপ্টেন আনামসহ গোপনে ৩ জুলাই কর্মস্থল ত্যাগ করেন এবং দুর্গম পার্বত্য এলাকা ও মুনাওয়ার তায়ী নদী অতিক্রম করে শিয়ালকোটের কাছে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।

মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরকে ৭নং সেক্টরের মেহেদিপুর (মালদহ জেলায়) সাবসেক্টরের কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। এ সময় লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান ৭নং সেক্টরের সেক্টর-কমান্ডার ছিলেন। মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর অসামান্য বীরত্বের সাথে আরগরারহাট, কানসাট, শাহপুর এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং মুক্তাঞ্চল গঠন করেন। এই ত্যাগী যোদ্ধা বেতন থেকে ২০ টাকা নিজের জন্য রেখে বাকি টাকা শরণার্থীদের সাহায্যার্থে দান করতেন। যুদ্ধকালে তিনি গুরুতর আহত হন এবং পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার আগেই পুনরায় যুদ্ধে অংশ নেন।

১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের যুদ্ধে শহীদ হন এবং তাকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ঐতিহাসিক ছোট সোনামসজিদ প্রাঙ্গণে মেজর নাজমুল হকের পাশেই সমাহিত করা হয়।

ফুটনোট

[1] রাজাকারদের নিয়ে গঠিত ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স।

[2] শত্রু ট্রেঞ্চের ভেতর অতর্কিতে গ্রেনেড ছুড়ে শত্রু নিধন করে ট্রেঞ্চ দখল।

[3] যে দূরত্ব পর্যন্ত মেশিনগানের গুলি হতাহত করবার মত কার্যকর থাকে।

[4] আক্রমণ করতে আসা সৈন্যদের সারি।

[5] জঙ্গী আর বোমারু বিমানের সহায়তা।

তথ্যসূত্র ও সহায়ক গ্রন্থাবলি

১।  হাসান হাফিজুর রহমান কর্তৃক সম্পাদিত, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, অষ্টম থেকে একাদশ খণ্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সম্পাদিত, বিজি প্রেস, তেজগাঁও, ঢাকা, নভেম্বর, ১৯৮২।
২।  গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক সংকলিত, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ-ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস, দশদিশা প্রিন্টার্স, ১২৪, আরামবাগ, ঢাকা-১০০০, মার্চ, ২০০৬।
৩।  গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক সংকলিত, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ-সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, দশদিশা প্রিন্টার্স, ১২৪, আরামবাগ, ঢাকা-১০০০, মার্চ, ২০০৬।
৪।  মুহাম্মদ নূরুল কাদির, দুশো ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা, মুক্ত প্রকাশনী, ১২৯ দক্ষিণ কমলাপুর রোড, ঢাকা-১২১৭, ২৬ মার্চ, ১৯৯৭।
৫।  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ১ম থেকে ৭ম খণ্ড, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শিক্ষা পরিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত, এশিয়া পাবলিকেশনস, ৩৬/৭ বাংলাবাজার, ঢাকা, বইমেলা ২০০৮।
৬।  মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান, ১ম থেকে ৭ম খণ্ড, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শিক্ষা পরিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত, এশিয়া পাবলিকেশনস, ৩৬/৭ বাংলাবাজার, ঢাকা, মে ২০১৫।
৭।  বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাস, ১ম থেকে ৫ম খণ্ড, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শিক্ষা পরিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত, এশিয়া পাবলিকেশনস, ৩৬/৭ বাংলাবাজার, ঢাকা, মে ২০১৫।
৮।  মিলি রহমান সম্পাদিত, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর স্মারকগ্রন্থ, আগামী প্রকাশনী, ৩৬ বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০, ফেব্রুয়ারি ২০০৫।
৯।  লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির, বীর প্রতীক, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুরের দেশে ফেরা, শুধুই মুক্তিযুদ্ধ প্রকাশনী, ৭২ ইন্দিরা রোড, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫, ফেব্রুয়ারি ২০০৮।
১০। চন্দন চৌধুরী, বীরশ্রেষ্ঠ, কথাপ্রকাশ, আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা-১০০০, ফেব্রুয়ারি ২০০৮।
১১। সাইদ হাসান দারা, সাত বীরশ্রেষ্ঠ ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, সময় প্রকাশন, ৩৮/২ক বাংলাবাজার, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১০।
১২। ডা. মোহাম্মদ সেলিম খান, বাংলার বীরশ্রেষ্ঠ, মুক্তপ্রকাশ, ৩৮ বাংলাবাজার, ঢাকা, ডিসেম্বর ২০১১।
১৩। History of Counter Insurgency Operations in Chittagong Hill Tracts (1976-1999), Vol-2, Chapter – 3, 4 and 5, Page – Appendix 4E1-1.

ফিচার ছবি- রহমান আজাদ

[বি: দ্র: ডেল এইচ খানের লেখা সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্বের সবকটি গল্প পড়তে চাইলে দেখুন আদর্শ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের বীরগাথা‘ বইটি।]

joined the Mukti Bahini during the 1971 Liberation War. He was born on 7 March 1949 in the village of Rahimgonj under Babugonj Upazila of Barisal district. He was an officer in Sector 7 of the Muktibahini.

Related Articles

Exit mobile version