বাংলাদেশের সিনেমা জগতের এক স্বর্ণালী অতীত রয়েছে। সিনেমা কিন্তু শুধু শিল্প-সংস্কৃতিরই অংশ নয়, অর্থনৈতিক দিক থেকেও এর ভালই প্রভাব রয়েছে। সে কারণেই বাংলাদেশের সিনেমাগুলোতে মানবিক দিকগুলোর সাথে সাথে বাণিজ্যিক বিষয়গুলোও আগে থেকেই বেশ সুন্দর ভাবে মিশে ছিল। ১৯২৭ সালে সেই যে স্বল্পদৈর্ঘ্যের সিনেমা “সুকুমারি” দিয়ে শুরু, তারপর ১৯৩১ এ তৈরি হল পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা “দি লাস্ট কিস”। বাংলাদেশের প্রথম সবাক সিনেমা ছিল “মুখ ও মুখোশ”। তবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা ১০ সিনেমার তালিকা করতে গেলে অবধারিত ভাবেই যে সিনেমার নাম ফিরে ফিরে আসবে তা হল “জীবন থেকে নেয়া”। আজ আমরা জহির রায়হানের সেই জীবন থেকে নেয়া সিনেমার নির্মাণ থেকে শুরু করে কাহিনীসহ কিছু বিষয় জানার চেষ্টা করব।
নির্মাণ ইতিহাস
সিনেমার নাম ‘জীবন থেকে নেয়া’। পরিচালক জহির রায়হান। ১৯৭০ সালের এপ্রিল মাসে মুক্তি পাওয়া এ সিনেমাটিকে শুধু একটি সাধারণ সিনেমা ভেবে থাকলে ভুল করে থাকবেন। এ সিনেমাটি শুধু সাধারণ কোন সিনেমা নয়। এ সিনেমার সাথে অতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বাঙ্গালির স্বাধিকার আন্দোলনের কথা। সে সময়ের বাংলার মানুষের চাওয়া পাওয়ার কথা।
বড় পর্দায় জনগণের রাজনৈতিক কোন চাহিদার এত স্বতঃস্ফুর্ত রুপায়ন বাংলাদেশের আর কোন সিনেমায় দেখতে পাওয়া যায় না। যদিও ঘরানার দিক থেকে সিনেমাটিকে সামাজিক বা, পারিবারিক বলা চলে কিন্তু, এর মাঝেই জনগণের অব্যক্ত কথার সুন্দর প্রতিফলন ঘটিয়ে দেখিয়েছেন নির্মাতা জহির রায়হান। সিনেমাটিতে প্রধান চরিত্রগুলোতে অভিনয় করেছেন রাজ্জাক, সুচন্দা, রোজী সামাদ, খান আতাউর রহমান, রওশন জামিল, আনোয়ার হোসেন প্রমুখ। এই সিনেমাটিই ছিল জহির রায়হান নির্মিত শেষ সিনেমা।
সিনেমার কাহিনী
সিনেমার গল্প গড়ে উঠেছে বাংলার অতি সাধারণ এক পরিবারকে কেন্দ্র করে। দুই ভাই আনিস (শওকত আকবর) ও ফারুক (রাজ্জাক), বড়বোন রওশন জামিল এবং বোনের স্বামী খান আতাউর রহমান। বড়বোন রওশন জামিল বিবাহিত। কিন্তু বিবাহিত হলে কি হবে? তিনি থাকেন বাবার বাসাতেই। তার স্বামীও অত্যন্ত নিরীহ প্রকৃতির। সংসারের সব ক্ষমতা রওশন জামিলেরই হস্তগত। এই ক্ষমতার অপব্যবহার করেই তিনি তার স্বামীসহ নিজের দুই ভাইদের উপর একরকম নির্যাতনই চালিয়ে থাকেন। আঁচলে চাবির গোছা নিয়ে ঘোরেন তিনি। পেছনে পেছনে পানের বাটা নিয়ে ঘোরে বাড়ির গৃহ পরিচারিকা। তার দোর্দন্ড প্রতাপে অস্থির সবাই। হ্যাঁ, পাঠক! ১৯৭০ সালের পটভূমি বিবেচনা করলে ননদের এই রুপক চরিত্রটি চিনতে কারোরই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তৎকালীন পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদেরই মূলত রুপক আকারে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল এ চরিত্রটিতে।
রওশন জামিলের স্বামী খান আতাউর রহমান আদালতের কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। খান আতাউর রহমান তার এক বন্ধুর পরামর্শে তার শালা শওকত আকবরের বিয়ে ঠিক করেন। পাত্রী ছিল সাথী (রোজী সামাদ) নামের এক শান্ত শিষ্ট তরুণী মেয়ে। কিন্তু রওশন জামিল সম্পূর্ণ বেঁকে বসলেন। তিনি তার ভাইয়ের বিয়ে দিতে একদমই নারাজ। তিনি ভয় পাচ্ছিলেন যে সংসারের চাবি না আবার তার হাত ফস্কে নতুন বউয়ের হাতে উঠে যায়। ফলশ্রুতিতে রওশন জামিলকে না জানিয়েই তার ভাইয়ের বিয়ে দিয়ে দেন খান আতাউর রহমান।
সাথী বউ হয়ে ঘরে আসলে তার উপর রওশন জামিলের অত্যাচারের খরগ নেমে আসে। অপর দিকে সাথীর ছোট বোন বীথির (সুচন্দা) প্রেমে পরে যান ফারুক ওরফে রাজ্জাক। দুলাভাই আর বড় ভাই অনুমতি দিলে বীথিকে বিয়ে করে ফেলেন তিনিও। সাথী এবং বীথির বড় ভাই আনোয়ার হোসেন। আনোয়ার হোসেন ছিলেন অত্যন্ত প্রগতিশীল ধারার রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মী। দেশের মানুষের অধিকারের কথা উচ্চারণ করে তার ঠায় হয় কারাগারে।
অন্যদিকে সাথী তথা সুচন্দার নেতৃত্বে বাড়ির সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়। নিজেদের বাড়ির ভেতরেই দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগানো হল। রওশন জামিলের চাবির গোছা চলে আসে দুই বোনের কাছে। পানের বাটা ঘুরতে থাকে তাদের পেছনে পেছনে। ক্ষমতা হারিয়ে পাগল প্রায় হয়ে পরেন রওশন জামিল। নতুন নতুন ষড়যন্ত্র করতে শুরু করেন। এরই মাঝে সাথী ও বীথি সন্তান সম্ভবা হয়ে পরলে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
দুর্ভাগ্যক্রমে মৃত সন্তান জন্ম দেয় সাথী। ডাক্তার আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে এ শোক হয়তবা সাথী সহ্য করতে পারবে না। তাই বীথির সন্তানপকে তুলে দেয়া হয় তার কোলে। নিজের সন্তান ভেবে তাকে লালন পালন করতে শুরু করে সাথী। রওশন জামিল সুযোগ বুঝে দুই বোনের মাঝে খারাপ সম্পর্কের সৃষ্টি করে দেয়। কৌশলে বীথিকে বিষ খাওয়ান তিনি আর সেই দোষ চাপান সাথীর উপর। বীথি সুস্থ হয়ে বেঁচে উঠলেও বিষ খাওয়ানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার হয় সাথী। আদালতে মামলা উঠলে নিজের স্ত্রীকে দোষী মনে করে শওকত আকবর তার বিরুদ্ধে মামলা লড়েন, আর সাথীর পক্ষের উকিল হন খান আতাউর রহমান। খান আতাউর রহমান আদালতে প্রমাণ করে দেন যে তার নিজের স্ত্রী রওশন জামিলই আসলে বিষ প্রয়োগের মূল হোতা। এভাবেই সিনেমার কাহিনী শেষ হয়।
সিনেমা যখন প্রতিবাদের ভাষা
এ সিনেমাটিতে মূলত সাধারণ এক পারিবারিক গল্পের আড়ালে এক রাষ্ট্রের গল্পই বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার এবং সংগ্রামের কথা। তাই এ সিমেটিকে সবাই আমাদের মুক্তির আন্দোলনেরই একটা বড় অংশ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। এ সিনেমাতেই অমর একুশের ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গানটি যেমন ছিল ঠিক তেমনি নজরুলের কারার এ লৌহ কপাট গানটিও ব্যবহৃত হয়েছিল। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সরকার হাস্যকরভাবে রেডিও টিভিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ করে দেয়। এর মাত্র কিছু বছরের মাথাতেই জহির রায়হান তার সিমেটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “আমার সোনার বাংলা” গানটিকে প্রথম বারের মত কোন সিনেমায় ব্যবহার করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর এ গানটিই বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পায়।
এই সিনেমাটির মূল স্লোগান ছিল-
“একটি দেশ
একটি সংসার
একটি চাবির গোছা
একটি আন্দোলন
একটি চলচ্চিত্র…”
স্লোগানটি মূলত অধিকার আদায়ের আন্দোলনের দিকেই ইঙ্গিত করে। এছাড়াও সিমেটিতে নবজাতক শিশুর নাম রাখা হয়েছিল মুক্তি। এসব ছোট থেকে ছোট বিষয়েও পারিবারিক গল্পের ছলে জহির রায়হান এ সিনেমাটিতে নিজের সহ গণ মানুষের আকাঙ্খার প্রকাশ ঘটিয়েছেন বার বার।
স্বৈরশাসনের ভেতরে থেকে এক উত্তাল সময়ের সিনেমা জীবন থেকে নেয়া। জীবনের সিনেমা জীবন থেকে নেয়া। মুক্তির আজন্ম আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটানো সিনেমা জীবন থেকে নেয়া। সিনেমাটি শুধু মানবিক আবেদনের দিক থেকেই শ্রেষ্ঠদের কাতারে নয়, ব্যবসায়িকভাবেও বেশ সফল ছিল।
বাংলা চলচ্চিত্রের সেরা প্রতিভাদের একজন ছিলেন জহির রায়হান। দুঃখের বিষয়, মুক্তিযুদ্ধের পরপরই মাত্র ৩৬ বছর বয়সে নিজ ভাই শহীদ বুদ্ধিজীবি শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে যেয়ে নিজেই নিখোঁজ হয়ে যান তিনি। তাই বাংলা চলচ্চিত্রে জহির রায়হান এক আফসোসের নাম। স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা মানুষটি নিজেই বেশিদিন সেই স্বাধীনতা ভোগ করে যেতে পারলেন না। স্বাধীন দেশে আরো স্বাধীনভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে যেতে পারলেন না। আজ বাংলা চলচ্চিত্র মোটামুটিভাবে এক দুর্দশার মধ্য দিয়েই যাচ্ছে বলা চলে। জহির রায়হানের সিনেমা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলার সিনেমা পরিচালকরা আবার আমাদের সিনেমার অতীত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনবেন, সবাইকে হলমুখী করবেন এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।