কেমন হতো, যদি আমাদের ক্যালেন্ডারটি এমন হতো যে, প্রতি বছরই এর তারিখগুলো নির্দিষ্ট বারে পড়ত? অর্থাৎ জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ প্রতি বছরই যদি সোমবারে (বা অন্য কোনো বারে) শুরু হতো, আপনার জন্মদিনটি যদি সব সময়ই রবিবারে পড়ত, একুশে ফেব্রুয়ারি যদি সব সময়ই বুধবারে পড়ত? অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু আমাদের প্রচলিত ক্যালেন্ডারের প্রায়োগিক সমস্যাগুলোর চমৎকার সমাধান দেওয়া এরকম একটি ক্যালেন্ডার সত্যি সত্যিই আছে, শুধু বিশ্বব্যাপী মানুষের মন জয় করে কার্যকর হওয়াটাই বাকি!
বর্তমানে যে ক্যালেন্ডারটি আমরা ব্যবহার করি, সেটি প্রায় ৪০০ বছরের পুরানো ক্যালেন্ডার। কিন্তু এর মূল ভিত্তি আরো অনেক পুরানো, অন্তত দুই হাজার বছর। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সালে জুলিয়াস সীজার কর্তৃক প্রণীত জুলিয়ান ক্যালেন্ডারকে সংশোধন করে পোপ গ্রেগরি ১৫৮২ সালে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের প্রচলন করেন, যা আমরা এখনও ব্যবহার করে থাকি। সূর্যের অবস্থান এবং ঋতু পরিবর্তনের হিসেব রাখার জন্য ক্যালেন্ডারটি অত্যন্ত নির্ভুল, কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্মের জন্য এটি খুব বেশি ব্যবহার বান্ধব না।
প্রচলিত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের অন্যতম বড় ত্রুটি হল, এতে বিভিন্ন বছর বিভিন্ন তারিখে বিভিন্ন বার পড়ে। সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মপরিকল্পনা এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনের জন্য এটি বেশ বড় একটি সমস্যা। উদাহরণস্বরূপ, কোনো স্কুল, কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে একটি কোর্স প্রতি বছর হুবহু একই হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র বারগুলো ভিন্ন হওয়ার কারণে প্রতি বছর শিক্ষাবর্ষ চালুর তারিখ এবং পাঠদান পরিকল্পনা নতুন করে প্রণয়ন করতে হয়। প্রতি বছর সরকারি ক্যালেন্ডার এবং ছুটির দিনের তালিকা পরিবর্তন করতে হয়। যে বছর জাতীয় দিবস শুক্রবারে বা শনিবারে পড়ে, সে বছরের তুলনায় যে বছর সোমবারে পড়ে, তার পরিকল্পনা ভিন্নভাবে করতে হয়।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমস্যাটি আরও প্রবল। যেমন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মার্চ মাসের শুরুর বারের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন বছর মার্চ মাসের কার্যদিবসের সংখ্যা ২০, ২১, ২২ বা ২৩ দিন হতে পারে। যেসকল প্রতিষ্ঠান কার্যদিবস হিসেবে বেতন, ছুটি প্রভৃতি হিসেব করে থাকে, তাদের জন্য এটি বাড়তি একটি সমস্যা। বছরের বিভিন্ন মাসে বিভিন্ন সংখ্যক দিন এবং সেগুলোর অসম বন্টনও একটি বড় সমস্যা।
এসব সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে অনেকেই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ত্রুটিগুলো সংশোধন করে নতুন ধরনের ক্যালেন্ডারের প্রস্তাব করেছেন। তাদের মধ্যে হ্যাংক-হেনরি পারমানেন্ট ক্যালেন্ডার বা সংক্ষেপে (HHPC) এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ক্যালেন্ডারের নামটি এসেছে এর আবিষ্কারক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিদ এবং অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট রিচার্ড কন হেনরি এবং পদার্থবিদ স্টিভ এইচ হ্যাংকের নামানুসারে।
গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে সপ্তাহের বারগুলো যে স্থির থাকে না, তার কারণ এক সৌর বছরে দিনের সংখ্যা (৩৬৫.২৪), সপ্তাহে বারের সংখ্যা (৭) দ্বারা বিভাজ্য না। বছরে যদি ৩৬৪ দিন হতো, তাহলেই এ সমস্যা এড়ানো যেত, কারণ ৩৬৪ সংখ্যাটি ৭ দ্বারা বিভাজ্য। হ্যাংক-হেনরি ক্যালেন্ডারে ঠিক এই কাজটিই করা হয়েছে। এখানে প্রতি বছরে ৫২টি পূর্ণ সপ্তাহে মোট ৩৬৪ দিন ধরা হয়েছে।
কিন্তু তারপরেও সমস্যা থেকে যায়। বছরে ৩৬৫ দিন দিন ধরেও গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ঋতু পরিবর্তনের সাথে ক্যালেন্ডারকে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে গিয়ে প্রতি ৪ বছর পরপর ১ দিন বাড়তি যোগ করতে হয়। সেটি না করা হলে ১০০ বছর পরে দেখা যাবে ঋতুগুলো প্রায় ১ মাস স্থানান্তরিত হয়ে গেছে। বছরে ৩৬৪ দিন ধরলে এই সমস্যা আরও অনেক ব্যাপক আকার ধারণ করবে। হ্যাংক এবং হেনরি এই সমস্যাটির অভিনব এক সমাধান দিয়েছেন, যা তাদের ক্যালেন্ডারকে প্রস্তাবিত অন্য অনেক ক্যালেন্ডার থেকে ভিন্নতা এনে দিয়েছে।
তারা প্রস্তাব করেন, ৩৬৪ দিনের বছরকে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখার জন্য প্রতি ৫ বা ৬ বছর পর পর বছরের শেষে সম্পূর্ণ অতিরিক্ত একটি ‘লিপ উইক’ যুক্ত করা হবে, যাকে তারা ‘মিনি মান্থ’ অথবা Xtr (Extra) হিসেবে নামকরণ করেন। এ পদ্ধতিতে পূর্ণ একটি সপ্তাহ যোগ করার ফলে লিপ ইয়ারের আগে বা পরেও বারগুলো অপরিবর্তিত থাকবে।
হ্যাংক-হেনরি ক্যালেন্ডারের আরো কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য আছে। এখানে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস ৩০ দিনে এবং মার্চ মাস ৩১ দিনে। আবার এপ্রিল-মে মাস ৩০ দিনে, জুন মাস ৩১ দিনে। অর্থাৎ পরপর দুইটি ৩০ দিনের মাসের পর একটি ৩১ দিনের মাস। বছরের চারটি ভাগ যেন সমান ৯১ দিন বিশিষ্ট হয়, সেজন্যই মাসগুলোতে দিনের সংখ্যা এভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই যেহেতু আয়-ব্যয়ের হিসাব এবং অর্থনৈতিক পরিকল্পনা চতুর্মাসের (কোয়ার্টার) ভিত্তিতে করে, তাই এই পদ্ধতি তাদের জন্য খুবই সহায়ক হবে। সরকারি ছুটি বাদে প্রতি কোয়ার্টারের প্রথম ও দ্বিতীয় মাসে কর্মদিবসের সংখ্যা ২২ দিন এবং তৃতীয় মাসে কর্মদিবস ২১ দিন। এছাড়াও প্রতিটি কোয়ার্টারে বারের ধারাবাহিকতা অনুরূপ। অর্থাৎ জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখ যদি শুক্রবার হয়, তাহলে যেকোনো কোয়ার্টারের প্রথম মাস, যেমন এপ্রিল, জুলাই, অক্টোবরের ৫ তারিখও শুক্রবার হবে।
হ্যাংক-হেনরি ক্যালেন্ডারের অবশ্য কিছু ত্রুটিও আছে। এটি বৈজ্ঞানিক এবং মহাকাশীয় হিসেব-নিকেশের জন্য খুব উপযোগী হবে না। যেমন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে যেরকম প্রতি বছরই উত্তর গোলার্ধে ২৩ জুন সবচেয়ে বড় দিন এবং ছোট রাত হয়, হ্যাংক-হেনরি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সেটি নির্দিষ্ট থাকবে না। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে এতে সব সময়ই সর্বনিম্ন ১ দিন এবং সর্বোচ্চ ৪ দিনের পার্থক্য থাকবে। এই ক্যালেন্ডারে লিপ ইয়ারের হিসেব বের করাও গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের মতো সহজ না। জটিল গাণিতিক হিসাবের মাধ্যমে তা নির্ণয় করতে হয়।
তবে ক্যালেন্ডারটির উদ্ভাবক হেনরির মতে, ক্যালেন্ডারটি বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা মানুষের মানসিকতা। তিনি জানান, তিনি আটলান্টাতে আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিকাল সোসাইটিতে যখন ক্যালেন্ডারটি উপস্থাপন করেন, তখন তার বক্তব্য শেষে দুজন ভদ্রমহিলা তার সাথে কথা বলতে আসেন। একজন ক্যালেন্ডারটির বেশ প্রশংসা করেন। কিন্তু অপরজন অপছন্দ করেন এই অজুহাতে যে, তার জন্মদিন প্রতি বছরই বৃহস্পতিবারে পড়বে।
শুধু নির্দিষ্ট দিনে জন্মদিন পড়াটাই অবশ্য একমাত্র সমস্যা হবে না। যাদের জন্মদিন লিপ ইয়ারে পড়বে, তাদেরকে বর্তমানের চেয়েও আরো বেশি সময়, অর্থাৎ পাঁচ বা ছয় বছর পরপর জন্মদিন পালন করতে হবে। আর এ ধরনের মানুষের সংখ্যাও বর্তমানের চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ বেশি।
হ্যাংক-হেনরি ক্যালেন্ডারটি অনেক সমস্যার সমাধান দিতে পারলেও চন্দ্র নির্ভর ধর্মীয় ক্যালেন্ডারকে প্রতিস্থাপন করতে পারবে না। মুসলিম বিশ্ব ছাড়াও চীন, বুলগেরিয়া, ইসরায়েল তাদের নিজ নিজ ধর্মে এবং সংস্কৃতির জন্য পৃথক পৃথক ক্যালেন্ডার ব্যবহার করে। তাদেরকে আগের মতোই সেসব ক্যালেন্ডার ব্যবহার করতে হবে।
হ্যাংক এবং হেনরি চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাদের ক্যালেন্ডারটি বিশ্বব্যাপী চালু করার জন্য। তারা একাধিকবার জাতিসংঘের কাছেও চিঠি দিয়েছেন। তাদের ইচ্ছে ছিল ২০১৭ বা ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসের এক তারিখ থেকে এই ক্যালেন্ডারটি বিশ্বব্যাপী চালু করার। কিন্তু যত সুবিধাজনকই হোক, বিশ্বব্যাপী দিন তারিখের হিসেব রাখার মতো মৌলিক একটি রীতির পরিবর্তনে কাউকে রাজি করানো খুব একটা সহজ হবে না।