কথায় আছে “আগে দর্শনধারী, এরপর গুণবিচারী”। কথাটি সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হলেও গুণ বিচার করতে গিয়ে প্রথমে আমরা মানুষের ব্যক্তিত্বই খেয়াল করি। ব্যক্তিত্ব মানুষের অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্য; আচার-আচরণ, চিন্তা-ভাবনা, অনুভূতির সমন্বয় যা প্রত্যেক ব্যক্তিকে করে তোলে অনন্য। এসবের মিশ্রণেই কাউকে আমরা অন্তর্মুখী বা বহির্মুখী, দয়াবান বা নির্দয়, যত্নবান বা উদাসীন, উদ্বিগ্ন বা ভাবনাহীন ইত্যাদি নামে চিহ্নিত করে থাকি।
ব্যক্তিত্ব পরিবর্তনশীল। সময় এবং পরিস্থিতির সাথে মানুষের ব্যক্তিত্ব অন্য রূপ নিতে পারে। দুজন মানুষের ব্যক্তিত্ব কখনো এক হতে পারে না। ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন যে শুধু মনের এমন নয়, শারীরিক দিক দিয়েও ব্যক্তিত্বে আলাদা করা যায় মানুষকে। সুতরাং আলোচনা থেকে বোঝাই যাচ্ছে, ব্যক্তিত্ব মনোবিজ্ঞানের বেশ জটিল কিন্তু মজার একটি বিষয়। আজ চলুন ব্যক্তিত্ব নিয়ে মনোবিজ্ঞানীদের বেশ কিছু জেনে নেয়া যাক।
বিগ ফাইভ তত্ত্ব
‘Big Five‘ নামে পরিচিত এই তত্ত্ব মানুষের বৈশিষ্ট্যকে আলাদা করে একেকটি নাম দেয়, যার ফলে আমরা বাকিদের থেকে নিজেদের আলাদা করতে পারি। এটি শুধু বৈশিষ্ট্যই নির্ধারণ করে না, এর মাধ্যমে একজন মানুষের ব্যক্তিত্বের সাথে জীবনের অন্যান্য উপাদানের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে।
এই তত্ত্ব কোনো ব্যক্তির একক কাজের প্রতিফলন নয়। ১৯৩০ এর দিকের গবেষণার ভিত্তিতে তত্ত্বটি গড়ে ওঠে। ১৯৬১ সালে রেমন্ড ক্রিস্টাল এবং আর্নেস্ট পাঁচটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেন যাতে অন্য গবেষকরা এ নিয়ে নতুন নতুন বিশ্লেষণ কিংবা চিন্তা করতে পারেন। অতঃপর ১৯৮১ সালে লুইস গোল্ডবার্গ ‘Big five’ নামে একে চিহ্নিত করেন।
Big five-এর প্রতিটি তত্ত্ব নির্দেশ একটি মানুষ কীভাবে চিন্তা করে, তার আচরণ কেমন, সে কীভাবে অনুভব করে ইত্যাদি।
১) অকপটতা (Openness to Experience)
নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে- এই বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষ নতুনত্বের খোঁজে থাকে এবং সৃজনশীল থাকে কাজকর্মে। নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে মুখিয়ে থাকে তারা। কল্পনাশক্তি প্রবল, এবং শিখতে তারা বেশ আগ্রহী।
অকপটতার সাথে সামগ্রিকভাবে সুখ এবং ইতিবাচকতার একটি সুন্দর সম্পর্ক আছে। যারা এই বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষ, তাদের মধ্যে একটি চাঞ্চল্য থাকে। এছাড়াও তারা তাদের আশেপাশের লোকজনের সাথে উষ্ণ এবং সম্প্রীতির সম্পর্ক বজায় রাখে।
গবেষণাতেও অকপটতার সাথে দুশ্চিন্তা কিংবা এই সংক্রান্ত কোনো মনোবৈজ্ঞানিক ডিজঅর্ডারের সম্পর্ক পাওয়া যায়নি। তবে অকপট মানুষ পরিবর্তনে বিশ্বাসী হওয়ায় এরা কম ব্যবহারিক হতে পারে। নতুন নতুন জিনিসে তাদের মনোযোগ। সেটি ঘুরতে যাওয়া কিংবা বিলাসবহুল কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়াও হতে পারে।
২) বিবেক (Conscientiousness)
ফারহাতুন সামা একটি আইটি ফার্মের পরিচালক। কাজে তৎপর, ভীষণ পরিশ্রমী, লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে সচেতন, দায়িত্বশীল এবং নির্ভরযোগ্য। তিনি পেশাগত এবং ব্যক্তিজীবনে দায়িত্ব এবং কর্তব্য মেনে চলেন।
বিবেকবান মানুষেরা সাধারণত সফল হয়। গবেষণাতেও তাদের মধ্যে মেলবন্ধন দেখা গেছে। সামাকেও তাই এই ভাগে ফেলা যায়।
আবেগপ্রবণতা এরকম মানুষের মধ্যে কম দেখা যায়। তারা লক্ষ্য এবং তা কত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে সেই সম্বন্ধেও সচেতন।
৩) বর্হিমুখীতা (Extroversion)
আমাদের চারপাশে এরকম মানুষ কিন্তু অনেক যারা অনেক সামাজিক, সহজেই সবার সাথে বন্ধুত্ব করতে পারে, অনেক কথা বলতে পারে, যাকে বলে এনার্জিতে ভরপুর! তারা মূলত অন্তর্মুখীদের (Introvert) বিপরীত।
সব এক্সট্রোভার্ট বা বহির্মুখী মানুষ যে অনেক দ্রুত সবার সাথে মিশতে পারে এমনও নয়। কেউ কেউ হয়তো মানুষজনকে ঘিরে থাকতে পছন্দ করে, কিন্তু অপরিচিতদের সাথে শুরুতেই যথেষ্ট আপন বোধ করে না। এদের জন্যও আছে একটি নাম, এবং সেটি হলো অ্যাম্বিভার্ট (Ambivert)।
৪) সম্মতি (Agreeableness)
এ বৈশিষ্ট্যের মানুষ সাধারণত প্রতিযোগিতার মনোভাব নিয়ে থাকে না। সবার মতামতের ভিত্তিতে চলে এবং মনোমালিন্য এড়িয়ে চলতে চায়। সম্মতিপূর্ণ ব্যক্তিরা বেশি বিশ্বাসী, স্নেহশীল, পরোপকারী এবং সাধারণত অন্যদের তুলনায় বেশি সামাজিক আচরণ প্রদর্শন করে। এই সামাজিক বৈশিষ্ট্যের মানুষ সহানুভূতিশীল, অন্যদের কল্যাণের জন্য উদ্বেগ দেখায়, যখন কেউ বিপদে পড়ে তখন তারাই প্রথমে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করে।
৫) স্নায়বিকতা (Neuroticism)
এই বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষের ভেতরে নেতিবাচক অনুভূতি কাজ করে। এরা সাধারণত বিষণ্নতায় ভোগে। বদমেজাজ এবং মানসিক অস্থিরতায় থাকে। এদের মধ্যে মানসিক ডিজঅর্ডারও পরিলক্ষিত হয়। মুড সুইং, দুশ্চিন্তা, হীনম্মন্যতা, বিরক্তি ইত্যাদি দেখা যায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, সময়ের সাথে এটা ঠিক হয়ে যেতে পারে। এছাড়া এই সমস্যা বেশি দেখা দিলে সাইকোথেরাপি বা কিছু অভ্যাসের মাধ্যমে স্বাভাবিক হওয়া যায়।
নিজের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং তা নিয়ে নিরীক্ষা করা বেশ জরুরি। কারণ, এর ফলে নিজেকে তো চেনা যায়ই, এছাড়া এটি সঠিক পেশা বেছে নিতে, অন্যদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে, নিজের শক্তি এবং দুর্বলতা শনাক্ত করতে সাহায্য করে। বিগ ফাইভ ছাড়াও বিভিন্ন তত্ত্ব আছে যার মাধ্যমে ব্যক্তিত্বের শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছে।
একজন মানুষ শুধু অকপট কিংবা বহির্মুখী এরকম ঠিক হয় না। একজনের মাঝে অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন মাত্রায় থাকতে পারে। কোনোটা প্রকট, কোনোটা মাঝারি, কোনোটা আবার একদমই কম। আপনিও এটি পড়ে নিজের একটি ব্যক্তিত্বের পরীক্ষা কিন্তু করে ফেলতে পারেন!