চকোলেট খেতে ভালো লাগে? উঁহু! খাওয়া যাবে না, মোটা হয়ে যাবেন! মেয়োনেজ অনেক পছন্দ? আরে, বেশি মেয়োনেজ খেলে তো ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়! কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই কেন যেন পৃথিবীর সবচাইতে ভালো আর সুস্বাদু খাবারগুলোই আমাদের শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত হয়। আর চিকিৎসকেরা তো এদিক দিয়ে সবসময় এক ধাপ এগিয়ে। তারা পারলে কেবল চকোলেট বা মেয়োনেজ কেন, পছন্দসই সবগুলো খাবারকেই পাঠিয়ে দেয় লাল দাগের ঐপাশে। আর এই তালিকা থেকে বাদ পড়েনি কফির মতন নিরীহ, অথচ অসাধারণ স্বাদের পানীয়টিও।
অনেকেই আছেন, যাদের সকালবেলা এক কাপ গরম কফি না হলে চলেই না। তাদের জন্যই বলছি, এতদিন ধরে নিশ্চয়ই কফি পান করলে কত ঝামেলা তৈরি হয় শরীরে সেসব শুনে এসেছেন? আর ক্যাফেইনের দোষ-গুণ সম্পর্কেও কম জানেন না নিশ্চয়ই? তবে মজার ব্যাপার হলো, কেবল ক্যাফেইন নয়, কফিতে আছে এমন আরো অনেক উপাদান, যেগুলো আমাদের শরীরে অসাধারণ কিছু পরিবর্তন এনে দেয়। কী সেই পরিবর্তনগুলো? চলুন জেনে আসা যাক।
১) একটি সুন্দর সকাল
সকালে এক কাপ কফি পান করলে হয়তো আপনার সকালটা সুন্দর হয়ে যায়, তবে ব্যাপারটি কিন্তু এত হালকা কিছু নয়। সত্যিই কেবল কফিহোলিকদের জন্য নয়, সবার জন্যই এই ব্যাপারটি সত্যি। এক কাপ কফি পান করলে আপনার মন অনেকটাই ভালো আর সতেজ হয়ে যাবে।
২০১১ সালের এক গবেষণা অনুসারে, মাঝামাঝি পরিমাণের কফি পান করেন এমন মানুষদের ভেতরে হতাশা কম কাজ করে। বিশেষ করে, কফি পান করেন এমন নারী এবং পুরুষদের ভেতরে হতাশা এবং আত্মহত্যা প্রবণতা কম থাকে। কফি পান করলেই আপনার মন ভালো হয়ে যাচ্ছে এটা আপনার কল্পনা নয়। কফির ভেতরে মজুদ থাকা সেরোটোনিন, ডোপামিন আর নোরাড্রেনালাইন সত্যিই এ ব্যাপারে সাহায্য করে আপনাকে।
২) মানসিক সুস্থতা
এক কাপ কফি আপনাকে মানসিকভাবে অনেকটাই সুস্থতা এনে দেয়। সেইসাথে আপনার স্মৃতিশক্তিকেও অনেক বেশি প্রখর করে তোলে। কী ভাবছেন? কেবল মানসিক সুস্থতা আর স্মৃতিশক্তির প্রখরতা? একদম নয়! এগুলোর পাশাপাশি এক কাপ কফি আপনাকে আলঝেইমার্সের মতন মানসিক ব্যাধি থেকেও অনেকটা মুক্ত রাখে। মস্তিষ্কের যে অংশে পারকিনসন আঘাত হানে, সেখানটাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে কফি আর সম্ভাবনাকে ২৫ শতাংশ কমিয়ে দেয়।
৩) ডায়াবেটিস প্রতিরোধ
কফি পানের অভ্যাস যে আপনাকে কেবল মানসিকভাবেই সতেজ করে তোলে তা নয়, পাশাপাশি এটি আপনার শরীরে প্রচুর পরিমাণে এডিপোনেক্টিন উৎপন্ন করে। এডিপোনেক্টিন হলো সেই উপাদান যেটি আমাদের শরীরে সুগার লেভেল এবং ইনসুলিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এই ছোট্ট উপাদানটির সাথে খানিকটা ম্যাগনেসিয়াম আর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মিলে তৈরি হয় ডায়াবেটিসকে ঝেটিয়ে বিদায় করার মতন এক উপকারী পানীয়। তবে তাই বলে যাদের এর ভেতরেই ডায়াবেটিস হয়ে গিয়েছে, তারা কফির এই সুফলটি পাবেন না। আপনি কি ভয় পাচ্ছেন ডায়াবেটিসে? তাহলে কফি করুন আপনিও!
৪) হৃদয় থাকুক ভালো
মানুষের মধ্যে প্রচলিত ধারণা আছে যে, কফি হৃদপিণ্ডের জন্যে ভালো নয়। কিন্তু ব্যাপারটা কি আসলেও তাই? বাস্তবে কিন্তু কফি পান আর হৃদপিণ্ডের রোগব্যাধি- এই দুটোর কোনো সম্পর্কই নেই। উলটো কফি হৃদপিণ্ডের জন্য যথেষ্ট ভালো বলে প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি দিনে তিন থেকে পাঁচ কাপ কফি আপনার স্ট্রোকের সম্ভাবনাকেও অনেকাংশে কমিয়ে আনতে সাহায্য করে। হৃদক্রিয়া বন্ধ হওয়া এবং করোনারি হার্ট ডিজিজের মতন বিষয়গুলোও সামলে নেয় কফি একাই!
৫) সতেজ চোখ
বর্তমান সময়ে দৃষ্টিশক্তির সমস্যায় ভুগছেন না এমন খুব কম মানুষ আছেন। আর এই সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে আপনাকে সাহায্য করতে পারে কফি। চোখ ভালো রাখতে হলে গাজর খেতে হবে এমন কথা সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছেন যারা তারা এবার পান করতে পারেন কফি। কফিতে আছে ক্লোরোজেনিল অ্যাসিড। এই অ্যাসিড আমাদের চোখকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। তাই এখন থেকে আর বিরক্তিকর গাজর নয়, প্রতিদিন পান করুন কফি আর চোখকে রাখুন সতেজ!
৬) ক্যান্সারের বিরুদ্ধে ব্রহ্মাস্ত্র
সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে আসে, কেবল ডায়াবেটিস বা চোখেন নানারকম অসুখ নয়, ক্যান্সারের বিরুদ্ধেও লড়াই করে কফি। না, সব ধরণের ক্যান্সার নয়। তবে বেশ কিছু ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কাজ করে এই পানীয়টি। মুখগহ্বরের ক্যান্সার, মস্তিষ্ক কিংবা জরায়ুর ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কাজ করে কফি। তাই প্রতিদিন চার বা এর বেশী কাপ কফি পান করে খুব সহজেই নিজেকে ক্যান্সারের হাত থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারবেন আপনি।
এক গবেষণায় উঠে এসেছে, যেসব নারীর কফি পানের অভ্যাস আছে তারা তলপেট সঙ্ক্রান্ত যেকোনো ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ১৯ শতাংশ কম ঝুঁকিতে থাকেন। আর স্তনের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এ ঝুঁকি কমে আসে ৪৯ শতাংশ পর্যন্ত।
৭) ওজন কমানোর মহৌষধ
যারা কেবল চকোলেট কফি বা ক্রিমে ভর্তি কফি পান করতে পছন্দ করেন তাদের কথা বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, তাদের কথা, যারা বিশুদ্ধ কালো কফি পান করেন। আপনি কি জানেন, কালো কফি আপনার ওজনকে অনেক বেশি কমিয়ে আনে? কফিতে যে প্রচুর পরিমাণে ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড থাকে সেতো আগেই বলেছি। এই অ্যাসিড যে কেবল চোখের জন্যে ভালো তা নয়। সেইসাথে কার্বোহাইড্রেটকে ধীর করে দিয়ে শরীরের ওজন বৃদ্ধিকেও কমিয়ে দেয় এটি। তবে তাই বলে অতিরিক্ত কফি পানের কোনো মানে নেই। কারণ, অতিরিক্ত কফি পান করলে ধীরে ধীরে শরীরের ওজনের উপর কফির এই প্রভাব কেটে যাবে। সুতরাং, আপনি যদি ডায়েট করে থাকেন তাহলে কফি পান হয়তো অনেকক্ষণের জন্যে না হলেও অল্প সময়ের জন্য আপনার শরীরের পক্ষে অনেক বেশী উপকারী একটা ব্যাপার হতে পারে।
৮) ফুসফুসকে ভালো রাখে
নানারকম অনিয়ম করে যারা ভাবছেন নিজেদের ফুসফুস ইতিমধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে, তাদের জন্য কফি পান একটা বড় রকমের ইতিবাচক অভ্যাস হয়ে উঠতে পারে। ফুসফুসের ক্যান্সার থেকে শুরু করে সিরোসিস পর্যন্ত সবটুকুই সামলে নিতে পারেন আপনি অনেকখানি এই কফির বদৌলতে! প্রতিদিন দুই কাপ কফি আপনার ফুসফুসের সক্রিয়তাকে বাড়িয়ে দিতে পারে আরো অনেকটা সময় পর্যন্ত।
ভাবছেন, কীভাবে হয় এতসব? কফিতে আছে ক্যরেফেস্টোল আর কাহউয়েল নামক দুটি উপাদান যারা ফুসফুসকে সুস্থ রাখতে অনেকখানি সাহায্য করে। তবে এজন্য আপনাকে ঠিক কতখানি কফি পান করতে হবে প্রতিদিন সেটা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। জীবনপদ্ধতি ও শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভর করে এই মাত্রা ভিন্ন হয়। তবে পরিমাণ যতটুকুই হোক না কেন, সেটা আপনার শরীরে ও ফুসফুসে খানিকটা হলেও ইতিবাচক প্রভাব আনবেই!
অসুস্থতা আর মোটা হয়ে যাওয়ার ভয়ে এতোদিন কফি পান করতেন না? করলেও অনেক মেপে মেপে করতেন? এখন থেকে আর কোনো ভয় নয়। নিশ্চিন্ত মনে কফি পান করুন, যতটা চান ঠিক ততটাই! আর ফলাফল? নিজেই দেখুন!
ফিচার ইমেজ- Visa Franchise