আজকাল সাজগোজ ছাড়া যেন আমরা ঘর থেকে বাইরে এক পা ফেলার কথা ভাবতে পারি না। নিয়মিত দৌড়ঝাঁপের জন্য বাসা থেকে বের হতেও সানব্লকের পাশাপাশি চাই ঠোঁটে অন্তত ন্যুড শেডের একটি লিপস্টিক। অবশ্য নিয়মিত ভার্সিটি বা অফিস করতেও নারীরা বিভিন্ন ডার্ক শেডের লিপস্টিক ব্যবহার করেন, যা তাদেরকে শুধুমাত্র লিপস্টিকের ছোঁয়াতেই একটি ‘বোল্ড লুক’ পেতে সাহায্য করে। সাধ এবং সাধ্যের মধ্যে মিলিয়ে নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সকলেই কিনে থাকেন বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কিংবা নন-ব্র্যান্ড লিপস্টিক। কিন্তু আজকে আমরা যেসব আধুনিক ফর্মুলার লিপস্টিক, লিপগ্লস কিংবা লিপ বাম ব্যবহার করি, কেমন ছিল ইতিহাসের পাতায় তার বিবর্তন? চলুন দেখে নেওয়া যাক সাজগোজের অপরিহার্য এই রঙিন ঠোঁটকাঠির বিবর্তন।
প্রাচীন যুগ
সুমেরীয় সভ্যতা থেকে মিশরীয় সভ্যতা, এরপর রোমান সভ্যতা- নারী এবং পুরুষ উভয়ই ঠোঁট রাঙাতে ব্যবহার করেছে বেরি বা জাম জাতীয় ফল, লাল সীসা, মাটি, মেহেদি, বিভিন্ন পোকামাকড়, গাছ-গাছড়া কিংবা বিভিন্ন খনিজ। তবে সেসব উপাদান ব্যবহার করা হতো আঠার সাহায্যে, যেন তা ঠোঁটে লেগে থাকে। তবে মজার ব্যাপার হলো, সেই সময়েই এসব উপাদানকে শুধুমাত্র সৌন্দর্যবর্ধনের উপাদান নয়, বরং সুরক্ষার জন্য ঔষধি উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হতো, যা কি না ত্বককে বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা থেকে যেমন- শুষ্কতা, ঝড়ো বাতাস ইত্যাদি থেকে সুরক্ষা দিতে পারে।
প্রসাধনী সামগ্রী হিসেবে লিপস্টিকের শৈল্পিক ব্যবহার করতে দেখা যায় মেসোপটেমিয়ার ইন্দু উপত্যকা প্রদেশ এবং মিশরে। কিন্তু সভ্যতার অগ্রগমনে বরাবরই আমরা মিশরকে এগিয়ে থাকতে দেখেছি। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি তার। মিশরীয়রা পেয়ে গেলো কোসিনিয়াল নামের একধরনের পরজীবী পতঙ্গ, যা নোপল নামক ক্যাকটাস গাছে বাসা বাঁধে। এই পতঙ্গ থেকে ঠোঁট রাঙানো উপাদান পাওয়া এতটাও সহজ ছিল না। কোসিনিয়াল পতঙ্গ নোপল গাছে বাসা বাঁধার পর পাতাগুলো কেটে আনা হতো। তারপর সেসব পাতা নব্বই দিন উষ্ণ জায়গায় রেখে তাঁ দেওয়া হতো। এর ফলে পাতায় বাসা বাঁধা কোসিনিয়ালগুলো আকারে বড় হয়ে যায়। তিনমাস তাঁ দেওয়ার পরে কোসিনিয়াল গুঁড়ো করে তাতে পানি মিশিয়ে পাওয়া যায় কারমাইন রঙ। চমৎকার মেরুন রঙের এই প্রাকৃতিক তরল তখন ঠোঁটে এনে দিতো রাজকীয় সৌন্দর্য।
গ্রিসের দিকে ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাবো ভিন্ন চিত্র। সেই সময়ে গ্রিসে লিপস্টিক ব্যবহার করতো যৌনকর্মীরা। এমনকি এটি আইন করা হয়েছিলো যে যৌনকর্মীরা অবশ্যই লিপস্টিক পরিধান করবে। শুধু এখানেই শেষ নয়, যৌনকর্মী হয়েও লিপস্টিক না পরাতে বিচারের মুখোমুখিও হতে হয়েছিল কয়েকজনকে।
কিন্তু লিপস্টিক এবার আরেক ধাপ এগিয়ে গেলো একজন মুসলিম চিকিৎসকের হাত ধরে। পাউডার কিংবা তরল পদার্থ দিয়ে ঠোঁট রাঙানোর বদলে কঠিন পদার্থ দিয়ে ঠোঁট রাঙানোর চিন্তা আসলো মানব মস্তিষ্কে। আর সেই সূত্র ধরে আট থেকে তেরো শতকের মধ্যে সলিড লিপস্টিকের ধারণার অগ্রগতি হয়। ৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের আল-আন্দালুসে জন্ম নেন আরব চিকিৎসক আবুল কাজিজ। তিনি শরীরে সুগন্ধি মাখার জন্য একটি উপাদান আবিষ্কার করেন, যা মুড়িয়ে ফেলা যাবে এবং একটি ছাঁচে ফেলা যাবে। সেই ছাঁচের উপাদান শরীরে মাখলেই সুগন্ধ হবে। কিন্তু তিনি শুধু সুগন্ধিতেই থেমে থাকলেন না, আবারও এই প্রক্রিয়া চেষ্টা করলেন। পার্থক্য হয়ে গেলো এখানে যে, এবার তিনি এসবের সাথে রঙ মিশিয়ে দিলেন। জন্ম লাভ করলো সর্বপ্রথম সলিড লিপস্টিক।
এগারো থেকে তেরো শতকের মধ্যে দেখা গেলো নারীরা হরহামেশাই বেগুনি কিংবা কমলা রঙের লিপস্টিক ব্যবহার করছেন।
মধ্যযুগে এসে লিপস্টিক আবারও পড়লো ধর্মের করতলে। খ্রিস্টান ধর্মের প্রসারের ফলে লাল লিপস্টিক পরা হয়ে গেলো প্রশ্নবিদ্ধ। এমনকি একে শয়তানের কাজের সাথে জড়িত বলে মনে করা হতো। প্রসাধনী নিষিদ্ধ করার জন্য পোপ একটি নির্দেশনা প্রচলন করলেন। এর ফলে লিপস্টিক পুরোপুরি বন্ধ হয়নি, কিন্তু লাল বা গাঢ় রঙের পরিবর্তে জায়গা করে নিলো প্রাকৃতিক গোলাপি রঙ, যা নারীদের পাপশূন্যতার প্রতীক হিসেবে গ্রহণযোগ্য ছিলো।
ষোড়শ শতাব্দী
ষোল শতকে রানী প্রথম এলিজাবেথ সিংহাসনে আরোহণের পর প্রসাধনী আবার হালে চলে আসলো। তিনি প্রসাধনীর প্রতি ছিলেন বিশেষভাবে আকৃষ্ট। তিনি সাধারণত ঠোঁটে লাল রং ব্যবহার করতেন। এরপর কোসিনিয়ালের কারমাইন রঙের সাথে শ্বেতস্ফটিক মিশিয়ে তৈরি হলো আরেক ধরনের লিপস্টিক। এই মিশ্রণকে শক্ত করার জন্য রঙিন কাগজে মুড়িয়ে রোদে শুকানো হতো।
রানী স্বয়ং প্রসাধনীর প্রতি আকৃষ্ট হলেও প্রসাধনীর প্রতি চার্চের বিরোধিতা পুরোপুরি মিটে যায়নি। চার্চগুলো মনে করতো, প্রসাধনী হলো জাদুবিদ্যার আবিষ্কার। এর প্রধান কারণ ছিলো জনপ্রিয় এক বিশ্বাস যে, প্রসাধন মানুষকে প্রাকৃতিক জরা এবং রোগবালাই থেকে সুরক্ষা দেয়। এর ফলে মানুষ মৃত্যুকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে সৃষ্টিকর্তার বিরোধিতা করার চেষ্টা করছে। অথচ মজার ব্যাপার হলো, এই শতকে মানুষ ধীরে ধীরে যেসব উপাদান লিপস্টিকে ব্যবহার করতে শুরু করলো, তার অধিকাংশই ছিল ক্ষতিকারক, যা মৃত্যুকে নিবৃত্ত করার বদলে বরং ত্বকের ক্ষতিই করছিলো।
সপ্তদশ শতাব্দী
১৬৫৬ সালে একজন জপমালা বা তসবিহ কারিগর ঘটালেন এক যুগান্তকারী ঘটনা। লোকটি ফরাসি, নাম ফ্রাঁসোয়া জ্যাকুইন। তিনি কিছু মাছের আঁশ থেকে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করে ফেললেন কৃত্রিম মুক্তার নির্যাস। এই নির্যাস ক্রিস্টালাইন গুয়ানাইন নামে পরিচিত, যা আধুনিক প্রসাধনীতে একটি সিনথেটিক উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। লিপস্টিকে একে ব্যবহার করা হয় একটি স্বচ্ছ, উজ্জ্বল আর চকচকে আভা দিতে।
ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস এবং ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের রাজত্বকালে নারী এবং পুরুষ উভয়ই খুব গাঢ় করে ঠোঁট আবৃত করে রাখতেন। এর প্রধান কারণ ছিলো উভয় দেশে থিয়েটারের প্রসার এবং সাধারণ মানুষের জীবনে অভিনেতাদের হাল-ফ্যাশনের প্রভাব। কারমাইন আর চর্বির উপাদান নারী-পুরুষ উভয়েই ব্যবহার করতেন। এমনকি তখনকার দাড়ি-গোঁফওয়ালা পুরুষেরাও তাদের গোঁফে আবৃত ঠোঁটের নিচে লিপস্টিক পরতে দ্বিধা করতেন না।
অষ্টাদশ শতাব্দী
চোখ ধাঁধানো রঙের পরিবর্তে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপ জুড়ে মানুষের ঠোঁটে জায়গা করে নিলো হালকা রঙ, যদিও ফ্রান্স এক্ষেত্রে তাদের পুরনো হালেই রয়ে গেলো। মোম, বিভিন্ন প্রাণীর অস্থিমজ্জা এবং স্বর্ণপাতা চলে এলো ঠোঁট রঙ করার নতুন উপাদান হিসেবে। কিন্তু ঠোঁট রাঙানো যে কালো জাদুর সাথে সম্পৃক্ত, সেই ধারণা কিন্তু তখনও রয়েই গেলো।
উনবিংশ শতাব্দী
রানী ভিক্টোরিয়ার যুগে প্রসাধনী ব্যবহার করাকে ধরে নেওয়া হতো অভিনেত্রী, সন্দেহজনক চরিত্রের কিংবা যৌনকর্মীদের কাজ বলে। উচ্চ শ্রেণীর নারীরা এ যুগে কদাচিৎ প্রসাধনী ব্যবহার করতেন। জোরালোভাবেই লিপস্টিক নিষিদ্ধ করা ছিলো। ফলে শৌখিন নারীরা কখনো কখনো লুকিয়ে লিপস্টিকসহ অন্যান্য প্রসাধনী ব্যবহার করতেন। আবার অনেক নারীই আবেদনময়ী ঠোঁট পাওয়ার জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতেন। এর মধ্যে ছিল ঠোঁটে সুঁই ফোটানো, ঠোঁট কামড়ানো কিংবা বিভিন্ন দানাদার উপাদান দিয়ে ঠোঁট ঘষা। ঠোঁটে বাম ব্যবহার করা ছিল ঠোঁট সাজানোর এক জনপ্রিয় উপায়। মাঝে মাঝে নারীরা বামের সাথে গোপনে রঙ মেশাতেন।
উনবিংশ শতব্দীর শেষদিকে আবার ঘুরে দাঁড়ায় প্রসাধনী শিল্প। সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক লিপস্টিক উৎপাদনের কৃতিত্বও ফ্রান্সের ঝুলিতে। ১৮৮০ সালে প্যারিসে সুগন্ধী শিল্পেই তৈরি হয় বাণিজ্যিক লিপস্টিক। ১৮৯০ সালের শেষদিকে ইউরোপ এবং আমেরিকা জুড়ে লিপস্টিক বিক্রি করা শুরু হয় এবং এর প্রচার প্রসারে বিজ্ঞাপন দেওয়াও শুরু হয়। এসব লিপস্টিক কাগজের কৌটায় বা টিউবে বিক্রি করা হতো।
ভিক্টোরিয়ান যুগে নারীবাদেরও উৎপত্তি ঘটে। এর ফলে দেখা যায় লিপস্টিকের ব্যবহার নারী বিদ্রোহের এক প্রতীক হয়ে দাড়ায়। নারীরা ভাবতে শুরু করলেন, তারা কী পরবেন বা কী করবেন, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব তাদের নিজেদের। এ সময়ে তারা তাদের সম অধিকার আর ভোটাধিকারের জন্য লড়ছিলেন। অগ্রচিন্তার অধিকারিণী নারীরা মনে করলেন, লিপস্টিক ব্যবহার করা তাদের সমাজের প্রচলিত বাধার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার শামিল। এটি তাদের জীবন আর তাদের শরীরের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রাখার প্রকাশ।
মঞ্চের ভেতরে এবং বাইরে অভিনেত্রীদের দ্বারা লিপস্টিকের চলমান ব্যবহার এই শতকের শেষের দিকে একে একটি জনপ্রিয় প্রসাধনীতে রূপান্তর করে।
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক
শতাব্দীর ঘূর্ণনে প্রসাধনী হয়ে যায় নারীদের জন্য আধুনিক এবং উন্মুক্ত। ইউরোপ এবং আমেরিকা জুড়ে ফ্যাশন ম্যাগজিনগুলো এক ধারাবাহিক জনপ্রিয় উচ্চতায় পৌঁছায়। পুরুষেরা খুশি হলো এই ভেবে যে নারীরা এখন রাজনৈতিক ব্যাপার কিংবা ভোটাধিকার নিয়ে মাথা ঘামানোর বদলে ফ্যাশনের প্রতি বেশি আগ্রহী। এ সময়ে চার্লস গিবসনের তুলির আঁচড়ে উঠে আসা চিত্রকর্ম ‘গিবসন গার্ল’ থেকে নারীরা উদ্বুদ্ধ হয় সূক্ষ্ম প্রাকৃতিক ঠোঁটের প্রতি। এ সময়ে নারীরা আবারও ফিরে গেলো কারমাইনের প্রাকৃতিক রঙের দিকে। এটিকে আরও নমনীয় এবং ব্যবহার উপযোগী করা যেত মোম আর তেল মিশিয়ে। এ যুগে কারমাইনের সিনথেটিক রেপ্লিকাও পাওয়া যেতো।
১৯১৪ সালে সিনেমা শিল্পে ব্যবহারের জন্য সর্বপ্রথম প্রসাধনী উৎপাদিত হয়। এসব প্রসাধনী ছিল থিয়েটারে ব্যবহৃত প্রসাধনীর চেয়ে হালকা। আর এর মাধ্যমেই প্রসাধনী শিল্প এক আধুনিক বাণিজ্যের দিকে পা বাড়ায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কর্মক্ষেত্রে নারীদের উপস্থিতি বাড়তে লাগলো, সেই সাথে বাড়তে লাগলো নারীদের আত্মবিশ্বাস আর স্বাধীনতাও। পুরুষেরা যা করতে পারে, নারীরাও তা-ই করতে পারে এবং সাজগোজ এক্ষেত্রে কোনো বাধা সৃষ্টি করে না। নারীরা তাদের উপার্জনের টাকায় প্রসাধনী কিনতে লাগলো আরও বেশি করে।
১৯১৫ সালে মরিস লেভি সর্বপ্রথম ধাতব কৌটার লিপস্টিক বানালেন, যা ঠেলে উপরে তোলা যায়। এরই হাত ধরে আধুনিক লিপস্টিকের প্রথম ধাপ সম্পন্ন হলো। এটি বহনযোগ্য, প্রস্তুতকৃত আর ছিল সাধারণ নারীদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে। একধরনের লিপ বামও তৈরি হলো, যা ঠোঁটে দেওয়ার পর তার প্রতিক্রিয়ায় ঠোঁট লালচে হয়ে যায়। বিভিন্ন ফ্লেভারড বাণিজ্যিক লিপস্টিকও হয়ে উঠলো জনপ্রিয়।
১৯২০ এর দশক
সর্বপ্রথম সুইভেল-আপ লিপস্টিক উদ্ভাবন হয় ১৯২৩ সালে। আমেরিকার ন্যাশভিলের জেমস ব্রুস জুনিয়র এটি উদ্ভাবন করেন। এটিই হলো সেই লিপস্টিক, যা আমরা আজ ‘আধুনিক লিপস্টিক’ বলে জানি। জেমস ব্রুস জুনিয়র এই লিপস্টিককে বলেছিলেন ‘টয়লেট আর্টিকেল’।
প্যাকেজিং আর ব্র্যান্ডিং হয়ে গেলো লিপস্টিক বিক্রির কেন্দ্রবিন্দু। ট্যাঙ্গি কিংবা ম্যাক্স ফ্যাক্টর নারীদের কাছে হয়ে উঠলো সেই সময়ের নীরব চলচ্চিত্রের আর তাদের স্বপ্নের তারকাদের মতন করে সাজবার স্বপ্ন বিক্রির কেন্দ্রস্থল।
বিশের দশকে গাঢ় লালচে বেগুনি, বেগুনি, টকটকে লাল, গাঢ় লাল আর বাদামি রঙ ছিল হালে থাকা বহুল ব্যবহৃত লিপস্টিক শেড। এর মধ্যে লিপস্টিক ব্যাপক উৎপাদন হয় আর হয়ে ওঠে স্বল্প মূল্যের। নারীরা তাদের ব্যাগে লিপস্টিক আর আয়না বহন করতে শুরু করেন। শুধু তা-ই নয়, নারীরা এবার নজর দিলো লিপস্টিক দিয়ে এঁকে কৃত্রিমভাবে ঠোঁটের আকৃতি গঠন করাতেও।
‘ইট (It)’ চলচ্চিত্রের ‘দ্য ইট গার্ল’ খ্যাত আমেরিকান অভিনেত্রী ক্লারা বাউয়ের ঠোঁটের আকৃতি হয়ে উঠলো তুমুল জনপ্রিয়। তার ঠোঁটের আকৃতিতেই উঠে আসে জনপ্রিয় ঠোঁটের আকৃতি ‘কিউপিড’স বাউ’। এদিকে কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করার জন্য ফ্যাশন ম্যাগাজিনগুলো নারীদের আরও প্রসাধনী ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করতে লাগলো।
আরেকদিকে এক আমেরিকান নারী প্রসাধনী উদ্যোক্তা হেলেনা রুবিনস্টেইন উদ্ভাবন করলেন কিউপিড’স বাউ লিপস্টিক, যা দাবি করে দশকের হালে থাকা আকর্ষণীয় ঠোঁটের আকৃতি পাওয়া যাবে। এমনকি নারীরা ঠোঁটের একটি নিখুঁত আকৃতি পেতে স্টেনসিলও ব্যবহার করতে শুরু করলেন।
১৯৩০ এর দশক
প্রসাধনীর উপর ধর্মীয় নাক সিঁটকানো বন্ধ হলো। নারীরাও তাদের ভোটাধিকার পেলো এবং বাইরে কাজ করার পরিমাণ বাড়লো। এই দশকে অতিরিক্ত রঙচঙে বা উদ্ভট রঙের লিপস্টিকের ব্যবহার কমে আসলো। তার বদলে জায়গা করে নিলো রুবি পাথরের মতো অভিজাত লালচে ম্যাট রঙ। লিপস্টিক ছিল সকল স্তরের নারীদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে। এমনকি আর্থিক হতাশায় থাকা নারীদের কাছেও লিপস্টিক ছিল এমন একটি বস্তু, যা দিয়ে তারা একটু আভিজাত্যের ছোঁয়া পেতে পারেন।
ম্যাক্স ফ্যাক্টর সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক লিপগ্লস তৈরি করে, যা শুধুমাত্র চলচ্চিত্র তারকারা ব্যবহার করতেন। এটি ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে এটি হয়ে যায় হলিউডের গ্ল্যামার আর সিনেমার স্বর্ণযুগের প্রতীক। সিনেমা তারকারা হয়ে ওঠেন অনুকরণীয় আর দেবতুল্য। ১৯৩০ সালে অভিনেত্রী ইভ আর্ডেন দাবি করেন, যেসব নারীরা লিপস্টিক পরিধান করেন, তাদের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
এদিকে লিপস্টিক যতই বাণিজ্যিক সফলতা পেতে লাগলো, কিস প্রুফ লিপস্টিক তৈরির লক্ষ্যও তত বাড়তে লাগলো। ১৯৩৯ সালে ম্যাক্স ফ্যাক্টর জুনিয়র একটি কিসিং মেশিন আবিষ্কার করলেন যাতে একটি চাপ পরিমাপক যন্ত্রের সাথে একটি রাবারের লিপস্টিকের ছাঁচ সংযুক্ত করা। এটি ব্যবহার করে তিনি কিস প্রুফ লিপস্টিক তৈরির চেষ্টা চালাতে লাগলেন। কিন্তু সে যাত্রায় ম্যাক্স ফ্যাক্টর জুনিয়র সফল হলেন না।
১৯৪০ এর দশক
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বছরগুলোতে লিপস্টিকের ব্যবহার কিছুটা কমে আসলো। কারণ সব কিছু সরবরাহ ঘাটতিতে ছিল। এর ফলে প্রসাধনীর ব্যবহার কিছুটা কমে বিভিন্ন রকম চুলের স্টাইলের মাধ্যমে নিজেকে আকর্ষণীয় আর রুচিশীল হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা চললো। কাঁচামালের ঘাটতির কারণে ধাতব লিপস্টিক টিউবের বদলে ব্যবহার হতে লাগলো কাগজ বা প্লাস্টিকের টিউব। এ বছরে ম্যাক্স ফ্যাক্টর সক্ষম হয় স্মাজ প্রুফ লিপস্টিক উৎপাদন করতে।
কিন্তু এরই মাঝে উৎপাদকেরা কিন্তু কিস প্রুফ লিপস্টিক তৈরির কথা ভুলে যায়নি। তাদের অবিরাম চেষ্টা চলছিলো। ম্যাক্স ফ্যাক্টরের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও ব্যর্থ হননি রসায়নবিদ হ্যাজেল বিশপ। তার প্রচেষ্টায় ১৯৪৯ সালে তৈরি হয় নিখুঁত কিস প্রুফ লিপস্টিক।
১৯৫০ এর দশক
এ সময়ে নারীদের কাছে লাল ঠোঁটের সাথে বেড়াল চোখের সাজ ছিল তুঙ্গে। কিন্তু কিশোরীরা তাদের প্রফুল্ল, বালিকাসুলভ আর নিষ্পাপ চেহারা ফুটিয়ে তুলতে খুঁজে বেড়াচ্ছিলো তারুণ্যদীপ্ত রঙ। এতে করে লিপস্টিকের শেডের ব্যবহার দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। তরুণীরা বেছে নিলো হালকা শেডের লিপস্টিক, যা তাদেরকে সপ্রতিভ দেখাবে আর প্রাপ্তবয়স্ক নারীরা বেছে নিলো গাঢ় শেডের লিপস্টিক, যা তাদেরকে আবেদনময়ী দেখাবে।
এদিকে লিপস্টিকের কেমিক্যাল ফর্মুলা উন্নত করতে ব্র্যান্ডসমূহের মধ্যে চলছিলো তুমুল প্রতিযোগিতা। সাথে সাথে ক্রেতাদের হৃদয় জিতে নিতে বাড়ছিলো বিজ্ঞাপন আর প্রচারণার পরিমাণও।
১৯৬০ এর দশক
এ যাত্রায় অস্পষ্ট রঙগুলো উঠে এলো হাল ফ্যাশনে। সাদা বা ধূসরের মতো অস্বাভাবিক সব শেডের লিপস্টিক ঠোঁটে চাপলো। এর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল আবেদনময়ী দেখানোর পরিবর্তে চেহারায় একটি শৈল্পিক ছোঁয়া আনা।
১৯৭০ এর দশক
ত্রিশের দশকে হলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে তুঙ্গে থাকা লিপগ্লস চলে আসলো সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে। প্রসাধনী কর্নারগুলো ছাপিয়ে উঠলো লিপগ্লসে। এটি হয়ে গেলো তারুণ্যদীপ্ত আনন্দের প্রতীক। এ সময়ে বয়স্ক নারীরাও হালকা রঙের লিপগ্লস ব্যবহার করতেন, যেন তাদেরকে সতেজ দেখায়।
পাংক আদিবাসী সংস্কৃতি প্রাকৃতিক ধরনের সাজের মাধ্যমে সৌন্দর্য বর্ধনের বিরোধিতা করলো। তারা এক নতুন বাঁকের জন্ম দিলো, যাতে আদিবাসী সাজের ধরন হয়ে যায় হালের ফ্যাশন আর ভেঙে দেয় সৌন্দর্যের ব্যাপারে পশ্চিমা বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিকে। এর ফলে ঠোঁটের সাজে উঠে আসলো সাদা, ধূসর, কালো এবং বেগুনি রঙের ব্যবহার। এসব রঙের ব্যবহারের উদ্দীপনার জন্ম নেয় কম বাজেটের বাণিজ্যিক হরর মুভিগুলো থেকে।
১৯৮০ এর দশক
লিপগ্লসের ব্যবহারের পর হাল ফ্যাশনে আবারও উঠে এলো কড়া রঙের লিপস্টিক। আভিজাত্যের লাল রঙ আবারও দখল করে নিলো লিপস্টিকের বাজার। কিন্তু এর পাশাপাশি উনবিংশ শতাব্দীর রোমান্টিক কাব্যিক চেহারা পেতে কালো রঙের লিপস্টিকের ব্যবহারও চলছিলো বহাল তবিয়তে।
১৯৯০ এর দশক
এই দশকে পরিবেশবাদী চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটে। ফলে মানুষ তাদের আশেপাশে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ চাওয়ার পাশাপাশি তাদের সাজগোজেও চাইছিলো স্বাস্থ্যকর ছোঁয়া। তাই নারীরা ঝুঁকে গেলো নিউট্রাল আর আর্থ-টোনের লিপস্টিকের দিকে। লিপগ্লসের পরিবর্তে লিপলাইনারের ভেতরে ম্যাট লিপস্টিকের ব্যবহার জায়গা করে নিলো নারীদের পছন্দের তালিকায়।
এদিকে ঠোঁটে ট্যাটু আঁকাও মুভি আর পপ তারকাদের মধ্যে হয়ে ওঠে জনপ্রিয়। ঠোঁটে নিউরোটক্সিক প্রোটিন বোটক্স অনুপ্রবেশ করানোর মাধ্যমে তারকারা পেতেন ‘ট্রাউট পাউট’। আবার শল্য চিকিৎসার অগ্রগতিতে সার্জারির মাধ্যমে ঠোঁট স্ফীত করাও শুরু করেন তারকারা।
এভাবেই বহু ধাপ পেরিয়ে একবিংশ শতাব্দীতে আমরা ব্যবহার করছি উচ্চ মানের আধুনিক কেমিক্যাল ফর্মুলার বিভিন্ন ব্র্যান্ডের লিপস্টিক। যুক্তরাজ্য আর যুক্তরাষ্ট্রের লরিয়েল, এস্টি লডার, ম্যাক, কালার পপ, ওয়েট এন ওয়াইল্ড ইত্যাদি ব্র্যান্ডের মতো দামী দামী লিপস্টিকসহ এখন চীন আর জার্মানিও বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করছে ফোকালিউর কিংবা ইমাজিকের মতো খুবই সুলভ মূল্যের ব্র্যান্ডেড লিপস্টিক। তবে উচ্চমূল্যের ব্রিটিশ কিংবা আমেরিকান ব্র্যান্ডের চেয়ে আমাদের দেশে সাধারণ স্তরে চায়না ব্র্যান্ডই এখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে।
ফিচার ইমেজ- Pexels.com