![](https://assets.roar.media/assets/ZglqlpXnkN7T4bk0_autumn.png?w=1200)
আসছে শীত, হিমের বুড়ি বিবর্ণ চাদরে ঢেকে দেবে পথ-প্রান্তর। পিঠাপুলি, রবিশস্য আর খেঁজুরের রসের পাশাপাশি আগমন ঘটবে কিছু উটকো সমস্যারও, যা ঋতুভেদে এসে জোটে। শীতকালেই নয় কেবল, অন্য ঋতুতেও দেখা দিতে পারে এই আপদ, যার নাম সিজনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডার, সংক্ষেপে এসএডি( SAD)। দেখলেন তো, নামের সংক্ষিপ্ত রূপখানাই কেমন দুঃখমাখা! এই প্রতিবেদনে ঋতুভিত্তিক এই আজব অসুবিধারই সাতসতেরো জানা যাবে। কী এমন বিষয় এই সিজনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডার?
সিজনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডার
মুনের আজব রকম খারাপ লাগার পালা শুরু হচ্ছে। হুটহাট বিষণ্ণতায় ছেয়ে যাচ্ছে মন। আলস্যের মাত্রাও ঠিক যেন আগের মতো নয়, একটু গভীর হয়ে পড়েছে। সেটা হয়তো আমলে নেয়ার মতন বিষয় ছিলো না, কিন্তু তাহলে কেন আলোচনা হচ্ছে এই নিয়ে? কারণ, মুনের মনের উপর এই খারাপ প্রভাব পড়ছে প্রতি বছরই একটি নির্দিষ্ট সময়ে। আর তাই একে চিহ্নিত করা হচ্ছে মৌসুমি ব্যাধি হিসেবে। বিষণ্ণতার এমনই এক বিশেষ রূপ এই সিজনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডার, যা বিরূপ প্রভাব ফেলে শরীরেও। তুলনামূলকভাবে নারীরাই এসএডিতে আক্রান্ত হয় বেশি। আবার বয়স্কদের চেয়ে কমবয়সীদের মাঝে এর হার বেশি দেখা যায়।
![](https://assets.roar.media/assets/08mS0TQVPBV0O3iH_maxresdefault-%282%29.jpg)
সিজনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডারকে সিজনাল ডিপ্রেশন বা মৌসুমি বিষণ্ণতাও বলা হয়ে থাকে। মৌসুমের আসা-যাওয়ার সাথেই যে এর সম্পর্ক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঋতুবদলের সাথে সম্পৃক্ত এই আপদের উদ্ভব ঘটে সাধারণত শীতকালের আগে, হেমন্তের বার্তা আসার ক্ষণে।ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এই ব্যাধি, যা ডালপালা পুরো মেলে দেয় শীতের সময়টায়।
অল্পস্বল্প মন খারাপেরা বেড়ে যায় বহুগুণে।আবার বসন্তের উজ্জ্বল রঙিন দিনকাল আসার সাথে সাথে এই আপদ কেটে যেতে থাকে, গ্রীষ্মে এর উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে এসএডিকে কেবলই শীতকালীন বলে চালিয়ে দেয়া যাচ্ছে না, কিছু ক্ষেত্রে এই আপদ দেখা দেয় বসন্ত আর গ্রীষ্মের রোদ ঝলমলে দিনেও। তবে শীতেই এর উপস্থিতির আধিক্য থাকে। ঠান্ডার দিনে মন খারাপের ঝক্কিও যদি পোহাতে হয়, তা-ও কি না এত কড়া মাত্রায়, ব্যাপারটা কি সুবিধার ঠেকে মোটেও? একদমই নয়! আরেকটা বাজে সত্যি হলো এই দেশে মনের অসুখবিসুখ নিয়ে মাতামাতির চল এখনো খুব জোর হয়ে ওঠেনি। তাই এই এসএডি ব্যাপারটাও অনেকেরই জানার আড়ালে রয়ে যায়। অথচ ব্যাপারি হেলা করার মতো কিন্তু নয়! আপনার মনে প্রতি বছর নির্দিষ্ট একটি সময়ে কুরুক্ষেত্র হয়ে যাচ্ছে প্রায়, আর আপনি তা সম্পর্কে সঠিক কিছু জানছেনই না, এ কেমন কথা ভাবুন দেখি!
![](https://assets.roar.media/assets/GDL2S4VvXXBuz7ek_a-sad-woman-looking-out-of-the-window.jpg)
লক্ষণ এবং উপসর্গ
সিজনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডারের লক্ষণ ও উপসর্গ কেমন হতে পারে তা জানানো হচ্ছে এখানে। কোনোটা আপনার মৌসুমি মন খারাপের সাথে মিলে যায় কি না, দেখুন তো-
- বিষণ্নতা সঙ্গী হচ্ছে প্রায় দিনই, হতে পারে রোজই।
- একসময়ের প্রিয় কাজগুলোতে আর আগ্রহ আসছে না।
- কর্মচাঞ্চল্য কমে যাচ্ছে আগের চেয়ে অনেক।
- ব্যাঘাত ঘটছে ঘুমে।
- খাবারের রুচিতে পরিবর্তন হচ্ছে, তারতম্য দেখা দিচ্ছে ওজনে।
- আলস্য আসছে প্রবলভাবে।
- কোনো কিছুতে মনোনিবেশ করা কঠিন হচ্ছে।
- হতাশা, অপরাধবোধ দেখা দিচ্ছে প্রায়ই।
- মৃত্যুচিন্তা বেড়ে যাচ্ছে, এমনকি আত্মহত্যার চিন্তাও উঁকি দিচ্ছে মনে।
![](https://assets.roar.media/assets/nv27f5iwJWIpuMSf_new-are-you-sad-seasonal-depression-is-more-than-just-the-winter-blues-1.jpg)
হেমন্ত ও শীতের বিষণ্ণতা
শীতকালীন বিষণ্নতার বিশেষ কিছু লক্ষণ হিসেবে ধরা হয় এগুলোকে-
- ঘুমের আধিক্য
- খাবারের রুচিতে পরিবর্তন, বিশেষ করে উচ্চমাত্রার কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাদ্যের প্রতি দুর্বলতা
- ওজন বৃদ্ধি
- ক্লান্তি বেড়ে যাওয়া
- কর্মচাঞ্চল্যের ঘাটতি
বসন্ত ও গ্রীষ্মের বিষণ্ণতা
গ্রীষ্মকালীন বিষণ্ণতার বিশেষ লক্ষণ হতে পারে এরকম-
- ঘুমের ব্যাঘাত বা নিদ্রাহীনতা
- ক্ষুধামন্দা
- ওজন হ্রাস পাওয়া
- উদ্বিগ্ন হওয়া, অস্থির বোধ করা
![](https://assets.roar.media/assets/cBnrCuMUiHFPn2g3_girl-3421489_1280.jpg)
কেন হয় এসএডি?
মৌসুমি বিষণ্নতার একটি কারণ হিসেবে দেখা হয় মস্তিষ্কে বায়োকেমিক্যাল ভারসাম্যহীন এক অবস্থাকে, যা শীতের দিনের সময়টার স্বল্পমেয়াদ আর স্বল্প সূর্যালোকের কারণে সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ দিন যে জলদি ফুরিয়ে যাচ্ছে, সূয্যিমামা সঙ্গ দিচ্ছে না বেশি, এই ব্যাপারগুলো মস্তিষ্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে। মস্তিষ্কে সেরোটোনিন নামক মনোঅ্যামিন নিউরোট্রান্সমিটারে সামান্য তারতম্যের সাথে এসএডির সূচনা ঘটতে পারে, আর স্বল্প সূর্যালোক মনোঅ্যামিন নিউরোট্রান্সমিটারের তারতম্য ঘটাতে ভূমিকা রাখে। এই নিউরোট্রান্সমিটার মানুষের মেজাজকে প্রভাবিত করে। মৌসুমি বদল তারতম্য আনে শরীরের মেলাটোনিনের মাত্রায়ও, যা মেজাজ এবং ঘুমের ধরনকে প্রভাবিত করে।ঋতুর বদল ঘটার সাথে মানুষের অভ্যন্তরীণ বায়োলজিক্যাল ক্লকে এমন ছন্দের পরিবর্তন আসাটা তাই অস্বাভাবিক কিছু নয়।
অসুখের বিপত্তি এবং ঝুঁকি বাড়ার কারণ
অসুখটা যেহেতু বিষণ্নতারই একটি প্রবল স্তর, এর হাত ধরে আসতে পারে আরো অনেক ঝুটঝামেলা। মনের কোনো অসুখই বিপত্তি ছাড়া তো হয় না! সিজনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডারে ভুগলে একজন সামাজিকভাবে হেয় হতে পারে যেকোনো অবস্থায়, কাজকর্মে অসুবিধা পোহানো তো প্রায় অবধারিতই। সার্বিক মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে প্রতিনিয়ত। আরো আছে আত্মহত্যার চিন্তা, যা ভয়াবহ পরিণতিও ডেকে আনতে পারে। কাজেই, এসব ঝামেলায় না জড়িয়ে অসুখের শুরুতেই সতর্ক হওয়া চাই।
সিজনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডারের ঝুঁকি বাড়বে কখন? পরিবারের কারো এসএডি কিংবা অন্য কোনো মানসিক অসুবিধা থাকলে একজন ব্যক্তির এই অসুখে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা তৈরি হয়। আগে থেকেই বিষণ্নতায় ভোগেন যারা, ঋতুভেদে সেই বিষণ্নতা অনেকাংশে বেড়ে এসএডির সূচনা ঘটায়। বাইপোলার ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাঝে সিজনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডার সাধারণ ব্যাপার। ভৌগোলিক কারণে যারা শীতপ্রধান অঞ্চলে বসবাস করেন, তাদের ঝুঁকি স্বাভাবিকভাবেই বেশি, কেননা শীতই তো এই অসুখের আসল মৌসুম!
চিকিৎসা প্রয়োজন কখন?
সামান্য মন খারাপ নিয়ে মাথা ঘামানোর অবশ্যই কিছু নেই। কিন্তু মন খারাপ যখন দিন দিন গভীর হচ্ছে, সাথে শরীরেও দেখা দিচ্ছে বিরূপ প্রভাব, তখনও হাত গুটিয়ে বসে থাকা কেন? মাঝেমধ্যে বিষণ্ণ হওয়াটা স্বাভাবিক, কিন্তু নির্দিষ্ট একটা সময়ের মাঝে বহুদিন ধরে বিষণ্ণ হয়ে থাকাটা মোটেও তাচ্ছিল্য করার ব্যাপার নয়। দীর্ঘকালীন বিষণ্নতা যখন পেয়ে বসে আর পছন্দের কাজে অনাগ্রহী হয়ে পড়ার মাত্রা বেড়েই চলে, চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। যেকোনো অসুখ বাড়তে দিলেই বিপদ বাড়ে, মাথায় রাখুন এই সহজ কথাটি। বিশেষ করে যখন ঘুম আর খাবারের রুচিতে অধিক তারতম্য দেখা দেয়, বিধ্বংসী চিন্তা-ভাবনা প্রভাব ছড়ায় খুব, চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি প্রয়োজন তখন।
![](https://assets.roar.media/assets/xTEgMasa9yg1GfTb_Beating-SAD.jpg)
মনের অসুখগুলো আজব হয় বটে, কিন্তু কোনোটাই হেলাফেলা করার মতো সামান্য হয় না। মন ভালো না থাকলে সুস্থ শরীরেও বাসা বাঁধতে পারে হাজারটা রোগ। তাছাড়া মনই যদি তরতাজা না থাকে, জীবনটা ভালো কাটবে কেমন করে? আনন্দের একটি উপলক্ষ এসে ফিরে যাবে, আপনি বসে থাকবেন বিষণ্ন হয়ে, ভালো লাগে সেটা? সিজনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডার বা এসএডি নিয়েও তাই লক্ষণ বোঝামাত্র সতর্ক হন। যত্ন নিন মানসিক স্বাস্থ্যের। শীত বা গ্রীষ্মে জ্বর-সর্দি বাঁধানোর মতো মনের মধ্যেও একটি অসুখকে শেকড় গেড়ে বসতে দেবেন না যেন!