জীবনে চলার পথে হরেক রকমের মানুষের সন্ধান মেলে। কেউ খুবই উপকারী, কেউ বন্ধুসুলভ, কেউবা বন্ধুরূপী শত্রু- এদের আমরা মুখোশধারী বলে থাকি, আবার কেউ আপনার কাজ এবং আপনাকে একদমই সহ্য করতে পারে না। চারপাশে এই হরেক রকমের মানুষদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত নানা ধরণের মন্তব্য শুনতে হয়; হোক সেটা ভালো কিংবা মন্দ।
কেউ কেউ গঠনমূলক সমালোচনা করে, কেউবা ব্যক্তিগতভাবে আঘাত করার জন্য কুটিল মন্তব্য করে। বিষয়টা হলো- সবসময় সব মন্তব্যে আপনার মেজাজ-মর্জি ঠিক না-ও থাকতে পারে। আর আপনি যদি হন রাগী কিংবা দুর্বল চিত্তের মানুষ, তাহলে একটা না একটা অঘটন ঘটিয়েই ফেলেন। যার জন্য আমাদের সমাজে অনেক অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটছে। চলুন আজ তাহলে জেনে নেই সমালোচনার মুখোমুখি হলে নিজেকে কীভাবে সামলাবেন এবং সমালোচকের প্রতি আপনার ব্যবহার কেমন হবে।
সমালোচনার ধরণ
প্রথমেই বুঝতে চেষ্টা করুন আপনার কাজের কিংবা চিন্তাভাবনার যে সমালোচনা করা হচ্ছে, তা কি গঠনমূলক নাকি শুধু আঘাত করার জন্য বলা হচ্ছে। এক্ষেত্রে শিক্ষক বা গুরুজনদের সমালোচনাগুলোকে ধরে নিতে হবে আপনার জীবনের পাথেয়। তাদের সমালোচনার উদ্দেশ্য হলো আপনাকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা।
অনেক ছাত্রের মাঝে শিক্ষকদের এই সমালোচনা নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। তাদের জন্য বলছি, শিক্ষকের কাজই হলো আপনাকে আপনার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করা। শিক্ষক বা গুরুজনের উপর শুধু রাগ না করে তাদের কথায় মনোযোগ দিন।
মানুষ কখনো নিখুঁত এবং পরিপূর্ণ হয় না
মানুষ কখনোই সবদিক থেকে নিখুঁত কিংবা পরিপূর্ণ হয় না। সবাই একরকমও হয় না। তেমনি আপনাকেও মেনে নিতে হবে, আপনারও ভুল হতেই পারে। আপনার কাজেরও সমালোচনা হতে পারে, নিন্দা হতে পারে। নিজের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিন। আপনি চাইলে আপনার বদ অভ্যাস কিংবা ভুলগুলোর একটা তালিকা তৈরি করতে পারেন। সমালোচনাকে কখনো খারাপভাবে নিবেন না। মনে রাখবেন সমালোচনাই আপনাকে ধীরে ধীরে নিখুঁত এবং পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে।
ব্যক্তিগত আঘাত আর সমালোচনার মাঝে পার্থক্য বুঝুন
মনে করুন, আপনার বস আপনার কাজ তেমন পছন্দ করলেন না এবং কাজের ভুলভ্রান্তি ধরিয়ে দিলেন, সাথে খানিক বিদ্রূপাত্মক হাসি উপহার দিলেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় আপনি অর্থাৎ অধীনস্থ চাকুরে ভুলভ্রান্তির দিকে নজর না দিয়ে সেই বিদ্রূপাত্মক হাসির প্রতি বেশি মনোযোগ দেন এবং অফিসে অনর্থক মন কষাকষির সৃষ্টি করেন। নিজের ভুলভ্রান্তিগুলো শুধরে কাজটি আবার করে এবং পরবর্তী কাজগুলো মন দিয়ে করলে দেখবেন আপনার বসের সেই বিদ্রূপাত্মক হাসি উৎসাহের এবং গর্বের হাসিতে পরিণত হয়েছে। বিষয়টা শুধু চাকুরীজীবীদের জন্য নয়, সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
ধরুন পরীক্ষায় কোনো বিষয়ে আপনি ‘সি গ্রেড’ পেলেন। আপনার নিশ্চয়ই খুব খারাপ লাগবে। তার মানে এই নয় যে আপনার শিক্ষক বুঝাতে চেয়েছেন যে আপনি একটা ‘গাধা’। ঐ গ্রেড দ্বারা আপনাকে বুঝতে হবে যে, আপনার লেখায় বেশ কিছু ত্রুটি ছিল এবং সঠিক তথ্যের অনেক অভাব ছিল।
সহজেই আবেগতাড়িত হয়ে পড়বেন না
পূর্বেই উল্লেখ করেছি, সবাই একই ধাঁচের হয় না, সবার আবেগ নিয়ন্ত্রণের ধারাও এক নয়। সমালোচনার বা নিন্দার মুখোমুখি হয়ে কেউ অল্প কথায় রেগেমেগে, কেঁদেকেটে একাকার করে ফেলেন, কেউবা রাগের ঝাল ঝাড়েন জিনিসপত্রের উপর, কেউবা অনেক ধৈর্য নিয়ে পুরো পরিস্থিতি মোকাবিলা করে। আপনি যদি খুব সহজেই রেগে যাওয়ার মানুষ হন, তবে এক্ষেত্রে আপনার ‘চামড়া মোটা’ করতে হবে অর্থাৎ সংবেদনশীলতা কমাতে হবে। ঠান্ডা মাথায় নিজের ভুলত্রুটিগুলো শুনতে হবে এবং সমাধানের চিন্তা করতে হবে।
ব্যবসায় উন্নতির জন্য সমালোচনা খবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। আপনি যদি অল্পতেই রেগে যান কিংবা অল্পতেই কষ্ট পান, তাহলে আপনার সহকর্মী, কর্মচারী এবং ক্রেতারা সত্য কথা কিংবা সমালোচনা থেকে বিরত থাকবে কিংবা ভয় পাবে সত্য কথা বলতে। তাই অতিসত্বর নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলুন।
ধন্যবাদ দিন
যে মানুষটি আপনার ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দিচ্ছে, আপনার সমালোচনা করছে, তাকে ধন্যবাদ দিন। কারণ তার সমালোচনা থেকে আপনি নিজেকে শুধরে নিয়েছেন এবং আরো সাফল্য অর্জন করছেন/করবেন। এটা সমালোচক এবং নিন্দুক উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
এখন মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, নিন্দুককে কেন ধন্যবাদ দিবেন? প্রথমত নিন্দুক একজন সমালোচক। কিন্তু সমালোচনাকে সে খারাপভাবে বা আঘাত করার জন্য ব্যবহার করে। ধন্যবাদ আপনার বিনয়কে প্রকাশ করছে। একজন নিন্দুককে ধন্যবাদ দিলে আপনি তার মাঝে বিনয়ের বীজও বপন করেবেন।
অজুহাত দিবেন না
যখন আপনার কাজের কিংবা আচরণের গঠনমূলক সমালোচনা হয়, তখন মাঝ থেকে কোনো অজুহাত দিয়ে উঠবেন না। মনে করুন- আপনাকে একটা প্রজেক্ট দেয়া হয়েছে, সেটা তেমন ভালো হয়নি কিংবা প্রচুর ভুল করেছেন। তখন আপনার শিক্ষক কিংবা বস তার সমালোচনা করলে তা চুপচাপ শুনবেন কিংবা ভুলগুলো নোট করবেন। কিন্তু কখনোই অজুহাত দিবেন না- “স্যার, আমি অসুস্থ ছিলাম…”। কিংবা “স্যার, আসলে আমি কাজটা ভালোভাবে করেছিলাম, কিন্তু তমুকের জন্য এমন হয়েছে…”- এ জাতীয় অজুহাত দিবেন না। এতে আপনার বস কিংবা শিক্ষকের মনে আপনার সম্পর্কে বাজে ধারণার সৃষ্টি করবে।
এতক্ষণ জানলাম কীভাবে সমালোচক বা সমালোচনাকে কীভাবে মোকাবিলা করা যায়। এখন জেনে নেই কীভাবে নিন্দুককে সামলাবেন।
নিন্দুক কেন নিন্দা করছে
নিন্দুকরা সাধারণত ব্যক্তিগতভাবে আঘাত করেই কথা বলে। অনেকসময় হিংসাবশত অনেকেই নিন্দা করে। তাই কেউ কেন নিন্দা করছে তা জানাটা জরুরি।
ধরুন, আপনি একটা নতুন জামা কিনেছেন। আপনার মনে হচ্ছে জামাটায় আপনাকে বেশ ভালোই মানাবে। কিন্তু আপনার কোনো বন্ধু বলল যে জামাটাতে আপনাকে ভালো দেখাচ্ছে না। তারপর আপনি জামাটা কিনলেন। দেখা গেল, সে এই নিয়ে অন্যদের কাছে আপনার নিন্দা করছে, তাহলে আপনার দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই।
আবার ধরুন, আপনি একটা কিছু লিখলেন। আপনার কোনো বন্ধু বললেন যে লেখাটি ভালো হয়নি। হতে পারে তার আসলেই ভালো লাগেনি। কিন্তু কখনো কখনো দেখা যায়, বন্ধুরা হিংসাবশত কিছু কথা বলে। যা-ই হোক, মোদ্দাকথা হলো আপনাকে নিন্দুকের কথা থেকে ভালোটুকু গ্রহণ করতে হবে।
আত্মবিশ্বাসী হোন
যে যা-ই বলুক, আপনি আপনার নীতিতে অটল থাকুন (নিন্দুকের ক্ষেত্রে)। আত্মবিশ্বাসী থাকুন নিজের কর্মে এবং ভবিষ্যৎ কর্ম কৌশলে। নিন্দুকের কথায় কিছুতেই হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে গেলে চলবে না। বরং তাদের কথার অন্তর্নিহিত কোনো অর্থ না থাকলে, নিন্দুককে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে নিজের মতো এগিয়ে যান।
নিন্দা শুনতে কারোই ভালো লাগে না। কখনো কখনো মন খারাপ হয়, কেউবা রাগারাগি করেন। কেউবা গালি গালাজ করে নিন্দুকের জ্ঞাতি গোষ্ঠী উদ্ধার করে ছাড়েন। তাদের জন্য বলছি, আপনি যত বেশি রুঢ় আচরণ করবেন, নিন্দুক তত বেশি আপনার নিন্দা করবে। বরং নিজের উদারতা আর মানসিক সৌন্দর্য দিয়ে নিন্দুককে মোকাবিলা করুন। আর এই উদারতার মাঝেই আপনার মহত্ত্ব।
তথ্যসূত্র
১) wikihow.com/Deal-With-Criticism
২) professional-counselling.com/dealing_with_criticism_rejection.html
৩) lifehack.org/articles/featured/7-effective-ways-to-deal-with-criticism.html