আপনি হয়তো ওয়ার্কআউট, শারীরিক কসরতের গুরুত্ব জানেন। আপনি জানেন, নিয়মিত আপনি যে কায়িক পরিশ্রম করেন, তা আপনার শরীরের তুলনায় পর্যাপ্ত না। কিন্তু তারপরেও আপনি পর্যাপ্ত অনুপ্রেরণা, সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে নিজের সীমিত সময়ের মধ্য থেকে কিছুটা সময় ওয়ার্কআউটে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী না।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কিছুদিন ঘাম ঝরানোর পর লাইফস্টাইল, অভ্যাস, সময়, পছন্দ, অপছন্দসহ নানা ধরনের জিনিস বাদ সাধে; যে কারণে হয়তো আপনি ওয়ার্কআউটের ব্যাপারে অনিয়মিত হয়ে পড়েন, নয়তো পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। কিন্তু আপনি যদি নিম্নে উল্লেখিত বিভিন্ন ক্রিড়াব্যক্তিত্ব, ফিটনেস-কোচদের দ্বারা প্রস্তাবিত ধাপগুলো অনুসরণ করে সামনে আগান, তাহলে হয়তো এমন অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারেন।
১) পছন্দের ওয়ার্কআউট প্রোগ্রামটি খুঁজে বের করুন
পৃথিবীব্যাপী নানা ধরনের ওয়ার্কআউট প্রোগ্রাম রয়েছে। কেউ হয়তো ক্রসফিটের দিকে ঝুঁকছে, কেউ বা শুধুমাত্র সাধারণ ওয়েট-লিফটিংয়ের মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ করে রাখছে। এছাড়াও ক্যালিসথেনিক্স, বডি-বিল্ডিং, পাওয়ার-লিফটিং এবং সাধারণ স্পোর্টস ওয়ার্কআউট ছাড়াও পছন্দের তালিকায় যুক্ত করার মতো আরো অসংখ্য ওয়ার্কআউট প্রোগ্রাম রয়েছে। আর সবগুলো ওয়ার্কআউটই অ্যারোবিক মুভমেন্ট, এনডুরেন্স, ফ্লেক্সিবিলিটি, স্ট্রেংথ ট্রেনিংয়ের উপর নির্ভরশীল; অর্থাৎ আপনি চাইলেই যেকোনো প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেই খুব সহজেই ফিট থাকতে পারছেন।
তবে প্রাথমিক অবস্থায়, আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে, আপনি কোন ধরনের ওয়ার্কআউট বেশি পছন্দ করেন। আরো নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, আপনার পারিপার্শ্বিক অবস্থা, জিমের ধরন, সময়, ভবিষ্যতের লক্ষ্য ছাড়াও নানা দিক বিবেচনায় একটি ওয়ার্কআউট প্রোগ্রাম খুঁজে বের করাটা জরুরি। কেননা, বিচ্ছিন্নভাবে করা ওয়ার্কআউটগুলো সুনির্দিষ্ট কোনো ফলাফল এবং শারীরিক পরিবর্তন বয়ে আনে না, যার ফলে, ওয়ার্কআউট শুরু করার কিছুদিন পর হয়তো আপনি মোটিভেশন হারিয়ে ফেলবেন। কিন্তু আপনি যদি আপনার পছন্দসই, সুনির্দিষ্ট একটি ওয়ার্কআউট প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেন, প্রোগ্রামের জন্য নির্ধারিত রুটিন মেনে ওয়ার্কআউট করেন, তাহলে নির্দিষ্ট সময় পর আপনার প্রত্যাশিত শারীরিক পরিবর্তন দেখতে পারবেন, যা আপনাকে ওয়ার্কআউট করার ব্যাপারে সুস্থির এবং নিয়মিত হতে অনুপ্রেরণা যোগাবে।
২) একটি ওয়ার্কআউট প্ল্যান তৈরি করুন
একটি নির্দিষ্ট ওয়ার্কআউট প্ল্যান নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আপনার কতটুকু শারীরিক পরিবর্তন হতে পারে, তা নির্দেশ করতে সক্ষম। তাছাড়া ওয়ার্কআউট প্ল্যানগুলো আপনার লাইফস্টাইল, সময়, ওজন, শারীরিক কাঠামো এবং লক্ষ্যের উপর নির্ভর করে তৈরি করা হয়। এ কারণে ডায়েট, রেস্ট ডে, রিকভারি সহ আরো নানা বিষয়াদি সেখানে যুক্ত থাকে। অর্থাৎ, হঠাৎ করে ওয়ার্কআউটের প্রতি অবসাদগ্রস্ত হওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না।
৩) দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যের সাথে সাথে স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্য থাকাটাও জরুরি
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ ম্যারাথন দৌড়ানো, সিক্স প্যাক অ্যাবস, কিংবা ২০ পাউন্ড ওজন কমানোর মতো বড় ধরনের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য নির্ধারণ করে ওয়ার্কআউট শুরু করে। যদিও এ ধরনের চূড়ান্ত ফলাফলভিত্তিক লক্ষ্যগুলো নিয়মিত ওয়ার্কআউট করার ব্যাপারে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে, কিন্তু এগুলো আপনাকে প্রাথমিক অবস্থা থেকে কীভাবে ধীরে ধীরে সামনে এগোতে হবে, সেই নির্দেশনা দেয় না। অন্যদিকে, চূড়ান্ত ফলাফলের সাধ দীর্ঘ সময়ের সাধনার ফসল। কিন্তু শুধুমাত্র চূড়ান্ত ফলাফলের দিকে লক্ষ্য রাখলে আপনি যেকোনো সময় বিরক্ত হয়ে মোটিভেশন হারিয়ে ফেলতে পারেন। এ কারণে স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্য থাকাটা জরুরি, যা ‘প্রসেস গোল’ হিসেবে পরিচিত।
স্পোর্টস সাইকোলজিস্ট ব্র্যানডন এস. হ্যারিসের মতে, আপনার চূড়ান্ত লক্ষ্য যদি হয় সিঁড়ির সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছানো, তাহলে ‘প্রসেস গোল’ হচ্ছে ঐখানে পৌঁছানোর জন্য প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র পদক্ষেপ। আরো সহজ করে বলতে গেলে, আপনি যদি বছর শেষে ম্যারাথন দৌড়াতে চান, তাহলে প্রত্যেক সপ্তাহে নির্দিষ্ট পরিমাণ দূরত্ব বাড়ানো হচ্ছে আপনার প্রসেস গোল। আর এই প্রসেস গোলগুলো পূর্ণ করার মাধ্যমে আপনি যে অর্জনের অনুভূতি লাভ করে থাকেন, তা আপনাকে আপনার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছনোর পূর্ব পর্যন্ত নিয়মিত দৌড়ানোর ব্যাপারে অনুপ্রেরণা প্রদান করবে।
৪) প্রয়োজনে একাধিক ওয়ার্কআউট প্ল্যান রাখুন
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কাজের চাপ, সময়ের অভাবসহ নানা কারণে নির্ধারিত দিনের রুটিন মেনে ওয়ার্কআউট করা হয় না। এমনকি মাঝে মাঝে ঐসকল কাজগুলো এত বেশি হয়ে যায় যে, লম্বা সময়ের জন্য রুটিন মাফিক চলা ওয়ার্কআউটগুলো থেকে দূরে থাকতে হয়। ফলে দীর্ঘ সময় ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলা শরীরে আলস্য ভর করতে থাকে। পাশাপাশি ওয়ার্কআউট করার ব্যাপারে যে প্রেরণাগুলো কাজ করতো, সেগুলো ম্লান হতে থাকে। আর এরকম পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্যই একের অধিক ওয়ার্কআউট প্লান থাকাটা জরুরি।
ধরুন, আপনি আপনার সাপ্তাহিক রুটিনে থাকা লেগ ডে’তে জিমে যেতে পারলেন না। সেক্ষেত্রে আপনি বাসায় বিভিন্ন ধরনের স্কোয়াট, লাঞ্জ, কাফ রাইজসহ নানা ধরনের বডি-ওয়েট ব্যবহার করে লেগ-মাসলসের জন্য ওয়ার্কআউটগুলো করতে পারেন। তাছাড়া, আপার বডির জন্য বিভিন্ন ধরনের পুশ-আপ, কোর মাসল এবং এবসের জন্য বিভিন্ন ধরনের সিট-আপ, প্ল্যাঙ্কগুলো করেও আপনি আপনার ওয়ার্কআউটের সাথে থাকা সম্পর্কটাকে অবিচল রাখতে পারেন।
৫) বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারেন
বর্তমানে হার-জিতের প্রচলিত খেলাগুলো ছাড়াও ম্যারাথন, ট্রায়াথলন, ওয়েট-লিফটিংয়ের মতো এনডুরেন্স এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের ইভেন্টগুলো বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বিশেষ করে, বিভিন্ন ফান্ড রাইজিং, সচেতনতা বৃদ্ধিসহ নানা কারণে এ ধরনের ইভেন্টগুলো অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এ ধরনের স্পোর্টস ইভেন্টগুলোতে অংশগ্রহণকারীরা যতটা না জেতার জন্য অংশগ্রহণ করে থাকে, তার চাইতে বেশি নিজেদের সক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য অংশগ্রহণ করে। আপনি চাইলেই এ ধরনের ইভেন্টগুলোতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। এসবে অংশগ্রহণ আপনার ওয়ার্কআউট করার ব্যাপারটিতে নির্দিষ্ট মর্ম যোগ করবে, যা অনেকটা আত্মতৃপ্তি দিয়ে থাকে। আর যেখানে আত্মতৃপ্তির ব্যাপারটি চলে আসে, সেখানে নিরবচ্ছিন্নভাবে লেগে থাকাটা সহজ হয়ে যায়।
৬) নিজের জন্য করুন
ওয়ার্কআউট ব্যাপারটি বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী হাল-ফ্যাশনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ যতটা না নিজের জন্য প্রত্যেকদিন জিমে যায়, তার চাইতে বেশি প্রভাবক হিসেবে কাজ করে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার, সহপাঠী, কিংবা কোনো ইভেন্ট। এ ধরনের প্রভাবকগুলো ওয়ার্কআউটের সাথে নিজের সম্পৃক্ততা বজায় রাখতে সাহায্য করলেও, লম্বা দৌড়ে টিকে থাকতে হলে আপনাকে অবশ্যই এখান থেকে বের হতে হবে।
আপনি যদি নিজের শারীরিক সুস্থতার কথা বিবেচনা করে জিমে যান, যদি প্রত্যেকটি সেটে অতিরিক্ত ওজন ব্যবহার করে, কিংবা এক রেপ্স বেশি করে আনন্দ পান, যদি মাসের শেষ সপ্তাহে দৌড়ানোর পর গতি এবং দূরত্বের উন্নতি দেখে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলেন, তাহলেই আপনি এই লম্বা দৌড়ে টিকে থাকতে পারবেন।
৭) সামাজিক হোন
জার্নাল অফ বিহেভিয়রাল মেডিসিনের একটি গবেষণায় বলা হয়, সামাজিক সমর্থন ওয়ার্কআউটের প্রতি মানুষের অনুরাগ তৈরিতে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে সাহায্য করে।
আপনি চাইলে জিমে সহপাঠী তৈরি করে নিতে পারেন, যারা নিয়মিত আপনাকে জিমে আসার ব্যাপারে উৎসাহী করবে। সুযোগ থাকলে কোনো প্রশিক্ষকের শরণাপন্ন হতে পারেন; তারা আপনাকে সঠিক দিক নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি ওয়ার্কআউটের প্রত্যেকটি সেট শেষ করার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করবে। এছাড়াও, নানা ধরনের ফিটনেস প্রোগ্রাম, সাপ্তাহিক অথবা মাসিক ফিট থাকার ব্যাপারে উৎসাহীদের আড্ডায়ও অংশগ্রহণ করতে পারেন। তবে, খেয়াল রাখবেন ‘সামাজিক সমর্থন’গুলো যেন আপনাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে প্রত্যেকদিন ওয়ার্কআউট করার ব্যাপারে উদ্যমী করে তোলে।
৮) নিজের সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল থাকুন
আপনার উদ্যমী মনোভাব হয়তো আপনাকে অল্প সময়ের মধ্যে বিশ পাউন্ড কমানো অথবা আগের দিন থেকে পাঁচ কিলোমিটার বেশি দৌড়ানোর ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করবে। কিন্তু মাঝে মাজে এ ধরনের মনোভাব আপনাকে ওয়ার্কআউট করার ব্যাপারে এতটাই আক্রমণাত্মক করে তুলতে পারে যে, সে সময় নিজের শারীরিক সীমাবদ্ধতা ভুলে আপনি সামনে এগোনোর চেষ্টা করে যাবেন। যার ফলে বড় কোনো আঘাত পাওয়াসহ নানা ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে পারেন। আর বড় যেকোনো শারীরিক আঘাত আপনাকে লম্বা সময়ের জন্য ওয়ার্কআউট করা থেকে দূরে রাখবে।
আরো পড়ুন
১) নিজেকে সুস্থ এবং শক্তিশালী রাখার জন্য চার সহজ ব্যায়াম
২) ব্যায়ামের আগে ও পরে যা যা করবেন
৩) কম্পাউন্ড বনাম আইসোলেশন: ব্যায়ামে কোন পদ্ধতিটি অনুসরণ করা উচিত?