বর্তমানে আমাদের কাজের পরিধির ব্যাপকতার কারণে নানা বিষয় নিয়ে ভাবতে হয়। নিজের কাজ, পরিবার সামলানো কিংবা সামাজিক বিষয়গুলো নিয়ে প্রতিনিয়তই আমাদের ভাবতে হয়। কারণ সবসময়ই কোনো না কোনো সমস্যা লেগেই থাকে। আবার কোনো কাজ শুরু করার আগেও একটু ভেবে নিতে হয়। ব্যাপারটা যখন চিন্তার এবং চিন্তাই সমস্যা সমাধানের উপায়; তখন মাথাকে কাজে লাগাতেই হবে।
কিন্তু সব চিন্তাই যে ইতিবাচক হবে এমন না। দৈনন্দিন স্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনাগুলোকে আমরা অনেক সময় উদ্বেগে রূপ দিয়ে দিই। যার কারণে জীবন হয়ে পড়ে দুর্বিষহ, মনের শান্তি হারিয়ে ফেলি আমরা। এটা তখনই ঘটে যখন আমরা সবকিছু নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত চিন্তা করতে শুরু করি। আমরা যখন বুঝতে পারি না যে, আমাদের আসলে কী নিয়ে কতটুকু চিন্তা করা উচিৎ; তখনই বাধে বিপত্তি! এর প্রভাব পড়ে শরীর ও মনের উপর। চিন্তা তখন আর চিন্তা থাকে না, পরিণত হয় উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তায়। অথচ কতগুলো ব্যাপার মাথায় রেখে চিন্তা করলেই আমাদের আর উদ্বিগ্ন হতে হয় না। সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে বাড়তি চিন্তার হাত থেকে বাঁচতে চলুন কিছু কৌশল জেনে নিই।
ভাবনাগুলো গুছিয়ে নিন
আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই নানা ভাবনার উদয় হয়। আবার মুহূর্তের ভেতর এক ভাবনা ফেলে অন্য ভাবনায় চলে যাই। পুরো একটি দিনে যতগুলো ঘটনার সম্মুখীন আমরা হই, মোটামুটি সব ঘটনা নিয়েই আমরা ভাবি। আমাদের সাথে ঘটা কোন ঘটনাগুলো আমাদের কাছে গুরুত্ব পাবে, সেটা নির্ভর করে আমাদের জীবনধারার উপর।
তাই এখানে কোনো কিছু নিয়ে অতিরিক্ত ভাবনার সম্ভাবনা তৈরি হয়। আমাদেরকে ঠিক করতে হবে আসলে আমরা জীবনে কী চাই, চাওয়ার সাথে আমাদের ভাবনাগুলোর মিল রয়েছে কি না। আবার কোনো ব্যাপার নিয়ে ঠিক কতটুকু ভাবা উচিৎ। অনেকের জীবনে উদ্বেগের প্রধান কারণ ভাবনাগুলোকে গুছিয়ে চিন্তায় রূপ দিতে না পারার কারণে। তাই ভাবনাগুলোর নিয়ন্ত্রক হতে হবে আপনাকে।
যদি এমন হতো!
আচ্ছা, যদি লোকটার সাথে আরেকটু হেসে কথা বলতাম, তাহলে বোধহয় ভালো হতো। ওইদিন বোধহয় একটু বেশিই কথা বলে ফেলেছি। ইস! হাসার সময় আমার দাঁতগুলো কী বিশ্রী লাগছিল।
এগুলোই হচ্ছে ‘কী হলে কী হতো’ টাইপ চিন্তা-ভাবনা। একটা কাজ করে ফেলার পর সেটা নিয়ে আপনার মনে যে খুঁতখুঁতে ভাব জেগে ওঠে, সেখান থেকেই আপনি নিজের মনে হীনম্মন্যতাকে বেড়ে ওঠার সুযোগ দেন। তখন দু’একটা জায়গায় আর ভাবনাটা থাকে না, সেটা ছড়িয়ে পড়ে আপনার প্রতিটি কাজে।
তাই ‘কী হলে কী হতো’ টাইপ চিন্তা থেকে বাঁচতে নিজের করণীয় আগেই ঠিক করে নিন। পরিবেশ, পরিস্থিতি অনুধাবন করার মানসিকতা গড়ে তুলুন। কোনো কাজ করার আগেই সেই কাজের ব্যাপারে আইডিয়া নিয়ে রাখলে তখন আর কাজ করার পর মনে খুঁতখুঁতে ভাবটা আসবে না। একই কথা মানুষের সঙ্গে মেশার সময়ও। অন্তত মানুষটার সামনে হাসলে আপনাকে কেমন লাগবে সেটা আগেই নিশ্চিত হয়ে নিন!
বাস্তববাদী হোন
চিন্তা করা স্বাভাবিক, শুধু জানা থাকতে হবে কখন, কোথায়, কতটুকু চিন্তা করা উচিৎ। এটাই একজন বাস্তববাদী মানুষ আর কল্পনার জগতে বাস করা মানুষের প্রধান পার্থক্য। কল্পনার জগতে বাস করা মানুষ বাস্তবে কোনো কিছু অন্যভাবে ঘটতে দেখলে চিন্তিত হয়ে পড়ে। তার কাছে মনে হতে থাকে, এটা তো এভাবে হওয়ার কথা ছিলো! যার কারণে তার নিজের উপর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। এই পুরো প্রক্রিয়াটাকে উল্টো পথে চালাতে হলে বাস্তববাদী হতে হবে। বাস্তববাদী হওয়া মানে যেকোনো পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকা। যেমনটাই ঘটুক না কেন, আমি নিজের জায়গায় অনড় থাকবো, সমস্যার সমাধান করবো। আমার মতো হয়নি বলে দুশ্চিন্তার পথে পা বাড়াব না। জীবনটাকে বাক্সবন্দি না করে ‘অনেক কিছুই হতে পারে’ ভাবনার জায়গাটা তৈরি করতে পারলেই সমস্যা আর সমস্যা থাকে না।
পরিপূর্ণতা পরিহার
সব কাজে যদি আপনার একদম হুবহু যেভাবে ভেবেছেন সেভাবেই পেতে হয়, তবে আপনি কখনো সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবেন না। কেন? কারণ সবকিছুতে পূর্ণতা পাওয়া মানুষের পক্ষে অসম্ভব। এটা একেবারেই একটি অবাস্তব চিন্তা, সেই সাথে মানসিক অপরিপক্বতারও বহিঃপ্রকাশ।
আপনার সব কাজ যেভাবে চিন্তা করেছেন সেভাবেই হতে হবে, নইলে কাজটা হয়নি- এমন মনোভাব আমাদের জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করে। ছাড় দেওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে না পারলে কিছুদিনের মাথায় আপনি মনের শান্তি হারিয়ে ফেলবেন।
ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তা
আমাদের ভেতর একটা বৃহৎ অংশ ভবিষ্যত নিয়ে পড়ে থাকি। আজকের করণীয় কী, সেটার চেয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনাই আমাদের কাছে প্রাধান্য পায় বেশি। ভবিষ্যত নিয়ে পরিকল্পনা করা যেতেই পারে, কিন্তু আমরা মাত্রাতিরিক্ত আশা রাখি ভবিষ্যতের ব্যাপারে। যার কারণে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না আসলে আমরা ভেঙে পড়ি। এটা আমাদেরকে মাথায় রাখতে হবে যে, ভবিষ্যত আমাদের হাতে নেই, পুরো অনিশ্চিত আর ধোঁয়াটে একটি ব্যাপার।
আমাদের কাজ হলো পরিকল্পনা মতো বর্তমানকে গুছিয়ে নেওয়া। একে পুরোপুরিভাবে কাজে লাগানো আর ভবিষ্যত যেকোনো (ভালো কিছু হবে প্রত্যাশা রাখতে হবে) ফলাফলের জন্য মানসিক প্রস্তুতি রাখা। এটাই দুশ্চিন্তা না তৈরি করে এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ।
ঘুরোঘুরি ও বই পড়া
কাজের চাপে যখন নাজেহাল, তখন আপনার প্রয়োজন একটু বিশ্রাম। এটা অনেক সময় শরীরের না হয়ে মনের হয়ে পড়ে। আর মনের যখন বিশ্রাম প্রয়োজন পড়ে তখন মন এদিক-ওদিক ভাবতে শুরু করে। যার ফলাফল হিসেবে আপনার কাজের গতি হারিয়ে যায়, মাথার ভেতর চিন্তাগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে, যার চূড়ান্ত রূপ হলো দুশ্চিন্তা।
এসব থেকে বাঁচতে চিন্তাগুলোকে একটু বিশ্রাম দিন। বিশ্রাম দেওয়ার ভালো কিছু মাধ্যম হলো আপনার পছন্দের কোনো জায়গায় ঘুরতে বের হওয়া। এটা বাড়ির পাশের কফি শপ হতে পারে, পাহাড়ি ঝর্ণা হতে পারে কিংবা আপনার কোনো পছন্দের আত্মীয়ের বাড়ি। সে যা-ই হোক না কেন, আজই ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ুন। সাথে দুই-একটা বই নিতে ভুলবেন না। হতে পারে আপনার পড়া বই থেকেই সমস্যা সমাধানের কোনো সূত্র পেয়ে গেছেন!
ভয়কে জয়
মানুষের চলার পথে একটা বড় অংশজুড়ে থাকে ‘ভয়’ এর মতো বিষয়। ভয়কে ঘিরেই আমাদের অনেকের চিন্তা, পরিকল্পনা আবর্তিত হয়। আর ভয়গুলো গজিয়ে ওঠে আমাদের আগের ব্যর্থতা ঘিরেই। সাধারণত মানুষ এমন কাজে পা বাড়ায় না, যেটাতে সে আগে একবার ব্যর্থ হয়েছে। তাই এমন কাজ আবার করতে গেলে দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না।
কিন্তু সফল হওয়ার জন্য সামনে পা ফেলার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। এগুলোকে ব্যর্থতা হিসেবে না দেখে, সুযোগ হিসেবে দেখতে হবে। তবেই দুশ্চিন্তার বদলে মনে সাহস জন্মাবে।
নিজের উপর আস্থা
স্বপ্ন পূরণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো নিজের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলা। আস্থা হারানোর প্রক্রিয়াটাও একদিনে ঘটে না। জীবনে চলার পথে নানা ঘাত-প্রতিঘাত আমাদের দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। আমরা হয়ে পড়ি চূড়ান্ত হতাশ। এসব হওয়ার একটা বড় কারণ হলো নিজের যোগ্যতার চেয়ে বেশি প্রত্যাশা করা। যদিও স্বপ্ন বড় রাখা উচিত, কিন্তু সেটা তখনই, যখন আপনি নিজেকে প্রতিনিয়ত উন্নত করার জন্য কাজ করতে পারবেন। তাই নিজের উপর অল্পতেই আস্থা হারাবেন না, নিজেকে তৈরি করুন ধৈর্য নিয়ে।
কৃতজ্ঞ থাকুন
অযাচিত চিন্তা থেকে বেঁচে থাকার জন্য সবসময় সবকিছুর জন্য কৃতজ্ঞ থাকুন। কৃতজ্ঞ থাকুন সৃষ্টিকর্তার কাছে এবং মানুষকেও তাদের সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ দিন। আপনি যা পেয়েছেন তা নিয়ে যদি সন্তুষ্ট থাকেন, তবে দুশ্চিন্তাগুলো এমনিতেই মন থেকে পালাবে। সবকিছু আপনার নয়, তাই সবকিছু নিয়ে ভাবতে যাবেন না। আবার সবার সব সমস্যা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বেন না। ততটুকুই করুন, যতটুকু করে আপনি নিজেও সন্তুষ্ট। নিজের ভেতর কৃতজ্ঞতার চর্চার পাশাপাশি কৃতজ্ঞ মানুষদের সাথেও মেলামেশার চেষ্টা করুন।
ঘুম
চিন্তাগুলোকে গুছিয়ে নিতে শরীরের মতো মস্তিষ্কেরও বিশ্রাম প্রয়োজন। আর এমন বিশ্রামের সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হচ্ছে ঘুম। সাধারণত আমাদের ভেতর প্রচলিত মানসিক সমস্যাগুলোর একটা বড় কারণ পর্যাপ্ত না ঘুমানো। তাই যত চাপই থাকুক, চেষ্টা করতে হবে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঘুম যাতে নিশ্চিত করা যায়। তাহলেই আর চিন্তাগুলো মাথার ভেতর প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঘুরপাক খাবে না!