দৈনন্দিন জীবনে আমাদের আশেপাশের মানুষদের সাথে নানা প্রয়োজনে যোগাযোগ স্থাপনে যা ব্যবহার করে থাকি তার নামই ভাষা। শারীরিক অভিব্যক্তি প্রকাশ অথবা বাগযন্ত্রের সাহায্যে অর্থবোধক ধ্বনি তৈরি, সবই এই ভাষার অন্তর্গত। পৃথিবী জুড়ে সব মানুষই তাদের নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলতে, লিখতে ও পড়তে সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে থাকে। কারণ, জন্মের পর থেকে একটি মানুষ যে পরিবেশে বড় হয়, সে মূলত তার পরিবেশ থেকেই ভাষাগত দক্ষতা অর্জন করে।
আমাদের যাদের মাতৃভাষা বাংলা, তারা জন্মের পর থেকেই আশেপাশের পরিবেশ থেকে ধীরে ধীরে এ ভাষাটি রপ্ত করেছি। সুতরাং জন্মের পরে একটি শিশুর যখন ভাষার বিকাশ শুরু হয়, তখন বাচ্চাটি সে ভাষাতেই কথা বলতে পটু হয়ে ওঠে, যা সে তার আশেপাশের সবার মুখে শুনছে। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র ও যোগাযোগ স্থাপনের মতো অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাধারণত মাতৃভাষা বা রাষ্ট্রভাষাই বেশি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে মাতৃভাষার বাইরেও আরো এক বা একাধিক ভাষা আয়ত্ব করার গুরুত্ব আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কেন নিজের ভাষা ব্যতীত অন্য ভাষা শিখব। শুধু কি শখের বশে, নাকি এর ব্যবহারিক গুরুত্বও আছে?
ভিন্ন ভাষা শিক্ষার সর্বপ্রধান গুরুত্ব হলো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যোগাযোগ স্থাপনের দক্ষতা অর্জন। বিশ্বব্যাপী নির্দিষ্ট কিছু ভাষাকে আন্তর্জাতিকভাবে বহুল ব্যবহৃত ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। দেশের বাইরের কারোর সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কিংবা দেশের ভেতরে অবস্থানরত কোনো ভিন্নভাষীর সাথে ভাব বিনিময়ের জন্যে আপনাকে তাদের ভাষা অথবা প্রচলিত কোনো একটি আন্তর্জাতিক ভাষা জানতেই হবে। আমাদের দেশের কথাই যদি বলি, আমরা বাংলার পাশাপাশি ভিন্ন ভাষা হিসেবে ইংরেজির চর্চা করে থাকি। এ দেশের বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ে ইংরেজি ভাষাশিক্ষা আবশ্যক করা হয়েছে। কারণ, বর্তমানে বিদেশে শিক্ষা অর্জন করতে গেলে কিংবা নিজ দেশেও যদি উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে হয়, সেক্ষেত্রে একাডেমিক রেফারেন্স, কারিকুলাম ও পাঠ্যবইগুলোর বেশিরভাগই ইংরেজিতে রচিত।
ইংরেজি ভাষা আদতে ভিন্ন ভাষা হলেও আবশ্যিক পাঠ হবার কারণে একে ঠিক ভিন্ন ভাষা শিক্ষা হিসেবে অনেকে আলাদা চোখে দেখেন না। অনেকের চোখে ভিন্ন ভাষা বলতে মূলত আরবি, রাশান, স্প্যানিশ, চীনা, ফরাসি, মালয়, জার্মানের মতো ভাষা মনে করেন। আন্তর্জাতিক না হলেও ক্ষেত্র বিশেষে এসব ভাষা শিক্ষার গুরুত্বও কোনোভাবেই কম নয়। তবে, ভিন্ন ভাষা শিক্ষার পূর্বে চাই কিছু নির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করা এবং সে অনুযায়ী সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন।
সারা বিশ্বে প্রায় সাত হাজারের মতো ভাষা রয়েছে। একজনের পক্ষে এটি মোটেও সম্ভব নয় যে, সে সবক’টি ভাষা ঠিকঠাকভাবে শিখে ফেলবে। তাই আমরা কোন ভাষাটি শিখব আর কোন ভাষাটি শিখব না, তা মূলত নির্ভর করবে আমরা কী উদ্দেশ্যে ভাষাটি শিখতে চাচ্ছি।
ইংরেজি ভিন্ন অন্য কোনো ভাষা শেখার পেছনে বড় একটি কারণ কর্মক্ষেত্রের সুবিধার্থে। আপনি যদি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট চিন্তা করেন তবে দেখতে পাবেন, হাজার হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক প্রতি বছর কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে মধ্যপ্রাচ্য বা ইউরোপের কিছু দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এসব দেশে সাধারণ শ্রমিক পর্যায়ের কর্মক্ষেত্রগুলোতে সে দেশের মাতৃভাষা বেশি ব্যবহৃত হয় বিধায় এই ভাষাগুলোতে দক্ষ শ্রমিকদেরকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এসব দেশে যাবার পূর্বে তাদের ভাষায় সাধারণ যোগাযোগ দক্ষতা থাকাটা বেশ জরুরি। বাইরের দেশে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে যাবার পূর্বে অনেককেই সে দেশের ভাষা শিক্ষার উপর তিন বা ছয় মাসের প্রস্তুতিবিষয়ক কোর্স করে নিতেও দেখা যায়। তাই, নিজের প্রয়োজনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ভাষা চর্চা করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আপনার যদি চীনের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার ইচ্ছা থাকে, বা চীনে কাজ করতে যাওয়ার পরিকল্পনা থেকে থাকে, তবে সেক্ষেত্রে চীনা ভাষা শিখে রাখাটা বেশ প্রয়োজনীয়। বর্তমানে চীন পলিসিগত দিক থেকে যথেষ্ট রক্ষণশীল। নিজেদের আবিষ্কৃত প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি যোগাযোগ বা পড়াশোনা, সব ক্ষেত্রেই তারা চীনা ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তাছাড়াও চীনা ভাষাভাষীর সংখ্যাটা পৃথিবী জুড়ে এক বিলিয়নেরও বেশি। বিশ্বের প্রথম সারির অর্থনৈতিক পরাশক্তির এ দেশটিতে পাড়ি জমাতে চাইলে চীনা ভাষায় যোগাযোগ দক্ষতা বেশ সুবিধা দেবে বৈকি!
যারা ইউরোপ বা আমেরিকার দেশগুলোতে ঘুরতে কিংবা পড়াশোনা করতে যেতে চান, তাদের জন্যে ইংরেজির পাশাপাশি বিশেষভাবে স্প্যানিশ বা ফরাসি ভাষায় ন্যূনতম যোগাযোগ দক্ষতাটুকু থাকা বেশ ভালো। উত্তর আমেরিকার অনেক মানুষ, এমনকি ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস বা আরিজোনার মতো স্টেটগুলোতে অনেকেই স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আর দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় পুরো মহাদেশ জুড়েই স্প্যানিশ মোটামুটি জাতীয় ভাষা। সেখানকার মানুষেরা বরং ইংরেজি ভাষাতে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। এছাড়াও ইউরোপের দিকে অধিকাংশ দেশেই স্প্যানিশ বা ফ্রেঞ্চ ভাষার ব্যাপক প্রচলন আছে। যোগাযোগ স্থাপনের জন্যে কিছু ভাষাগত দক্ষতা থাকাটা বেশ প্রয়োজন।
বিশেষ কোনো কর্মক্ষেত্রের পরিকল্পনা বা শিক্ষার্জনের উদ্দেশ্য বাদেও ভাষা শেখা যায়। একটি ভাষা মূলত তার সমাজ-সংস্কৃতির একটি বড় অংশের প্রতিফলন ঘটায়। একটি দেশ সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে হলে অন্যদের রচনা পড়ে বা সে দেশের ভাষায় রচিত সাহিত্যকর্ম, সঙ্গীত ইত্যাদির অনুবাদের মাধ্যমে ততটা অনুভব করা যায় না, যতটা সরাসরি সে ভাষার রচনার মধ্য দিয়ে পারা যায়।
এছাড়াও, একজন ভিন্নভাষীর মন সহজে জয় করে নেয়ার অন্যতম চমৎকার উপায় হলো তার সাথে তার মাতৃভাষায় মনের ভাব বিনিময় করা। আমাদের সাথে যেমন ভিন্নভাষী কেউ ভাঙ্গা ভাঙ্গা অশুদ্ধ বাংলায় কথা বললেও আমরা তাতে যারপরনাই খুশি হই, অন্যদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি একইভাবে কাজ করে। যোগাযোগের পাশাপাশি বাড়ে অন্তরঙ্গতাও। ভিন্ন ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও অন্যদের সংস্কৃতির প্রতিও আগ্রহ জন্মায়। ভিন্ন ভাষাভাষী ও তাদের সংস্কৃতির প্রতি ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়।
তবে নতুন কোনো ভাষা শেখা নেহায়েত সহজ কোনো কাজ নয়। মানুষের ভাষাগত বিকাশের বয়স হচ্ছে তিন থেকে সাত বছর। এ সময়ে মানুষ একটি ভাষা সবচেয়ে ভালোভাবে আত্মস্থ করতে পারে। তাই বড় হয়ে নতুন করে ভাষা শিখতে যাওয়াটা অনেক ঝক্কি ও ধৈর্য্যের কাজ। নতুন ভাষা শেখার জন্য চাই আগ্রহ ও পরিশ্রম। নিয়মিত চর্চার পাশাপাশি ভিন্ন ভাষা সম্বলিত গান, চলচ্চিত্র, সিরিজ ইত্যাদির মাধ্যমে ভাষার ব্যবহার শেখা আরো সহজ হয়। আমাদের অনেকেই যেমন হিন্দি ভাষার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও ছোটবেলা থেকে নানা ভারতীয় গান বা চলচ্চিত্রের সুবাদে হিন্দি ভাষা শুনে বুঝতে বা বলতে পারি, ব্যাপারটা তেমন।
এই বিশ্বায়নের যুগে সমগ্র পৃথিবী আমাদের কাছে বিশ্বগ্রামে পরিণত হয়েছে। পেশাদারিত্ব হোক বা বিনোদন, প্রয়োজনের তাগিদে আমাদের বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে বেড়াতে হয়, প্রয়োজন হয় নানা দেশের নানা মানুষের সাথে সংযোগ স্থাপনের। আর তাই একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রয়োজন ভিন্ন ভাষার দক্ষতা।