বর্তমান বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের তালিকা করলে একদম প্রথমের দিকে একটি নাম চলে আসবে। সেটি হল, জ্যাক মা। বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠান আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারম্যান এই মানুষটি বর্তমানে চীনের শীর্ষ ধনী ব্যক্তি। তার মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় পঁচিশ বিলিয়ন ডলার। অথচ মানুষটার জীবনের শুরুটা ছিল অন্য দশজন সাদামাটা মানুষের মতন। চীনের সাধারণ এক পরিবারে জন্ম নেওয়া জ্যাক মা ছাত্রজীবনে কখনোই ভালো ছাত্র ছিলেন না। জীবনের প্রাথমিক অবস্থায় বারবার ব্যর্থতার সম্মুখীন হওয়া এই মানুষটির জীবন থেকে শেখার আছে অনেক কিছুই। চলুন দেখে নেওয়া যাক জ্যাক মা’র জীবন থেকে পাওয়া পাঁচটি শিক্ষা!
প্রত্যাখ্যান? সে তো সফলতার আরেক নাম
কোন কাজ শুরু করার আগে দু’টি ব্যাপার আমাদের মাথায় আসে।
১. যদি কাজটি সুন্দরভাবে শেষ করতে পারি, তাহলে কী হবে? ২. যদি কাজটি কোন কারণে করতে না পারি, তাহলে কী হবে?
অবাক করা বিষয় হলো, প্রথমটির চেয়েও দ্বিতীয় ব্যাপারটাই আমাদের মাথায় সবচেয়ে বেশি আসে। এতে কিন্তু আমাদের দোষের কিছু নেই। ছোটবেলা থেকে আমরা দেখে এসেছি, কোনো কাজে অসফল হওয়া কিংবা প্রত্যাখ্যাত হওয়া যেন ব্যর্থতারই অন্য রূপ। জ্যাক মা তার জীবনে ব্যর্থতার এই রূপের সম্মুখীন হয়েছিলেন অসংখ্যবার।
হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য দশ-দশবার আবেদন করেছিলেন। এবং প্রত্যেকবারই সফলভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি। চীনে প্রথম যখন কে.এফ.সি. এসেছিল, ২৪ জন তখন সেখানে চাকরির আবেদন করেন। এর মধ্যে ২৩ জনকে বাছাই করে নিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। বাদ পড়ে যান একজন, তিনি জ্যাক মা। ছোটবেলা থেকেই প্রত্যাখ্যানকে সমার্থক শব্দ হিসেবে নিয়ে বড় হওয়া এই মানুষটির জীবনে সফলতার পেছনে এই ব্যাপারটি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। প্রত্যাখ্যাত হতে হতে একসময় তার মন থেকে প্রত্যাখ্যানের ভয়টাই চলে গিয়েছিল।
‘না’ বলা মানুষগুলোকে ‘না’ বলা
আলিবাবা’র আইডিয়া যখন তার মাথায় আসল, তখন তিনি ভাবলেন- বন্ধুদের সাথে বিষয়টি আলোচনা করবেন। তিনি তার ২৪ জন বন্ধুকে বাসায় ডাকলেন। সবার সাথে আলিবাবা’র আইডিয়া নিয়ে আলোচনা করলেন। কিন্তু ২৪ জনের মধ্যে ২৩ জনই তার এই আইডিয়া হেসে উড়িয়ে দিলেন। তারা তার পাশে থাকতে রাজি হলেন না। কেবলমাত্র একজন বন্ধু তার পাশে থাকতে রাজি হলেন। তবে তার সেই বন্ধু শর্ত দিলেন, যদি দেখা যায় তারা তেমন কোন লাভের মুখোমুখি হচ্ছেন না, তাহলে তারা এই ব্যবসা থেকে ফেরত যাবেন। আর সামনের দিকে যাবেন না।
আমাদের প্রতিদিনকার জীবনে এমন অনেক মানুষের সাথে আমাদের দেখা মেলে, যাদের কাছ থেকে যে কোন কাজে ‘না’ ছাড়া অন্য কিছু আশা করা যায় না। এমনকি মহৎ কোনো সামাজিক কাজেও তারা প্রথমেই ‘না’ বলে বসেন। এই ‘না’য়ের পেছনে তাদের অজুহাতেরও সীমা থাকে না। কিন্তু তাই বলে কি বসে থাকলে চলবে? অবশ্যই না। বরং এই ‘না’ বলা মানুষগুলোকে বাদ দিয়েই আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
নিজের ইচ্ছাশক্তিকে জিইয়ে রাখা
জ্যাক মা’র জীবনের একটি শক্তিশালী দিক হল তার প্রবল ইচ্ছাশক্তি। আলিবাবা’র কথা বাদ দিলে তার জীবন অনেকখানি ব্যর্থ। এই প্রতিষ্ঠানটি শুরু করার আগে জ্যাক মা আরো দু’টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করেছিলেন। কিন্তু এদের কোনোটিই তখন সফলতার মুখ দেখেনি। তা-ই বলে তিনি কিন্তু বসে থাকেননি। কঠোর পরিশ্রম এবং প্রবল ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে তিনি নতুন উদ্যমে, নতুন চিন্তা-ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছেন।
প্রথম ইন্টারনেট চালাতে গিয়ে তিনি খেয়াল করলেন China, Beer সহ বেশ কিছু শব্দ ইন্টারনেটে আছে, কিন্তু চীনের এগুলো সম্পর্কিত কোনো ওয়েবসাইট নেই। তখন তিনি এ ধরনের শব্দগুলো নিয়ে চীনের একটি সাইট তৈরি করেন। পরবর্তীতে চীন সরকারের কাছে তিনি এটি বিক্রি করে দেন। একসময় তিনি বুঝতে পারলেন, সামনের দিনগুলো ইন্টারনেট নির্ভর হবে। এজন্য তিনি কাজ করা শুরু করলেন। কিন্তু তিনি যতটা ভেবেছিলেন, তখনকার বাজারে তার কাজগুলো ততটা যায়নি।
কিন্তু জ্যাক মা’র আছে আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগ, যাকে আদর করে নাম দেওয়া হয়েছে ‘ইচ্ছাশক্তি’। এই আশ্চর্য ইচ্ছাশক্তির ফলাফল আজকের দিনের ‘আলিবাবা’।
লক্ষ্য যখন সুনির্দিষ্ট, সাফল্য তখন সুনিশ্চিত
“প্রতিটি কোম্পানিই জানে, তারা কী করছে; অনেক কোম্পানি জানে, তারা কীভাবে তা করছে; কিন্তু খুব কম কোম্পানিই জানে- তারা কেন তা করছে!”
অনেক সময় দেখা যায়, কোনো কাজ করার ক্ষেত্রে আমরা চেষ্টার কোন ত্রুটি না রাখার পরেও দিনশেষে আমরা কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছি। এর কারণ হল, কোনো কাজ করতে করতে ধীরে ধীরে অন্য কোথাও হারিয়ে যাওয়া কিংবা তা থেকে দূরে সরে যাওয়া। প্রতিটি লক্ষ্যের পেছনে কিছু সুনির্দিষ্ট পথ থাকে। একজন মানুষ যখন সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়, তখন তাকে সেই পথগুলো পাড়ি দিতে হয়। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, রাস্তা পাড়ি দিতে গিয়ে আমরা ভুল পথে হারিয়ে গিয়েছি। অর্থাৎ, প্রাথমিক অবস্থায় আমাদের যে লক্ষ্য ছিল, আমরা তা থেকে অনেকখানি দূরে সরে এসেছি।
জ্যাক মা’র জীবন থেকে একটা ব্যাপার নিশ্চিত করে বলে দেওয়া যায়, তা হল তিনি লক্ষ্যের ব্যাপারে কখনোই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ছিলেন না। তিনি খুব ভালোভাবে জানতেন, তিনি কী করতে চান, কেন করতে চান এবং কীভাবে করতে চান। জ্যাক মা’র কথা অনুযায়ী,
“প্রতিটি সফল মানুষের ৫০ বছর বয়স হওয়ার পর অর্থের চিন্তা ছেড়ে দিয়ে মানব সেবা ও নতুনদের সফল করার কাজে মনোনিবেশ করা উচিত।”
তিনি এর মধ্যে ঘোষণা দিয়ে ফেলেছেন, এ বছরের মধ্যে তিনি তার প্রতিষ্ঠান থেকে অবসর নিয়ে শিক্ষার প্রসার এবং তরুণদের জন্য কাজ করা শুরু করবেন। উপরের সবকিছু আর কিছুই নয়, বরং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের অংশ মাত্র!
নিজেই যখন নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী
ক্র্যাব মেন্টালিটি বা কাঁকড়ার মানসিকতা বলে একটি ব্যাপার প্রচলিত আছে। পুকুর বা নদী থেকে কাঁকড়া তুলে যখন কোনো পাত্র কিংবা জারে রাখা হয়, তখন কাঁকড়াগুলো সেই জার বা পাত্র থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করে। সমস্যার শুরু হয় এখানেই! এক কাঁকড়া যখন দেখে তাদেরই এক কাঁকড়া জার থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে, তখন সে এসে তাকে শুঁড় দিয়ে টেনে ধরে। ফলে সেই কাঁকড়ার আর বেরিয়ে আসা হয় না। অনেক সময় দেখা যায়, অন্য কাঁকড়ারাও চলে এসেছে সেই কাঁকড়াকে টেনে নামানোর জন্য। এভাবে কোনো কাঁকড়াই জার থেকে বেরিয়ে যেতে পারে না।
আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের আশেপাশের মানুষ এবং পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছি। আমরা মানুষেরা স্বভাবগতভাবেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পছন্দ করি। তবে মাঝে মাঝে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিকট এবং কুৎসিত আকার ধারণ করে। তখন আমাদের অবস্থাও সেই কাঁকড়ার মতন হয়ে যায়। জ্যাক মা’র জীবনের একটি বড় শিক্ষা হলো- তিনি তার আশেপাশের এমনকি ব্যবসা ক্ষেত্রে তার প্রতিযোগীদেরও কখনো প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেন না। বরং তিনি নিজেকেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে পছন্দ করেন। তিনি নিজে ঠিক করে নেন, তার আজকের দিনটি হবে গতদিনের তুলনায় আরেকটু ভালো। আপনি নিজেই যখন নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী, তখন আশেপাশের কোনোকিছু আপনাকে আপনার লক্ষ্য অর্জন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না।
জ্যাক মা’র জীবনের এই শিক্ষাগুলো যদি আপনি আপনার ব্যক্তিগত জীবনে কাজে লাগাতে পারেন, তবে আপনার জীবনও দেখা পেতে পারে কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের ছোঁয়ার। তবে আর দেরি কেন? আজকে থেকেই শুরু হোক এই শিক্ষাগুলোর বাস্তবায়ন!
বিশ্বের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
জ্যাক মা সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইটিঃ