Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ষড়যন্ত্র তত্ত্ব: জমজমাট গল্পের অন্তরালের বাস্তবতা

‘করোনা ভাইরাস চীনের সৃষ্টি: দাবী মার্কিন রাজনীতিবিদের!’

‘অতিরিক্ত মেধাই হতে পারে দাম্পত্য জীবনে কলহের কারণ!’

‘এফবিআই’র গোপন মিশনে বেরিয়ে এলো চাঞ্চল্যকর তথ্য!’

‘সুরাইয়া তারাতেই হবে করোনার সকল অবসান’

সুপ্রিয় পাঠক, অনলাইনে এসব রকমারি সংবাদ শিরোনামের খবরাখবর দেখতে আমরা সকলেই কমবেশি অভ্যস্ত। মূল ধারার পাঠকদের অনেকের কাছে এসব দুর্ধর্ষ সংবাদ, রোমাঞ্চের অনুভূতি বইয়ে দিলেও যাদের স্বভাব একটু সতর্ক অবস্থানে থাকা, তারা হয় অনায়াসেই এসব খবর এড়িয়ে যান অথবা কখনও কখনও নিছক বিনোদনের উৎস হিসেবে নিয়ে একহাত সমালোচনা করে ফেলেন। ঘটনার অন্তরালের সত্যিকার কাহিনী তুলে ধরা, বিশ্লেষণধর্মী লেখা উপস্থাপন, তথ্যবহুল আলোচনা করার বদলে অত্যন্ত চমকপ্রদ, রসময়, চোখ ধাঁধানো শিরোনামের এসব খবরকে বলা হয়ে থাকে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’।

ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়ানোর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? কেন একজন লেখক কিংবা একজন সংবাদকর্মী একটি ভ্রান্তিমূলক শিরোনামের মোড়কে কিছু চটুল, হাস্যকর, সংবেদনশীল, অপ্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সাজানো একটি খবর পেশ করতে উদ্যত হন? একটি কারণ হতে পারে- ব্যক্তিগত স্বার্থ। আবার কখনও কখনও কোনো দেশের সরকার স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করতেও সংবাদ মাধ্যমকে ব্যবহার করতে পারে। রাজনৈতিক কোনো দল নিজের ইমেজকে স্পষ্ট করতে কিংবা বিরোধী দলকে হেয় প্রতিপন্ন করতে প্রচারণা চালনা করার হাতিয়ার হিসেবে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ব্যবহার করতে পারে।

তবে আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় হচ্ছে- সমাজের মূল জনস্রোতের একজন হিসেবে এসব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আমাদের কী শিক্ষা দেয় এবং এসব তত্ত্ব দ্বারা প্ররোচিত হয়ে যেকোনো ধরনের পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে আমরা নিজেদের কীভাবে দূরে রাখতে পারি?

ষড়যন্ত্র তত্ত্বের দরুন বহু মানুষের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন হয়ে থাকে; Image Source: theconversation.com

শুরুতেই একটু ইতিহাসের দ্বারস্থ হওয়া যাক। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩১ অব্দে রোম এক রোমহর্ষক ঘটনার সম্মুখীন হয়। কোনো এক অজানা কারণে একের পর এক নাগরিক অসুস্থ হচ্ছিল এবং স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সকলেই মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছিল। প্রাচীন এই সভ্যতার সকলেই স্বাভাবিকভাবে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন এবং কোনো সমাধানও খুঁজে পাচ্ছিলেন না। আচমকা একজন নারী এসে রোমের একজন প্রশাসনিক ব্যক্তিত্বকে (বর্তমানে প্রচলিত ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ) জানালেন, তিনি এই ক্রমিক মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশক্রমে তিনি ঘরে ঘরে তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনা করেন এবং দাবি করেন, উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কিছু সম্ভ্রান্ত নারী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিষ তৈরি করছেন।

গোপনে কাজ চালিয়ে যাওয়া এসব নারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলে তাদের সকলকে রোমের কেন্দ্রীয় চত্বরে হাজির করা হয় এবং নিয়ম মোতাবেক তাদেরকে সুযোগ দেওয়া হয় আত্মপক্ষ সমর্থনের। তাদের দাবি ছিল, তাদের এই রাসায়নিক দ্রব্য কোনো বিষ নয়, বরং ঔষধি গুণাগুণসম্পন্ন। বিচারকের আদেশে অভিযুক্তদের মাঝে দুজন সেটি পান করলে তৎক্ষণাৎ মারা যান। ফলাফল হিসেবে ব্যপক ধরপাকড় শুরু হয় রোমে এবং শেষ অবধি ১৭০ জন ব্যক্তি গ্রেপ্তার হন। অশুভ শক্তিকে দমনের জন্য রোমে এরপর ধর্মীয় অর্চনা শুরু হয়।

রোমে উচ্চবিত্ত নারী ও দাসী- উভয় দলকেই বিশ্বাসঘাতক ও অশুভ শক্তির উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হতো ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্যে; Image Source: bbc.com

ইতিহাসবেত্তা লিভি তার রচনায় এই ঘটনাটিকে উল্লেখ করলেও তার পর্যবেক্ষণ, বিচার-বুদ্ধি ইত্যাদি বলে যে, বিষ তৈরির অভিযোগটি পুরোটাই মূলত মিথ্যাচার ছিল। অধুনা ইতিহাস বিশ্লেষকদের মতামতও লিভির সাথে সাযুজ্যপূর্ণ। লিভির মতামত হচ্ছে, তৎকালীন রোমের নাগরিকরা মূলত একটি মহামারিকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। ধারণা করা হয়ে থাকে, রোমে সে সময় প্লেগের প্রাদুর্ভাবে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয় এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হয়তো সত্যিই ওষুধ বানাচ্ছিলেন, যা তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ইতিহাসে সুপ্রাচীন ঘটনার অস্তিত্ব এই প্রমাণ করে যে, এসবের চল আধুনিক বিশ্বের সৃষ্টি নয় বরং ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছিল রোমান সাম্রাজ্যের আর্থসামাজিক অস্থিরাবস্থার জন্য দায়ী।

তথ্যের অপ্রতুলতা

আপনাকে তখনই কোনো একটি বিষয়ে প্রভাবিত করা সম্ভব, যখন সুনির্দিষ্ট সেই বিষয়ে আপনার কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে তথ্য থাকবে না। আপনার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে আপনাকে ইচ্ছেমতো একটি নির্দিষ্ট মতবাদ, বিশ্বাস, ধারণার দিকে চালিত করা খুবই সহজ একটি বিষয়। ১৯৯০ সালে বিজ্ঞানী অ্যান্ড্রু ওয়েকফিল্ড দাবি করেন, এমএমআর টিকা অটিজমের জন্য দায়ী। এ দাবি শেষ পর্যন্ত ভুল প্রমাণিত হয় কয়েক দশক পর। অথচ এ সময়ের মাঝে যা ক্ষতি হওয়ার, তা হয়ে গেছে। বিজ্ঞান সবসময়ই চলে যুক্তির উপর নির্ভর করে; অর্থাৎ, এখানে ‘মনে হওয়া’র কোনো সুযোগ নেই।

ওয়েকফিল্ডের এ দাবিকে ভুল প্রমাণিত করতে অনেকটা সময় চলে গেল, কেননা এ দাবিকে মিথ্যা অভিহিত করার জন্য অত্যন্ত বৃহৎ কলেবরের ও সুদীর্ঘ সময়ব্যাপী গবেষণার দরকার ছিল। যেহেতু বিজ্ঞান, সরকারি বিভিন্ন কাজকর্ম, বিভিন্ন আইনানুগ প্রক্রিয়াসমূহ সহজাতভাবেই দীর্ঘসূত্রিতা অনুসরণ করে চলে, তাই এসব বিষয়ে মানুষকে সঠিক তথ্য দেওয়ার বদলে সমাজে প্রচলিত বিশ্বাস, ভ্রান্ত ধারণা, জনপ্রিয় বিষয়সমূহের ভিত্তি করে একটি ব্যাখ্যা দেওয়া খুবই সহজ। আরেকটি বিষয় আমরা প্রায়ই শুনে থাকি, মিথ্যাকে বারবার বললে সেটি সত্যের মতো শোনায়। কোনো একটি বিষয়ের (সেটি প্রমাণিত সত্য না হলেও) চর্বিতচর্বণ একটি সুদৃঢ় সত্যের প্রতিষ্ঠালাভের পথ সুগম করে দেয়।

সাম্প্রতিক টুইট বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, মাত্র ৩৪.৮ শতাংশ টুইটে কোভিড-১৯ ও ফাইভ-জি নেটওয়ার্কের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। তাহলে এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের এত বহুল জনপ্রিয়তার কারণ কী? অন্যান্য ক্ষেত্রে এই দুয়ের সম্পর্ককে অনুমোদন দেওয়া না হলেও অন্তত একে শুধু উচ্চারণ করার (একটি বক্তব্য বা ফ্যাক্ট হিসেবে) কারণেই এটি মানুষের এতটা নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। অর্থাৎ, মানুষ ব্যাখ্যার চেয়ে স্পর্শকাতর তথ্যের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল। 

অনিশ্চয়তা

আপনার লক্ষ্য যদি হয়, যেকোনো মূল্যে একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার- তাহলে মানব সভ্যতার যেকোনো ক্রান্তিকাল হতে পারে সবচেয়ে লোভনীয় এবং সঠিক সময়। বিভ্রান্তি ছড়াবার জন্য সংকটময় মুহূর্তের চেয়ে চমৎকার আর কিছুই হতে পারে না। সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া বহুল আলোচিত তত্ত্বগুলোর মাঝে একটি হলো, ফাইভ জি এবং করোনা ভাইরাসের মধ্যকার সম্পর্ক। বিষয়টি কিন্তু এমন নয় যে, আলোচনার টেবিলে ফাইভ জি এই প্রথমই উঠে এলো। ফাইভ জি নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা নিয়ে তর্ক, আলোচনা, বাদানুবাদ চলছে প্রায় তিন দশক যাবত। অথচ তুমুল আলোড়ন তৈরি হলো কখন? যখন পৃথিবী অসহায় চোখে করোনাভাইরাসের তাণ্ডবলীলা দেখে যাচ্ছে। 

‘সাসপিশিয়াস মাইন্ডস: হোয়াই উই বিলিভ কনস্পিরেসি থিওরিস’ বইয়ের প্রচ্ছদ; Image Source: amazon.com

ফাইভ-জি ভিত্তিক কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্বই জনপ্রিয়তার এতটা উচ্চে অবস্থান করতে পারেনি, যতটা পেরেছে করোনাভাইরাস ইস্যুতে। অর্থাৎ, যেকোনো তুমুল সংঘর্ষ বা দ্বন্দ্বমুখর পরিস্থিতিতে মানুষের মস্তিষ্ক একটি স্বস্তিজনক ব্যাখ্যা পেতে ভালোবাসে। একটি ভালো চিত্রনাট্যের (পড়ুন, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব) সকল উপাদান একেবারে সঠিক অনুপাতে বিদ্যমান রয়েছে করোনা ও ফাইভ-জি উপাখ্যানে। একটি জমজমাট প্লট, তুখোড় খলনায়ক এবং সবশেষে কিছু নৈতিক শিক্ষা- এসবের মিশেলে এই তত্ত্বটি ষড়যন্ত্রের দৌড়ে অন্য সব ব্যাখ্যাকে নিমেষেই পেছনে ফেলে দিয়ে এগিয়ে গেছে।

গোষ্ঠীগত বিশ্বাস

বিশ্বাস সবসময় ধর্মভিত্তিক হয় না। সামাজিক ও ব্যক্তিক প্রভাব, শিক্ষা, রাজনীতি, বয়স ইত্যাদি নানা কিছু দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠী নানা ধরনের ধ্যান-ধারণায় বিশ্বস্ত হয়ে ওঠে। সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মাঝে বিশ্বাস, মতবাদ ইত্যাদিতে রকমফের লক্ষ্য করা যায়। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব একই গোষ্ঠীর মানুষকে সংঘবদ্ধ হতে উদ্বুদ্ধ করে

ফাইভ জি ও কোভিড-১৯ এর ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কারণে মানুষের ভাঙচুর করা নেটওয়ার্ক টাওয়ার; Image Source: businessinsider.com

একটু সহজ করে ব্যাখ্যা করা যাক। ধরা যাক, চলমান কোনো একটি সমস্যা নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে। এখন সমাজের নানান মতবাদে বিশ্বাসী লোকজনের মাঝে কোনো একটি দলের কাছে চলমান সমস্যার কারণ ও সমাধান যৌক্তিক বলে মনে হলো এবং অন্য দলগুলো এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিল। এতে করে হলো কী? উপস্থাপিত ষড়যন্ত্র তত্ত্বটি যে দল বিশ্বাস করছে, তার অন্তর্ভুক্ত সদস্যদের মধ্যকার বন্ধন আরও দৃঢ় ও মজবুত হবে। এভাবে ক’দিন বাদে হয়তো নতুন একটি তত্ত্ব আসবে, যেটি হয়তো অন্য কোনো দলের কাছে অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হবে এবং তাদের অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সেটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। 

দরকার যাচাই বাছাই

‘ইলুমিনাতির খোঁজ মিলল অবশেষে!’

‘সত্যিই কি মানুষ চাঁদে অবতরণ করেছিল?’

‘এতদিন জেনে এসেছেন ভুল; মূলত পৃথিবী সমতল!’

এগুলো সম্ভবত সবচেয়ে বহুল আলোচিত তিনটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। আচ্ছা আপনাদের মনে কি কখনও প্রশ্ন জেগেছে যে, পৃথিবীতে অসংখ্য ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচলিত থাকলেও কিছু সুনির্দিষ্ট তত্ত্ব এত সাড়া জাগায় কেন কিংবা অন্যগুলোর চেয়ে এসব তত্ত্বের ব্যাপ্তিকাল এত সুদীর্ঘ কেন, বা এদের মাঝে ব্যতিক্রমী কী আছে? ষড়যন্ত্র তত্ত্বের উৎস বা শেকড় সন্ধানেই মিলতে পারে এদের অবসানের রসদ। অর্থাৎ, ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে বাতিল করার জন্য এর মূলানুসন্ধান করাটা খুব জরুরি। এগুলো কেন মিথ্যা, এই সম্পর্কিত গবেষণার পাশাপাশি এগুলোর সৃষ্টি কেন হয়েছিল, সেটা জানাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ বৈকি। 

আরেকটি বিষয় হচ্ছে- গণতন্ত্রের সুপ্রতিষ্ঠা। একটি জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা জোরদারের মাধ্যমে সরকার, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সংবাদ মাধ্যম এবং জনগণের মাঝে একটি স্পষ্ট, পরিচ্ছন্ন সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে, যার কারণে কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্বই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার অবকাশ পাবে না। একের পর এক তত্ত্বের কারণে সাধারণ মানুষ, বহুকাল হয়ে গেল কর্তাব্যক্তি, গবেষকদের ওপর আস্থা হারাতে বসেছে।

This article is about the lessons we can take from conspiracy theories and what we should do not to be overwhelmed with them. This article is written in the Bengali language.

All the necessary references are hyperlinked within the article.

Featured Image: bbc.com

Related Articles