১৫-২০ মিনিট সময় নির্বাচন করুন। কোলাহলবিহীন কোনো স্থানে গিয়ে বসুন। ধীরে ধীরে মনকে স্থির করার চেষ্টা করুন। ভাবুন আপনার প্রিয় কোনো জায়গার কথা যেখানে আপনার সময়গুলো অনেক ভালো কাটে কিংবা এমন কোনো জায়গা যেখানে গেলে আপনার মন এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। চলে যান সেখানে। ঘুরে বেড়ান নির্জন সে জায়গায়। জীবনের সব ব্যস্ততা ভুলে সময় দিন আপনার কল্পনাকে। এভাবেই শুরু হবে আপনার মেডিটেশন। নিয়মিত বসুন মনকে সময় দিতে। অভ্যাস গড়ে ফেলুন। মনের সকল রাগ, ক্ষোভ, সকল অশুভ অনুভূতি যা আপনি কখনোই প্রকাশ করতে চান না, ধীরে ধীরে এসব আপনার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। নীরবে বসে সুনির্দিষ্ট অনুশীলনের মাধ্যমে মনকে স্থির করার এই প্রক্রিয়াই হল মেডিটেশন।
কীভাবে উৎপত্তি
মেডিটেশনের উৎপত্তি সম্পর্কে সঠিক ধারণা কখনোই পাওয়া যায়নি। তবে ইতিহাসবেত্তাদের ধারণা, যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৫,০০০ বছর আগে থেকেই মেডিটেশন করতো মানুষ। কেউ কেউ এমনটাও বলনে যে, যারা জঙ্গলে পশু-পাখি শিকার করতো তাদের মধ্যে মেডিটেশনের প্রচলন ছিল বেশি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তাদের মাধ্যমেই আজকের মেডিটেশনের এই রূপ পেয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে রচিত হিন্দু বেদ শাস্ত্রেও মেডিটেশন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। যোগব্যায়ামের সাথে মেডিটেশনের অনবদ্য সম্পর্ক রয়েছে। ৪০০ – ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ‘পতঞ্জলির যোগসূত্র’ সংকলনে মেডিটেশনের কথা পাওয়া যায়। পরবর্তীতে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মেডিটেশন নিয়ে নানারকম শাস্ত্র রচিত হয়েছে। জাপানে সর্বপ্রথম মেডিটেশন হল গাংগোজি মন্দির তৈরি হয় ৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে। মূলত প্রাচীন চীন, জাপান আর ভারতীয় বৌদ্ধদের মাধ্যমেই মেডিটেশনের নানারকম সংস্কার আর বিবর্তন ঘটে।
কেন করবেন মেডিটেশন?
মনকে নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মানুষ তার মন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ধ্যানে বসে, মেডিটেশন করে। মন শান্ত থাকলে ভুল কম হয়, বিচার বিশ্লেষণ এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। সর্বোপরি প্রচণ্ড ধৈর্যশীল এবং সহিঞ্চু হওয়ার দক্ষতা অর্জন করা যায়। ফলশ্রুতিতে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, প্রতিবেশী ও সহকর্মীদের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে উঠে। তবে শুধু মনকে নিয়ন্ত্রণ করাই একমাত্র লক্ষ্য নয়। মনের সাথে স্বাস্থ্যও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মনকে নিয়ন্ত্রণ করা মানেই মনের প্রশান্তি। আর যখন আমাদের মন শান্ত থাকে তখন আমাদের শরীর প্রায় অনেকাংশেই সুস্থ থাকে। নানা রকম রোগশোক থেকে দূরে থাকা যায়।
একটি গবেষণা করা হয় এর উপর। যেখানে দুই দল ব্যক্তিবর্গের মধ্যে শুধুমাত্র একটি দলকে টানা ৮ সপ্তাহ মেডিটেশন করানো হয়। মেডিটেশন শেষ হলে তাদের সকলের শরীরে একটি ফ্লু রোগের ইনজেকশন দেওয়া হয়। যারা মেডিটেশন করেছিল, দেখা যায় যে তাদের প্রতিরক্ষা ক্ষমতা দ্রুত কাজ করতে শুরু করেছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, মেডিটেশনের ফলে তাদের বাম-মস্তিষ্কের কার্যক্রমে দ্রুততা আসে। তাই তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও বেশী কার্যকর হয়ে উঠে।
মেডিটেশন বিষণ্ণতা ও উদ্বেগের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। দুঃখজনক কোনো স্মৃতি যা মানুষকে প্রচণ্ড বেদনার মধ্যে রাখে এমন অনুভুতিগুলো সহ্য করার ক্ষমতা বাড়ায়। গবেষণায় দেখা যায়, যারা মেডিটেশন করেন তাদের ধকল গ্রহণের ক্ষমতা বেশি থাকে। গবেষণায় এটিও পাওয়া যায় যে, যারা নিয়মিত মেডিটেশন করে তাদের মস্তিষ্কের স্মৃতি সংরক্ষণ ও অনুভূতি নিয়ন্ত্রক অঞ্চলগুলো সদা কার্যকর থাকে। তারা খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং তাদের স্মৃতিশক্তিও প্রখর হয়।
শুধু মস্তিষ্ক নয়, শরীরের অন্যান্য অঙ্গের সাথেও মেডিটেশনের সম্পর্ক রয়েছে। মেডিটেশন মানুষের শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। অর্থাৎ আমরা কতটুকু অক্সিজেন গ্রহণ করছি তার উপর ভিত্তি করে শরীরে সঠিক পরিমাণ রক্ত সঞ্চালন ঘটায়। এছাড়াও আমেরিকার ‘হার্ট ফাউন্ডেশন’-এর মতে, মেডিটেশন শরীরের পীড়ন ও উদ্বিগ্নতা বাড়াতে দায়ী কিছু হরমোনকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
প্রতিদিন নানা রকম আবেগ, দুশ্চিন্তা আমাদেরকে চারপাশ থেকে ঘিরে রাখে। মেডিটেশনের মাধ্যমে এসব থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আমাদের দেশে আইবিএস রোগের অন্যতম লক্ষণ হলো টেনশন, যা সাধারণত মহিলাদের ক্ষেত্রে অধিক লক্ষণীয়। আইবিএস রোগের কারণে যে উদ্বিগ্নতা দেখা যায় তা প্রতিকারেও মেডিটেশন অনেক বেশি কার্যকরী।
কীভাবে করবেন মেডিটেশন?
ধরুন আপনি বান্দরবন কিংবা রাঙ্গামাটির কোনো নির্জন এলাকায় ঘুরছেন। শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে আপনার প্রতিটি মুহুর্ত কাটবে অত্যন্ত প্রশান্তিময়। মেডিটেশন আমাদের ঠিক তেমনই একটা প্রশান্তির অনুভূতি দেয়। চোখ বন্ধ করে ভাবুন কোনো এক অচেনা নির্জন জায়গার কথা। যেখনে কোনো কোলাহল, যানজট, ব্যস্ততা নেই। আছে শুধুই নীরবতা। তবে সবকিছু ভাবার আগে আপনার দরকার একটি সঠিক স্থান। নীরব কোনো স্থান খুঁজে নিন। এরপর বসে পড়ুন মেডিটেশনে। আরাম করে বসুন, কোনোরকম শারীরিক চাপ নিয়ে বসবেন না, শরীরকে নিজের মতো করে বসতে দিন। নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস শিথিল রাখুন, এখানেও কোনো বল প্রয়োগ নয়। আপনার স্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন বজায় রাখুন, বেশি উত্তেজিত হবেন না।
এবার কল্পনার সকল দুয়ার খুলে দিন। এমন কোনো স্থানে চলে যান যেখানে যেতে আপনার কখনোই খারাপ লাগে না। হতে পারে সেটা কোনো সমুদ্রের পাড়, হতে পারে পাহাড়, জঙ্গল কিংবা আপনার নিজের গ্রামের বাড়ি যেখানে আপনি সময় কাটাতে পছন্দ করেন। কাটিয়ে আসুন ১০ থেকে ১৫ মিনিট। কোনোরকম মানসিক চাপ মনকে নিতে দেবেন না এই কিছুক্ষণ। সম্পূর্ণ ভারহীন রাখুন নিজের মন। যত বেশি মনকে স্থির রাখতে পারবেন ততই মেডিটেশন কার্যকর হবে। এভাবে প্রতিদিন চালিয়ে যান। চেষ্টা করবেন প্রতিদিন একই সময়ে বসতে। এখানে একটি লক্ষণীয় ব্যাপার হলো আজ যতক্ষণ ধরে মেডিটেশন করলেন পরবর্তী দিন সেই সময়কালটি বাড়াতে পারেন কিংবা একই রাখতে পারেন, কিন্তু কখনোই কমাবেন না।
যেকোনো সময় করা যায় মেডিটেশন। তবে ধারণা করা হয় ভোর ৪টা আর বিকেল ৪টা মেডিটেশনের সবচেয়ে ভালো সময়। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, এ সময়ে সূর্য ও পৃথিবী ৬০ ডিগ্রী কোণে অবস্থান করে। এর ফলে বসার সঠিকতার শর্তে আমাদের পিটুইটারি ও পিনিয়াল গ্রন্থির অবস্থান মেডিটেশনের সর্বোচ্চ উপযোগিতা দেয়।
ক্ষতিকর দিক
মেডিটেশন কি সবসময় ইতিবাচক প্রভাব ফেলে? মেডিটেশনের যেমন উপকারী দিক আছে তেমনি এর ক্ষতিকর কিছু প্রভাবও রয়েছে। এর মাধ্যমে যেমন আসে মনের প্রশান্তি, আত্মবিশ্বাস আর দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচকতা তেমনি আবার এর ক্ষতিকর দিক ও রয়েছে। যেমন-
- ভুল পদ্ধতি অনুসরণ- অনেক ধরনের মেডিটেশনের বই পাওয়া যায় যেখানে বিভিন্ন প্রকার মেডিটেশন পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা থাকে এবং প্রত্যেকেই নিজেদের পদ্ধতিকে সঠিক বলে দাবী করে। সঠিকের মধ্যেও যেটা সঠিক তা বাছাই করে সে পদ্ধতি অনুসরন করতে হবে।
- ক্ষতিকর আবেগের সম্মুখীন- মেডিটেশন আমাদের মনকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যায় যেখানে আমরা কল্পনার স্বাধীনতা অর্জন করি। যেমন আপনি নিজেকে একটি সিংহ ভাবতে পারেন কিংবা আপনি পাখি ভেবে নিজেকে আকাশে উড়াতে পারেন। কিন্তু যা কিছু ঘটছে তার সবই আপনার কল্পনায়। এর বাস্তব কোনো রূপ নেই। এমন একটি পরিস্থিতিতে আপনার মনে যেসব ক্ষতিকর আবেগ রয়েছে সেগুলো জাগ্রত হতে পারে। যেমন আপনার ছোটবেলার কারো প্রতি দুর্বলতা কিংবা কোন কিছুর প্রতি ভয়।
- নিজেকে দুর্বল ভাবা- চারিদিকে আপনি যখন দেখবেন এবং শুনবেন সবাই মেডিটেশনের মাধ্যমে উপকার পাচ্ছে কিন্তু আপনি আপনার মনকে স্থির করতে পারছেন না তখন হিতে বিপরীত ঘটার সম্ভাবনা আছে। শুরুতেই আপনাকে একটা বিষয় মনে স্থির করতে হবে যে, মেডিটেশন সবার ক্ষেত্রে কার্যকর হয় না।
- ‘সাদা আলো’ দেখার প্রবল ইচ্ছা- এটা অনেকেই বলে থাকে যে মেডিটেশনের মাধ্যমে অন্য এক জগতে চলে যাওয়া যায়। মেডিটেশনে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে আপনি নিজেকে বিভিন্ন জায়গায় কল্পনা করত পারবেন। ‘সাদা আলো’ দেখার বিষয়টিও কারো কারো কথায় তার মেডিটেশনের একটি সফলতা। কিন্তু এ ধরনের কথাবার্তা মানুষকে আরো বেশি নিরাশ করে তোলে। মানুষ ভাবতে শুরু করে, তার হয়ত অন্য কোনো সমস্যা রয়েছে যা তাকে মেডিটেশন করতে বাঁধা দিচ্ছে। যার কারণে ‘সাদা আলো’র দেখা পাচ্ছে না। মনকে স্থির করতে গিয়ে মানুষ আরো বেশি অস্থির হয়ে ওঠে। উচ্চাকাঙ্খা দূর করতে হবে। মেডিটেশন একটি প্রাকৃতিক ব্যাপার। এটা কোনো ওষুধ নয় যা আপনি খেলেন আর সাথে সাথে রোগ ভালো হয়ে যাবে।
- সামাজিক যোগাযোগে অধোগমন- অতিরিক্ত মেডিটেশন আপনার চরিত্রে পরিবর্তন আনতে পারে যা পরবর্তীতে আপনার সামাজিক যোগাযোগে প্রভাব ফেলতে পারে।
- নিজেকে অতিপ্রাকৃতিক কিছু ভাববেন না- মেডিটেশনের মাধ্যমে আপনি হয়ত অতিপ্রাকৃতিক কোনোকিছু অনুভব করতে পারেন। তবে তাই বলে নিজেকে কখনোই তেমনটা ভাববেন না। মেডিটেশন মানুষের মস্তিষ্কে নানারকম অনুভুতির সংযোগ ঘটায় যা আপনার মনকে শান্ত করতে সহায়তা করে। কিন্তু তাই বলে তা বাস্তবে কখনো সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে মেডিটেশনে যা কিছু ঘটে তার সবকিছুই কল্পনায় ঘটে, বাস্তবে নয়। সাদা আলো দেখা কিংবা শূন্যে ভাসার মতো অভিজ্ঞতাগুলো সব আপনার মস্তিষ্কের ভেতর ঘটে। আজপর্যন্ত কেউ সত্যিকার অর্থেই মেডিটেশন করে শূন্যে ভাসতে পারেনি, তাই নিজেকে কোনো অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতার অধিকারী ভাবাটা বোকামি হবে।
মেডিটেশনের সময় মন প্রায়ই এদিক সেদিক চলে যায়। মেডিটেশন চর্চাকারীকে সতর্ক থাকতে হয় যেন তার মেডিটেশন নিরবচ্ছিন্ন হয় এবং বার বার মনকে মেডিটেশনের মধ্যে ফিরিয়ে আনতে হবে। অনুশীলনের শুরুর দিকে মনোযোগের সাথে চর্চার চেষ্টা করলে এবং বার বার অনুশীলন করলে এটাকে আয়ত্তে আনা যায়। আপনি যখন একবার মনকে স্থির রাখার প্রক্রিয়া নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আসবেন তখন মেডিটেশন এর বাইরে অন্যান্য সময়েও মনকে বিক্ষিপ্ত চিন্তা ভাবনা থেকে দূরে রাখার দক্ষতা অর্জিত হবে।
ফিচার ইমেজ- gaiam.com