নতুন বছর শুরু হলো এই ক’দিন হলো মাত্র, এই বছরে কী কী করা হবে তার তালিকা তৈরি হয়তো এখনো চলছে, যার মধ্যে আছে নিশ্চয়ই ভ্রমণের তালিকা, কেনাকাটা আবার কারো ক্ষেত্রে হয়তো বা সেমিস্টারের সিজিপিএ’র অংকটা বাড়িয়ে তোলার ইচ্ছাও রয়েছে। এসব কিছুর পাশাপাশি আরেকটি জরুরি ব্যাপারও আপনার তালিকায় জায়গা দিন, আর সেটা হলো অর্থকড়ির সঠিক ব্যবস্থাপনা। না, এখানে শুধু টাকা জমানোর কথা বলা হচ্ছে না। টাকা জমানোটা এখানে ছোট্ট একটি অংশ মাত্র। আমাদের আজকের বিষয় আর্থিক ব্যবস্থাপনা। কীভাবে ২০১৮ সালের পুরো সময়টা জুড়ে একটা ভালো এবং পরিকল্পিত আর্থিক ব্যবস্থাপনা আপনাকে বছর শেষে একটা ভালো অবস্থান গড়ে দেবে।
সঞ্চয়ের অভ্যাস
শুরুটা সঞ্চয়ের কথা দিয়েই হোক। এক্ষেত্রে ওয়ারেন বাফেটের একটি উপদেশের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ওয়ারেন বাফেটের মতে, ব্যয় করার পর অবশিষ্ট টাকা সঞ্চয় না করে, ব্যয়ের আগেই নির্দিষ্ট একটি অংশ জমানোর জন্যে রেখে বাকিটা থেকে খরচ করুন। এটা করার জন্যে একটি সেভিংস একাউন্ট খুলতে পারেন যেটাতে মাসিক বেতনের একটি নির্ধারিত অংশ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই জমা হতে থাকবে। তা হতে পারে আপনার আপদকালীন, বাড়ি তৈরী বা ভ্রমণের তহবিল। এতে টাকা জমা হওয়ার পর অবশিষ্ট অর্থে জীবন যাপন করতে আপনি অভ্যস্ত হয়ে যাবেন এবং সমান্তরালভাবে আপনার একটি তহবিলও গড়ে উঠবে।
খরচের সঠিক পরিকল্পনা তৈরী করুন
২০১৭ সালে, উইলস টাওয়ার ওয়াটসন নামক এক আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠন এক গবেষণায় দেখায় যে, সারা বিশ্বে মাত্র ৩৫% মানুষ যথাযথ ও নিয়ন্ত্রিতভাবে বাজেট তৈরী করে খরচ করেন। আর ৪৪% মানুষই খরচের ব্যাপারে কোনো বাজেট বা পরিকল্পনার ধার ধারে না, অর্থাৎ খাঁটি বাংলা প্রবাদের সাথে মিলিয়ে বলা যায় ‘মাস আনে মাস খায়’। ফলে এদের দেনা এবং আর্থিক চাপে থাকতে হয়।
টাকা কোথায় কোথায় খরচ হবে তার একটা সঠিক পরিকল্পনা করা এবং সেটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে চললে আপনার মিলবে মানসিক প্রশান্তি। পরিকল্পনার আগে যেটা করতে পারেন তা হলো এক মাসে কোথায় কোথায় কত খরচ হচ্ছে তার একটি বিস্তারিত তালিকা তৈরী করা, পর্যবেক্ষণ করা যে টাকা কোথায় যাচ্ছে। এরপরে সেখান থেকে বের করা যে কোন কোন খরচ আদৌ দরকারি কিছু নয় বা চাইলে কমিয়ে আনা সম্ভব। এভাবে প্রয়োজনীয় খরচ চিহ্নিত করে নেয়ার পর বাড়ি ভাড়া, বাজার সদাই, যাতায়াত খরচ ইত্যাদি খাতে কত টাকা লাগে সে অনুযায়ী বাজেট তৈরী করে নিয়ে খরচ করুন।
খরচে লাগাম টানুন
গ্যলআপ নিউজের করা এক জরিপে দেখা গেছে, একজন আমেরিকান প্রতিদিন গড়ে ১০০ ডলার খরচ করেন, অনেকটা হিসাব ছাড়াই। সেগুলো হয় যাতায়াতে, চা কফি পানে বা নাস্তা খেতে। আপাতদৃষ্টিতে দরকারী মনে হলেও দেখা যায় যে, চা কফি কাজের ফাঁকে একাধিক বার পান করা, প্রয়োজন ছাড়াই নাস্তা করায় দরকারের থেকে বেশি টাকা খরচ হয়। এ ধরনের অভ্যাসের থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করতে পারেন এক অভিনব পন্থায়। সেটা হলো ‘No spend day’ অর্থাৎ খরচবিহীন দিবস। সপ্তাহের কোনো একদিন কোনো অপ্রয়োজনীয় খরচ করবেন না এই মর্মে প্রতিজ্ঞা করে নিজেকে বাধ্য করতে পারেন। এতে আপনার মধ্যে অপ্রয়োজনীয় খরচের অভ্যাস ত্যাগের মানসিকতা গড়ে উঠবে ধীরে ধীরে।
অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রকে টাকায় রূপান্তর করুন
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে আমরা নানা জিনিসপত্র কিনে ঘর ভরিয়ে ফেলি মাঝে মধ্যে শুধু এই চিন্তা থেকে যে ‘যদি কাজে লাগে’। শুধু এই কারণেই আমাদের বাসায় জমা হয় দরকারের থেকেও বেশী আসবাবপত্র, বাসন-কোসন, গৃহস্থালি নানা দ্রব্যাদি। দরকারের থেকে অতিরিক্ত জিনিসপত্র অনলাইন বেচাকেনার সাইটে (যেমন বিক্রয়.কম) বিক্রি করে জঞ্জাল বিদায় করতে পারেন। অবশ্য এটি কোনো সহজ কাজ নয়। জাপানের ‘মিনিমালিজম’ জীবনধারা অনুযায়ী সারা বিশ্বের অনেকেই এখন এই পথে এগোচ্ছে, যা দরকারি শুধু সেগুলোই রাখা।
বিনিয়োগে সতর্ক হোন
আবারও বিনিয়োগ গুরু ওয়ারেন বাফেটের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে এই ব্যাপারে। একটি আয়ের উপর নির্ভরশীল না থেকে আয়ের একাধিক উৎস দরকার, আর সেজন্য অনেকেই নানা দিকে বিনিয়োগ করে থাকেন (যেমন শেয়ার বাজার, নানা রকম ব্যবসা)। এ ধরনের বিনিয়োগে সতর্ক থাকুন, বিনিয়োগে বেশী মাত্রায় রক্ষণশীল হলে যেমন আয় বেশি হবে না, তেমনি বেপরোয়া হলে সবই হারানোর ঝুঁকি থাকে। নিশ্চিত হোন যে, আপনি সঠিক মাত্রায় ঝুঁকি নিচ্ছেন।
খাবার খরচ গুছিয়ে আনুন
রাস্তায় খাবারের দোকানগুলোতে ভিড়ে বোঝা যায় প্রতিদিন বিশাল সংখ্যক মানুষ বাইরেই নাস্তা বা দুপুরের খাবারের কোনো না কোনোটা সারে। প্রতিনিয়ত খাবারদাবারের দোকান আর রেস্তোরাঁর সংখ্যা বৃদ্ধি থেকেও আন্দাজ করা যায় মানুষের বাইরে খাওয়া দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। সমস্যা হলো বাইরের খাবার খাওয়া যে শুধু স্বাস্থ্যহানির কারণ তা-ই নয়, সেটা আপনার মানিব্যাগের জন্যেও খারাপ। খরচ বৃদ্ধির একটা অন্যতম কারণ হলো প্রায়ই বাইরে খাওয়া দাওয়া করা। তাই মাসে ক’বার বাইরের রেঁস্তোরায় খাওয়া হবে তা আগে ঠিক করে নিন, এটা নিয়ন্ত্রণে থাকলে এমনিতেই খরচ কমে আসবে।
বাসার বাজার সদাইয়ের ব্যাপারেও কৌশলী হতে পারেন। অনেক সময় শহরের বাইরের দিকের বাজারে সস্তায় এবং টাটকা মাছ, মাংস ও সবজি পাওয়া যায়। এসব জায়গা থেকে বাজার করলে আপনার খরচের খাতায় কমে আসবে টাকার অংকটা।
ভ্রমণে কৌশলী হোন
প্রতি বছর নানা পরিকল্পনার মধ্যে বড় একটা অংশ জুড়ে থাকে ভ্রমণ পরিকল্পনা। আর ভ্রমণ মানেই বড় অঙ্কের টাকা খরচ। তাই ভ্রমণ করার আগে ভালোভাবে কৌশল ঠিক করে নেয়া ও খোঁজ খবর নেয়া জরুরি। তা না হলে হয়তো একটি হোটেলে তাড়াহুড়া করে উঠলেন, খোঁজ নিলে জানতে পারতেন হয়তো একই মানের হোটেল আরো কম দামে পেতেন। এছাড়াও এক জায়গায় যেতে যাতায়াত ব্যবস্থায় বাস বা ট্রেন কোনটায় কত খরচ, কতজন এক সাথে গেলে যাতায়াত ও হোটেল খরচ ভাগাভাগি করা যাবে, বছরের কোন সময় গেলে কম খরচে ভ্রমণ সম্ভব ইত্যাদি আগে থেকে খোঁজ নিয়ে গেলে অনেক সাশ্রয়ীভাবে ভ্রমণটা সারতে পারবেন। খুব বেশি সমস্যা না হলে কিছু কিছু জায়গা অফসিজনে ঘুরে এসেও অর্থের সাশ্রয় করতে পারেন।
ভিন্নধর্মী বিনোদনে আনন্দ খুঁজে নিন
নাগরিক ব্যস্ততায় হাঁপিয়ে উঠে বিনোদনের মাধ্যমেই অবসাদ দূর করতে হয়। আর সেজন্যই দরকার বিনোদন। কিন্তু একাজে সবাই এখন ব্যয়বহুল কোনো রেস্তোরাঁয় গিয়ে সময় কাটাতে হাজির হন। কিন্তু এর বদলে যেতে পারেন বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক কনসার্টগুলোতে, যেখানে থাকে না কোনো প্রবেশমূল্য। কিংবা আউটডোর কোনো কাজে খুঁজে নিতে পারেন বিনোদন। যেমন হাইকিং বা বাইসাইক্লিং- বন্ধু বান্ধবের সাথে বেরিয়ে পড়ুন আশপাশের কোনো অজানা দিকে অথবা খেলাধুলা শুরু করুন। এতে সময়টাও যেমন আনন্দে কাটবে তেমন শরীর স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে। এভাবে বছরের শুরুতেই সঠিক পরিকল্পনা করে নিয়ে নিজেকে আর্থিকভাবে করে তুলুন স্বাবলম্বী।
ফিচার ছবি- business2community