আমরা কেউই জীবনে ব্যর্থ হতে চাই না। চাই সফল মানুষদের মতো নিজেদের জীবন পরিচালিত করতে। এজন্য তাদের অনেক কিছুই আমরা অনুসরণ করতে চাই। তাদের জীবন থেকে অনুপ্রেরণা পেতে চাই। তাদের কেউ হয়তো অনেক খারাপ অবস্থা থেকে অনেক ভালো অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছেন। এসব দেখে আমরা অনুপ্রাণিত হই। চাই তাদের মতো পরিশ্রম করতে। কিন্তু সফল হতে গেলে নিজের চেষ্টাই কি সব?
তাদের জীবনের দিকে ভালোভাবে তাকালে বোঝা যায়, নিজের চাওয়া আর চেষ্টাই সব না। সফলতার পেছনে নিজের পরিশ্রমের পাশাপাশি আরো অনেক বিষয় নির্ভর করে, যেগুলোর উপর আপনার-আমার নিয়ন্ত্রণ নেই! আপনি কোন পরিবেশে বড় হয়েছেন, কোন শহরে বড় হয়েছেন, কেমন পরিবারে জন্ম নিয়েছেন ইত্যাদি নানা বিষয়ের উপরেও আপনার সফলতা নির্ভর করে। সফলদের জীবনী দেখে তাদের মতো হওয়ার আগে একবার ভাবুন, তারা যে সুযোগ আর ভাগ্যের সহায়তা পেয়েছিলেন, সেটা আপনার আছে তো?
বিল গেটস প্রায় ৯৪ বিলিয়ন ডলার নিয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তি। গত বছর আমাজনএর সিইও জেফ বেজোস তাকে টপকে যাওয়ার আগে দীর্ঘদিন তিনিই ছিলেন বিশ্বের শীর্ষ ধনী। যে কারণে ধনী ব্যক্তিদের প্রসঙ্গ উঠলে সবাই বিল গেটসের নামই নেন সবার আগে। তিনি বিশ্বের অন্যতম বড় সফটওয়্যার কোম্পানি মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড্রপ আউট ছিলেন। আজকের অবস্থানে আসার পেছনে তার মেধা-যোগ্যতা যতটা কাজ করেছে, সেগুলোর পাশাপাশি তার পেছনে বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে তার পাওয়া অনেক বড় সুযোগও। সেই সুযোগগুলো কী ছিল সেগুলো একটু বিশ্লেষণ করা যাক।
বিল গেটস বড় হয়েছেন ওয়াশিংটনের সিয়াটলে। তার বাবা ছিলেন সিয়াটলের একজন ধনী উকিল, আর মা ছিলেন একজন ধনী ব্যাংকারের মেয়ে। অর্থাৎ বিল গেটস আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন পারিবারিকভাবেই ধনী। তিনি যখন সপ্তম গ্রেডে ওঠেন, তখন লেকসাইড প্রাইভেট স্কুলে ভর্তি হন, যেখানে অভিজাত শ্রেণীর ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করতো। আর এই স্কুলই তার জীবন বদলে দেয়।
লেকসাইডে ‘মাদার্স ক্লাব’ নামে একটি সংগঠন ছিল, যেটা থেকে বাচ্চাদের মায়েরা স্কুলকে মোটা অংকের ডোনেশন দিত, যা স্কুলের বিভিন্ন উন্নয়নের কাজে লাগানো হতো। এমনই এক উদ্যোগে লেকসাইড স্কুলে কম্পিউটার ক্লাব চালু হয়। বিল গেটস তখন অষ্টম গ্রেডের শিক্ষার্থী। কম্পিউটার ক্লাবের কথা এখন শুনতে যতটা সহজ মনে হয়, তখন তা ছিল না। তখন ছিল ১৯৬৮ সাল। কম্পিউটারই তখন সহজলভ্য ছিল না। বেশিরভাগ স্কুল-কলেজেই কম্পিউটার ক্লাব ছিল না। তাছাড়া তখন প্রোগ্রামিংয়ের ভাষাও আজকের তুলনায় অনেক জটিল ছিল। কিন্তু লেকসাইডের শিক্ষার্থীদের জন্য তুলনামূলক সহজ প্রোগ্রামিং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। তখন থেকে বিল গেটস কম্পিউটার নিয়েই থাকতেন সারাক্ষণ। কম্পিউটার ক্লাবে বন্ধুদের সাথে প্রোগ্রামিং শিখতে থাকেন তখন থেকেই।
তখন ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির প্রোগ্রামাররা ‘কম্পিউটার সেন্টার কর্পোরেশন’ বা ‘সি কিউবড’ নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এর একজন প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন লেকসাইড স্কুলের একজন ছাত্রের বাবা। সি কিউবড তখন তাদের সফটওয়্যারগুলো লেকসাইডের কম্পিউটার ক্লাবে পরীক্ষা করে দেখতো, আর বিনিময়ে লেকসাইডের ছাত্রদের ফ্রি প্রোগ্রামিং করতে দিতো। তখন স্কুল শেষে গেটস চলে যেতেন সি কিউবডের অফিসে, আর সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রোগ্রামিং করতেন।
একসময় সি কিউবড বন্ধ হয়ে গেলে বিল গেটসের কোডিং করাও বন্ধ হয়ে যায়। তখন বন্ধুদের সাথে একদিন ‘ইনফরমেশন সায়েন্স ইঙ্ক’ বা ‘আইএসআই’ নামে একটি কোম্পানির খোঁজ পান। এই কোম্পানি তাদেরকে ফ্রিতে কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ দেয়। বিনিময়ে তাদেরকে কোম্পানির একটি সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করে দিতে হয়। এরপর একদিন তার বন্ধু, মাইক্রোসফটের আরেক সহ-প্রতিষ্ঠাতা পল অ্যালেন একটি কম্পিউটারের খোঁজ এনে দেন। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির মেডিকেল সেন্টার আর ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের কম্পিউটার রাত ৩টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত অব্যবহৃত থাকতো। তারা এই সময়টা কাজে লাগান। রাতের বেলা লুকিয়ে লুকিয়ে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার চালাতেন। এজন্য মজা করে তিনি এখনও ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিকে কৃতজ্ঞতা জানান।
একসময় আইএসআই-এর একজন প্রতিষ্ঠাতা বাড পেমব্রোকের কাছে ‘টিআরডব্লিউ’ নামে আরেকটি কোম্পানি একটি পাওয়ার স্টেশন কম্পিউটারাইজড করার কাজের জন্য প্রোগ্রামারের খোঁজ করে। তখন প্রোগ্রামারের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। পেমব্রোক তখন লেকসাইড স্কুলের বিল গেটস আর তার বন্ধুদের কথা বলেন। গেটস তখন তার শিক্ষকদের কাছ থেকে কোডিং করার জন্য ছুটি নিয়ে নেন।
উপরের ঘটনাগুলো দেখলে বোঝা যায়, তিনি অনেক সুযোগ সুবিধা আর ভাগ্যের ছোঁয়া পেয়েছিলেন, যা সমসাময়িক অনেকেই পাননি। কী কী সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি?
- তিনি ধনী পরিবারে জন্মেছেন, যে কারণে লেকসাইড স্কুলে পড়তে পেরেছেন। আর লেকসাইডে পড়ার কারণে কম্পিউটার ক্লাব ব্যবহারের সুযোগ পান।
- কম্পিউটার ছিল ষাটের দশকের দুর্লভ জিনিস। কিন্তু তিনি তা ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছিলেন, তা-ও মাত্র অষ্টম গ্রেডে পড়ার সময়।
- লেকসাইড স্কুলের মায়েদের ছিল প্রচুর টাকা-পয়সা। যে কারণে তারা মাদার্স ক্লাবের মাধ্যমে কম্পিউটার ক্লাব তৈরি করতে পেরেছিলেন।
- সি কিউবডের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন স্কুলের একজন ছাত্রের অভিভাবক। যে কারণে তিনি অনেক সুযোগ পেয়েছেন।
- ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি ছিল তার বাড়ি থেকে হাঁটার দূরত্বে। যে কারণে সহজেই তিনি সেখানে চলে যেতে পারতেন।
- ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার ৩ ঘন্টা খালি পড়ে থাকতো।
- আইএসআই-এর সাথে পরিচিত হওয়া। সেখান থেকে টিআরডব্লিউ কোম্পানিতে সুযোগ পাওয়া।
- লেকসাইড স্কুল তাকে কোডিং করার পর্যাপ্ত সুযোগ দিয়েছিল।
ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিল গেটস সময়ের তুলনায় অনেক সুযোগ পেয়েছেন। স্কুলে থাকাকালীন সময় থেকেই কোডিংয়ে দক্ষ হয়ে যান। কারণ, খেয়াল করলে দেখবেন, প্রতিটি সুযোগেই তিনি বেশি বেশি কোডিং করার প্র্যাক্টিস করতে পেরেছেন। আর ‘প্র্যাক্টিস মেকস এ ম্যান পারফেক্ট’ এ কথা তো সবারই জানা।
এত কম বয়সে সেসব সুযোগ সবাই পাননি তখন। এসবই তাকে আজকের পথে আসতে সাহায্য করে। তিনি মাইক্রোসফটের জন্য হার্ভার্ড ছেড়ে আসার ঝুঁকি নিতে পেরেছিলেন, কারণ তার পেছনে ছিল বাবা-মায়ের আর্থিক নিরাপত্তা। এছাড়া তার জন্মের সময়টাও গুরুত্বপূর্ণ। দেখা গেছে, যারা ১৯৫২-৫৮ এই ৬ বছরের মধ্যে জন্মেছেন, প্রযুক্তি খাতে তারাই বড় কিছু করতে পেরেছেন। বিল গেটস জন্মেছিলেন ১৯৫৫ সালে। সমসাময়িক স্টিভ জবস, পল অ্যালেন, এরিক স্মিট, বিল জয় সবাই এই সময়েই জন্মেছিলেন। কারণ ১৯৭৫ এর দিকে যখন কম্পিউটার বিপ্লব শুরু হয়, তারা সবাই তরুণ, কলেজ পড়ুয়া ছিলেন। কেউ খুব ছোটও ছিলেন না, আবার চাকরি ও বিয়ে করে সংসারীও হননি। তাই তারা কোম্পানি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিলেন।
তাই দেখা যাচ্ছে, সফল হওয়ার জন্য শুধু নিজের চেষ্টা আর ইচ্ছাই যথেষ্ট নয়। আপনার পারিপার্শ্বিকতা কেমন সেটাও অনেক বড় নিয়ন্ত্রক।বিল গেটসের মতো হওয়ার আগে ভাবুন, তিনি যেরকম সুযোগ পেয়েছিলেন, সেগুলো আপনার আছে তো? তার আজকের অবস্থানে আসার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান লেকসাইড স্কুলের। তার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া লেকসাইড স্কুল বলে তিনি স্বীকার করেন। আপনি কি আপনার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সেরকম সুবিধা পাচ্ছেন বা পেলেও তা কাজে লাগাচ্ছেন? ড্রপ আউট হওয়ার আগে দেখুন, আপনার আর্থিক ভিত শক্তিশালী আছে তো?
সবকিছু ঠিকভাবে মেলাতে পারলেই বুঝবেন, সম্ভাবনা আছে। কিন্তু তা-ই বলে কি ভাগ্যই সব? না তা অবশ্যই নয়। বিল গেটসের মতো তার সহপাঠীরাও সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু তারা কি তার মতো হতে পেরেছেন? অবশ্যই না। সুযোগগুলো কাজে লাগাতে হবে। তাই আপনার সামনে যেভাবে সুযোগগুলো আসছে, সেগুলো কতটা কাজে লাগাতে পারবেন সেটা বিবেচনা করুন।