আর্জেন্টিনা, দুবারের বিশ্বকাপজয়ী অন্যতম পরাশক্তি এবং পেশাদার ফুটবল দল। সম্প্রতি বিশ্বকাপের গ্রুপপর্বের আসরে তারা ক্রোয়েশিয়ান ফুটবল দলের কাছে নাস্তানাবুদই হয়েছে। গোলকিপারের মারাত্মক ভুলে প্রথম গোল হজম করার পরে অনেকটাই ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে দলটির খেলা। একের পর এক ভুল করতেই থাকে। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে পুরো দলটি। তবে শুধু আর্জেন্টিনাই নয়, বিশ্ব আসরে অনেক তারকাখচিত দল নিয়মিত ধরাশায়ী হয় প্রতিপক্ষ দলগুলোর কাছে। খেলোয়াড়দের শক্তিমত্তা ছাড়াও খেলাধুলায় জয়-পরাজয়ের পেছনে অন্যতম যে বিষয়টি কাজ করে সেটি হলো বডি ল্যাংগুয়েজ বা শরীরী ভাষা। খেলা চলাকালীন সময়ে প্রতিপক্ষ যখন ঠিক আপনার ঘাড়ের উপর নিশ্বাস ফেলছে, তৈরি হয়েছে সাময়িক পরাজয়ের আবহ, এই পরিস্থিতিতে শরীরী ভাষা দিয়ে যে দল যত ভালোভাবে মোকাবেলা করতে পারবে সেই দল জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
খেলার মাঠে নামার পর থেকেই প্রতিপক্ষের কিংবা নিজ দলের খেলোয়াড়দের সাথে মুখের ভাষায় যতটা না কথা হয় তার চেয়ে অনেক বেশি কথা হয় এই শরীরী ভাষায়। একজন খেলোয়াড় কিংবা একটি দলের শরীরী ভাষাতেই প্রতিপক্ষ দল মানসিক অবস্থার ব্যাপারে টের পেয়ে যায়। সাধারণ অবস্থাতেই মনের ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে শব্দের ভূমিকা প্রায় ৭ শতাংশ। ‘নন ভার্বাল কমিউনেকশন’ বা ‘শব্দহীন যোগাযোগ’ দখল করে আছে সেখানে প্রায় ৯৩ শতাংশ।
আর শব্দহীন যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ আমাদের শরীরী ভাষা। ৫৫ শতাংশের বেশি জায়গা দখল করে আছে এই ভাষা। আর প্রতিযোগিতা কিংবা খেলার মাঠে এই শরীরী ভাষার ভূমিকা আরো বেশি। আর্জেন্টিনা-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচের দিকে তাকালেই দেখা যাবে শুরু থেকেই আর্জেন্টাইন অধিনায়ক ছিলেন মনমরা। জাতীয় সংগীত চলার সময় হাত দিয়ে কপাল ঘষবার সময়ও ধরা পড়েন ক্যামেরায়। পুরো ম্যাচেই তার শরীরী ভাষা ছিলো অনেকটাই ম্রিয়মাণ। বলা বাহুল্য, অধিনায়কের এই শরীরী ভাষার দুর্বলতা বাকিদের উপরেও ছড়িয়ে পড়েছে।
চাপে ভেঙে পড়লে প্রতিপক্ষের সামনে নিজেকে আত্মসমর্পণ করতে হয়। এই কথা শুধু ফুটবলে নয়, যেকোনো খেলাতেই প্রযোজ্য। টেনিসের অন্যতম তারকা খেলোয়াড় রাফায়েল নাদালের মতেও শরীরী ভাষাই মাঠে সামর্থ্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। ক্যারিয়ারের ষোলতম গ্র্যান্ডস্লাম জয়ের ব্যাপার নিয়ে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে নাদাল বলেছিলেন,
“আমি কোর্টে মোটেই শান্ত থাকতে পারছিলাম না, আমি ভীষণভাবে আতংকিত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু ঐ মুহুর্তে আমার যা করার ছিলো তা হলো আমার নিজেকে ধরে রাখা। আমার শরীরী ভাষাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। আমি চেষ্টা করছিলাম যাতে কোনোভাবেই শারীরিক আচরণের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের কাছে আমার আতংক প্রকাশ না পেয়ে যায়। আমি নিজের সাথে কথা বলছিলাম, নিজেকে প্রতিটি চলাফেরাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিলাম। আর শুধু ঐ ম্যাচেই না সারাজীবন ধরেই একজন পেশাদার হিসেবে এই একটি জিনিস আমি চেষ্টা করে আসছি।”
তাই প্রতিযোগিতা চলাকালীন সময়ে নিজের সাথে কথা বলা জরুরি। নিজেকে সাময়িক হারের আবহ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও এটি বেশ কাজে দেয়। দলগতভাবে পরিচালিত খেলাগুলোতে শুধু নিজের মধ্যেই নয়, দলের বাকি সবার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা জরুরি। এতে মানসিকভাবে দৃঢ় থাকা যায়। দলের কেউ একজন কোনো একটি ভুল করে বসলে বাকিদের কাছে থেকে সান্ত্বনাসূচক বাণী খুবই জরুরি। আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারটিকে কাজের মনে না হলেও গবেষকদের দৃষ্টিতে এতে ঐ ব্যক্তির একই ধরনের ভুল করার হার অনেক কমে আসে।
শরীরী ভাষায় আপনাকে প্রতিপক্ষ শিবিরের সামনে নিজেকে প্রতিমুহূর্তে জয়ীর মতোই আচরণ করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিযোগিতা চলাকালীন সময়ে জয়ীর মতো আচরণ করায় নিজেকে যেমন উজ্জীবিত বোধ হয়, ঠিক তেমনি প্রতিপক্ষের কাছেও আপনার শক্তিমত্তা সম্পর্কে একটি পরিষ্কার বার্তা পৌঁছে যায়। তাই ক্রিকেট, ফুটবল কিংবা অন্য যেকোনো খেলায় ছোট-বড় যেকোনো অর্জনকে উদযাপন করা অনেক জরুরী। এতে একদিকে দল যেমন চাঙা থাকে, অন্যদিকে দলের ইতিবাচক শরীরী ভাষার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো যায়।
আমাদের দেহ এবং মস্তিষ্ক খুব সুচারুভাবে সংযুক্ত। আমাদের মন খারাপ হয়ে গেলে কিংবা আমরা হতাশ বোধ করলে আমাদের অজান্তেই মস্তিষ্ক সেই ব্যাপারটি দেহের বিভিন্ন অংশে পাঠিয়ে দেয়। ফলে আমাদের হতাশা কিংবা রাগের সাথে সাথে দেহের ভাষা পরিবর্তিত হয়ে যায়। তাই প্রতিযোগিতার মঞ্চে নিজেকে ধরে রাখতে হলে নিজের শরীরী ভাষাকে ঠিক রাখা জরুরি। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় উঠে এসেছে ঠিক বিপরীত উপায়ে ইতিবাচক শরীরী ভাষাকে নিজের আয়ত্ত্বে আনার মাধ্যমে নিজের মানসিক দুর্বলতাও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এই ইতিবাচক শরীরী ভাষার ধরণ ব্যক্তি, দল কিংবা নারী-পুরুষের জন্য আলাদা হতে পারে। তবে কিছু ভাষা সবার মধ্যেই বিদ্যমান।
রেসলিং, টেনিস কিংবা ফুটবল যেকোনো খেলাতেই দেখা যায় বিজয়ী তার হাত আকাশের দিকে তুলে উদযাপন করে থাকেন। নারী কিংবা পুরুষ, যে সংস্কৃতিরই ধারক-বাহক হোক না কেন, এই ব্যাপারটি কম-বেশি সবার মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়।
এমনকি জন্মগতভাবে দৃষ্টিশক্তিহীন খেলোয়াড়দের মধ্যেও ব্যাপারটি সাধারণ। গবেষকদের দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর জানা গেছে এই ব্যাপারটি আমাদের প্রভাব বিস্তার এবং তা প্রদর্শনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জয়ীদের অনেককেই দেখা যায় একহাত তুলে কিংবা হাত মুষ্ঠিবদ্ধ অবস্থায় প্রতিপক্ষের দিকে তাকিয়ে গর্জন করেন। এটিও ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশে সাহায্য করে। এতে প্রতিপক্ষের অবচেতন মনে সাময়িক ভীতির সঞ্চার হয়।
ঠিক বিপরীতভাবে প্রতিযোগিতা চলাকালীন সময়ে হাত গুটিয়ে নিলে, ঘাড়ে, মাথায় কিংবা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে পড়লে সেটি প্রতিপক্ষের কাছে দুর্বলতার বার্তা পৌঁছে দেয়।
প্রতিপক্ষের দিকে চোখের দিকে সরাসরি তাকাতে না পারা, আকাশের দিকে কিংবা খেলার মাঠের বাইরে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকাও একটি দলের হতাশা আর রণকৌশলের দুর্বলতা প্রকাশ করে দেয়। তাই প্রতিপক্ষের চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে থাকতে পারাও আত্মবিশ্বাসের পালে একটু হাওয়া দেয়।
খ্যাতিমান গবেষক ‘এমি কাডি’র ২০১০ সালের এক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে শরীরী ভাষা দিয়েও দেহের জৈবরাসায়নিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। প্রতিযোগিতা চলাকালীন সময়ে কিংবা মানসিক চাপে ভেঙ্গে পড়ার বিজয়ীর মতো আচরণ করে উত্তেজনাকে কমিয়ে আনা সম্ভব। মূলত উত্তেজিত অবস্থায় টেস্টোস্টেরন আর কর্টিসলের সাম্যাবস্থা নষ্ট হয়।
প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সাথে সাথেই টেস্টোস্টেরনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে শুরু করে। এটি আমাদের ক্ষমতা আর প্রভাব বিস্তারে সহায়তা করে। তবে একইসাথে ‘স্ট্রেস হরমোন’ নামে পরিচিত কর্টিসলের পরিমাণ বেড়ে গেলে আমাদের মধ্যে সঞ্চার হয় হতাশা আর নেতিবাচকতা। সাময়িকভাবে হারের আবহ কিংবা প্রতিকূল পরিবেশের সাথে পাল্লা দিয়ে কর্টিসল আমাদের শরীরী ভাষাকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতে পারে। যেমনটা দেখা যায় ফুটবল ম্যাচের শেষের দিকে একটি গোল হজম করলে অনেক দল লড়াই করে ম্যাচে ফিরে আসা দূরে থাকুক, বরং আরো দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই প্রতিযোগিতা জুড়ে ধরে রাখতে হবে বিজয়ীর শরীরী ভাষা, নিজের সাথে কথা বলা, প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে যে দল লড়াই করতে পারে সেই দলের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ততই বেড়ে যায়।
Feature image source: ted.com