আজ আমাদের আলোচনা শুরু করবো এক মেয়ের গল্প দিয়ে, একটু মনে করে দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা। ১৩ বছর বয়সী কিশোরী, অন্বেষা। ফেসবুক, টুইটার, স্ন্যাপচ্যাট, ইন্সটাগ্রাম কোনটিই যেন বাদ নেই তার স্মার্টফোনে। তার অধিকাংশ সময় কাটে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই। লাইক, রিয়েকশন, সেলফি, মেসেজিং- এসব নিয়ে তার দিনের অধিকাংশ সময়ই কেটে যায়।
বাসার খাবার টেবিলে, এমনকি বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গেলেও কথা বলার চেয়ে ফোন নিয়ে অন্বেষার ব্যস্ততার যেন শেষ নেই। কি, চিনতে পেরেছেন? আপনার আশপাশে হয়তো এমন অনেক অন্বেষাকেই আপনি চেনেন, যারা মোবাইল ফোন আসক্তিতে ভুগছেন। কিন্তু তাদের সামাজিক হবার চেষ্টা কখন যে আসক্তিতে পরিণত হয়েছে তা নিজেরাই বুঝতে পারেননি।
বর্তমান যুগকে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যুগ বলে আখ্যায়িত করা হয়। তবে প্রযুক্তির যে সকল উপাদান রয়েছে তার মধ্য থেকে এমন একটি যদি বাছাই করতে হয়, যা আমাদের জীবনে অনেক বিশাল স্থান দখল করে নিয়েছে, তাহলে সেই স্থান নিঃসন্দেহে দিতে হয় স্মার্টফোনকে। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিটি (বিটিআরসি) এর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে এখন ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকার আছে প্রায় ৮ কোটি লোকের।
ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর প্রতি ৩ জনে একজন শিশু এবং প্রতি ৮ সেকেন্ডে নতুন কেউ এই সুবিধা ভোগ করছে। স্মার্টফোন খুবই কার্যকরী একটি গ্যাজেট। আমাদের যোগাযোগ মাধ্যম সহজ করে দিলেও মানুষ স্মার্টফোনের প্রতি অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।
নটিংহ্যাম ট্রেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর মার্ক গ্রিফিথস মতামত ব্যক্ত করেন,
অধিকাংশ মানুষ স্বভাবজাতভাবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন, কিন্তু একে আমি আসক্তি বলবো না। আপনার প্রিয় কোনো জিনিস সবসময় সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়ালেন, তার মানে এই নয় যে, আপনি আসক্ত।
এর ব্যাখ্যা এভাবেও দেওয়া যায়। ধরুন, আপনার হাতে ঘড়ি পরার অভ্যাস আছে। ঘড়ি ঘরে ফেলে গেলে, আপনার একটু অপূর্ণ মনোভাব সারাদিন ধরেই কাজ করে, তাই না? তার মানে তো এই নয় যে, আপনি ঘড়ি পরা নিয়ে আসক্ত।
তবে ডক্টর মার্ক এও বলেন, যারা এ ধরনের প্রযুক্তি প্রচুর ব্যবহার করেন এবং আসক্ত তাদের চিহ্নিত করার জন্য ডক্টর মার্ক তার এক গবেষণার অংশ হিসেবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন ১০টি প্রশ্ন। তার গবেষণা অনুযায়ী, কারো ৬টি উত্তর যদি হ্যাঁ সূচক হয় তাহলে তিনি আসলেই মোবাইল ফোনে আসক্ত। তাহলে দেখা যাক প্রশ্নগুলো কী কী-
- আপনার ফোন কি আপনার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস?
- আপনার এবং আপনার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তর্কের সৃষ্টি হয়েছে যার কারণ ছিল আপনি কত সময় মোবাইলে দিচ্ছেন?
- আপনার ফোন আপনার অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজের (যেমন কাজ, পড়াশুনা, ঘুম ইত্যাদি) পথে কি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে?
- আপনি কি অন্য যেকোনো কাজের চাইতে ফোনের পিছনে সময় বেশি ব্যয় করেন?
- আপনি কি আপনার ফোন মেজাজ ঠাণ্ডা করার একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন?
- আপনার মোবাইল ফোন ব্যবহার কি সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে?
- ফোন ব্যবহার করতে না পারলে কি আপনার বিরক্ত এবং খিটখিটে লাগে?
- ফোন ব্যবহার করলে কি আপনার উত্তেজনা অনুভূত হয়?
- কোনো এক কাজের খাতিরে ধরুন কিছুদিন ফোন ব্যবহার কমিয়ে দিতে হলো। কাজ শেষে কি আবারও সে একই পরিমাণেই ফোন ব্যবহার করেন?
- আপনি কি অন্যদের আপনি দিনে কি পরিমাণে ফোন ব্যবহার করেন সেটা নিয়ে মিথ্যা কথা বলেছেন?
এই ১০টি প্রশ্নের উত্তর আপনি নিজেই একবার নিজের জন্য ভেবে দেখুন না হয়। আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা ভয় করেন এই আসক্তি নিয়ে এবং অনেকে আছেন যারা এই প্রশ্নগুলোর কিছুর উত্তর হ্যাঁ দিবেন। আর এমন অনেককে খুঁজে পাওয়া যাবে যারা আসলেই আসক্ত, যদি আপনি নিজের প্রতি সৎ হয়ে থাকেন।
২০১৭ সালে ডেলয়েট নামক একটি সংস্থা যুক্তরাজ্যে একটি জরিপ চালায় মোবাইল ফোনের ব্যবহার নিয়ে, যেখানে ৪,১৫০ জন পূর্ণবয়স্ক ব্রিটিশ নাগরিক অংশগ্রহণ করেন। অংশগ্রহণকারীদের বয়স ১৬ থেকে ৭৫ বছর পর্যন্ত ছিল। তাদের মধ্যে শতকরা ৩৮ শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করেন যে, তারা স্মার্টফোন বেশি ব্যবহার করছেন। ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে এই সংখ্যা প্রায় অর্ধেক ছিল। তাছাড়া তারা এটিও জিজ্ঞাসা করেন যে, ঘুম থেকে ওঠার কতক্ষণ পর তারা ফোন ব্যবহার করেন।
অবিশ্বাস্য হলেও শতকরা ৭৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী এই ব্যাপারে হ্যাঁ সূচক উত্তর দেন। ধারণা করা হয়, এই অতিরিক্ত মোবাইল ফোনের ব্যবহার আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপরেও প্রভাব ফেলছে। এই ব্যাপারে সাইকোথেরাপিস্ট হিলডা বার্ক বলেন,
আমার কাছে যেসব রোগীরা আসেন, তাদের বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহার শীর্ষস্থান দখল না করে থাকলেও, উদ্বিগ্নতা বা অনিদ্রা বা সম্পর্কের সমস্যাগুলোর সাথে এই সমস্যার সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে। সমস্যার তালিকায় যখন উদ্বিগ্নতা এবং অনিদ্রা থাকে তখন এটি খুবই বিরল যে সেসব রোগীরা ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার করেন না।
আমাদের প্রয়োজনের অনেক কিছুর জন্যই আমরা এখন বিভিন্ন অ্যাপের ওপর নির্ভর করি। কিন্তু এই অ্যাপগুলো অনেক ক্ষেত্রে সাহায্যের হাত বাড়ানোর চেয়ে আমাদের এর দিকে টেনে ধরে রাখার জন্য চেষ্টা করে। কেননা, আপনি যত বেশি সময় ব্যয় করবেন এর পেছনে, অ্যাপের মালিক ততই লাভবান হবেন। ব্রিটিশ অ্যাপ ডেভেলপার নিক কুহ বলেন,
বর্তমানে অনেক কোম্পানি মনোবিজ্ঞানীদের নিয়োগ করছেন যাতে আপনাকে তাদের অ্যাপের দিকে বারবার ফিরিয়ে আনতে পারেন। এরকম অ্যাপ নিয়ে আমি নিজেও কাজ করেছি, যে কাজ নিয়ে আমি মোটেও গর্বিত নই।
টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক তাদের গবেষণার ফল হিসেবে বলেন, স্মার্টফোন আমাদের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা হ্রাস করছে। এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবার জন্য তারা ৮০০ স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সহায়তা নেন। পরীক্ষা করেন তাদের সৃজনশীলতার ক্ষমতা এবং জ্ঞান নিয়ে। তারা দেখতে পান যে, একটি ফোন হাতের কাছে থাকলে একজন ব্যক্তি কোনো কাজের প্রতি একান্ত মনোযোগ দিতে পারেন না।
অ্যাপ নির্ভর এই সমাজে আমাদের মানসিক দুর্বলতার উপর ভর করে গড়ে উঠেছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য। আমাদের এই মনোযোগের ওপরে যেন নির্ণয় করা হয়েছে মূল্য। নয়তো আপনিই একবার চিন্তা করে দেখুন, কি করেই বা ফেইসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামের মতো প্রতিষ্ঠান বিনামূল্যে আপনাকে প্রতিনিয়ত সেবা দিয়েই যাচ্ছে।
কিন্তু এই স্মার্টফোনের জাল থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব কি? যেকোনো রোগের মতো এর প্রথম ধাপ হলো চিহ্নিতকরণ বা মেনে নেওয়া যে, আপনার একটি সমস্যা রয়েছে। পরবর্তী ধাপ নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমিরেটাস ল্যারি রোসেন বলেন,
আমাদের মস্তিষ্ককে পুনর্বিন্যস্ত করতে হবে। বারবার নোটিফিকেশন চেক করার প্রয়োজন থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে।’
দিনে কতবার ফোন অপ্রয়োজনে ব্যবহার করছেন তা বের করুন। ধীরে ধীরে এই ব্যবহারের সংখ্যা কমাতে হবে। ধরুন, আপনি প্রতি ঘণ্টায় ৩-৪ বার ফোন চেক করেন, প্রতিবার ৫-৬ মিনিট করে। কিছুটা বিরতি নিয়ে ফোন চেক করতে পারেন। ১ মিনিটের জন্য ফোন দেখে ১৫ মিনিটের জন্য ফোনটা রেখে দিন একদিকে। ১৫ মিনিট হয়ে গেলে আবার ১ মিনিটের জন্য ফোন চেক করুন। এভাবে পুনরাবৃত্তি করতে থাকুন যতক্ষণ না আপনার কাছে আরামপ্রদ মনে হচ্ছে। ধীরে ধীরে এই সময়টি বাড়াতে থাকুন।
তাছাড়া আপনার ফোন ঘুমানোর সময় মাথার কাছে রাখা বন্ধ করুন। অনেকেই মোবাইল ফোনে অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমান। শুধুমাত্র এই কাজের জন্য ফোন মাথার কাছে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। একটি এলার্ম ঘড়ি কিনুন, খুব বেশি দামী না সেটা। সম্ভব হলে ফোন বিছানা থেকে দূরে রেখে ঘুমান। ডাক্তার রোসেনের মতে, এই দুটি কাজ আপনাকে মূল কাজের প্রতি তুলনামূলক বেশি মনোযোগ দিতে সহায়তা করবে এবং আপনার উদ্বেগ কমাতেও সহায়তা করবে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্মার্টফোন প্রযুক্তির খুব সুন্দর একটি উপহার। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের উন্নতি সাধনে এই গ্যাজেটের ভূমিকা হয়তো অনেক। কিন্তু এর সমস্যার প্রতি নজর না দিলে তা বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে। আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী জিন টুয়েনগে অভিমত প্রকাশ করেন,
হয়তো স্মার্টফোনের ব্যবহার তেমন কোনো খারাপ প্রভাব ফেলবে না। এ বিষয়ে সুনিশ্চিত কোনো দলিল নেই। কিন্তু আপনার এটাও মনে রাখতে হবে যে, গত কয়েক বছরে হতাশায় আক্রান্তদের সংখ্যা ভয়ানক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফিচার ইমেজ: qz.com