‘ঘড়ির কমপ্লিকেশন’, এ আবার কী? শিরোনাম দেখে হয়তো অনেকের মাথায় ঠিক এই প্রশ্নটিই এসেছে। সাধারণ অভিধানে কমপ্লিকেশন অর্থ ‘জটিলতা’ হলেও হরোলজি বা ঘড়ি-নির্মাণবিদ্যায় অর্থটি একটু অন্যরকম।
আধুনিক সময়ে ঘড়িতে নানা ধরনের ফিচার থাকলেও মূলত ঘড়ির প্রধান কাজ হচ্ছে ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ডের হিসেব প্রদর্শন করা। সেই ক্লিশে ভূমিকার বাইরে একটি ঘড়ি যা যা করতে সক্ষম, তা-ই ঘড়িটির কমপ্লিকেশন। এই ‘করতে পারা’র তালিকায় থাকতে পারে অ্যালার্ম দেওয়া থেকে শুরু করে, বার-তারিখ-মাসের হিসাব, মাসের হিসাব, স্টপওয়াচ-সহ আরো অনেক কিছুই।
ভ্যাসুরন কন্সতান্তিনের রেফারেন্স ৫৭২৬০ ঘড়িটি পৃথিবীর সবথেকে জটিল এবং অধিক কমপ্লিকেশন-সম্পন্ন ঘড়ি হিসেবে স্বীকৃত, যাতে ৫৮টি ভিন্ন ভিন্ন কমপ্লিকেশন রয়েছে। আজকে আমরা ঘড়িতে সচরাচর ব্যবহৃত হয়, এমন কিছু সাধারণ কমপ্লিকেশন নিয়ে আলোচনা করবো।
ডেট কমপ্লিকেশন
ডেট বা তারিখ প্রদর্শন অবশ্যই ঘড়ির সবচেয়ে সাধারণ, কার্যকর এবং জনপ্রিয় কমপ্লিকেশন। সময় জানানোর পাশাপাশি এইসব ঘড়ি আপনাকে মাসের তারিখের হিসেব রাখতেও সাহায্য করবে। সাধারণত ঘড়ির ডায়ালে ছোট কোনো উইন্ডোর সাহায্যেই তারিখ প্রদর্শিত হয়।
তবে অনেকসময় সেকেন্ড, মিনিট এবং ঘণ্টার কাঁটার পাশাপাশি আরেকটি কাঁটার সাহায্যেও তারিখের হিসেব রাখা হয়। ঘড়ির এ ধরনের ডেট ডিসপ্লে-কে বলা হয় পয়েন্টার ডেট বা ব্যাংকার্স ডেট।
অনেক ঘড়িতে তারিখের পাশাপাশি সপ্তাহের দিন বা বারও দেখা যায়, যা ডে-ডেট কমপ্লিকেশন নামে পরিচিত। অধিকাংশ সময় ডেট-কমপ্লিকেশনের উইন্ডো ঘড়ির ডায়ালে ৩-এর কাছাকাছি থাকলেও মডেল ভেদে তা ৪,৫,৬,৯ এমনকি ১২-এর ঘরের কাছেও দেখা যায়। ডে-ডেট কমপ্লিকেশনে দিন এবং তারিখের জন্য দু’টি আলাদা উইন্ডো থাকে, যা অনেকসময় পাশাপাশি, আবার অনেকসময় আলাদা আলাদাও দেখা যায়।
ডেট কমপ্লিকেশন কেমন হবে, তা পুরোপুরি নির্ভর করে ঘড়ির ব্র্যান্ড এবং ঘড়ির মডেলের ওপর।
কমপ্লিট ক্যালেন্ডার বা ত্রিপল ক্যালেন্ডার বা অ্যানুয়াল ক্যালেন্ডার
ঘড়ির এই ধরনের কমপ্লিকেশনে তারিখ ও বারের সাথে মাসের হিসেবও সংরক্ষিত থাকে, অর্থাৎ ঘড়ি দেখে জানা যায় মাসের নামও। এসব ঘড়ি কমপ্লিট ক্যালেন্ডার বা ত্রিপল ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। ঘড়ি নিয়ে রোর বাংলায় ইতোপূর্বে প্রকাশিত একটি লেখায় পারপেচুয়াল ক্যালেন্ডার (perpetual calendar) নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। পারপেচুয়াল ক্যালেন্ডার-ঘড়ির সাথে এইসব ঘড়ির পার্থক্য হচ্ছে, এইসব ঘড়িতে অধিবর্ষের (leap year) হিসেব সংরক্ষিত থাকে না।
জাম্প আওয়ার
এখন যে কমপ্লিকেশনটি নিয়ে আলোচনা করা হবে, তা তুলনামূলক বিরল। জাম্প আওয়ার (jump hour) এমন একটি কমপ্লিকেশন, যেখানে ঘড়িতে ঘণ্টার কাঁটার পরিবর্তে একটি আলাদা উইন্ডো’র মাধ্যমে ঘণ্টার হিসেব প্রদর্শিত হয়। এই উইন্ডো দেখতে অনেকটা ডেট-উইন্ডোর মতো হলেও এটি কিন্তু ডেট-উইন্ডোর মতো ২৪ ঘণ্টা পর হালনাগাদকৃত হয় না; প্রতি ৬০ মিনিট অন্তর অন্তর উইন্ডোর মধ্যে ঘণ্টার অঙ্কে বদল আসে।
ক্রনোগ্রাফ
ক্রনোগ্রাফ (chronograph) শব্দটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। এই কমপ্লিকেশনটিকে ক্রনোগ্রাফ না বলে স্টপ ওয়াচ বললেই বোধহয় বুঝতে সুবিধা হবে। সাধারণত অ্যানালগ ঘড়িতে একাধিক সাব-ডায়াল এবং আলাদা সেকেন্ডের কাঁটা ব্যবহার করে এই কমপ্লিকেশনটি যুক্ত করা থাকে।
ক্রনোগ্রাফ সংযুক্ত ঘড়িতে ক্রাউনের (যে হাতল ঘুরিয়ে ঘড়ির সময় বদলানো হয়) পাশাপাশি এক বা একাধিক পুশার থাকে। এই পুশারের সংখ্যার এবং কাজের উপর ভিত্তি করে ক্রনোগ্রাফকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ক্রনোগ্রাফে একটি পুশার থাকলে তাকে মনোপুশার (monopoussoir), ২ টি পুশার থাকলে তাকে ফ্লাই ব্যাক (flyback) এবং তিনটি পুশার থাকলে তাকে স্প্লিট সেকেন্ড (split-second) ক্রনোগ্রাফ বলা হয়।
আপনার ঘড়িতে যদি ক্রনোগ্রাফ কমপ্লিকেশনটি থাকে, তাহলে সেটির ফ্লাই ব্যাক ক্রনোগ্রাফ হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৯৫%; যেখানে ওপরের পুশারটি দিয়ে স্টপ ওয়াচের সেকেন্ডের কাঁটাটিকে চালু করা এবং থামানো হয়। নিচের পুশারটি দিয়ে সেকেন্ডের কাঁটাকে শুরুর অবস্থানে ফিরিয়ে নেওয়া যায়।
মনোপুশার ক্রনোগ্রাফে একটি পুশার দিয়েই সবকিছু করতে হয় বলে, একবার বিরতি দিয়ে আবার সেখান থেকেই সময় গণনা করা সম্ভব হয় না। কেননা, প্রথম চাপে শুরু, দ্বিতীয় চাপে বন্ধ হওয়ার পর তৃতীয় চাপে পুনরায় সেটি শুরুর অবস্থায় ফিরে যায়। এই সীমাবদ্ধতার কারণে মনোপুশার ক্রনোগ্রাফগুলো বর্তমানে প্রায় বিরল। স্প্লিট সেকেন্ড ক্রনোগ্রাফে দু’টি ভিন্ন সেকেন্ডের কাঁটা থাকে, যা দিয়ে দু’টি আলাদা আলাদা মুহূর্তের হিসেব রাখা সম্ভব হয়।
ক্রনোমিটার
অনেকেই ক্রনোগ্রাফ শব্দটির সাথে ক্রনোমিটার শব্দটি গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। ক্রনোমিটার শব্দটি দিয়ে প্রকৃতপক্ষে ঘড়ি বোঝানো হলেও, আপনার ঘড়িতে ক্রনোমিটার শব্দটি লেখা থাকলে বুঝতে হবে, ঘড়িটি অত্যন্ত নির্ভুলভাবে সময়ের হিসেব রাখতে সক্ষম। ক্রনোমিটার শব্দটি সাধারণত অটোমেটিক ঘড়ির একটি বৈশিষ্ট্য এবং একে ঠিক কমপ্লিকেশন বলা যায় না।
কোন ঘড়িকে ক্রনোমিটার বলতে হলে ঘড়িটির মুভমেন্টকে অনেক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। যেহেতু অটোমেটিক ঘড়ি বৈদ্যুতিক শক্তি ছাড়া স্থিতি শক্তির সাহায্যে চলে, তাই এতে ভুলভ্রান্তির সম্ভাবনা কোয়ার্টজ ঘড়ির থেকে অনেক বেশি থাকে। দিনের হিসাব দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ঘড়ি যদি ±৫ সেকেন্ডের (মতভেদে +৬ এবং -৪) বেশি ভুল না করে, অর্থাৎ ৮৬৪০০ সেকেন্ডে (১ দিন) যদি তা ৫ সেকেন্ডের কম বা বেশি হিসেব না করে, তাহলে সেই ঘড়িকে ক্রনোমিটারের তকমা দেওয়া যেতে পারে।
সি.ও.এস.সি (C.O.S.C) ক্রনোমিটার পরীক্ষা করা এবং এর সার্টিফিকেট দেওয়ার বিশ্ববিখ্যাত একটি প্রতিষ্ঠান, যা সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অবস্থিত। রোলেক্স, ওমেগা-এর মতো বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ডের ক্রনোমিটার ঘড়ি সি.ও.এস.সি সনদ প্রাপ্ত। তবে প্যাটেক ফিলিপ তাদের ঘড়ির ক্রনোমিটার তাদের নিজের পরীক্ষাগারে পরীক্ষার পর বাজারজাত করে এবং তাদের দাবি অনুসারে, তাদের মান নিয়ন্ত্রণের মাপকাঠি সি.ও.এস.সি-এর থেকে অধিক নির্ভুল এবং আদর্শ।
বর্তমানে রোলেক্স তাদের ঘড়িতে ‘সুপারল্যাটিভ ক্রনোমিটার’ (superlative chronometer) মুভমেন্টের প্রচলন করেছে, যা তাদের দাবি অনুসারে নরমাল ক্রনোমিটার মুভমেন্টের থেকেও অধিক নির্ভুল এবং ১ দিনের হিসাবে ±২ সেকেন্ড পর্যন্ত সঠিক সময়ের হিসেব রাখতে পারে।
মুনফেইজ কমপ্লিকেশন
সবচেয়ে কম প্রয়োজনীয় কমপ্লিকেশনগুলোর কথা বলতে গেলে অবশ্যই মুনফেইজ কমপ্লিকেশনটির কথা আসবে। দৈনন্দিন জীবনে এই কমপ্লিকেশনটির তেমন কোনো ব্যবহার না থাকলেও আপনার ঘড়িটিকে আরো দৃষ্টিনন্দন করতে এটি অবশ্যই ভূমিকা পালন করবে। মুনফেইজ কমপ্লিকেশনের দ্বারা পূর্ণিমা, অর্ধ-পূর্ণিমা, নতুন চাঁদ, অমাবস্যাসহ চন্দ্রমাস-সংক্রান্ত যেকোনো হিসেব রাখা যায়। মুনফেইজ কমপ্লিকেশনসম্পন্ন ঘড়ি নির্মাণ করা যথেষ্ট জটিল হওয়ায়, এই কমপ্লিকেশনটি ঘড়ির মূল্য বৃদ্ধি করতে পারে বহুগুণে।
ট্যাকিমিটার (tachymeter)
আপনার ঘড়ির ডায়ালের বাইরের দিকে যদি অনেক সংখ্যা লেখা থাকে, তাহলে এই কমপ্লিকেশনটি ট্যাকিমিটার হওয়ার সম্ভাবনা ৯৯%। ট্যাকিমিটার মূলত গতিবেগের হিসাব করার একটি স্কেল, তবে এর সাহায্যে নানাবিধ ব্যবহারিক কাজ করা সম্ভব। ট্যাকিমিটার সাধারণত ক্রনোগ্রাফের সাথে সংযুক্ত থাকে।
ধরা যাক, আপনি একটি গাড়িতে করে কোথাও যাচ্ছেন। কোনো কারণে ড্রাইভারের সামনে থাকা গতির স্কেলটি আপনি দেখতে পাচ্ছেন না। এখন আপনার ঘড়িতে ট্যাকিমিটার থাকলে, সহজেই আপনি আপনার গাড়ির গতি সম্পর্কে ধারণা পেতে পারেন। এজন্য আপনাকে সুনির্দিষ্ট ১ কিলোমিটার কিংবা ১ মাইল দূরত্ব পার হতে কত সময় লাগে, তা ঘড়ি দেখে হিসাব করতে হবে।
ধরা যাক, একটি কিলোমিটার-পোস্ট পার হওয়ার পর আপনি আপনার ক্রনোমিটারটিতে সময় গণনা শুরু করলেন। পরবর্তী কিলোমিটার-পোস্ট পার হওয়ার সময় আপনি ক্রনোমিটারটি বন্ধ করলে ১ কিলোমিটার পার হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের হিসাব পাওয়া যাবে। মনে করি, ১ কিলোমিটার পার হতে আপনার সময় লাগে ১৫ সেকেন্ড। স্টার্ট-পয়েন্ট থেকে শুরুর পর ক্রনোমিটারের সেকেন্ডের কাঁটা ১৫ সেকেন্ড পর ট্যাকিমিটারের ২৪০-এর ঘরে আসে (ছবি অনুসারে)। এ থেকে বলা যায়, আপনার গাড়ির গতি ঘণ্টায় ২৪০ কিলোমিটার। মূলত ট্যাকিমিটারের সাহায্যে একঘণ্টায় কোনো কাজ কতবার সম্পন্ন করা যায়, তার হিসাব করা হয়।
পাওয়ার রিজার্ভ ইনডিকেটর
এই কমপ্লিকেশনটি শুধু অটোমেটিক ঘড়িতেই দেখা যায়। অটোমেটিক ঘড়িতে যে পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত আছে, তা দিয়ে ঘড়িটি আর কত সময় সচল থাকবে, তা নির্দেশ করাই এই স্কেলটির কাজ। অধিকাংশ ঘড়িতে এই স্কেলে সময়ের একক হিসেবে ঘণ্টা ব্যবহৃত হলেও, দীর্ঘ সময় সচল থাকতে পারা কোনো কোনো দামি ঘড়িতে একক হিসেবে দিনও ব্যবহৃত হয়।
অ্যালার্ম
অ্যালার্ম কমপ্লিকেশনটির সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। প্রায় সকল ডিজিটাল হাতঘড়িতে অ্যালার্ম দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও অ্যানালগ ঘড়িতে অ্যালার্ম ফিচারটি কদাচিৎ দেখা যায়। ঘড়ির ব্যবহারকারীকে নির্দিষ্ট কোনো সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া উদ্দেশ্য হলেও, অনেক সময় ঘড়িতে কমপ্লিকেশন সংখ্যা বাড়ানোর উদ্দেশ্যেও এটি যুক্ত করা হয়।
ডুয়াল টাইম জোন বা জি.এম.টি ওয়াচ
‘৫০-এর দশকে প্যান অ্যাম এয়ারলাইন্স রোলেক্সকে তাদের পাইলটদের জন্য এমন একটি ঘড়ির ডিজাইন করতে বলে, যা একই সাথে আলাদা দু’টি জায়গার সময়ের হিসেব রাখতে পারবে। সেই ফরমায়েশ মেনে রোলেক্স তখন তাদের বিশ্ববিখ্যাত ঘড়ি জি.এম.টি মাস্টারের সাথে বিশ্বকে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং একই সাথে ঘড়ির সম্পূর্ণ নতুন একটি ক্যাটাগরি চালু করে, যা ডুয়াল টাইম জোন বা জি.এম.টি ওয়াচ নামে পরিচিত।
রোলেক্স জি.এম.টি মাস্টার ঘড়িতে সেকেন্ড, মিনিট এবং ঘণ্টার কাঁটা ছাড়াও চতুর্থ একটি কাঁটা ব্যবহার করা হয়েছে, যা প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একবার পূর্ণ ঘূর্ণন সম্পন্ন করে। সহজভাবে বললে, এর গতি ঘণ্টার কাঁটার অর্ধেক। ঘড়ির বাইরের দিকে ২৪ ঘণ্টার যে হিসেব দেখা যায়, তা ঘোরানো সম্ভব এবং এই অংশটি ঘুরিয়েই আপনি দ্বিতীয় যে জায়গার সময়ের হিসাব রাখতে চান, সেখানে কয়টা বাজে, তা চতুর্থ কাঁটার সাথে সামঞ্জস্য করে দু’টি আলাদা জায়গার সময়ের হিসেব রাখতে পারবেন।
আলাদা আলাদা জায়গার সময়ের হিসাব রাখার এই ব্যবস্থা ঘড়ির মডেলের সাথে সাথে ভিন্ন হতে পারে। অনেকসময় একই ঘড়ির ভিতর দু’টি আলাদা আলাদা ঘড়ি দেখা যায় (ডুয়াল মুভমেন্ট)। অন্যভাবে একই ঘড়ির মধ্যে দু’টি আলাদা মুভমেন্টের সাহায্যে আপনি সহজেই দু’টি ভিন্ন জায়গার সময়ের হিসাব রাখতে পারবেন। একই ঘড়ির মধ্যে দু’টি আলাদা মুভমেন্টের জন্য অনেকসময় একই শক্তি উৎস আবার অনেকসময় ভিন্ন শক্তি উৎসও ব্যবহার করা হয়।
এই ক্যাটাগরির ঘড়ির একটি জটিলতম সংস্করণ হচ্ছে ওয়ার্ল্ড টাইম জোন ওয়াচ। এসব ঘড়িতে ঘড়ির ঘূর্ণায়মান ব্যেজেল বা বহির্বলয়ে ২৪টি মূল টাইম জোনের (পৃথিবী ২৪টি টাইম জোনে বিভক্ত) ২৪টি প্রধান শহরের নাম লেখা থাকে এবং ২৪ ঘণ্টায় একবার ঘূর্ণন সম্পন্নকারী চতুর্থ একটি কাঁটা দ্বারা এসব শহরের সময়ের হিসেব রাখা যায়। মূল ঘড়ি হিসেব রাখে স্থানীয় সময়ের।
ট্যুরবিয়োন
মুনফেইজ কমপ্লিকেশন ছাড়াও যেসব কমপ্লিকেশন ঘড়ির দাম বৃদ্ধি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাদের তালিকা করতে বসলে সবার ওপরেই থাকবে ট্যুরবিয়োন (tourbillon) নামক কমপ্লিকেশনটি। অবশ্য ট্যুরবিয়োনকে কমপ্লিকেশন বলা যায় কিনা, সেটি নিয়েই অনেক মতভেদ আছে। কারণ কমপ্লিকেশনের সংজ্ঞা অনুসারে, ট্যুরবিয়োন সময় দেখার পাশাপাশি বাড়তি কোনো ব্যবহার যুক্ত করে না, বরং একে ঘড়ি নির্মাণের একটি আলাদা পদ্ধতি বলা যায়।
১৭৯৬, মতান্তরে ১৭৯৫ সালে আব্রাহাম লুই বিগ্রে সর্বপ্রথম ট্যুরবিয়োন আবিষ্কার করেন। তিনি একজন বিশ্বখ্যাত ঘড়ি নির্মাতা এবং একইসাথে ব্রেগ্যে (Breguet) ব্র্যান্ডটির প্রতিষ্ঠাতা।
মেকানিক্যাল পকেট-ঘড়িই ছিল তৎকালীন ঘড়িসমূহের একমাত্র প্রকরণ। দম দেওয়া এইসব পকেট-ঘড়ি অধিকাংশ সময় পকেটেই থাকতো বিধায়, বর্তমানের অটোমেটিক ঘড়ির মতো এগুলার অবস্থার পরিবর্তনের সুযোগ ছিল সামান্যই। দীর্ঘ সময় একইভাবে থেকে অভিকর্ষ বলের প্রভাবে এই ঘড়িগুলোর স্প্রিং বসে যাওয়ার ভয় ছিল।
যেহেতু মেকানিক্যাল ঘড়ি স্প্রিং দিয়েই গতিশীল থাকে, সেহেতু স্প্রিং বসে গেলে ঘড়ির সময়ের হিসেবে ত্রুটি হওয়া স্বাভাবিক। এই সমস্যা দূর করার জন্যই ট্যুরবিয়োনের আবিষ্কার। ট্যুরবিয়োন ঘড়ির মূল অংশগুলো- ব্যালেন্স হুইল, এস্কেপমেন্ট, স্প্রিং ইত্যাদিকে নিজের অক্ষের ওপর ঘূর্ণ্যমান রাখে, যা এই অংশগুলোর ওপর অভিকর্ষ বলের প্রভাবকে নাকচ করে।
ট্যুরবিয়োন নির্মাণ পদ্ধতি অসম্ভব জটিল, তাই ঘড়িতে এর উপস্থিতি ঘড়ির দাম বাড়িয়ে দিতে পারে বহুগুণে। প্রযুক্তির ব্যবহারের জন্য বর্তমানে অটোমেটিক বা মেকানিক্যাল ঘড়িতে এর কোনো প্রয়োজন না থাকলেও বাহ্যিক সৌন্দর্য, আভিজাত্য এবং জটিল ঘড়ি নির্মাণের জন্য এখনো ট্যুরবিয়োনের ব্যবহার দেখা যায়।
মিনিট রিপিটার
নিঃসন্দেহে বলা যায়, ঘড়িতে মিনিট রিপিটার (Minute repeater) কমপ্লিকেশনটি দেখা মানুষের সংখ্যা খুবই সামান্য। যদিও এটি সচরাচর দেখা কমপ্লিকেশনগুলোর মধ্যে পড়ে না, তবুও মিনিট রিপিটার ঘড়ির কথা না বললে ঘড়ি নিয়ে লেখা অসম্পূর্ণই থেকে যায়।
আগে পকেট ওয়াচে মিনিট রিপিটার কমপ্লিকেশনটি দেখা গেলেও বর্তমানে নামকরা ঘড়ি নির্মাতারা সংগ্রাহকদের জন্যই মূলত এই ঘড়িগুলো নির্মাণ করেন। এই ঘড়িগুলো সাধারণত প্রতি এক মিনিট, পনেরো মিনিট, আধঘণ্টা এবং এক ঘণ্টা বিরতিতে বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শব্দ করতে পারে। সবথেকে আশ্চর্যজনক বিষয় এই যে, নির্দিষ্ট বিরতিতে এই শব্দগুলো একটি আরেকটির থেকে আলাদা। মিনিটের শব্দ আর আধঘণ্টার শব্দ যেমন ভিন্ন, তেমনি আধঘণ্টার শব্দ আর পূর্ণঘণ্টার শব্দও ভিন্ন। ভালো ব্র্যান্ডের একটি মিনিট রিপিটার ঘড়ির জন্য আপনাকে অবশ্যই ন্যূনতম কয়েক হাজার ডলার খরচ করতে হবে।
শত বিজ্ঞানীর জ্ঞান, হাজার শিল্পীর সৃষ্টিশীলতা আর লাখো শ্রমিকের একাগ্রতার ফসল এই ঘড়ি। পরতে ভালোবাসুন আর না-ই বাসুন, ঘড়ির বিবিধ ব্যবহার, বৈচিত্র্য ও এর পেছনের গল্পগুলো জানতে পারলে মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না!