একটি প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি। প্রযুক্তি আমাদের জন্য নাকি আমরা প্রযুক্তির জন্য? আপনার উত্তর যদি হয়, আপনি আপনার নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় কাজে প্রযুক্তির ব্যবহার করছেন, তাহলে আপনাকে অভিনন্দন। কিন্তু অবস্থা যদি এমন হয় যে, আপনি প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া দিনের এক মুহূর্তের কথাও ভাবতে পারেন না, তাহলে আপনার জন্য অশনি সংকেত অপেক্ষা করছে।
আমাদের হাতের কাছের প্রযুক্তি বলতে আমরা কী কী চিনি? মোবাইল ফোন, ক্যামেরা, কম্পিউটার, টেলিভিশন এগুলোই তো। এখন নতুন এবং ভিন্ন একটি তথ্য দেখুন। পৃথিবীতে ৭০০ কোটি মানুষের মধ্যে ৬০০ কোটি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী আছে। তার বিপরীতে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহার করার সুবিধা আছে ৪৫০ কোটি মানুষের। সংখ্যা দুটি খেয়াল করুন। এ পার্থক্য আমাদের বুঝিয়ে দেয়, প্রযুক্তি কতটা বিস্তৃত আকারে আমাদের ছেয়ে ফেলেছে। যেখানে আমাদের স্বাস্থ্যসম্মত জীবনের পূর্ণ নিশ্চয়তা নেই, সেখানে আমরা পরিপূর্ণভাবে প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়ছি।
আমরা সাধারণত দিনে গড়ে ৫-৬ ঘণ্টা মোবাইল বা কম্পিউটারের দিকে কুঁজো হয়ে তাকিয়ে থেকে কাটিয়ে দিই। কারো কারো ক্ষেত্রে সংখ্যাটা আরো বেশি। প্রশ্ন হলো, আমরা অনেকেই তো চাই নিজেদের প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখতে। মোবাইল, কম্পিউটার সব বন্ধ করে রাখি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নেশা কাটানোর জন্য সেটিও বন্ধ রাখি। কিন্তু তারপরও আমরা প্রযুক্তির প্রতি এতো আকৃষ্ট হচ্ছি কেন? উত্তরটা খুব সহজ। আপনি যদি একবার কোনো জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন, তাহলে সেটা থেকে আপনি যত দূরেই যেতে চান না কেন, সেটি আপনাকে আরো বেশি করে কাছে টানবে। অনেকেই হাতের কাছে মোবাইল ফোন না পেলে অস্থির হয়ে উঠে। এই অস্থিরতার একটি নামও আছে। নোমোফোবিয়া। ভেঙ্গে বললে, নো মোবাইল ফোবিয়া।
চাইলেই প্রযুক্তি থেকে দূরে সরে যেতে পারবেন না আপনি। আপনাকে প্রতিনিয়ত প্রযুক্তির সাথেই বাস করতে হচ্ছে। আপনি জরুরী কোথাও কথা বলতে চান কিংবা ক্ষুধা লেগেছে বলে খাবার আনিয়ে নিতে চান, সবক্ষেত্রেই আপনার প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হবে। তবে তার মানে এই না যে, এগুলো করতে গিয়ে আপনি পুরোপুরি প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়বেন।
আমাদের মস্তিষ্ক স্বভাবতই পুরষ্কৃত হতে চায়। পুরষ্কার পেয়ে তৃপ্ত হতে চায়। ধরুন, আপনি মোবাইলে একটি ভিডিও গেইম খেলছেন। একেকটি স্তর পার করার জন্য পুরষ্কার পান। এটি আপনার মস্তিষ্কে ডোপামিনের ক্ষরণ করে। এই ডোপামিন ক্রমশ ক্ষরণ হতে থাকে এবং আপনার গেইমটির প্রতি আকর্ষণ ক্রমশ বাড়তে থাকে। মাঝখান থেকে সময় যে কোথায় উড়ে চলে যায়, তার খবরই থাকে না। একই ঘটনা ঘটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা যেকোনো প্রকার নেশাজাত দ্রব্যের ক্ষেত্রে।
নতুন কোনো প্রযুক্তি আসলে আমরা স্বভাবতই সেটার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। আধুনিক স্মার্ট ফোনগুলোর কথা চিন্তা করলেই তা বুঝতে পারবেন। আমরা কীভাবে প্রযুক্তির এই আগ্রাসন থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারি? প্রথম কথা হলো, উদ্যোগ আপনার নিজেকে নিতে হবে। আপনি নিজে যদি পরিবর্তন করতে না চান, তাহলে কেউ আপনাকে সাহায্য করতে পারবে না। যেসব উদ্যোগ আপনি নিতে পারেন-
যা আপনাকে নেশাগ্রস্ত করে ফেলে, তা থেকে দূরে থাকুন
পড়ালেখার সময় হাতের কাছে মোবাইল ফোন থাকলে কারোরই আসলে পড়া হয় না, যদি না সেটা পড়ার কাজে ব্যবহার করে থাকেন। পড়ার মাঝে মনে হলো ফেসবুকে একটু ঘুরে আসি। ২ মিনিটই তো। এতে কিছু হবে না! কিন্তু এই ২ মিনিট শেষ হতে যে আমাদেরর ৩০ মিনিট লাগে সেটা আমরা বোধ হয় ভুলেই যাই! তাই এভাবে যাতে সময় নষ্ট না হয়, সেজন্য মোবাইল ফোনটি হাতের থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখা উচিৎ। একটি কার্যকর উপায় হলো, পড়ার টেবিলে বসার পর মোবাইলটি দূরে কোথাও ছুড়ে মারা। এতে যা হবে, পড়ার মাঝে যতবারই আপনার মোবাইলের কথা মনে পড়বে, আপনি চেয়ার ছেড়ে উঠে যেতে চাইবেন না। অথবা, মোবাইলটি বাসায় কারো হাতে দিয়ে বলতে পারেন, সামনের এক ঘন্টায় আপনার যতই দরকার হোক না কেন, মোবাইলটি যেন আপনার হাতে না দেয়া হয়। এভাবে দিনের কিছুটা সময় আপনি নিজেকে মোবাইল অথবা অন্যান্য প্রযুক্তি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন।
বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন
বলা হয়, মানুষের সবচেয়ে কাছের বন্ধু বই। এই বন্ধুর সাহায্য নিয়ে আপনি চাইলে নিজেকে প্রযুক্তির আসক্তি থেকেও দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন। আপনার পছন্দের বিষয়ের উপর বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করুন। এতে আপনার সময় অনেক ভালো কাটবে। তবে অবশ্যই কাগজের বই পড়তে হবে। আপনি যদি মোবাইলের পর্দার দিকে তাকিয়ে বই পড়তে থাকেন, তাহলে দেখা যাবে আবার সেই প্রযুক্তির মাঝেই নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন। তাই এমনভাবে বই পড়ার অভ্যাস করুন যাতে আপনার প্রযুক্তির প্রতি নির্ভরশীলতা না আসে।
কোথাও ঘুরতে যান
বন্ধুদের সাথে নিয়ে কোথাও ঘুরতে চলে যান। ঘুরতে গেলে প্রায় সময় আমরা ঘুরার চেয়ে ছবি বেশি তুলি। এবার একটি ভিন্ন কাজ করুন। ঘুরতে যাবেন কিন্তু কোনো ছবি তুলবেন না। তুললেও খুবই কম তুলার চেষ্টা করবেন। স্মৃতিগুলো মস্তিষ্কে রেখে দেবার চেষ্টা করবেন। যখনই মনে পড়বে, মস্তিষ্ক থেকে সেগুলো খুঁজে নেবার চেষ্টা করবেন। দেখবেন অন্যরকম একটা প্রশান্তি কাজ করছে। অথবা ক্ষুধা লাগলে খাবার বাসায় অর্ডার না করে যদি সম্ভব হয়, নিজে দোকানে গিয়ে খেয়ে আসুন। এতে আপনার এক ঘরে বসে থাকার প্রতি বিরক্তি ভাবটাও দূর হবে। আর খাওয়ার সময় চেষ্টা করবেন মোবাইলে সময় কম দিতে। আপনি যার সাথে ঘুরতে বের হয়েছেন, তার সাথে কথা বলেই সময় কাটানোর চেষ্টা করুন।
মোবাইল ফোন সাথে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন না
আমাদের খুবই সাধারণ একটি অভ্যাস হলো, মোবাইল ফোন সাথে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়া। রাত জেগে মোবাইল ফোন না চালালে আমাদের যেন চলেই না। কিন্তু আপনি যত রাত জেগে মোবাইল ফোনের পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকবেন, আপনার ঘুম ততই বিঘ্নিত হবে। একই কথা অন্যান্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে। বলা হয়, সুন্দর ঘুমের জন্য ঘুমানোর আগে ২-৩ ঘন্টা কোনো প্রকার প্রযুক্তির সংস্পর্শে থাকা উচিৎ না। তাই চেষ্টা করবেন ঘুমানোর সময় এসব প্রযুক্তি থেকে নিজেকে যথাসম্ভব দূরে রাখতে।
প্রযুক্তিকে আমরা কীভাবে ব্যবহার করব তা সম্পূর্ণ আমাদের ইচ্ছার উপর। আমরা চাইলে কেবল আমাদের নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় কাজে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারি অথবা চাইলে নিজেদেরকেই প্রযুক্তির মাঝে হারিয়ে ফেলতে পারি। তবে নিজেদের মঙ্গলের জন্য অবশ্যই আমাদে প্রযুক্তির ব্যাপারে সচেতন থাকা উচিৎ। প্রযুক্তি যেন আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, আমরাই যেন হই প্রযুক্তির নিয়ন্তা।
ফিচার ছবি- Pinterest