নিজেই করুন চুলের সমস্যার সমাধান

আধুনিক পৃথিবীর মানুষ নিজেদের সৌন্দর্য নিয়ে অনেক সচেতন। আর সৌন্দর্যের অংশ হিসেবে চুলের প্রতিও মানুষ বেশ যত্নবান। আগের দিনের মানুষেরা খাবার ও পরিবেশের বিশুদ্ধতার কারণে ত্বক ও চুলের সমস্যায় ভুগতো এখনকার চেয়ে অনেক কম। সেই সাথে নিজেদের যত্নে তারা ব্যবহার করতো নানা প্রাকৃতিক উপাদান। এখন মানুষ দূষণ ও ভেজালের কারণে ত্বক ও চুলের নানা সমস্যায় আগের দিনের চেয়ে অনেক বেশি ভোগে। সেই সাথে তারা কৃত্রিমভাবে প্রস্তুতকৃত রাসায়নিক দ্রব্যাদির প্রতি ঝুঁকেছে ব্যাপকহারে। কিন্তু প্রকৃতির মতো যত্ন আমাদের কোনো কৃত্রিম উপাদানই দিতে পারে না। চুল ও ত্বকের সমস্যাগুলো প্রাথমিকভাবে মোকাবেলায় ঘরোয়া প্রাকৃতিক যত্ন আমাদের দিতে পারে দারুণ ফলাফল। আজ আমরা চুলের সাধারণ সমস্যাগুলো সমাধানে ঘরোয়া, প্রাকৃতিক উপায়ের কথাই বলবো।

চুল পড়া

চুল পড়া একটি বড় সমস্যা; source: sabah.com.tr

সবচেয়ে সাধারণ এই সমস্যা এখন প্রায় সবাইকেই কম-বেশি ভোগাচ্ছে। আসুন জানি ঘরে বসেই এটি কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়।

৫-৬ চা চামচ আমলা গুঁড়ো সমপরিমাণ পানিতে মিশিয়ে সমস্ত চুলে দিয়ে ৩০ মিনিট রেখে হালকা শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। কাঁচা আমলার রসও ব্যবহার করতে পারেন মাথার ত্বকে। চাইলে আমলার সাথে ৩-৪ চা চামচ শিকাকাই পাউডার মিশিয়ে নিতে পারেন। এক্ষেত্রে আগের দিন রাতে পানিতে এই মিশ্র পাউডার মিশিয়ে রাখলে ভালো ফলাফল পাবেন। সপ্তাহে তিনবার চুলে আমলার ব্যবহার চুল পড়া রোধ করা সহ চুল সাদা হয়ে যাওয়াও রোধ করে।

মাথার ত্বকের রক্ত চলাচল বৃদ্ধিতে ও চুল পড়া রোধ করতে নিমও বেশ ভালোই কাজে লাগতে পারে। এক মুঠো নিমের পাতা তিন কাপ পানিতে ১৫ মিনিট ধরে ফুটিয়ে ঠান্ডা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। এরপর এই পানি দিয়ে গোসল শেষে মাথার ত্বকসহ সমস্ত চুল ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে তিনদিন এর ব্যবহার আপনার ত্বকের যাবতীয় সমস্যা কমিয়ে চুল পড়া কমাতে সাহায্য করবে। এই পদ্ধতির পরিবর্তে শুকনা নিম পাতার গুঁড়া পানিতে মিশিয়েও ব্যবহার করা যায়। এক্ষেত্রে ৩০ মিনিট রেখে শ্যাম্পু করে ফেলাই যথেষ্ট।

মেথি, শিকাকাই, ব্রাহ্মী, রিঠা- এগুলো সবই চুল পড়া রোধ করার জন্য প্রকৃতির আশীর্বাদ। তবে এক টেবিল চামচের অর্ধেক ঘৃতকুমারীর জেলের সাথে তিন টেবিল চামচ নারিকেল তেল ও দুই টেবিল চামচ মধুর মিশ্রণ চুল পড়া কমাতে বেশ উপকারি। সবগুলো উপাদান একসাথে মিশিয়ে পাতলা তরল মিশ্রণ করে নিতে হবে। এই পাতলা মিশ্রণ মাথার ত্বকে লাগিয়ে ৩০ মিনিট পরে কুসুম গরম পানি দিয়ে শ্যাম্পু করে ফেলাই যথেষ্ট। সপ্তাহে দুইবার এই মিশ্রণ ব্যবহার করা যেতে পারে।

সাদা চুল

source: aklat.net

বার্ধক্যের আগেই চুল সাদা হয়ে যাওয়ার সমস্যা প্রতিরোধ করার জন্যও আমলা প্রকৃতির এক অনন্য দান। আমলা গুঁড়ার সাথে মেহেদি ও তিলের তেলের মিশ্রণ চুলের স্বাস্থ্য  ধরে রাখতে যথেষ্ট সহায়ক।

উজ্জ্বল, নরম আর ঝলমলে চুল চান? গরম তেলের ম্যাসাজ করে দেখতে পারেন কিন্তু। নারিকেলের তেল, জলপাইয়ের তেল, বাদামের তেল আর ক্যাস্টর অয়েল একসাথে মিশিয়ে কুসুম গরম করে চুলে দিয়ে কিছুক্ষণ ম্যাসাজ করুন। এবার গরম তোয়ালে মাথায় জড়িয়ে রেখে দিন ৩০ মিনিট। শ্যাম্পু করার পর পার্থক্যটা নিজেই বুঝবেন। নিষ্প্রাণ চুলের প্রাণ ফিরিয়ে আনা আরেকটা প্যাক হলো ডিম, বাদামের তেল আর টক দইয়ের মিশ্রণ। দুটি ডিম, দুই টেবিল চামচ বাদামের তেল আর অর্ধেক কাপ টক দই একসাথে ভালোভাবে মিশিয়ে সমস্ত চুলে দিয়ে রাখুন ৩০ মিনিট। শ্যাম্পু করে গোসলের পরেই দেখতে পাবেন এর যাদুকরী ফলাফল।

খুশকি

source: attary1001.com

খুশকির সমস্যা নিয়ে চিন্তিত? লেবু আর নারিকেলের তেল গরম করে ৩০ মিনিট মাথার তালুতে দিয়ে শ্যাম্পু করে ফেলুন। শুকনো খুশকির সমস্যা হলে একটি বা দুটি ডিমের সাদা অংশ মাথার তালুতে দিয়ে দেখতে পারেন। জলপাইয়ের তেলও এক্ষেত্রে দারুণ কাজে লাগতে পারে। আপেল সিডার ভিনেগারও চুলে লাগিয়ে দেখতে পারেন। খুশকি থেকে মুক্তি পাওয়ার আধুনিক এই পদ্ধতিও এখন বেশ জনপ্রিয়। আপেল সিডার ভিনেগার ও সমপরিমাণ পানি একসাথে মিশিয়ে চুল ধোয়ার পরে সারা মাথায় দিয়ে রেখে দিন ১০-১৫ মিনিট। মাথায় কাঁটা-ছেঁড়া থাকলে এটি ব্যবহার করবেন না। এরপর চুল সাধারণ পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। নারিকেলের তেল, জলপাইয়ের তেল, টক দই আর মধুর মিশ্রণ তৈলাক্ত খুশকির জন্য বেশ উপকারি।

মেয়েদের বড় চুল রুক্ষ হয়ে অনেক সময় সামলানো বেশ কঠিনই হয়ে পড়ে। তাই বলে সবসময় বেঁধে রাখলেও তো চলে না। একটু নরম, সোজা, সেই সাথে সুন্দর চুল তাই অনেক মেয়েরই কাম্য। ২ টেবিল চামচ মধুর সাথে অর্ধেক কাপ দুধ মিশিয়ে পাতলা মিশ্রণ তৈরী করে তা মাথার ত্বকসহ সারা চুলে লাগিয়ে ২০ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন। এই দুটি উপাদানই চুলে প্রাকৃতিক আর্দ্রতা ফিরিয়ে এনে আপনাকে উপহার দেবে আপনার পছন্দের নরম, সোজা চুল।

চুল গজানো

শুধু চুল পড়া রোধ করতে ব্যবস্থা নিলেই শেষ না, প্রয়োজন নতুন চুল গজানোও। ক্যাস্টর অয়েল ভিটামিন ই ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড দ্বারা পূর্ণ থাকায় তা চুলের বৃদ্ধি ও নতুন চুল গজানো ত্বরান্বিত করে। ক্যাস্টর অয়েল ও সমপরিমাণ অন্য যেকোনো তেল (নারিকেল, বাদাম বা জলপাইয়ের তেল) মিশিয়ে গোসলের এক-দেড় ঘন্টা আগে মাথার ত্বক ও বাকি চুলে লাগিয়ে ভালো কোনো শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন। এই তেলের মিশ্রণে এসেনশিয়াল ওয়েল (বাজারে পাওয়া যায়) যোগ করলে আরো ভালো ফলাফল পাবেন। ডিম ও পেঁয়াজের রসও নতুন চুল গজানোর জন্য কাজে লাগে।

আগা ফেটে যাওয়া

source: lebanon24.com

চুলের আগা ফেটে যাওয়া মেয়েদের মধ্যে চুলের প্রধান সমস্যাগুলোর একটা। একটু বড় করতে গেলেই প্রায় সব মেয়েই এই সমস্যার সম্মুখীন হয়। পাকা পেঁপের কিন্তু এই সমস্যা রোধ করার ক্ষেত্রে বেশ সুনাম রয়েছে। পেঁপেতে প্রায় সকল প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ উপাদান থাকায় চুলকে পুষ্টি জুগিয়ে এটি আস্তে আস্তে চুলের আগা ফাটা কমিয়ে দেয়। প্রায় দেড় কাপ খোসা ছাড়ানো ও বীজ ছাড়া পাকা পেঁপে ও অর্ধেক কাপ টক দই ভালো করে মিশিয়ে প্রায় তরল বানিয়ে ফেলুন। গোসলের প্রায় ৪৫ মিনিট বা এক ঘন্টা আগে চুলে লাগিয়ে গোসলের সময় ভালোভাবে ধুয়ে ফেলুন। দৃশ্যমান ফলাফলের জন্য সপ্তাহে অন্তত একবার এই প্যাকটি ব্যবহার করুন।

এসকল মিশ্রণের পরিমাণ ও উপাদানের অনুপাত মাঝারি পরিমাপের চুলের জন্য দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তিভেদে চুলের পরিমাপ আলাদা হওয়ার কারণে তা প্রয়োজন মতো কম-বেশি করে নিতে হবে। তাছাড়া উপরে উল্লিখিত সকল ঘরোয়া সমাধানই প্রাথমিক পর্যায়ে চুলের সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। কিন্তু প্রাথমিকভাবে ঘরোয়া চর্চায় যদি ব্যক্তি লাভবান না হন, তবে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়াই উত্তম পন্থা।

লেখা শেষ করার আগে যেকোনো উৎসবে কাজে লাগার মতো চুল ঝলমলে আর প্রাণবন্ত লাগার একটি পদ্ধতির কথা বলে যাই। লেবুর খোসার কয়েক টুকরো বিশুদ্ধ পানিতে দিয়ে ১৫ মিনিট ফুটিয়ে নিন। এরপর ঠান্ডা করে তাতে কয়েক ফোঁটা এসেনশিয়াল অয়েল যোগ করে ভালোভাবে মিশিয়ে একটি স্প্রে বোতলে ফ্রিজের নরমালে সংরক্ষণ করুন। কোনো উৎসবে বা দাওয়াতে যাওয়ার আগে একদম শেষে এটি চুলে স্প্রে করে নিন। ছেলে-মেয়ে উভয়ই এটি ব্যবহার করতে পারেন। চুলের চেহারায় জাদুকরী পরিবর্তনটা নিজেই দেখতে পাবেন।

ফিচার ইমেজ: unitedhindi.com

Related Articles

Exit mobile version