স্মার্টফোন আর মোবাইলের যুগে সময়ের হিসাব রাখার জন্য ঘড়ির প্রয়োজনীয়তা সামান্যই। তবুও ফরমাল লুক তৈরি করতে ঘড়ির কোনো বিকল্প নেই। বর্তমানে ঘড়ি সময়ের হিসাব রাখার যন্ত্রের চাইতে আভিজাত্য, শখ এবং ফ্যাশনের অনুষঙ্গ হিসেবেই অধিক পরিচিত। মাত্র কয়েকশো টাকা থেকে শুরু করে ঘড়ির দাম হতে পারে আমার-আপনার কল্পনারও বাইরে। এই বিষয়ে সামান্যতম আগ্রহী মানুষের মনেও প্রশ্ন আসতে বাধ্য – কেন একটি ঘড়ির দাম এমন অবিশ্বাস্য রকমের বেশি?
ব্র্যান্ড
যে যা-ই বলুক ঘড়ির দাম নির্ধারণে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড মূল্য। কাউকে সবচেয়ে দামি ঘড়ির ব্র্যান্ড কোনটি জিজ্ঞাসা করলে অধিকাংশই বলবেন রোলেক্সের কথা। উত্তরে খুব বেশি ভুল নেই। কারণ সবচেয়ে অভিজাত ১০টি ব্র্যান্ডের তালিকায় অবশ্যই রোলেক্সের (Rolex) নাম থাকবে। ১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত সুইস এই কোম্পানি টেনিস, গলফের মতো অভিজাত খেলার সাথে নিজেদের নাম সম্পূরক করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়াও অসংখ্য বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের রোলেক্স ঘড়ি ব্যবহার তাদের ব্র্যান্ডের মূল্য বৃদ্ধি করেছে বহুগুণে।
তবে সবথেকে বিখ্যাত এবং দামি ঘড়ির নির্মাতা বললে অবশ্যই সবার আগে নাম আসবে প্যাটেক ফিলিপের (Patek Philippe)। ১৮৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সুইস কোম্পানির সবথেকে কম দামি ঘড়ির জন্যও আপনাকে খরচ করতে হবে প্রায় ১০,০০০ মার্কিন ডলার। এছাড়াও ভ্যাসুরন কনস্টান্টিন (Vacheron Constantin), এলাঙ্গে অ্যান্ড জুনা (A. Lange & Sohne), আই.ডব্লিউ.সি (I.W.C), ব্রিগেটস (Breguets), জেগার লেকুত (Jaeger- leCoultre), ওমেগা (Omega), ব্লংপান (Blancpain), অদ্রেমার পিঁগে (Audremars Piguet) ব্র্যান্ডগুলো শীর্ষ ১০ এ জায়গা করে নেবে।
মুভমেন্ট বা চালিকা শক্তি
মুভমেন্ট বা চালিকা শক্তির উপর নির্ভর করে ঘড়িকে সাধারণত ২ ভাগে ভাগ করা যায়। যা হচ্ছে যথাক্রমে কোয়ার্টজ বা ইলেকট্রিক্যাল মুভমেন্ট এবং মেকানিক্যাল মুভমেন্ট। আমাদের পরিচিত অধিকাংশ ঘড়ি (দেয়াল ঘড়ি থেকে শুরু করে অধিকাংশ কম বাজেটের ঘড়ি) কোয়ার্টজ বা ইলেকট্রিক্যাল মুভমেন্ট দ্বারা পরিচালিত। এই ধরনের মুভমেন্টে ব্যাটারির বিদ্যুৎ শক্তি একটি ছোটো মোটরকে শক্তি যোগায় যা ঘড়ির কাঁটাগুলোর সঞ্চালনে ভূমিকা পালন করে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আবিষ্কৃত এই কোয়ার্টজ মুভমেন্ট ঘড়ির দামকে সর্বসাধারণের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
কোয়ার্টজ ঘড়ি মেকানিক্যাল ঘড়ির থেকে অনেক বেশি নির্ভুল এবং দামের দিক থেকেও (সাধারণত) অনেক সাশ্রয়ী হলেও ঘড়ি সংগ্রহক হতে চাইলে মেকানিক্যাল ঘড়ি না থাকলে আপনার সংগ্রহ কখনই সম্পূর্ণ হবে না। মেকানিক্যাল ঘড়ি সঞ্চিত শক্তি থেকে সময়ের হিসাব রাখে। এর ভিতর কোনো ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রাংশ থাকে না। মেকানিক্যাল ঘড়ি না বলে একে ‘দম দেওয়া ঘড়ি’ বললে অনেকের কাছে চিনতে সুবিধা হতে পারে।
বিংশ শতাব্দীর আগে ঘড়ি বোঝালে এই মেকানিক্যাল ঘড়িকেই বোঝানো হতো। ঘড়ির কোনো হাতল (যা ঘড়ির ক্ষেত্রে ক্রাউন নামে পরিচিত) ঘুরিয়ে ঘড়িকে দম (watch winding) দেওয়া হতো। মেকানিক্যাল ঘড়ির প্রস্তুত প্রক্রিয়া ইলেকট্রিক্যাল ঘড়ির থেকে অনেক জটিল তবে যথাযথ যত্ন নিতে পারলে একটি মেকানিক্যাল ঘড়ি হতে পারে আপনার সারা জীবনের সঙ্গী।
বর্তমানে অটোমেটিক ঘড়ি খুব জনপ্রিয় যা মেকানিক্যাল ঘড়িরই আরেকটি প্রকার। এইসব ঘড়িকে আলাদা করে দম দেওয়া লাগে না বরং ঘড়িগুলো এমনভাবেই প্রস্তুত করা হয় যে, আপনার হাতে থাকার সময় হাতের সামান্য নাড়াছাড়াতেই তা শক্তি সঞ্চয় করে এবং পরবর্তীতে স্প্রিঙের সাহায্যে দীর্ঘ সময় (বিশ ঘণ্টা থেকে অনেক সময় শতাধিক ঘণ্টা পর্যন্ত) গতিশীল থাকে।
কমপ্লিকেশন
সময় দেখা ছাড়া একটি ঘড়িতে আর যা যা করা সম্ভব (Additional Features) তাকে ঘড়ির কমপ্লিকেশন (Complication) বলা হয়। আপনার হাতের ঘড়িটি যদি সময়ের পাশাপাশি তারিখও দেখাতে পারে তাহলে সেটিও ঘড়ির একটি কমপ্লিকেশন। অধিক কমপ্লিকেশন সংখ্যা ঘড়ির দাম বাড়িয়ে দিতে পারে বহুগুণে। সবচেয়ে বেশি কমপ্লিকেশন সম্পন্ন ঘড়ির কথা বলতে গেলে ভ্যাসুরন কন্সতান্তিনের রেফারেন্স ৫৭২৬০ মডেলটির কথা নাম আসবে। এই ঘড়িটি ২৮০০টি আলাদা আলাদা যন্ত্রাংশের সমন্বয়ে গঠিত। জানলে অবাক হবেন যে, ঘড়িটিতে ৫৭টি ভিন্ন ভিন্ন কমপ্লিকেশন আছে। এই রকম একটি ঘড়ির মালিক হতে চাইলে আপনার ব্যাংকে কমপক্ষে ৮০ লক্ষ মার্কিন ডলার থাকতে হবে।
মুভমেন্টের প্রকার
ঘড়ির মূল চালিকা শক্তির ধরনের উপর ভিত্তি করে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের কথা জানা গেলো। কিন্তু ভেতরের যন্ত্রাংশের ডিজাইন, ধরন, যন্ত্রাংশের আলাদা আলাদা কম্পাংক আর বিভিন্ন বিষয়ের উপর ভিত্তি করে কোয়ার্টজ, মেকানিক্যাল এবং অটোমেটিক ঘড়িকে আরও অনেক ভাগে ভাগ করা যায়। সবার কাছে ঘড়ির ভিতরের যন্ত্রাংশের এত খুঁটিনাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে না হলেও ঘড়ির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এবং অনেক সংগ্রহকের কাছে তা যথেষ্ট তাৎপর্য বহুল।
ঘড়ির শীর্ষ নির্মাতাদের কাছে মেকানিক্যাল ঘড়ির নির্মাণ একটি আর্ট। আর জটিল ঘড়ির (Complex Watch) নির্মাণ তাদের কাছে শ্রেষ্ঠত্বের পাশাপাশি মর্যাদার মাপকাঠি হিসাবেও ভূমিকা পালন করে। সবচেয়ে বেশি কমপ্লিকেশন থাকার পাশাপাশি উপরে বর্ণিত ভ্যাসুরন কনস্টান্টিনের রেফারেন্স ৫৭২৬০ মডেলটি একই সাথে বিশ্বের সবচেয়ে জটিল ঘড়িও।
শীর্ষ ব্র্যান্ডগুলো তাদের নিজেদের মুভমেন্ট সিস্টেম ব্যবহার করলেও অনেক বড় বড় নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তৃতীয় পক্ষের নির্মাণ করা মুভমেন্ট সিস্টেম ব্যবহার করে। অন্যতম দামি মুভমেন্ট সিস্টেমের মধ্যে ই.টি.এ এর নির্মিত ভ্যালজুক্স ৭৭৫০ মুভমেন্ট (যা ওমেগার কিছু ঘড়িতে ব্যবহৃত), লেমানিয়ার লেমানা ২৩১০ মুভমেন্ট (যা বিশ্ব বিখ্যাত প্যাটেক ফিলিপের কিছু ঘড়িতে ব্যবহৃত), আই.ডব্লিউ.সি ক্যালিবার ৫০০০ এর নাম উল্লেখ করতে হবে (উল্লেখিত সকল মুভমেন্ট মেকানিক্যাল ঘড়িতে ব্যবহৃত)।
এ ছাড়াও বিভিন্ন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব মুভমেন্ট সিস্টেম ব্যবহার করে থাকেন যা ‘ইন হাউস মুভমেন্ট’ নামে পরিচিত। ইন হাউস মুভমেন্ট মূল্য নির্ধারণে ভূমিকা রাখার সাথে সাথে নির্মাতাদের মর্যাদার একটি মাপকাঠি।
পারপেচুয়াল ক্যালেন্ডার
অনেক ঘড়ি সময়ের সাথে সাথে তারিখ এবং দিনের হিসাবও দেখাতে পারে যা ঘড়ির সিম্পল কমপ্লিকেশনগুলোর মধ্যে অন্যতম। আপনার ঘড়ি যদি সাধারণ কোনো ঘড়ি হয় আর তাতে যদি এই সুবিধা থাকে তাহলে বছরে আপনাকে কমপক্ষে ৫ বার তারিখ এবং দিনের হিসাব বদল করতে হবে (কারণ বছরের ৭টি মাস ৩১ দিনে আর ৪টি মাস ৩০ দিনে আর ফেব্রুয়ারি তো আছেই)।
তবে আপনার ঘড়িটি যদি হয় ডিজিটাল ঘড়ি তাহলে তারিখ আর দিনের হিসাব সেটা নিজেই রাখতে পারবে। ডিজিটাল ঘড়িতে ছোট চিপ ব্যবহৃত হয় যাতে কোন মাস ৩০ এবং কোন মাস ৩১ দিনের তার হিসাব তো থাকেই সাথে সাথে অধিবর্ষের হিসাব পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু অ্যানালগ ঘড়ির ক্ষেত্রে এইসব তথ্য সংরক্ষণ করা তুলনামূলক কঠিন।
কোয়ার্টজ ঘড়িতে অনেক ইলেকট্রিক্যাল চিপ ব্যবহার করা হয় যার সাহায্যে দিন তারিখের নির্ভুল হিসাব রাখা সম্ভব। কিন্তু মেকানিক্যাল ঘড়িতে এই বৈশিষ্ট্যটি অর্জন অত্যন্ত জটিল এবং তার জন্য এইসব ঘড়ির দাম হতে পারে আকাশ ছোঁয়া। অধিবর্ষ থেকে শুরু করে মাস দিন তারিখের হিসাব সঠিকভাবে রাখতে পারা এই ঘড়িগুলো পারপেচুয়াল ক্যালেন্ডার (perpetual calendar) ঘড়ি নামে পরিচিত।
উপকরণ
বলা বাহুল্য, নির্মাণ উপকরণ ঘড়ির দাম নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনেক আগে থেকেই ঘড়িতে প্লাটিনাম, সোনার মতো মূল্যবান ধাতুর ব্যবহার হয়ে আসছে যার সাথে হীরা পান্নার মতো মূল্যবান পাথরের ব্যবহার ঘড়ির মূল্যকে বহুগণ বাড়িয়ে দিতে পারে।
শীর্ষ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের জনপ্রিয় মডেলের ঘড়িগুলোর প্লাটিনাম, সোনার অথবা অন্য মূল্যবান পাথরের তৈরি সীমিত সংস্করণ বের করে; যার মূল্য একই মডেলের অন্য ঘড়িগুলোর থেকে অনেক বেশি হতে পারে। দামি ধাতু ছাড়াও রোলেক্স তাদের ঘড়িতে বিশেষ ধরনের স্টিল ব্যবহার করে যার গঠন প্রকৃতি তারা কঠোরভাবে গোপন রাখে। তাদের দাবি অনুসারে, এই স্টিল সাধারণ স্টেইনলেস স্টিলের থেকেও অনেক বেশি ক্ষয়রোধী এবং ঘাত সহনশীল।
সীমিত সংস্করণ
সীমিত সংস্করণগুলো সবসময় মূল্যবান ধাতু অথবা পাথরের নির্মিত না হলেও তাদের অসাধারণত্ব এবং স্বল্পতা তাদের অস্বাভাবিক মূলের কারণ হতে পারে। ২০১৬ সালে জেনেভা ওয়াচ অকশনে সাধারণ স্টিল ক্যেসিং এর প্যাটেক ফিলিপ রেফারেন্স ১৫১৮ ঘড়িটি প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ ডলারে বিক্রয় হয়েছিল। ঘড়িটির এই অস্বাভাবিক মূলের কারণ ঘড়িটি প্যাটেক ফিলিপের ‘দি অরিজিনালস’ সিরিজের অংশ যা এখন পর্যন্ত ৪টি নির্মিত হয়েছে। প্রথম ঘড়িটি নিলামে বিক্রি করা হয়।
নির্মাণকাল
নির্মাণকাল ঘড়ির মূল্য নির্ধারণে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি। শুনলে অবাক হবেন যে, রোলেক্সের দাবি অনুসারে একটি রোলেক্স ঘড়ি নির্মাণ করতে গড়ে সময় লাগে ১ বছর। আর প্যাটেক ফিলিপের দাবি তাদের সাধারণ ঘড়ি নির্মাণে গড়ে সময় লাগে ৪ বছর, জটিল ঘড়ির ক্ষেত্রে সময়কাল ৬ বছর এবং অতি জটিল (Very Complicated) ঘড়ি নির্মাণে সময় লাগে ৮ বছর। উদাহরণস্বরূপ প্যাটেক ফিলিপ গ্র্যান্ডমাস্টার কাইম ঘড়িটির কথা বলা যায়। ২৬ লক্ষ ডলার মূল্যের হাতে নির্মিত এই ঘড়িটি নির্মাণে প্যাটেক ফিলিপের সময় লাগে ১,০০,০০০ ঘণ্টা।
ইতিহাস
ঘড়ির নির্মাণকাল, নিজস্ব ইতিহাস আবার অনেক সময় বিখ্যাত মানুষের সংগ্রহে থাকার মতো ঘটনাও ঘড়ির দাম নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পারে। উদাহরণ হিসাবে ব্রিগেটের গ্র্যান্ড কমপ্লিকেশন মেরি এন্তোয়নেট ঘড়িটির কথা বলতেই হয়।
ঘড়িটি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দামি পকেট ঘড়ির মর্যাদা লাভ করছে (৩ কোটি মার্কিন ডলার)। ফরাসি রানী মেরি এন্তোয়নেট, আব্রাহাম লুই ব্রিগেটকে ১৭৮২ সালে এই ঘড়ি নির্মাণের দায়িত্ব দেন। আব্রাহামের পুত্র ১৮২৭ সালে এই ঘড়ির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। রানী এন্তোয়নেট ঘড়িটি দেখে যেতে পারেননি কারণ ঘড়ির কাজ সম্পন্ন হওয়ার ৩৪ বছর পূর্বেই তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। বিশ্বের সবথেকে দামি ঘড়িগুলোর মধ্যে এই ঘড়িটি ৩য় স্থানে অবস্থান করছে।
মূলত এই বিষয়গুলোই ঘড়ির অকল্পনীয় দামের পেছনে মূল ভূমিকা রাখে।