ভয় পাওয়া মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। ভয়ানক কিছু দেখলে কিংবা ভয়ংকর কোনো পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে মানুষ ভয় পাবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে ব্যক্তিভেদে মানুষের মধ্যে বিশেষ ধরনের কিছু ভয় বিরাজ করে। এই যেমন ধরুন, তেলাপোকা ভয় পাওয়া। ঘরের মধ্যে তেলাপোকা দেখলে আপনি হয়তো মারতে উদ্যত হবেন। কিন্তু আপনার পাশের কেউ একজন এই তেলাপোকা দেখলেই ভয়ে লাফিয়ে উঠতে পারে।
এবার একটি ভিন্ন ধরনের ভয় নিয়ে কথা বলি। অনেকে উড়োজাহাজে চড়তে ভয় পান। যারা নিয়মিত উড়োজাহাজে যাতায়াত করতে অভ্যস্ত, তারা হয়তো ব্যাপারটি লক্ষ্য করে থাকবেন। কিছু যাত্রী থাকেন, যারা উড়োজাহাজ উড্ডয়নের জন্য প্রস্তুত হলে অনবরত প্রার্থনা করতে থাকেন। এই ভয় কখনো অন্য যাত্রী, আবার কখনো এয়ার হোস্টেসদের বিরক্তির কারণ হতে পারে।
এই যে দুই রকমের ভয়ের কথা আলোচনা করা হলো, এগুলোকে ফোবিয়া বলে। উড়ন্ত ও কিলবিল করা তেলাপোকাকে ভয় পাওয়া অনেকের কাছে যুক্তিসঙ্গত লাগতে পারে। তবে বেশিরভাগ ফোবিয়াই অমূলক। কারণ, যে জিনিসটাকে ভয় করা হচ্ছে, তা কিন্তু আমাদের কোনো ক্ষতি করে না।
এই লেখাটিতে আমরা একটি বিশেষ ধরনের ফোবিয়া নিয়ে আলোচনা করবো। এই ফোবিয়ার নাম ভিনাস্ট্রাফোবিয়া। তবে তার আগে ফোবিয়া সম্পর্কে আরেকটু বিস্তারিতভাবে জানা যাক।
ফোবিয়া বলতে আসলে কী বোঝায়
ফোবিয়া শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘ফোবোস’ থেকে। এর অর্থ ভয়। কোনো নির্দিষ্ট বস্তু, পরিস্থিতি বা কোনো ব্যক্তিকে ভয় পাওয়াকে ফোবিয়া বলে। এই ফোবিয়া মূলত তিন প্রকার। এগুলো হলো সোশ্যাল ফোবিয়া, স্পেসিফিক ফোবিয়া ও অ্যাগোরাফোবিয়া। সোশ্যাল ফোবিয়া বিভিন্ন সামাজিক ঘটনার সাথে জড়িত। স্পেসিফিক ফোবিয়া আসে কোনো নির্দিষ্ট বস্তু বা ঘটনাকে কেন্দ্র করে। আর অ্যাগোরাফোবিয়া বলতে সেই সকল ভয়ংকর পরিস্থিতিকে বোঝায়, যা থেকে চাইলেই বের হয়ে আসা যায় না বা যেখান থেকে বেরিয়ে আসা লজ্জাজনক।
সারা পৃথিবীতে অনেক ধরনের ফোবিয়ার অস্তিত্ব রয়েছে। ব্রিটিশ জার্নাল অফ সাইকিয়াট্রি তাদের ১৯৯৮ সালে করা জরিপ থেকে বেশ কিছু প্রচলিত ফোবিয়ার তালিকা তৈরি করে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যাক্রোফোবিয়া বা উচ্চতার ভয়, অ্যারোফোবিয়া বা উড়োজাহাজে যাতায়াতের ভয়, অ্যারাকনোফোবিয়া বা মাকড়সার ভয়, হিমোফোবিয়া বা রক্ত ভয় পাওয়া। এরকম আরো অনেক অদ্ভুত ফোবিয়া এই তালিকায় রয়েছে।
আমরা এখানে আলোচনা করবো এমনই এক অদ্ভুত ফোবিয়া নিয়ে। ফোবিয়াটি অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হলেও আমাদের আশেপাশেই এই ফোবিয়ায় আক্রান্ত মানুষ চলাফেরা করেন।
ভিনাস্ট্রাফোবিয়ার উৎপত্তি ও সংজ্ঞা
ভিনাস্ট্রাফোবিয়া মানে হলো সুন্দরী মেয়েদের ভয় পাওয়া। এই ফোবিয়ার নামকরণ করা হয়েছে রোমান দেবী ভেনাস থেকে। ভেনাসকে প্রেমের দেবী বলা হয়। এছাড়াও তাকে যৌনতা ও সৌন্দর্যের দেবী হিসেবেও দাবি করা হয়। ফোবিয়ার তিনটি প্রকারভেদ সম্পর্কে আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি। ভিনাস্ট্রাফোবিয়া এগুলোর মধ্যে স্পেসিফিক ফোবিয়ার কাতারে পড়ে। একে ক্যালিগাইনিফোবিয়াও বলা হয়ে থাকে।
মানুষ স্বভাবগত দিক থেকেই সুন্দরের পূজারী। আর সুন্দরী মেয়েদের প্রতি সকলের এক আলাদা আকর্ষণ কাজ করে। তবে ভিনাস্ট্রাফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। এরা আকর্ষণীয় নারীদের আশেপাশে থাকতে একধরনের ভয় ও অস্বস্তি বোধ করে। এই অমূলক ভয়ের কারণে তারা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নারীদের সঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
ভিনাস্ট্রাফোবিয়াকে গাইনোফোবিয়ার অংশ হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। গাইনোফোবিয়া বলতে সকল মেয়েদের ভয় পাওয়াকে বোঝায়। তবে খুবই অল্প সংখ্যক মানুষ এই দুই ফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়। এরকম ফোবিয়ায় আক্রান্ত মানুষ অনেক হীনম্মন্যতায় ভোগে। সুন্দরী মেয়েদের সামনে দাঁড়ালে তারা নিজেদের শরীর ও মনের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না। তারা সত্যিকার অর্থেই অসুস্থ বোধ করে। নিজেদের অনুভূতির উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারায় তাদের চোখে-মুখে অস্বস্তির চিহ্ন ফুটে ওঠে। দ্রুত নিঃশ্বাস নেওয়া, অনবরত ঘামতে থাকা ইত্যাদি তাদের মাঝে দেখা দেয়।
কারণ
কারো মাঝে একটি ফোবিয়া সৃষ্টি হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ কাজ করে। পূর্বে ঘটে যাওয়া কোনো খারাপ অভিজ্ঞতা এই অমূলক ভয়কে ট্রিগার করতে পারে। আবার এর পেছনে জেনেটিক বা বংশগত কারণও দায়ী। পূর্বপুরুষদের কারো কোনো মানসিক রোগ বা অন্য কোনো ফোবিয়া থাকলে তা থেকে এই রোগের উৎপত্তি ঘটতে পারে। তবে বেশিরভাগ স্পেসিফিক ফোবিয়ার কিছু নির্দিষ্ট ঘটনাকে কেন্দ্রীভূত করে আবির্ভাব ঘটে।
একজন ব্যক্তির অতীত জীবনে সুন্দরী মেয়েদের সাথে কোনো খারাপ অভিজ্ঞতা, যেমন– হৃদয়ভঙ্গ হওয়া, জনসম্মুখে কোনো আকর্ষণীয় মেয়ের দ্বারা অপমানিত হওয়া ইত্যাদি মনে স্থায়ী আঘাত হানতে পারে। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এক্ষেত্রে অনেক প্রভাব ফেলতে পারে। একজন ব্যক্তি কেমন পরিবেশে বড় হয়েছে তার সাথে এই ফোবিয়ার যোগসূত্র তৈরি করা যায়।
আগে থেকে থাকা কোনো মানসিক রোগ, যেমন- অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার, জেনারালাইজড এংজাইটি ডিজঅর্ডার কিংবা অন্য কোনো এংজাইটি ডিজঅর্ডার থেকে এই ফোবিয়া আসতে পারে। এরকম কিছু মানসিক ডিজঅর্ডার ও অতীত খারাপ অভিজ্ঞতা একসাথে হানা দিলে এই অদ্ভুত ফোবিয়ার শিকার হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
একজন ভিনাস্ট্রাফোবিককে যেভাবে চিনবেন
যে ব্যক্তির ভিনাস্ট্রাফোবিয়া রয়েছে তাকে ভিনাস্ট্রাফোবিক বলে। সাধারণ মানুষজনের সাথে তাদের আচরণ ও সুন্দরী মেয়েদের সামনে তাদের আচরণের মাঝে বিস্তর পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এর পেছনে কী কী কারণ কাজ করে তা আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এগুলোর দরুণ একজন ভিনাস্ট্রাফোবিকের মস্তিষ্কে নানা রাসায়নিক ক্রিয়া ঘটতে থাকে। এগুলো তার ভাবভঙ্গি থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
যে লক্ষণগুলো সচরাচর একজন ভিনাস্ট্রোফোবিকের মাঝে দেখা যায় তা নিচে উল্লেখ করা হলো:
১) মেয়েদের সামনে প্রচন্ড অস্বস্তি বোধ করা।
২) সুন্দরী মেয়েদের চিন্তা মাথায় আসলে ইতঃস্তত বোধ করা।
৩) তাদের সাথে বাধ্য হয়ে কথা বলতে হলে ঘামতে থাকা, চোখে-মুখে এক ধরনের অনীহা ফুটে ওঠা।
৪) আকর্ষণীয় মেয়েরা থাকতে পারে এমন জায়গা পরিত্যাগ করা।
৫) অকারণে হীনম্মন্যতা ও লজ্জা অনুভব করা।
৬) নিজেকে একঘরে করে রাখা।
মূলত আগে থেকে ওসিডি বা জিএডি নামক মানসিক রোগ থাকা মানুষের মাঝে এই ফোবিয়া থাকার সম্ভাবনা বেশি। আসলে ফোবিয়া নিয়ে আমরা খুব একটা মাথা ঘামাই না। তবে এই ফোবিয়া কারো সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপনকে বাধাগ্রস্ত করলে অবশ্যই ভালো কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হতে হবে।
ভিনাস্ট্রাফোবিয়ার চিকিৎসা
সাধারণত ফোবিয়াগুলোর সরাসরি কোনো চিকিৎসা নেই। তবে এগুলো মানসিক রোগের সাথে সম্পর্কিত হওয়ায় কিছু মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের নিকট থেকে বিভিন্ন থেরাপি নেওয়া যেতে পারে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো টক থেরাপি ও এক্সপোজার থেরাপি। টক থেরাপির মধ্যে একটি হলো কগনিটিভ বিহেভিয়রাল থেরাপি (সিবিটি)। এই থেরাপির মাধ্যমে রোগী কোনো থেরাপিস্টের সাথে নিয়ম মেনে কথাবার্তা বলেন। নানা বিষয়ে খোলাখুলি কথাবার্তার মাধ্যমে তিনি নিজের ব্যবহার ও চিন্তা-ভাবনায় পরিবর্তন আনতে চেষ্ঠা করেন।
এক্সপোজার থেরাপি বলতে সরাসরি নিজের ভয়ের মুখোমুখি হওয়াকে বোঝায়। সুন্দরী মেয়েরা সচরাচর যেসব জায়গায় যায় সেখানে গিয়ে স্বেচ্ছায় নিজের ভয়ের মোকাবিলা করতে হয়। এভাবে চেষ্টা করতে থাকলে আস্তে আস্তে এই ফোবিয়া কেটে যেতে পারে।
এন্টি–ডিপ্রেসেন্ট বা অন্য কোনো ধরনের ওষুধও ফোবিয়ার চিকিৎসা হতে পারে। তবে এসব ওষুধ সেবনের পূর্বে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
পৃথিবীতে বহু বিচিত্র ও অদ্ভুত ফোবিয়া রয়েছে। এই যেমন ধরুন, হাইড্রোফোবিয়া। এই ফোবিয়ায় আক্রান্ত মানুষ আক্ষরিক অর্থেই পানিকে ভয় পায়। তারা পানি সহ্য করতে পারে না। প্যাপিরোফোবিয়ায় আক্রান্ত মানুষ কাগজ ভয় পায়। স্কোলিওনোফোবিয়ায় আক্রান্ত মানুষ স্কুলে যেতে ভয় পায়।
এরকম অদ্ভুত ফোবিয়াগুলোর তালিকা বলে শেষ করা যাবে না। ভিনাস্ট্রাফোবিয়া এসব অদ্ভুত ফোবিয়ার কাতারেই পড়ে। তবে সব রোগের মতো এই রোগগুলোরও চিকিৎসা রয়েছে। তাই চিকিৎসার ব্যাপারে অনীহা না দেখিয়ে দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত।