সে যুগে সিভিল সার্ভিসে যাওয়া খুব সহজ ছিল না। মহারানী ভিক্টোরিয়া সিভিল সার্ভিসকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত সবার জন্য উন্মুক্ত করলেও রিক্রুটমেন্ট পরীক্ষা হতো শুধু লন্ডনে। তাই মেধা থাকা সত্ত্বেও অনেকেই অর্থাভাবে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিতে পারেনি। তার উপর পরীক্ষার সিলেবাসও ছিল একপেশে। ১৮৫৩-তে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস বা আইসিএস সবার জন্যে উন্মুক্ত হলেও প্রথম কোনো ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে উত্তীর্ণ হন তার এক দশক পরে ১৮৬৩-তে। সেই লোকটি হলেন কলকাতার ঠাকুর বাড়ির দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যম পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পৈতৃকসূত্রে বিশাল জমিদারির উত্তরাধিকারী হলেও তার ঘাড়ে এসে বর্তেছিল পিতা দ্বারকানাথ ঠাকুরের রেখে যাওয়া মোটা অঙ্কের ঋণ। সুদসমেত তখনকার বাজারেই যা এক কোটি টাকা প্রায়! দেবেন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে পিতার সব ঋণ শোধ করে আমিষ-রিপু-বিলাসিতা ত্যাগ করে ঋষিব্রত গ্রহণ করলেন। একনিষ্ঠভাবে আধ্যাত্মিক চর্চায় ও ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হলেন। মহর্ষির প্রভাব তার মেঝ পুত্রের উপরে বিশেষভাবে পড়ল। বাল্যকাল থেকেই ধীমান সত্যেন্দ্রনাথকে দেওয়া হয় সংস্কৃত ও আরবির পাঠ। পাশাপাশি চলে ঠাকুরবাড়ির পরম্পরা অনুযায়ী কুস্তি ও ঘোড়দৌড় শিক্ষা। অগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথ ও গণেন্দ্রনাথের (খুড়তুতো) সাথে তার এ শিক্ষা চলত হরদিন সকালে ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়।
বাল্য পেরিয়ে কৈশোরে আগমন। হিন্দু স্কুলে পড়ার সময় এক বছর প্রতিযোগিতায় পুরষ্কার পেলেন রবিনসন ক্রুসোর বই। আরেকবার তো গোল্ডস্মিথ পুরো সেটটাই। তারপর ১৮৫৭ তে কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের এখতিয়ারে এন্ট্রাস (বর্তমানের এসএসসি) পরীক্ষা শুরু হল। সত্যেন্দ্রনাথ হিন্দু কলেজ থেকে পরীক্ষা দিয়ে প্রথম বিভাগে পাস করলেন। একই ব্যাচে পরীক্ষা দিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে।
বঙ্কিমচন্দ্রও প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি পরবর্তীতে স্ট্যাটুইটরি সিভিল সার্ভিসে নির্বাচিত হয়ে ডেপুটি কালেক্টর হয়েছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেন। সেখানে তিনি পেলেন তার জীবনের অন্যতম মহত্ত্বপূর্ণ সঙ্গী কেশবচন্দ্র সেনকে। সমরুচি সম্পন্ন ও সমমনা হওয়ায় দুজনের ভাব হতে বেশি সময় লাগল না। কথায় কথায় সত্যেন্দ্রনাথ জানতে পারলেন কেশব তার পারিবারিক গুরুদেবের কাছে দীক্ষা না নেওয়ায় বাড়ি থেকে তার উপর খুব চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। সত্যেন্দ্রনাথ কেশবকে বাবা দেবেন্দ্রনাথের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরে কেশবচন্দ্র সস্ত্রীক দেবেন্দ্রনাথের বাড়িতে এসে আশ্রিত হন। মননশীল এ দুটি প্রাণ দেবেন্দ্রনাথের দুটি হস্তে পরিণত হয়। ব্রাহ্মধর্মের প্রতি অনুরাগী হয়ে পিতার সাথে সত্যেন্দ্রনাথ ও কেশবচন্দ্র কৃষ্ণনগরে ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে সঙ্গী হন। বাঙালি নবজাগরণের অন্যতম মার্গদর্শক কেশবচন্দ্র সেন পরবর্তীকালে ‘ব্রহ্মানন্দ’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।
এরমধ্যে পারিবারিক রীতি অনুসারে কৈশোরেই সত্যেন্দ্রনাথের বিয়ে ঠিক করা হয়। পাত্রী যশোরের মেয়ে জ্ঞানদানন্দিনী। তখন সত্যেন্দ্রনাথের বয়স সতের আর জ্ঞানদানন্দিনীর আট। নয় বছরের ফারাক! বিয়ে হয়ে জ্ঞানদার ঠাকুরবাড়িতে আসার পরেই সত্যেন্দ্রনাথ পুরোদস্তুর লেগে যান স্ত্রীর মননশীলতা, চিন্তাশীলতার বিকাশে। বিয়ের আগে থেকেই সত্যেন্দ্রনাথ নারীর শিক্ষা ও স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন।
ঠাকুরবাড়ির কোনো মেয়ের বই পড়ার শখ হলে বা পারিবারিক পশুশালা, থিয়েটারে গমনের ইচ্ছে হলে সোজা চলে যেতেন সত্যেন্দ্রনাথের কাছে। সত্যেন্দ্রনাথ নারীদের অন্তরালের বন্দিশালা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে সংস্কৃতি চর্চার কথা বলতেন যা তৎকালীন গোঁড়া সমাজের অনেকেরই ভালো লাগেনি একদম।
ঠাকুরবাড়ির রীতি ছিল কোনো পরপুরুষ অন্দরের মেয়েদের দেখতে পারবে না। পুরুষ চাকরদেরও ভেতর বাড়ির মহিলা মহলে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। সত্যেন্দ্রনাথের পরম বন্ধু মনমোহন ঘোষ বেঁকে বসলেন বন্ধুর বউকে দেখবেন বলে। কিন্তু এ কী করে সম্ভব? দুই বন্ধু মিলে এক ফন্দি আঁটলেন। দুজনে সমান তালে হেঁটে ভেতর বাড়িতে ঢুকলেন। সত্যেন্দ্রনাথ বন্ধুকে মশারির ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে নিজে এক পাশে বসে রইলেন। তিনজনে মশারির ভেতর বসে রইলেন কিছুক্ষণ, কারো মুখে একটিও কথা নেই। জ্ঞানদা দেবীকে দেখার পরে ঠিক একইভাবে সত্যেন্দ্রনাথ বন্ধুবরকে অন্দরমহলের বাইরে রেখে আসেন।
মনমোহন ঘোষ সত্যেন্দ্রনাথের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। পৈতৃকসূত্রেই ঠাকুরবাড়ির সাথে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল তার। নিয়মিত যাতায়াত ছিল। মনমোহন ঘোষের ব্যাপারে সত্যেন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘যেন একটি বোমা আকাশ থেকে পড়ে সব ভেঙে চূরে দিয়ে গেল’। মনমোহন ঘোষের উৎসাহেই তিনি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য রাজি হন।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তখন সে সামর্থ্যও নেই ছেলেকে লন্ডনে পাঠিয়ে আইসিএস এর জন্যে প্রশিক্ষিত করানোর। মনমোহন ঘোষই অর্থ সাহায্য করলেন। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্যে লন্ডনের উদ্দেশ্যে জাহাজে চেপে বসলেন দুই বন্ধু। তখন সত্যেন্দ্রনাথের বয়স মাত্র বিশ। তৎকালীন লন্ডনে সিভিল সার্ভিসের কোচিংয়ের রমরমা ব্যবসা। প্রধানত গৃহশিক্ষক হিসেবেই প্রশিক্ষকগণ প্রার্থীদের প্রশিক্ষিত করতেন। লন্ডনে গিয়ে তারা জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুরের শরণাপন্ন হলেন। জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর ছিলেন প্রথম এশীয় যিনি বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করেছিল।
হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টানিটি গ্রহণ করার কারণে তার বাবা গোঁড়া হিন্দু প্রসন্নকুমার ঠাকুর তাকে ত্যাজ্য করেছিলেন। তিনি লন্ডনের আরেক হিন্দু ধর্মত্যাগী কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জির মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। জ্ঞানেন্দ্রমোহন তাদের দুজনকে অভিজ্ঞ গৃহশিক্ষক ঠিক করে দিলেন। দুজনেই ভয়ংকর পরিশ্রম করলেন। পরের বছর ১৮৬৩ তে তারা সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসলেন। মোট ৫০ জন প্রার্থী নির্বাচিত করা হয়েছিল। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেধাক্রম হল ৪৩। মনমোহন ঘোষ উত্তীর্ণ হতে পারেননি সেবারের পরীক্ষায় তবে কলকাতার বার কাউন্সিলে তার সিলেকশন হয়ে যাওয়ার পরে তিনি আর এ মুখো হননি।
অক্সফোর্ডে এক বছর কঠোর প্রশিক্ষণের পরে সত্যেন্দ্রনাথ পরের বছর নভেম্বরে দেশে ফিরে এলেন। তার জাহাজ বঙ্গোপসাগরে এসে পৌঁছাতেই পুরো কলকাতা জুড়ে এক বিশাল নাগরিক সম্বর্ধনার আয়োজন শুরু হয়ে গেল। মাইকেল মধুসূদন দত্ত শুভেচ্ছা জানিয়ে একটি সনেট লিখলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উপস্থিতিতে বেলগাছিয়ার বাগানে বাঙালি তাদের গৌরবকে মহাসমারোহে বরণ করে নিল।
তখন সিভিল সার্ভিসে নিয়ম ছিল- মেধাতালিকায় উপরে স্থান দখলকারীদের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে এবং বাকিদের অন্যান্য প্রেসিডেন্সিতে নিয়োগ দেওয়ার। সে হিসেবে সত্যেন্দ্রনাথের নিয়োগ হল মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে। বেলগাছিয়ার মাঠে খবরটি রটে যাওয়াতে জনগণের মধ্যে ভীষণ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি তাদের শান্ত করলেন। একজন নবীন সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে তিনি সেদিন যথেষ্ট পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। তার মতে এটি ছিল ‘ন্যায্য পজিশন’।
বাড়িতে ফিরে পিতা মহর্ষির কাছে আবেদন জানালেন সস্ত্রীক বোম্বে কর্মস্থলে যাবেন। মেয়েদের বাড়ির বাইরে বের করার আবদার শুনে পুরো বাড়িতে ছি ছি রব উঠল। তবুও, মহর্ষি পুত্রের আবেদন গ্রাহ্য করলেন। কিন্তু একটি শর্তে। জ্ঞানদা দেবী সবার সামনে দিয়ে গাড়িতে চড়তে পারবে না। ঘেরাটোপ দেওয়া পালকিতে চড়ে তাকে জাহাজ পর্যন্ত যেতে হয়েছিল।
সে না হয় হলো। কিন্তু পোশাক? সে যুগে মেয়েরা শুধু একটি শাড়িই পরত। মেয়েদের অন্তর্বাস, ব্লাউজ, সায়া পরার চল ছিল না। সত্যেন্দ্রনাথ একজন ফরাসি মহিলা দর্জিকে ডেকে এনে স্ত্রীর জন্য ব্লাউজ সদৃশ পোশাক ‘ওরিয়েন্টাল’ বানিয়ে আনালেন। দেখতে সুসভ্য হলেও সেটি জ্ঞানদাদেবী একা পরতে পারতেন না। প্রতিবার পরতে ও খুলতে সত্যেন্দ্রনাথের সাহায্য নিতে হতো। সেটি পরেই সেবারের মতো বোম্বে পাড়ি দিলেন। বোম্বেতে তারা এক সম্ভ্রান্ত পারসি বাড়িতে গিয়ে ওঠেন।
এই প্রথম জ্ঞানদার কলকাতার বাইরে আসা। সেখানে নারীদের অবাধ স্বাধীনতা, পুরুষ-নারীর একত্রভোজন, উৎসব আয়োজন ও পালন দুজনকেই মুগ্ধ করল। পারসিদের সাহচর্যে জ্ঞানদা দেবী শাড়ির সঙ্গে ওরিয়েন্টাল ছেড়ে সদরা বা ব্লাউজ পরা ধরলেন। শাড়ি পরার নতুন একটি ধরনও রপ্ত করলেন। ডান কাঁধের বদলে বাম কাঁধে আঁচল ফেলে বোম্বাই শাড়ি পরার যে ধারা বাংলা মুলুকে চালু করেছিলেন তা আজও ফ্যাশনদুরস্ত বাঙালি মেয়েরা মনে রেখেছে।
নতুন সাজে নতুন ঢংয়ে দুই দম্পতি যখন পরের ছুটিতে বাড়ির দোরে গাড়ি থেকে নামলেন সে দৃশ্য দেখে শুধু ঠাকুরবাড়ি নয় পুরো কলকাতায় সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। সমালোচনার ঝড়ে বাতাস দিয়েছিল আরেকটি ঘটনা। সেই ছুটিতেই সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে জ্ঞানদাদেবী গেলেন লাট সাহেবের বাড়ি ভোজের নিমন্ত্রণে। ইংরেজ মেমদের সাথে অবাধ ও খোলামেলা মেলামেশা দেখে তাকে অনেকেই ভূপালের বেগম ভেবেছিলেন। পূর্বোল্লিখিত প্রসন্নকুমার ঠাকুরও সেই সভায় আমন্ত্রিত ছিলেন। তিনি ঠাকুরবাড়ির বৌকে এভাবে চলাফেরা করতে দেখে লজ্জায় পালিয়ে এসেছিলেন এবং পরে ধিক্কার ও শাপ-শাপান্তও করেছিলেন।
তৎকালীন বোম্বে প্রেসিডেন্সি ছিল মহারাষ্ট্র, গুজরাট ও সিন্ধু প্রদেশের কিছু অংশ নিয়ে। সত্যেন্দ্রনাথের চাকরিতে বদলি ছিল খুব সাধারণ ব্যাপার। তিনি বোম্বে প্রেসিডেন্সির আমদাবাদে অ্যাসিস্ট্যান্ট কালেক্টর ও ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদান করার পর ৩২ বছরের কর্মজীবনে পুনে, আমদাবাদ, আহমদনগর ও সাতারায় কাজ করেন। তখন আইসিএসদের সামনে কয়েকবছর চাকরির পর অপশন দেওয়া হতো জুডিশিয়াল সার্ভিসে যাওয়ার। সত্যেন্দ্রনাথ কয়েকবছর কালেক্টরি করার পর জুডিশিয়াল সার্ভিসে গমন করেন।
একসাথে সিভিল সার্ভিসে উত্তীর্ণ হওয়ার পরেও পদোন্নতির সময় ইংরেজ অফিসারদের সাথে ভারতীয় অফিসারদের ব্যাপক বৈষম্য করা হতো। দীর্ঘদিনের সার্ভিসের পরেও সত্যেন্দ্রনাথকে হাইকোর্টের জজ হিসেবে ইংরেজ সরকার নিয়োগ দেয় না। তাই, সাতারার জেলা জজের পদ থেকেই তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তিনিই ছিলেন ভারতীয়দের মধ্য থেকে প্রথম সেশন জজ।
সিভিল সার্ভেন্ট ছাড়াও সত্যেন্দ্রনাথের আরো কয়েকটি পরিচয় ছিল। সুরকার, গীতিকার, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক। ১৮৬৭ তে দেশাত্মবোধ সঞ্চারের উদ্দেশ্যে আয়োজিত হিন্দুমেলার প্রথম অধিবেশনের সময় তিনি চাকরিসূত্রে পশ্চিম ভারতে অবস্থান করছিলেন বিধায় সেবার অংশ নিতে পারেননি। পরের বছরের অধিবেশনে অংশ নিয়েছিলেন এবং মেলা উপলক্ষ্যে ‘মিলে সব ভারত সন্তান’ গানটি রচনা করেছিলেন যেটিকে অনেকে ভারতের প্রথম জাতীয় সংগীতের মর্যাদাও দিয়ে থাকে।
১৮৯৭ এ চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর নিলেও তার অবসর ছিল না। বালিগঞ্জের নিজস্ব বাড়িতে গুণীজনের ভিড় সব সময় লেগেই থাকত। চাকরি থেকে অবসরের বছরেই তিনি নাটোরে আয়োজিত দশক বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে পৌরোহিত্য করেন। পরে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতিও নির্বাচিত হন। সাহিত্য সাধনার সাথে সত্যেন্দ্রনাথ আজীবন যুক্ত ছিলেন নিষ্ঠাবান হয়ে। ছুটির অবসরে খাতা কলম নিয়ে বসে যেতেন বাগানের এক কোনায়। নাট্যনির্দেশক ও আবৃত্তিকার হিসেবে তার সুনাম ছিল। চাকরি থেকে অবসরের পরে আমার বাল্যকথা ও বোম্বাই প্রয়াস নামে একটি স্মৃতিকথা রচনা করেছিলেন।
ষাট বছর বয়সে জুলিয়াস সিজার নাটকে মার্ক অ্যান্টনির ভূমিকায় তার অভিনয় সবাইকে চমকে দিয়েছিল। কর্মস্থলে ইউরোপীয় ক্লাবের আয়োজিত ফ্যান্সি ড্রেসে তিনি সোৎসাহে অংশ নিতেন।
সত্যেন্দ্রনাথের আমদাবাদের বাড়িতে অনুজ রবীন্দ্রনাথ ও বোন স্বর্ণকুমারী দেবীর যাতায়ত ছিল অহরহ। রবীন্দ্রনাথ বড়দার লাইব্রেরিতে গিয়ে উপুর হয়ে পড়ে থাকতেন। রবীপ্রতিভার বিকাশে সত্যেন্দ্রনাথের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। ছোটবোন স্বর্ণকুমারী ছিল বাংলা ভাষার প্রথম স্বার্থক মহিলা কবি।
সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্ঞানদানন্দিনীর ঘরে পাঁচটি সন্তানের আগমন হয়েছিল। প্রথমজন শৈশবেই মারা যায়। পরেরজন সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি রচনা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন এবং জাতীয়তাবাদী বিপ্লবের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। সুরেন্দ্রর পরে আগমন হয় ইন্দিরা দেবীর। বিদূষী ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী ছিলেন লেখক ও প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরীর সহধর্মিণী এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী উপাচার্য। পরের দুটো সন্তানের কেউই দীর্ঘায়ু হতে পারেনি।
একজন দক্ষ এবং জনপ্রিয় আইসিএস, নারী জাগরণী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী, সুসাহিত্যিক, বহুভাষী, আবৃত্তিকার ও লোকহিতৈষী মানুষ ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। স্মৃতিকথায় কৈশোরে নিজেকে আইনোক্লাস্ট বা লোকাচারভঙ্গকারী বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্ধত্ব ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন সারাটি জীবন। তিনি প্রতিটি বাঙালির গর্ব। তার জীবনকথা এবং জীবনকর্ম প্রতিটি বাঙালির অবশ্যপাঠ্য।