“আজ পর্যন্ত যতকিছু উদ্ভাবিত হয়েছে,জীবন তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।”-গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ
গল্পের মতো করে হয়তো প্রায়ই আমাদের মাথায় একটি প্রশ্ন উঁকি দেয়, আমাদের যে জীবন, এটাই কি আসলে একজন মানুষের প্রকৃত জীবন?নাকি জীবনের এই চাওয়া পাওয়ার বাইরেও থেকে যায় এক বিশাল জীবন? যা হাতের কাছে থাকলেও আমরা ছুঁয়ে দেখতে চাই না এই ভয়ে যে, না জানি আমাদের জানা সকল সংজ্ঞা উলট পালট হয়ে যায়। জীবন-যাপনের যে রীতি গড়ে উঠেছে সেখানে সুখ কি আসলেই সুখ নাকি আমরা একটি অভিনয়ের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি? এমন জটিল প্রশ্নের উত্তর কিছু ছোটগল্পেও পাওয়া যায়। আর সেসব ছোটগল্প লিখেন সাহিত্যের দুনিয়ায় অমরত্ব পাওয়া লেখকরাই।
নোবেল বিজয়ী কলম্বীয় সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তার ছোটগল্প ‘বালথাজারের অপূর্ব বিকেল’ (Balthazar’s Marvelous Afternoon)-এ আসলে জীবনের এমন অনেক কথাই তুলে ধরেছেন। আর সাথে ম্যাজিক রিয়েলিজমের ঝলক তো এই গল্পে বাড়তি পাওনা। মার্কেজ এমনই একজন লেখক যে কিনা ছোটগল্পেও জীবনের গভীরতা তুলে ধরতে দক্ষ, তাই এটা সর্বজন স্বীকৃত যে মার্কেজ শুধু সাহিত্যে নোবেলের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত নন, তার পরিচয় অসামান্য সব সাহিত্য আর ম্যাজিক রিয়েলিজম দিয়েই। ছোটগল্পে যখন হাত দিয়েছেন তখন তার বলা প্রতিটি ছোটগল্প উপন্যাসের গভীরতাকেও হার মানিয়েছে যেন অল্প কথায় বহু জীবনের শত-সহস্র গল্প শুনিয়েছেন।
মার্কেজের উপন্যাস তো আসলে পুরো দুনিয়ার কাছেই পরিচিত। তা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তবে মার্কেজের ছোটগল্পও তেমন, তার ছোটগল্পগুলো এখন বিশ্বসাহিত্যের বিস্ময় হিসেবে ধরা হয়। তেমনই একটা বিস্ময়কর গল্প হল ‘বালথাজারের অপূর্ব বিকেল’। এই গল্পটি মার্কেজের ছোটগল্পের বই ‘Collected Stories’ এর অন্তর্ভুক্ত। এটি এমন এক ছোটগল্প যা নিয়ে শত শত বিশ্লেষণ আর পর্যালোচনা লেখা হয়েছে। কারণ একটিই, এই গল্প মূল চরিত্রের নাম করে আমাদের জীবন ভাবনার কথা শোনায়।
গল্পের মূল চরিত্র বালথাজার একদিন এমন একটি পাখির খাঁচা বানায় যেটাকে দেখতে মানুষের ভীড় জমে যায়। তবে সে এটার মর্ম বুঝতে পারে না। বহু বছর ধরে খাঁচা বানাতে বানাতে ক্লান্ত মানুষটা নতুন করে আর এটার অন্যরকম সৌন্দর্য খুজে পায় না। তবে তার জীবন সঙ্গী উরসুলা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে মনে মনে চড়া দাম কল্পনা করতে থাকে। তার কল্পনায় হানা দেয় ক্ষণিকের জন্য হলেও কিছুটা দারিদ্রতা থেকে মুক্তির কথা। অবশ্য এসব কিছুই বালথাজারের চোখে পড়ে না, প্রতিবারের মতো এবারও খাঁচাটা বিক্রি হলেই হলো। চড়া দামের তো প্রশ্নই উঠে না।
গ্রামের স্বনামধন্য ডাক্তারের কানেও পৌঁছে যায় খাঁচার সৌন্দর্যের কথা। বহুদিনের এই পেশায় সে কামিয়েছে বহু। এখন একটু আয়েশ বিলাসিতা তাকে অবশ্যই শোভা দেয় আর এমনিতেও তার স্ত্রীর পাখি খুব পছন্দের। তাই তাদের বারান্দা ভর্তি হয়ে আছে খাঁচায় বন্দি পাখি দিয়ে। এসব পাখিরা তাদের বাড়ির শৌখিনতার প্রতীকও বটে। সবার মুখে প্রশংসা শুনে শুনে ডাক্তারও হাজির হয় সেই খাঁচা দেখতে। আর দেখেই পণ করে ফেলে এটি তার চাই ই চাই। কারণ মানুষ যতটা সুন্দর বলেছে এটি তার থেকেও শতগুন বেশি সুন্দর। আদিকাল থেকেই মানুষের যে সুন্দরের পূজা এ যেন তারই বহিঃপ্রকাশ।
তবে বাধা হয়ে দাড়ায় বালথাজার, সে জানায় খাঁচাটি গ্রামের ধনী ব্যবসায়ী মন্তিয়েলের ছেলের জন্য বানানো। এতে অবশ্য ডাক্তার ধমে যায় না। ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে থাকে সে তো নিশ্চয়ই একটি সাধারণ পাখির খাঁচা বানাতে বলেছে। তুমি একটা বানিয়ে দিলেই হলো এটা তো দুনিয়ার সবথেকে সুন্দর এবং আলাদা পাখি ছাড়া ঝুলিয়ে রাখলেও এটার সৌন্দর্য কমবে না।
এমন প্রশংসা আর টাকার প্রলোভনও যেন বালথাজারকে স্পর্শ করে না। সে যার জন্য বানিয়েছে তাকেই দেবে। যদিও উরসুলা চাচ্ছিল খাঁচাটা ডাক্তার কিনে নিয়ে যাক। কেননা এখানে মোটা অংকের টাকা পাওয়া যাবে কিন্তু সেটা আর হলো না। বালথাজার যার জন্য বানিয়েছে তাকেই দেবে বলে ছেলেমানুষি জেদ ধরে। এখানে বালথাজার যেন হয়ে উঠে মানুষের সরলতার প্রতীক।
মন্তিয়েলের বাসায় যেতে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করে বালথাজার। বড়লোকের বাসায় নানান নিয়ম মেনে শব্দ না করে হাটা এসব তার খারাপই লাগে।টাকাওয়ালা মন্তিয়েল অবশ্য শৈল্পিকতার ধার ধারে না। এই খাঁচা যেহেতু তার অনুমতি নিয়ে বানানো হয়নি তাই এটা সে রাখতে পারবে না বলে জানায়। কারণ বাচ্চা ছেলে যা চাইবে তা যদি সবাই নিয়ে আসে তাহলে তো হবে না। খাঁচার জন্য এক পয়সা দাম দিতেও নারাজ মন্তিয়েল। আর ছেলেমানুষি করে তাকে রাগাতে বারণ করে দেয়, কারণ ডাক্তার বলেছে কখনোই রাগ করা যাবে না। এতে বড় ধরণের সমস্যার ঝুকি আছে। এই ব্যাপারটা অবশ্য বালথাজার বুঝে উঠে না। এত টাকা কামিয়ে উঁচু দালান করে লাভ হলো কী যদি সামান্য রাগ করার স্বাধীনতাই না থাকলো?
বেশকিছু গালি হজম করেও বালথাজার তার বানানো খাঁচাটি মন্তিয়েলের ছেলে পেপেকে উপহার হিসেবে দিয়ে আসে কারণ সে এটি বাচ্চাটির জন্যই বানিয়েছিল। এদিকে চারদিকে কথা ছড়িয়ে পড়ে যে তার খাঁচাটি বিক্রি হয়েছে চড়া দামে, যেহেতু গ্রামের সবথেকে ধনী মানুষটি কিনেছে।
বালথাজার অবশ্য এসব কথায় নীরব সম্মতি জানায়। লোকে নাহয় ভাবুক সে হুট করে বেশ কিছু টাকার মালিক হয়েছে, তাতে কী বা আসে যায়?তাই সবার আনন্দে সরাইখানায় বন্ধুদের খাওয়াতেও হলো তার। উরসুলার কানেও পৌঁছে যায় চড়া দামে বিক্রির কথাটি। তাই সে নানারকম পদ রান্না করে অপেক্ষা করছিল আনন্দ উদযাপনের জন্য। অন্যদিকে মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরার পথে বালথাজার রাস্তায় এমনভাবে পড়ে থাকে যে পথচারীদের মনে হয় কেউ যেন মরে পড়ে আছে।
পুরো গল্পে এভাবেই বালথাজারের এলোমেলো জীবনের সাথে তার ছেলেমানুষি আর নির্লোভ মানসিকতার প্রকাশ ঘটে। সেইসাথে তার ভেতর থাকা শিল্পী সত্ত্বাও নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়। লেখক কখনোই বালথাজারের জীবন যাপনকে আদর্শ হিসেবে ধরেননি। তবে তার ছেলেমানুষি সরলতা আর নির্লোভ থাকায় ভর করে সমাজের নানান চিত্র হাজির করা হয় আমাদের সামনে। সেখানে আমাদের প্রতিষ্ঠিত সুখের সংজ্ঞায় বারবার আঘাত করা হয়, এই আঘাত অবশ্য ভাঙতে চাওয়ার নয়, গড়তে চাওয়ার আর নিজের জীবনের প্রতি সুবিচার করতে চাওয়ার আঘাত।
মার্কেজ এই গল্পের আড়ালে যেন আমাদের কানে ফিসফিস করে বলতে চেয়েছেন প্রকৃতপক্ষে জীবনের মানে কী। জীবনটা শুধু অর্থের পেছনে ব্যয় করে দিলে আসলে দিন শেষে তো হাত খালিই থেকে যায়। মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেই খালি হাতগুলো স্পষ্ট হতে শুরু করে। আসলেই অর্থ কি পারে নিজের ভেতর এক অন্যরকম সত্ত্বার জন্ম দিতে? আনন্দের সাথে এ জীবন যাপন করতে পারার চেয়ে বেশি মূল্যবান তো আর কিছুই হতে পারে না, হওয়ার কথাও না!