পৃথিবীর ইতিহাস পড়লে আমরা দেখতে পাব- প্রতিটি জাতি বা গোত্রের সাথে জড়িয়ে আছে সাহিত্য, হোক সেটি কোনো গল্প বা কাহিনী, কবিতা বা গান। সেসব সাহিত্য আমাদের ধারণা দেয় তাদের জীবনধারা ও চিন্তাচেতনা সম্পর্কে। এসব কিছু আমাদের জানান দেয় আদিকালে মানুষ কীভাবে তাদের সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য রক্ষার জন্য এসবের মাধ্যমে তা সংরক্ষণ করে রেখেছে। আজকের লেখায় আমরা এমনই এক জাতির সাহিত্য সম্পর্কে জানব, যারা কবিতা বা গানের মাধ্যমে নিজেদের সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করে রেখেছে।
পৃথিবীর বুকে আরবরা এমন এক জাতি, যারা যাযাবর হিসেবে পরিচিত হলেও তাদের ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ। যুদ্ধ-বিগ্রহ ছাড়াও তারা যে সাহিত্য সাধনায় সমান পারদর্শী তা তাদের সাহিত্য পড়লেই বোঝা যাবে। প্রথম উল্লেখযোগ্য আরবি সাহিত্য রচিত হয় ৪র্থ থেকে ৭ম শতাব্দীর মধ্যে, যা মধ্যযুগীয় গীতিকবিতার স্বর্ণযুগ হিসেবে পরিচিত। কবিতাগুলো বিশেষ করে ব্যক্তিগত কাসিদা বা ছোট কবিতা, তবে কিছু কিছু ১০০ লাইনেরও বেশি। এসব কাসিদাতে আরবের বিভিন্ন উপজাতি ও বেদুইন জীবন ও প্রেম, লড়াই, সাহস এবং শিকারের বিষয়বস্তুকে ফুটিয়ে তোলে। কবিতাগুলোর কথা রোমান্টিকভাবে উল্লেখ করা হয়নি, বরং কবি সরাসরি কথা বলেছেন প্রকৃতি এবং সৃষ্টিকর্তার শক্তির কথা। সংগ্রহ ও সংকলনের মাধ্যমে কাসিদাগুলো টিকে আছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মু’আল্লাকাত, হামাসা, মুফাদ্দালিয়্যাত এবং কিতাব আল-আগনি।
সাহিত্যের এই গৌরবময় যুগে কাব্যই ছিল সাহিত্য-চেতনা প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম। ‘কাসিদা’ (গীতিকবিতা) ছিল একমাত্র নিখুঁত কাব্যিক ধারা। আরবীয় বিভিন্ন উপজাতির আমলে, বিশেষত তাগলিব এবং কিনদা উপজাতির মানুষদের মধ্যেই গীতিকবিতার আবির্ভাব ঘটেছিল। কাসিদাগুলোতে হোমারীয় রচনাশৈলী দেখা গেলেও ছন্দের নিরিখে, জটিলতা ও ব্যাপকতার দিক থেকে সেগুলো ইলিয়াড ও ওডিসিকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কাসিদা কয়েকটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য: গতানুগতিক সূচনা, প্রচলিত গুণবাচক পদ, বক্তব্যের মূল অংশের উপস্থাপনা ও বিষয়বস্তুর সামঞ্জস্য। কবিতার বিষয়বস্তু আবেগে ভরপুর, শক্তিশালী কিন্তু বাহুল্যহীন ভাষায় রচিত। কিন্তু গীতিকবিতাগুলোতে মৌলিক চিন্তা বা চিন্তা-উদ্রেককারী চিত্রকল্পের অভাব লক্ষ্য করা যায়। তাই কবিতার পরিবর্তে বহুক্ষেত্রেই কবিই শ্রদ্ধা ভক্তির পাত্র হয়ে ওঠে। তবে অন্য ভাষায় অনূদিত হলে এসব কবিতার মাধুর্য নষ্ট হয়ে যায়। অধিকাংশ কবিতাতেই ব্যক্তিগত ও বিষয়মুখী উপাদানের উপস্থিতি প্রাধান্য লাভ করে।
ইসলাম-পূর্ব আরবি ভাষার সাহিত্য
মু’আল্লাকাত
আরবের প্রথমদিকের উল্লেখযোগ্য আরবি সাহিত্যের কথা বলতে গেলে প্রথমেই যে নামটি উঠে আসবে তা হলো বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ মু’আল্লাকাত। মু’আল্লাকাত হচ্ছে আরবি জাহেলি যুগের এক উল্লেখযোগ্য কাব্য সংকলন। তৎকালীন আরবে উকাজের মেলা খুব প্রসিদ্ধ ছিল। এই মেলায় কবিরা তাদের কবিতা শোনাতেন। যে কবিতাটি সবচেয়ে ভালো হতো, সেই কবিতা সোনার হরফে লিখে পবিত্র মক্কা নগরীর কাবা গৃহের দরজায় টাঙিয়ে দেওয়া হতো। যেহেতু এগুলো টাঙিয়ে রাখা হতো, তাই এর নাম রাখা হয় মু’আল্লাকাত। আরবি এই নামের অর্থ ‘দ্য সাসপেন্ডেড ওডেস’ (The Suspended Odes) বা ‘দ্য হ্যাঙ্গিং পোয়েমস’ (The Hanging Poems)।
মু’আলাকাত হচ্ছে সাতটি দীর্ঘ আরবি কবিতা সংকলিত একটি বই। এই বইয়ের বেশ কয়েকজন প্রসিদ্ধ লেখক হলেন:
- ইমরু আল-কাইস
- লাবিদ ইবনে রাবিয়া
- তারাফা ইবনে আল আবদ
- জুহাইর ইবনে আবি সুলমা
- আনতারা ইবনে শাদ্দাদ
- আমর ইবনে কুলসুম
- হারিস ইবনে হিল্লিজা
এই সাতজনের মধ্যে প্রথমজন ছিলেন ইমরু আল-কাইস (মৃত্যু আনুমানিক ৫৪০ খ্রি.), যাকে অনেকে মু’আল্লাকাত কবিদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত বলে মনে করেন। তার জন্ম বা মৃত্যুর সঠিক তারিখ নির্ধারণ করা না গেলেও ধারণা করা হয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে তার কবিতাগুলো লেখা হয়েছিল। ইমরু আল-কাইস ছিলেন দক্ষিণ আরবের কাহতানি গোষ্ঠীর কিনদা সম্প্রদায়ভুক্ত। তিনি ছিলেন প্রাচীনতম চারণকবিদের একজন। এজন্য তাকে আরব কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ‘কবিদের আমীর বা রাজপুত্র’ বলে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকৃতি জানানো হয়।
উমাইয়া শাসনকালের শেষের দিকের আগে মু’আল্লাকাতের কোনো সংগ্রহ প্রকাশ করার চেষ্টা হয়নি। অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগে হাম্মাদ আল-রাবিয়াহ্ নামে যে বিখ্যাত মহাকাব্য আবৃত্তিকারের আবির্ভাব ঘটেছিল, তিনিই অন্যান্য অনেক গীতিকবিতার মধ্য থেকে সাতটি উৎকৃষ্ট গীতিকবিতা বেছে নেন এবং তাদের একটি আলাদা বিভাগে সংকলিত করেন। গীতিকবিতার এই সংকলনটি অধিকাংশ ইউরোপীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
মুফাদ্দালিয়্যাত ও অন্যান্য
বিখ্যাত সাতটি গীতিকবিতা ছাড়াও ইসলাম-পূর্ব সময়ে আরো একটি কাব্য সংকলনের দেখা পাওয়া যায়। সংকলক আল-মুফাদ্দালি আল দাব্বি (মৃত্যু আনুমানিক ৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দ) এর নামানুসারে এই কাব্য সংকলনটির নাম হয়েছে ‘আল-মুফাদ্দালিয়্যাত”। এতে স্বল্পখ্যাত কবিদের মোট ১২০টি গীতিকবিতা সংকলিত হয়েছে, এছাড়া আছে কয়েকটি দিওয়ান (কাব্য সঞ্চয়ন) এবং আবু-তাম্মাম (মৃত্যু আনুমানিক ৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দ) সম্পাদিত দিওয়ান আল হামাসা ও আল-ইসবাহানি (মৃত্যু আনুমানিক ৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দ) রচিত কিতাব আল-আগানি থেকে সংগৃহীত এক বিরাট সংখ্যক অসম্পূর্ণ অংশ ও উদ্ধৃতি।
ইসলাম-পরবর্তী আরবি ভাষার সাহিত্য
আল-কুরআন
আল-কুরআন মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ও সর্বশেষ আসমানি কিতাব। সর্বশেষ নবী ও রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উপর দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতা হযরত জিবরাঈল (আ.)-এর মাধ্যমে এই কুরআন অবতীর্ণ করেন।
ইসলামের আবির্ভাবের সাথে সাথে কুরআন অধ্যয়ন ও তেলাওয়াত কেন্দ্রীয় কাজ হয়ে ওঠে। কুরআন ধ্রুপদী আরবিতে রচিত। পরবর্তীতে আরবি সাহিত্যে কুরআনের ধ্রুপদী রূপকে আদর্শ মান ধরে অন্যান্য সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছে। এজন্য ইসলাম-পরবর্তী যুগের সাহিত্যকর্মে কুরআনের প্রভাব দেখা যায়। কুরআন যে সময় অবতীর্ণ হচ্ছিল, ঠিক সেই সময় ও তার আগেও মক্কা ও তার আশপাশে কবিতা লেখার ব্যাপক প্রচলন ছিল। মক্কার বিখ্যাত সব কবি নিজেদের লেখা কবিতা নিয়ে কাবা ঘরের সামনে জড়ো হতো।
কুরআনের সূরাগুলোর রয়েছে ছন্দ, যা সুর দিয়ে পড়ার মাধ্যমে হৃদয়ে অদ্ভুত আলোড়ন সৃষ্টি করে। কুরআনের ভাষার অলংকার ও শব্দচয়ন অনন্য। এছাড়া, কুরআনের ব্যাকরণকে ধ্রুপদী আরবি ভাষার মূল হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তাই আরবি সাহিত্যের মধ্যে কুরআনকে আদর্শ হিসেবে ধরা হয়।
অন্যান্য সাহিত্যের মতো আরবি সাহিত্যেও গদ্য ও কবিতার প্রচলন আছে। সাহিত্যে ব্যবহৃত আরবি শব্দগুলো আদব বা শিষ্টাচার, ভদ্রতা, সংস্কৃতি এবং সমৃদ্ধিকে ফুটিয়ে তোলে। আরবি সাহিত্য সর্বাধিক বিকশিত হয়েছিল ইসলামি স্বর্ণযুগের সময়।
খুলাফায়ে রাশেদীন
খুলাফায়ে রাশেদীন বা ইসলামের প্রথম চার খলিফার সময়ে, অর্থাৎ সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামি সাহিত্য হিজাজ এলাকায়, অর্থাৎ মক্কা ও মদিনার মতো শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া দামেস্ক, ইরাক, কুফা ও বসরায় ইসলামি সাহিত্য বিকশিত হতে থাকে। এই সময়ে সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতা রচিত হয়েছিল, যা ইসলামের প্রসারে কাজ করে। সাহসী যোদ্ধাদের প্রশংসা করার জন্য বা যুদ্ধে সৈন্যদের অনুপ্রাণিত করার জন্য এবং যারা যুদ্ধে শহীদ হয়েছিল তাদের সম্মানার্থে শোক ও শ্রদ্ধা করার জন্যও কবিতা ছিল। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য কবিদের মধ্যে রয়েছেন কাব্ ইবনে জুহাইর, হাসান ইবনে সাবিত এবং নাবিঘা আল-জা’দী। বিনোদনের জন্য কবিতাগুলো প্রায়ই গজল আকারে ছিল। এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন জামিল ইবনে মা’মার, লায়লা আল-আখিয়ালিয়া, এবং উমর ইবনে আবি রাবিয়াহ।
উমাইয়া খিলাফত
উমাইয়া সাম্রাজ্য গঠনের পর পরই আরবে কাব্যসৃষ্টির এক নতুন জোয়ার আসে। তবে এই সময় আরব কবিদের মধ্যে রোমান্টিকতার প্রভাব দেখা যায়। তাদের মাঝে প্রেমমূলক কবিতাই বেশি লেখা হয়েছিল। বিখ্যাত ‘লায়লি-মজনু’ প্রেমকাহিনি এই সময়ে লেখা হয়।
এই সময় ইসলামের ইতিহাসে প্রথম ফিতনা সংঘটিত হয়, যার ফলে মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুন্নি বিভক্তির সৃষ্টি হয়। এটি আরবি সাহিত্যের উপরও বিরাট প্রভাব নিয়ে আসে। শুরুতে ইসলামি সাহিত্য ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লেও এই যুগের শুরুতে এর ভিত ভেঙে যায়। ক্ষমতার লড়াই ইসলামি শাসকদের উপজাতিবাদের দিকে পরিচালিত করে। এই সময়ের সাহিত্যগুলোতে রাজনৈতিক দল ও নিজ দলের প্রশংসা ও উপদেশ নিয়ে কবিতা রচনা করা হত। এই যুগের কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আল-আখতা আল-তাঘলিবি, জারির ইবনে আতিয়াহ, আল-ফারাজদাক প্রমুখ।
আব্বাসীয় খিলাফত
আব্বাসীয় যুগকে সাধারণত ইসলামি স্বর্ণযুগ হিসেবে ধরা হয়। এটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্য রচনার সময় ছিল। বাগদাদের বায়তুল হিকমাহ বা হাউজ অব উইজডম ছিল। আল-জাহিজ এবং ওমর খৈয়ামের মতো অসংখ্য পণ্ডিত ও কবি এ সময়ের পরিচিত নাম। এক হাজার এক রাতের বেশ কয়েকটি গল্পে আব্বাসীয় খলিফা হারুন আল-রশিদকে দেখানো হয়েছে। বসরার আল-হারিরি ছিলেন এই সময়ের একজন উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব। আব্বাসীয় সাহিত্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কবি ছিলেন বাশার ইবনে বুর্দ, আবু নুওয়াস, মুসলিম ইবনে আল-ওয়ালিদ।
বাগদাদের নতুন আরবি-ফার্সি সংস্কৃতির উত্থানের ফলস্বরূপ ৮ম এবং ৯ম শতাব্দীতে আব্বাসীয়দের সময়ে আরবি সাহিত্যের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও বিস্তার ঘটে। সাহিত্যের পাশাপাশি দর্শন, গণিত, আইন, কোরআনের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ, ইতিহাস এবং বিজ্ঞানের চর্চা করা হয়েছিল এই সময়ে, এবং আরবি কবিতার বইও সংকলিত হয়েছিল।
আরব্য রজনীর গল্প
আরবি সাহিত্যের সবচেয়ে বিখ্যাত ও বড় সংগ্রহ হলো ‘আরব্য রজনীর এক হাজার এক রাত’ বা ‘থাউজেন্ড অ্যান্ড ওয়ান নাইটস’। এটি আরবিতে ‘আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা’ এবং ইংরেজিতে ‘দ্য এরাবিয়ান নাইটস’ নামেও পরিচিত। এটি সমস্ত আরবি সাহিত্যের সর্বাধিক পরিচিত সাহিত্য, যা এখনও আরবি সংস্কৃতি সম্পর্কে অনারবদের কাছে বহুল পরিচিত নাম। একটি পুরনো পারসিক বইয়ের (হাজার আফসানা) উপর ভিত্তি করে এর গল্পগুলো লেখা হয়েছিল। সেই বইতে ভারতেরও অনেকগুলো কাহিনী ছিল। জনপ্রিয় আরবি গদ্য কল্পকাহিনীর কিছু উদাহরণ হলো আলাদিন ও তার আশ্চর্য জাদুর প্রদীপের গল্প, এবং আলি বাবা ও চল্লিশ চোরের কাহিনী, যদিও তা এই বইয়ের অংশ ছিল না। মূল গল্পগুলোর বেশিরভাগই সম্ভবত প্রাক-ইসলামিক যুগের। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রাণীর উপকথা, হিতোপদেশ, হাস্যরসাত্মক ও নৈতিক গল্প।
আরবি সাহিত্যের অন্যান্য ধারা
আরবি ভাষায় ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক রচনার প্রধান লেখকদের মধ্যে রয়েছেন বুখারি, আল-তাবারি, আল-মাসউদি, ইবনে খালদুন, ইবনে আল-আছির এবং ইবনে বতুতা। অগ্রগণ্য আরব ধর্মতত্ত্ববিদ ছিলেন আল-গাজ্জালি, চিকিত্সক ইবনে সিনা, যিনি চিকিৎসা ও ঔষধের উপর অনেক বই লিখেছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপর তার লেখা ৫ খণ্ডের ‘কানুন ফিততিব’ নামের বিশ্বকোষ মুসলিম বিশ্বে এবং ইউরোপে ১৮ শতক পর্যন্ত প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
ধর্মতাত্ত্বিক ও পরিব্রাজক ইবনে বতুতা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও জায়গা ভ্রমণের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি একুশ বছর বয়স থেকে শুরু করে জীবনের পরবর্তী ৩০ বছরে পৃথিবীর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তার এই ভ্রমণকাহিনীগুলো ‘রিহলা’ নামক বইতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। রিহলা একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ ভ্রমণকাহিনী।
আল-বিরুনি ছিলেন ইসলামী স্বর্ণযুগের একজন পণ্ডিত ও বিজ্ঞানী। তিনি একাধারে পদার্থবিদ, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ, ভূগোলবিদ ও ইতিহাসবিদ ছিলেন। তার উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর মধ্যে আছে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ ও পরিধি নির্ণয় পদ্ধতি, চাঁদের দশা বা পর্যায় ব্যাখ্যা ইত্যাদি। তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি ১০০০ সালে ঘণ্টাকে প্রথম মিনিট ও সেকেন্ডে ভাগ করেছিলেন। তার উল্লেখযোগ্য বই তরিকা আল-হিন্দ, কিতাবুত তাহফিম।
ইবনে কাসির ছিলেন একজন মুহাদ্দিস, ফকিহ, মুফাসসির ও ইতিহাসবিদ। তার উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে আছে পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘তাফসির ইবনে কাসির’, ইতিহাস গ্রন্থ ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’। তার ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থের ভাষা ও সাহিত্যমান উচ্চস্তরের হওয়ায় বিখ্যাত আরবি সাহিত্যিকদের কাছে এটি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত।
স্পেনের আরবি সাহিত্য
আরবী ভাষার কবিতাগুলোতে সুর ও সুন্দর শব্দ নির্বাচনের জন্য সকল শ্রেণীর মানুষের কাছেই সমাদর পেয়েছিল। শব্দের সৌন্দর্য ও মধুর উচ্চারণ ধ্বনিতে আনন্দ অনুভব করা ছিল আরবী কবিতার একটি বৈশিষ্ট্য এবং সুদূর স্পেনের মাটিতেও তার প্রকাশ ঘটেছিল। প্রথম উমাইয়া শাসক ও তার বেশ কয়েকজন উত্তরসূরি ছিলেন কবি। ফলে স্পেনের কর্ডোবাতেও কাব্য প্রতিভার অগ্নিশিখা জ্বলে উঠেছিল।
মুওয়াশশাহ্
প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়ে স্পেনীয় আরবী কবিতা নতুন ছন্দোবদ্ধ রূপ গড়ে তুলেছিল এবং প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রতি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিল। পল্লীগীতি ও ভালবাসার গানের মধ্য দিয়ে এক রোমান্টিক অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছিল যা ছিল মধ্যযুগীয় বীরত্বের পূর্বসুরী। একাদশ শতাব্দীর শুরুতে ‘মুওয়াশশাহ’ ও ‘জাজল’ নামে একধরনের গীতিকবিতার জন্ম হয়েছিল আন্দালুসে। উভয় গীতিকবিতাই সমবেত সঙ্গীত ধারার ওপর ভিত্তি করেই রচিত হয়েছিল, এবং সেগুলো সমবেতভাবেই গাওয়া হতো। বিশিষ্ট মুওয়াশশাহ্ রচয়িতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন টুডেলার অন্ধ কবি আবু-আল আব্বাস আল-তিউতিলি। এছাড়া অপর এক বিশিষ্ট কবি ছিলেন মুহাম্মাদ ইবন-ইউসুফ আবু-হায়্যানি (১২৫৬-১৩৪৪ খ্রিষ্টাব্দ) যিনি বার্বার সম্প্রদায়ের এক বহুভাষিক ব্যক্তি ও গ্রানাডার অধিবাসী ছিলেন।
আন্দালুসের শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন আবুল ওয়ালিদ আহমদ ইবন জায়দুন (১০০৩-১০৭১ খ্রিষ্টাব্দ)। স্পেনের মাটিতে আরব মহিলাদের মধ্যে কাব্য ও সাহিত্যের প্রতি বিশেষ অনুরাগ ও সহজাত প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন ছিলেন ওয়াল্লাদা (মৃত্যু আনুমানিক ১০৮৭ খ্রিষ্টাব্দ)। এই প্রতিভাময়ী কবি তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও সাহিত্যক্ষমতার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। এজন্য তাকে বলা হতো স্পেনের স্যাফো। ওয়াল্লাদার উদ্দেশে রচিত ইবন জায়দুনের বহু কবিতাতেই আল-জাহুরা ও তার বাগানগুলোর সৌন্দর্যের ছবি এবং প্রকৃতির প্রতি গভীর অনুরাগের ছবি ফুটে উঠেছে। স্পেনীয় আরবী কবিতার এটাই প্রধান বৈশিষ্ট্য।
তুলনামূলকভাবে কম খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিভাধরদের মধ্যে আবু-ইসহাক ইবন-খাফাজার, ইবন-আবদ-রাব্বিহ্, ইবন-হাজম্ ও ইবন-আল-খাতীব উল্লেখযোগ্য। এছাড়া স্পেনের মাটিতে আরও কয়েকজন কবির আবির্ভাব ঘটেছিল যাদের রচনাগুলোকে এখনও উন্নতমানের বলে গণ্য করা হয়।
সাধারণভাবে আরবী কবিতা, বিশেষ করে এই গীতিকবিতাগুলো স্পেনের খ্রিস্টানদের আকর্ষণ করেছিল এবং তারা শ্রদ্ধার সাথে তা আত্মস্থ করত। জাজল ও মুওয়াশশাহ্ নামে এই দুই ধরনের গীতিকবিতা ক্যাস্টিলিয়ার জনপ্রিয় কবিতার রূপ ‘ভিল্যানসিকো’তে গ্রহণ করা হয়েছিল। এই ভিল্যানসিকো বড়দিনের ভজনসংগীতসহ খ্রিস্টানদের প্রার্থনায় ব্যবহৃত হতো। এই সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতার শেষের ছয় চরণ সাধারণত সিডিই (CDE), সিডিই (CDE) ইত্যাদি ছন্দে উচ্চারিত হতো, এবং আন্দালুসীয় কবিদের রচনাবলিতে বিশেষত আরবী জাজলেই তা লক্ষ করা যায়।
সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন যুগের শাসনামলে আরবি ভাষায় বহু সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছে যা আরবি সাহিত্যের ভান্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ। ঊনবিংশ শতাব্দীর সময় মিশর, লেবানন এবং দামেস্ককে কেন্দ্র করে আরবি ভাষায় মুদ্রণ ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। এ সময় সংবাদপত্র, বিশ্বকোষ এবং বিভিন্ন বই প্রকাশিত হতে থাকে যেখানে আরব লেখকরা আরবী ভাষায় নিজেদের অনুভূতি এবং আধুনিক বিশ্বে তাদের অবস্থান প্রকাশ করার চেষ্টা করেছিলেন। বিভিন্ন প্রকার গদ্য, যেমন- গল্প, উপন্যাস রচিত হতে থাকে। একইসাথে এসব সাহিত্যে পশ্চিমা বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে উপন্যাস, নাটক লেখা হতে থাকে। সে যা-ই হোক, আরবি সাহিত্য যে তার গুণ ও মাধুর্য দিয়ে যুগ যুগ ধরে মানুষের মনকে বিমোহিত করে আসছে তা অনস্বীকার্য। বলা বাহুল্য যে এটা আরো দীর্ঘ সময় ধরে চলমান থাকবে।