আপনি বইপোকা হন বা সিনেমাপ্রেমী, ‘হ্যারি পটার’ নামটি নিশ্চয়ই শুনেছেন। এই সিরিজের বইসমূহ বা সিনেমাগুলো দেখেছেন নিশ্চয়ই। বিশ্ববিখ্যাত ‘হ্যারি পটার’ সিরিজের রচয়িতা জে কে রোলিং, বিশ্বব্যাপী যার রয়েছে ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা। বেস্টসেলার লেখিকা তিনি। যারা লিখতে ভালবাসেন বা লেখালেখিতে আগ্রহী তাদের জন্য তিনি ৮টি নিয়ম মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। চলুন, সেগুলো জেনে নেয়া যাক।
এক
লেখার সাথে কোনো আপোষ নয়। বিভিন্ন জরুরী কাজের অজুহাত দিয়ে লেখা বাদ দেয়া চলবে না। আমি নিজে বেশ দীর্ঘদিন যাবত পেশাদার লেখিকা হওয়া সত্ত্বেও প্রায়ই এই বিষয়টায় সমস্যার মুখোমুখি হই। লেখা ফেলে পরিবার-পরিজন, ভালবাসার মানুষের প্রতি মনোযোগ দিয়ে ফেলি। যদিও সেটা ঠিক নয়। অন্যদিকে, আমাদের ভালবাসার মানুষগুলোরও বোঝা উচিত লিখতে সময়ের প্রয়োজন, নির্ভার থাকা প্রয়োজন। তাই প্রিয়জনদের কাছ থেকে সময় চেয়ে লেখায় মনোনিবেশ করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ।
দুই
লেখা কোনো শখের বিষয় নয়। এটি একটি কাজ। এখানে শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, লেখালেখি যে একটি কাজ এটি খুব সহজেই আমরা ভুলে যাই। আমরা একে সবসময় সেরকম কাজ বলে গণ্যই করি না। উৎসাহ সবসময় থাকে না। কিন্তু একজন লেখক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই নিজেকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যেন ইচ্ছে না করলেও, মন না চাইলেও স্থির হয়ে বসে লেখা সম্ভব হয়। লেখার যখন খুব ভাল মুড থাকে তখনকার চেয়ে এই অনিচ্ছা সত্ত্বেও লিখতে বসাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই মুহূর্তগুলোই বিরাট পার্থক্য গড়ে দেয়।
তিন
নিজেকে ভিন্ন কিছু মনে করা বন্ধ করতে হবে। কাজ মানে কাজ। লেখার সময় শুধুই লেখা। লেখা শেষ না করে ওঠা চলবে না। হ্যাঁ, পাশাপাশি অন্য কাজ করেও এভাবে লেখা সম্ভব। অন্যান্য দায়িত্ব পালন করেও এমনটা করা সম্ভব। আপনি একজন লেখক, তাই না? জানি এ পর্যন্ত যা যা পড়েছেন তাতে আপনার মনে বিরুপ প্রভাব পড়েছে। তাই হয়তো মুখ বাঁকিয়ে “না” বলে উঠেছেন। কিন্তু সেটা ঠিক নয়। আমি জানি, আপনার ভেতরেও কোনো এক ছোট্ট কোটর থেকে ফিসফিস করে উচ্চারিত হচ্ছে “হ্যাঁ, আমি লেখক।” অবশ্যই আপনি লেখক! তাই আপনাকে লিখতে হবে। দৌড়বিদ দৌড়ায়। রাঁধুনি রান্না করে। চিত্রশিল্পী ছবি আঁকে। আর লেখক লেখে। দৃঢ়ভাবে এটা বিশ্বাস করুন এবং লিখে যান। দেখুন, আপনার বিশ্বাস আপনাকে কোথায় নিয়ে যায়।
চার
সেটাই লিখুন সেটা সম্পর্কে আপনি জানেন। আপনার ভালো লাগার বিষয়গুলো, বিশ্বাস, বন্ধু, পরিবার এমনকি পোষা প্রাণীটির কাছ থেকেও লেখার উপকরণ সংগ্রহ করতে পারেন। লিখতে হলে আপনার সেই বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। তাহলে এলিয়েন নিয়ে লিখতে গেলে এলিয়েনের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করার অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হতো। কী নিয়ে লিখবেন? খুঁজে পাচ্ছেন না?
আচ্ছা, গুগলের হোমপেইজের গুগল ডুডলসটা লক্ষ্য করুন তো। দেখুন একটা ছোট্ট অ্যানিমেশনের মাধ্যমে কোনো শব্দ না লেখা সত্ত্বেও একটা গল্প ফুটে উঠেছে সেখানে। পৃথিবীর সবপ্রান্তের মানুষের কাছে কিন্তু বিষয়টা বোধগম্য। ভাষা, সংস্কৃতির পার্থক্য এখানে কোনো সমস্যা তৈরি করতে পারেনি। কারণ, সব দেশের মানুষের অনুভূতিগুলো, আবেগগুলো একই। সবাই জানে একাকী বোধ করলে কেমন লাগে, হতাশ হলে কেমন অনুভব হয়, বন্ধুদের সাথে সময় কাটালে কেমন লাগে। তাই কোনো গল্প লিখতে কার্পণ্য করবেন না। আপনার মাঝে যদি আবেগ কাজ করে, অনুভূতিগুলো আপনাকে আন্দোলিত করে, তাতেই চলবে। এখন দরকার শৃঙ্খলা মেনে লেখার চর্চা।
পাঁচ
ছোটরা কেউ যখন আমার কাছে এসে লেখক হওয়ার জন্য টিপস চায়, আমি সবসময় ওদেরকে বলি পড়ো। যত পারো পড়ো। বিখ্যাত লেখিকা জেন অস্টিনও তাঁর কনিষ্ঠদেরকে এই টিপস দিতেন। পড়ার কোনো বিকল্প নেই। যত পড়বেন আপনার শব্দভাণ্ডার তত সমৃদ্ধ হবে। আপনি তত সুন্দরভাবে উপমা, বাক্যের অলংকরণ করতে পারবেন। যত বেশি পড়বেন তত ভাল লিখতে পারবেন, ভাল লেখক হতে পারবেন।
ছয়
অধ্যবসায় অত্যন্ত জরুরী। শুধু লিখলেই হবে না সেগুলোর সমালোচনা সহ্য করার মতো মানসিকতাও থাকতে হবে। যখন লেখা ছাপাতে যাবেন তখন অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা হতে পারে। একাধিক প্রকাশনীতে পাণ্ডুলিপি বাতিল হতে পারে। আমার লেখা হ্যারি পটার সিরিজের প্রথম বইটি কিন্তু প্রায় ২০টি প্রকাশনী বাতিল বলে ফেলে দিয়েছিল। যা হোক, বই প্রকাশ করতে পারলেই কিন্তু দায়মুক্তি নয়। প্রকাশিত বইয়ের বিপরীতে নেতিবাচক রিভিউ, পাঠপ্রতিক্রিয়া আসতে পারে।
আপনার লেখা সবার বুঝে না-ও আসতে পারে। তারা তখন আপনার বইটির ব্যাপারে বাজে কথা বলবে। আপনার এত আবেগ নিয়ে লেখা বইটি সম্পর্কে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেলে হয়তো আপনার হৃদয় ভেঙে হাজার টুকরো হয়ে যাবে। কিন্তু তাই বলে লেখা বন্ধ করে দিলে চলবে না। গালমন্দের ভয়ে কখনই লেখা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া যাবে না, কখনই নয়। লেখা চালিয়ে যেতে হবে। লেখা বাতিল হলে হোক, লোকে বাজে বললে বলুক, হাতে কলম তুলে নিন। লিখুন প্রাণ খুলে।
সাত
যখন যা লিখবেন তখন তাতে ডুবে যেতে হবে। তাই খেয়াল রাখবেন যা লিখছেন সেটা যেন আপনার ভালো লাগার বিষয় হয়। আপনার বিশ্বাস, অভিজ্ঞতাগুলো লেখায় ফুটে উঠবে।
কিছু বিষয় আছে আপনি জানেন যে ওগুলোর ব্যাপারে আপনি আসলে ভাল জানেন না। কিন্তু আপনার অবচেতন মন সেগুলো সম্পর্কে জানে। তখন আপনার লেখার মধ্যে সেগুলো প্রক্রিয়াজাত হয়ে বেরিয়ে আসবে। আপনি নিজেই নিজেকে আবিষ্কার করবেন নিজের লেখার মাধ্যমে। নিজেই নিজের লেখার যৌক্তিকতা বিচার করবেন। লেখালেখি একটি সাহসী কাজ। প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি বাক্যে জীবনযাত্রার এক অন্য রূপ দর্শন করা, আবিষ্কার করা যায়। কাজটি মোটেও সহজ নয়। মনে রাখবেন, লেখালেখি কখনোই সহজ বিষয় নয়।
আট
ব্যর্থতা আসবেই, তাই সেটাকে শক্তিতে পরিণত করতে হবে। লেখায় ভুল হবে, অপরিপক্বতা থাকবে। এটা স্বাভাবিক। লেখালেখি অনেকটা বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখার মতো। আপনি প্রথম দিকে প্রচুর ভুল নোটে, ভুল ছন্দে বাজাবেন।
সুর তুলতে পারবেন হঠাৎ হঠাৎ। তখন আপনার মনটা খুশিতে ভরে উঠবে। লেখালেখির ক্ষেত্রেও তাই। অতএব, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। লিখুন, আজেবাজে যা হোক, তবুও লিখুন। বছরের পর বছর লেগে যেতে পারে। লক্ষ লক্ষ শব্দ লিখতে হতে পারে। লিখুন। কিন্তু একদিন আপনি দক্ষ হয়ে যাবেন। আপনার সবচেয়ে পছন্দের লেখকের সমমানের লেখা হয়তো একদিন আপনার হাত দিয়েও বের হবে। কলমকে নিজের বন্ধু করে নিন। লেগে থাকুন। লিখতে থাকুন।
ফিচার ইমেজ: Newsmobile